জখমের সার্টিফিকেট
(স্মৃতি কথা)
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্পে চাকরি করেছি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত। নবীন ডাক্তার ছিলাম। মাত্র ১৮৫০ টাকা সরকারি বেতন ছিল। তাই, প্রাইভেট প্রাক্টিশ করতে হতো। দোতলা সরকারি বাসভবনের দোতলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতাম। বাসবভনের বৈঠকখানায়ই প্রাইভেট রোগী দেখতাম বিকেল বেলা। অল্প কয়েকজন করে রোগী আসতো। রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সের এডমিশন টেস্টের প্রস্তুতির পড়া পড়তাম। কলিগরা সন্ধায় অফিসারস ক্লাবে গিয়ে যখন সময় কাটাতেন তখন আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের সময় দিতাম। রোগী দেখে ২০ টাকা ফি নিতাম। সেটাও কম ছিলো না। ২০ টাকায় একটা বড় বোয়াল মাছ কেনা যেতো।
গ্রামে জমি নিয়ে অনেক মারামারি হতো। তারা মার খেয়ে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসতো। যে ডাক্তার চিকিৎসা দিতো তাকেই ইনজুরির সার্টিফিকেট দিতে হতো। সেই সার্টিফিকেট দিয়ে কোর্টে মামলা করতো। তখন উপজেলায়ই কোর্ট কাছারি ছিল। তাই, মামলা মোকোদ্যমা করা সহজ ছিলো। কিছু লোককে দেখতাম সবসময় মারামারির রোগীর সহায়তা করতো। মাঝে মাঝে রোগীকে বাইরে দাড়া করিয়ে রেখে আমার কাছে এসে বলতেন “রোগী খুব ভালো মানুষ। রোগী মামলা করবে একটা সার্টিফিকেট দিয়েন, স্যার।” বাইরে গিয়ে হয়তো বলতেন “আমি ডাক্তার সাবকে রাজি করিয়েছি একটা সার্টিফিকেট দিতে। এসব ব্যপারে পয়সাকড়ি লাগে। আপনাদের সামনে বলবেন না। আমার মাধ্যমেই দিতে হবে।” আমি বুঝেও কিছু করতে পারতাম না। আমি সবাইকেই ন্যায্য সার্টিফিকেট দিতাম বিনামূল্যে। মাঝখানে লাভবান হতো ঐ টাউটরা।
একবার আমি দুপুরে খাবার পর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এক ভদ্রলোক এলেন ব্রিফকেস হাতে নিয়ে।
– আপনার কী সমস্যা?
– আমি রোগী না। আমি ঢাকায় থাকি। এখানে গ্রামে আমার কিছু জমিজমা আছে। সেগুলো যারা দেখাশোনা করে তাদেরকে কিছু দুস্কৃতিকারী মারধর করেছে। তারা আপনার অধীন হাসপাতালে ভর্তি আছে। অপরাধীদেরকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। তাই, আপনি মারাত্মক জখমের একটা সার্টিফিকেট দিবেন।
– ওরা মারাত্মক জখম হয় নাই। মারাত্মক জখমের সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না।
এনিয়ে অনেক কথা খরচ করার পর কোনভাবেই যখন আমি রাজি হলাম না তখন আমার টেবিলের উপর রাখা তার ব্রিফকেসটি টাস করে খুলে পাশশত টাকার কচকচে নোটগুলো প্রদর্শন করলেন। বললেন “এখানে সত্তর হাজার টাকা আছে। আপনার সম্মানি।”
আমি ব্রিফকেস চাপ দিয়ে বন্ধ করে বললাম “আমি টাকা নেই না। প্লিজ আপনি চলে যান। আমি যা সত্য তাই লিখব। ”
অনেক পিরাপিরি করেও আমাকে রাজি করাতে পারল না। আমি তার পিঠে আদর করতে করতে দরজার বাইরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর সিরিতে ধরাম করে কিছু পড়ার শব্দ পেলেম। গিয়ে দেখি লোকটা সিরিতে কাত হয়ে পড়ে আছে। আমি ধরাধরি করে উঠালাম। লোকটা ঘোরের মধ্যে বিরবির করে বললেন “সত্তর হাজার টাকা একজন উপজেলার মেডিকেল অফিসার হয়ে নেয় না, এটা আমি বিশ্বাস করতাম না।” আমি তাকে বুজিয়ে সুজিয়ে বিদায় করলাম। আবার শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে হিসাব করলাম “৭০ হাজার টাকা ছিলো। ৭০ হাজার টাকা ভাগ ২০ টাকা সমান ৩,৫০০ জন রোগী দেখে যা উপার্জন করা যায়। ৭০ হাজার টাকা দিয়ে আগামীকালই একটা ভালো মানের মোটর সাইকেল কিনতে পারতাম। ভো ভো করে কলে যেতাম। ইনকাম আরও বেড়ে যেতো। কিন্তু সব যে দেখে ফেলছেন আল্লাহয়। সব যে লিখে ফেলছেন কেরামামান কাতেবিন। আমার মিথ্যা সার্টিফিকেট পেয়ে একজন বিনা কারনে জেল খাটবেন। কি করে এমন কাজটি করি? ভালোই করেছি না নিয়ে।”
আরেকদিন আমি দুপুরের পর ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। দরজায় লাথি দেয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। দরজা খুলে দেখি একজন হোমরাচোমরা লোক রাগে ফোসফাস করছে।
– আমি ঘুমাচ্ছি, আর আপনি দরজায় এভাবে শব্দ করছেন?
– খুব তো আরামে আছেন। এটা কী সার্টিফিকেট দিয়েছেন? মাথায় কোপ দিছে লেখেন?
– চলুন, টি এইচ এ সাবের কাছে যাই। দেখি কী লেখা যায়।
আমি ইউএইচএফপিও সাবকে ডেকে তুলে লোকটার আচরণের কথা জানালাম। লোকটা ক্যাম্পাসে দাড়িয়ে নায়কের মতো উচ্চস্বরে ডায়ালগ দিচ্ছিল “ডাক্তাররা সব ঘুষখোর। ঘুষ না দিলে ঠিকমতো সার্টিফিকেট দেয় না। ঔষধ চুরি করে বেইচা দেয়” ইত্যাদি। ডাঃ হাবীব ভাই লোকটার চিতকার শুনে উঠে এলেন। আমার কাছে বিস্তারিত শুনে মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে আমাকে পেছনে বসিয়ে একটানে থানায় গিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন “ও সি সাব কোথায়? ঘুমাইতেছেন? হাসপাতাল ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী প্রবেশ করে যাতা করছে, আর আপনারা এখানে আরামে আছেন?” ও সি তৎক্ষনাৎ পুলিশ পাঠিয়ে লোকটাকে ধরে এনে কাস্টোডিতে ঢুকিয়ে ফেললেন। আমাদেরকে চা নাস্তা করালেন। ফেরার সময় লোকটাকে দেখলাম মেঝেতে ল্যাটা দিয়ে করুনভাবে বসে আছে। আমার মায়া হলো। লোকটা হাত জোড় করে আমার কাছে অনুনয় করে বলতে লাগলেন “স্যার, আমি মুর্খ মানুষ। রাগের মাথায় কী করছি। আমাকে মাফ করে দিন।” আমি ও সি-কে বললাম “ওনাকে ছেড়ে দিন। উনি বুজতে পারেন নি।” ও সি বললেন “ওনারে আপনাদের কেসে ধরে আনিনি। উনি মেম্বার। উনি সরকারি গম মেরে খেয়েছেন, তাই ধরে এনেছি। তার জেল হবে। ”
সার্টিফিকেট দিলে কোন কোন সময় চিকিৎসকদের কোর্টে যেতে হয় স্বাক্ষ্য দিতে। আমি মাত্র একবারই গিয়েছিলাম স্বাক্ষ্য দিতে। সেখানে একটা মজার কাণ্ড হয়েছিলো, শুনুন।
কোর্টে স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্য আমার কাছে সমন এলো। পরদিন নকলার কোর্টে স্বাক্ষ্য দিতে যেতে হবে। প্রথমবার কোর্টে স্বাক্ষ্য দিতে যাবো। তাই, আগের রাতে এনিয়ে অনেক্ষণ ভাবলাম। কোর্টের কার্যক্রম বাংলা সিনেমায় ও নাটকে বহুবার দেখেছি। এবার বাস্তবে দেখতে হবে। স্বাক্ষ্য দিতে হবে। মনে পড়লো সিনেমার কোর্টের কথা। অনেক দিনেমায় আজিজুল কাদের কোরেশী (এ কে কোরেশী) বিচারকের অভিনয় করতেন। তাকে বিচারক হিসেবে খুব মানাতো। সাদা ধবধবে পাকা চুল। ক্লিন সেভ করা মুখমন্ডল। টেবিলে কাঠের হাতুড়ি ঠক ঠক করে “অর্ডার, অর্ডার, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা মোতাবেক আসামীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হলো।’ অনেক বাংলা সিনেমার সুপরিচিত সংলাপ এটি।
জজ এমনই হবে আমার কল্পনায় ছিল। অভিনেতা কায়েস সাধারণত উকিল ব্যারিস্টারের অভিনয় করতেন কালো গাউন পরিধান করে। প্রতিপক্ষ উকিলের উদ্দেশ্যে বলতেন “অবজেকশন, ইউর অনার।” জজ বলতেন “অবজেকশন সাসটেইনড।” এমনই হবে নকলার কোর্ট, এই কল্পনা নিয়ে স্বাক্ষ্য দিতে হাজির হলাম। “যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না” শপথ বাক্য পাঠ করলাম। আসামি পক্ষের উকিল আমাকে জেরা করা শুরু করলেন। তিনি আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। এক সাথে বাজার করতাম। এক রকম মাছ কিনতাম। ঠাট্টা মশকরা করতাম। কোর্টে তিনি এমন ভাব দেখালেন যেন আমাকে চেনেনই না। তাকে সাধারণ মানুষের মতোই মনে হলো। অভিনেতা কায়েসের মতো মনে হলো না। ম্যাজিস্ট্রেটও আমার বন্ধুর মতোই। এজলাসে বসে মনে হলো চুইংগাম চিবাচ্ছেন। সিনেমার জজের মতো মনে হলো না। হঠাৎ উকিল আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন
– আপনি কি ডাক্তার?
– জি।
– কোথায় চাকরি করেন?
– উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, নকলা।
– আপনার নাম কী?
– ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার।
– আপনার বয়স কতো?
– ২৯ বছর।
– আপনার জন্ম তারিখ মনে আছে?
– আছে, ১৫ এপ্রিল ১৯৬১।
– ইউর অনার, ইনি একজন ডাক্তার। নিজের বয়সটা ঠিকমতো বলতে পারেন না। ইনার বয়স হলো ৩১ বছর। বলেন কিনা ২৯ বছর। ইনি কিভাবে ডাক্তারি করেন!
– আমি তো হিসাব করে বলিনি। হয়তো তাই হবে।
(আমি তখন সুস্থ্য বিবাহিত পুরুষ ছিলাম। বয়সের হিসাব রাখতাম না। সাধারণত অবিবাহিত ও রোগীরা বয়সের হিসাব রাখে। জিজ্ঞেস করার সাথেসাথেই আন্দাজি বয়স বলে দিলাম। উকিল যে জন্ম তারিখ জিজ্ঞেস করবে তা তো জানতাম না)
উকিল জিজ্ঞেস করলেন
– এই সার্টিফিকেট কি আপনি দিয়েছেন? এই স্বাক্ষর কি আপনার?
– জি।
– এটা কি অরিজিনাল?
– এটা ফটোকপি। অরিজিনাল না।
– ফলস সার্টিফিকেট। অরিজিনাল না। এই সব ডাক্তার এমন কাজই করে থাকেন। অরিজিনাল না। ফলস, ফলস, ফলস। নিজের বয়সটা ঠিকমতো বলতে পারেন না। ফলস সার্টিফিকেট তো দিবেনই।
উকিল এদিক সেদিক হাটাহাটি করেন, আর বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে যেন কি কি বলতে থাকেন। উকিলের আচরণে মর্মাহত হই। মুখ লাল হয়ে যায়। ভেবাচেকা হয়ে পড়ি। এমন অপমানজনক কথা জীবনেও শুনিনি। তাও আমার একজন প্রিয় মানুষের মুখে। ম্যাজিস্ট্রেট বসে বসে চুইংগাম চিবাচ্ছিলেন কোন কিছু ভ্রুক্ষেপ না করে। উকিল ঘুরতে ঘুরতে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন “কিছু মনে করবেন না। আমার মক্কেলকে শুনাচ্ছি।” হঠাৎ খেয়াল হলো আমি কোর্টে আছি। উকিল মক্কেল থেকে টাকা খেয়েছেন। বাহাদুরি দেখানোর জন্য এমনই করবেন। আমি আশ্বস্ত হলাম। এতক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেট কী কী যেন লিখছিলেন। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন “ডাক্তার সাব, এখানে সই করুন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম “এটা কী?” তিনি বললেন “আপনি যা বলেছেন তা আমি লিখেছি। নিচে সই করুন।” আমি ইতস্তত না করে সই করলাম। আল্লাহই জানেন, কী লেখা ছিলো। তিনি বললেন “ডাক্তার সাব, ধন্যবাদ। এবার আসুন।” আমি কোর্ট থেকে বেড় হয়ে রিক্সা নিয়ে সোজা চলে এলাম বাসায়।
২৫/৫/২০২২
ময়মনসিংহ