এমআরআই পরীক্ষা
(স্বাস্থ্য কথা)
ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
এমআরআই কথাটার পূর্ণ শব্দগুলো হলো ম্যাগনেটিক রিজোনেঞ্চ ইমেজিং। এই পরীক্ষায় শক্তিশালী ম্যাগনেট (চুম্বক), রেডিও ওয়েভ (বেতার তরঙ্গ) ও কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। তাতে শরীরের ভেতরে জিনিসের বিস্তারিত এবং পরিস্কার ছবি পাওয়া যায়। শুধু ডাক্তারই না, রোগীও চায় রোগ হলে তার শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একটা পরিস্কার ছবি। এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় ক্ষতিকর আয়োনাইজিং রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এমআরআই পরীক্ষায় তা ব্যবহার করা হয় না বলে এতে রিস্ক নেই।
এটোমিক নিউক্লিয়াসের ম্যাগনেটিক প্রোপার্টি কাজে লাগানো হয় এমআরআই পরীক্ষায়। শরীরের প্রত্যেক কোষেই পানি থাকে। পানিতে থাকে হাইড্রোজেন এটোম। যার ভেতর থাকে সিঙ্গেল প্রোটন। যেহেতু শরীরের সব টিস্যুতে হাইড্রোজেন এটোম আছে সেহেতু সব টিস্যুরই এমআরআই করা যায়। হাইড্রোজেন এটোম কম্পাস কাটার মতো আচরণ করে। ম্যাগনেটিক স্ক্যানার যেদিকে ঘুরে সেদিকেই হাইড্রোজেন কম্পাস কাটা ঘুরে। স্ক্যানারের রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে হাইড্রোজেন কম্পাসকে ঘুরানো হয় এবং তারা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে অসিলেট করে ইকুইলিব্রিয়ামে চলে আসে। এই সময় রেডিও সিগনাল তৈরি হয় যেগুলো ক্যাপচার করা হয় এন্টিনা দিয়ে। পাঠিয়ে দেয়া হয় ও কম্পিউটার প্রসেসরে। প্রসেসর প্রসেস করে সেই টিস্যুর স্পষ্ট ছবি তৈরি করে মনিটরে শো করে । প্রিন্ট করে রিপোর্টের সাথে দেয়া হয়। সিগনালের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সাধারণত ৪০-১৩০ মেগাহার্টজ হয় যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর না।
এমআরআই করে ডাক্তারগণ রোগ বা ইঞ্জুরিটার ছবি স্পষ্ট দেখতে পান। রোগ চিকিৎসার সময় কেমন ভালো হচ্ছে তাও দেখতে পান। শরীরের বিভিন্ন অংশের এমআরআই পরীক্ষা করা যায়। বাস্তবে বিশেষ করে নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ু তন্ত্রের এমআরআই বেশি বেশি করা হয়। এর মধ্যে আছে ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ড। ব্রেইন থাকে মাথার খুলির ভেতর। আর স্পাইনাল কর্ড থাকে মেরুদণ্ডের হাড়গুলোর ভেতর দিয়ে যে পাইপ আছে তার ভেতর। ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ডকে একসাথে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বলা হয়। এগুলো খুবই নরম। আপনারা মুর্গি, গরু ও খাসির মগজ দেখেছেন। মুরগির মেরুদণ্ডের ভেতরের সাদা নরম জিনিসগুলো অনেকে কাঠি দিয়ে খোচা দিয়ে বের করে ফেলে দিয়ে রান্না করে। এটাই হলো স্পাইনাল কর্ড। মানুষের এমন ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ড আছে। ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ডের অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। সেইগুলা ধরার জন্য এমআরআই বেশি বেশি করা হয়। যেমন, রক্তনালি ডেমেজ, ব্রেইন ডেমেজ, ক্যান্সার, মাল্টিপল সক্লেরোসিস, স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরি, স্ট্রোক, চোখের সমস্যা, ভেতরের কানের সমস্যা ইত্যাদি।
হার্ট ও রক্তনালির রোগেও এমআরআই করা হয়। যেমন, রক্তনালির ব্লক, হার্ট এটাক হয়ে হার্ট ডেমেজ, হার্ট ডিজিজ, হার্টের গঠনগত ত্রুটি ইত্যাদি।
হাড় ও জয়েন্টের রোগ নির্ণয়েও এমআরআই ব্যবহার করা হয়। যেমন, বোন ইনফেকশন, ক্যান্সার, জয়েন্ট ডেমেজ, স্পাইনাল ডিস্ক প্রব্লেম, ঘার ও কোমরের ব্যাথার কারন নির্ণয় ইত্যাদি। মেরুদণ্ড বা কশেরুকা হাড়গুলো একটার সাথে আরেকটা সাজানো থাকে মাঝখানে কার্টিলেজ বা মুড়মুড়ে হাড্ডির ডিস্ক বা চাকতি বসিয়ে। এই চাকতিকে বলা হয় ইন্ট্রাভার্টিভ্রাল ডিস্ক। সামনের দিকে ঝুকে (হুতি দিয়ে) ভারী জিনিস তোলার সময় কোমরের ভার্টিভ্রার উপর চাপ পড়ে। ফলে ডিস্ক পিছলে পেছনের দিকে সরে গিয়ে স্পাইনাল কর্ডে চাপ দেয়। তখন রোগী এক ধরনের টাস করে শব্দ অনুভব করে কোমরে। ডিস্ক বা চাকতি আটকে থাকে ঐ অবস্থায় যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় প্রলাপ্স ইন্ট্রাভার্টিভ্রাল ডিস্ক, সংক্ষেপে পিএলআইডি। আগের দিনে গ্রামের মানুষ এই অবস্থাকে হুত উঠছে বলত। হুতি দিয়ে বোঝা উঠানোর সময় হতো বলে হুত উঠছে বলত। এটাকে টাস লেগেছে বলে টাসের ঝাড়া ফুকও দিত। কারন প্রলাপ্স জবার সময় টাস করে উঠতো বলে। এখন গ্রামের মানুষও পিএলআইডি বলতে পারে। পল্লী চিকিৎসকরাও জানে এটা পিএলআইডি। তারা রোগীকে বলে দেয় পিএলআইডি হইছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন চিকিৎসক সেজে শহরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালি করে। নিজে চিকিৎসা করতে না পেড়ে শহরে নিয়ে আসে এমআরআই পরীক্ষা করাতে। করাতে পেড়ে তারা খুশি হয়। খুশিতে পান চিবায়। পিএলআইডি ধরা পড়ার পর এমআরআই এর ছবিটা রোগীকে দেখিয়ে ব্যাখ্যা করে বুঝান। ছবি দেখে রোগী জিনিসটা বুঝতে পারে। আপনিও বুঝতে পারবেন। একদম পরিস্কার ছবি। এমআরআই পরীক্ষা কিন্তু ব্যয়বহুল। সাথে লোক আসে বলে হয়তো আরও ব্যয়বহুল হয়। রোগীর হয়তো ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই। হয়তো ঔষধ কেনার টাকা নেই। এমআরআই পরীক্ষা করে যা ছিলো সব শেষ করে ফেললো। আর অবস্থাশালী রোগী হলে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় কাউকে কাউকে। স্পাইনাল সার্জনকে দেখানো হয় হয়তো কোন কোন ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। অপারেশন করে ডিস্ক ঠিক মতো বসিয়ে দেন সার্জন সাহেব। বিরাট অংকের বিল আসে রোগীর জন্য। সাথে আসা লোকটার তখন আনন্দ ধরে না এমন কথা শুনা যায়। খুশিতে সে আরও বেশি করে পান চিবায়। কেউ কেউ অধিক টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে অপারেশন করায়। বিমানে ফিরে আসার সময় আরেকবার চোট লেগে হয়তো আবার আগের মতো হয়। তাই, আমার পরামর্শ হলো পিএলআইডি হয় এমন কোন কাজ না করা। হয়ে গেছে মনে হলে অর্থোপেডিক্স সার্জন অথবা স্পাইনাল সার্জন অথবা নিউরোসার্জনকে সরাসরি দেখান। কোন মাধ্যম রাখার দরকার নেই। এমআরআই পরীক্ষা করার টাকা না থাকলে করাবেন না। অপারেশন করার টাকা না থাকলে করাবেন না। ঔষধের ও নিয়ম কানুনের চিকিৎসাও আছে পিএলআইডির। তবে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে।
নিন্মলিখিত অর্গানের চেক আপ করাতেও এমআরআই পরীক্ষা করা হয়। যেমন, ব্রেস্ট (স্তন), লিভার, কিডনি, ওভারি (ডিম্বাধার), পেনক্রিয়াস, প্রোস্টেট, ইত্যাদি।
এমআরআই পরীক্ষায় রিস্ক নাই বললেই চলে। তবে খুব বেশি প্রোয়জন না হলে প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাসে এমআরআই না করাই ভালো।
১৬/৯/২০২০ খ্রি.
ময়মনসিংহ
কেমন লাগলো তার উপর ভিত্তি করে নিচের ফাইফ স্টারে ভোট দিন ক্লিক করে
ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার রচিত বই-এর অনলাইন শপ লিংক
http://www.daraz.com.bd/shop/talukder-pathology-lab/