ঢাকার নশা
(সংগৃহিত হাস্তর ও গীত)
ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
[আমাদের সখিপুরের গ্রাম এলাকায় ছোটবেলা লোক মুখে কিছু গল্প শুনতাম। সেগুলোকে বলা হতো হাস্তর। সুর করে কিছু কবিতা ও গান গাওয়া হতো। সেগুলোকে বলা হতো গীত। আমি সেসব হাস্তর বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় সংগ্রহ সীতাকরে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছি গল্পাকারে আমার মতো করে। এসবের ভেতর দিয়ে আগের দিনের গ্রামবাংলার আঞ্চলিক ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রকাশ পাবে বলে আমি মনে করি। এই লেখাটি তারই একটি অংশ]
গেন্দুর নানী-শাশুড়ী আম্বাতনকে আরেকটা গীত গাইতে বললে আম্বাতন এই গীতটা গাইল –
ঘরের ভিতর খারইয়া ক্ণ্যা পাও ডুলাইছে,
ঢাহা থিগা নশা মিয়া গোলখারু পাঠাইছে।
ও গোলখারু ভালা না দস্তা মিশাইছে।
আমারতা দিয়া জানি কারে ভুলাইছে।
ঘরের ভিতর খারইয়া কণ্যা মাঞ্জা ঢুলাইছে,
ঢাহা থিগা নশা মিয়া পানতারা পাঠাইছে,
ও পানতারা ভালা না, দস্তা মিশাইছে।
আমারতা দিয়া জানি কারে ভুলাইছে।
ঘরের ভিতর খারইয়া কণ্যা গলা খাউজাইছে,
ঢাহা থিগা নশা মিয়া মপচেইন পাঠাইছে,
ও মপচেইন ভালা না দস্তা মিশাইছে।
আমারতা দিয়া জানি কারে ভুলাইছে।
ধরের ভিতর খারইয়া কণ্যা কান ঢুলাইছে,
ঢাহা থিগা নশা মিয়া মাড়কি পাঠাইছে।
ও মাড়কি ভালা না তামা মিশাইছে।
আমারতা দিয়া জানি কারে ভুলাইছে।
ঘরের ভিতর খারইয়া কণ্যা নাক সিটকাইছে,
ঢাকা থিগা নশা মিয়া নোলক পাঠাইছে।
ও নোলক ভালা না, তামা মিশাইছে।
ময়ফল বললো,
– আম্বাতন, তুই একবার কস দস্তা মিশাইছে, আরেকবার কস তামা মিশাইছে। ইডার মানে কি।
– যে গয়না রুপার মোতন দেহা যায় হেডার মইদ্যে হস্তা দস্তা মিশাইছে। যে গয়না সোনার মোতন দেহা যায় হেডার মইদ্যে হস্তা তামা মিশাইছে। রুপাও দলা, দস্তাও দলা। আবার তামাও যেবা দেহা যায় সোনাও হেবা দেহা যায়। অনেকসুম চালাক নশারা ভ্যাবলা বউগ এবা কইরা ভুলাইয়া গয়না দেয়।
– ঢাহাইয়া নশার কাছে বিয়া না বয়াই ভালা। আংগ পাড়ার ছত্তরে ঢাহা থাহে। কী যে করে, আল্লাহই জানে। বাইত্যে আইয়া কী যে ফ্যারাংগি করে! ভাষা কথা কয়। জারেরে কয় শীত। টেলকারে কয় টালকা। কয় কী, আইজকা খুব শীত করতাছে। আবার পানি ছাইন্যা কয় কী, পানিডা কুব টালকা। ঠান্ডা না কইয়া কয় টালকা। বাদাইম্মা জান কুনকার! অবা টাউন্যা নশার কাছে বিয়া বমু না।
– ক্যা, তরে কি হে বিয়া করবার চাইছে?
– থোছে, আবার বিয়া বিয়া করতাছস?
– তুইতিই ত বিয়া বিয়া করতাছস।
নানী বললেন, তোমরা ঠেটাম কইরো না। গীত ভালাই হোনা যাইতাছে। যেঠার মইদ্যে বিয়া বিয়া নাই হেইডা গাও। আম্বাতন আবার গাইলো-
ডালিম গাছ রুইছি আলানে,
জিংগা গাছ বুনছি পালানে,
সসা, বাংগির বিচি বুনছি আমি
গোয়াইল ঘরের পা ~য়াছে রে ।।
বাপ অইছে আমার নিদারুন,
টেহা নইছেন জানি কী কারন,
আমারে বিয়াছে গ বিয়া
ঐ না দূরে দেশান্তর।।
দূর দেশের মানুষ পাই,
পংখী হইয়া আমি উইরা যাই,
উরিয়া দেখি আমি
দরদী মায়ের মুখ অ রে।
উরিয়া দেখি আমি
দরদী বাবার মুখ অ রে।।
নাও অ কিনলাম আমি চরিবার,
বৈঠা কিনলাম আমি বাইবার,
ইছামতির গাংগে দিছি
বাইছা বাইছি খেলিবার।
ময়ফল বললো, এই ছেড়ি, এইডাও ত বিয়ার গীত অইল।
আম্বাতন বললো, আইজকা ত গেন্দু ভাইর বিয়ার রাইত। আইজকা বিয়ার গীত গামু, না কবে গামু?
৩০/১/২০২১
শব্দার্থঃ
নশা – নওশা, বর
কণ্যা – কণে
মাঞ্জা – কোমর
ঢাহা – ঢাকা
থিগা – থেকে
গোলখারু – পায়ের রিং
আমারতা – আমারটা
পানতারা – কোমরের বিছা
খারইয়া – দাড়াইয়া
মপ চেইন – গলার মোটা চেইন
মাড়কি – মাকড়ি (কানের গহনা)
হস্তা – সস্তা
মোতোন – মতো
যেবা – যেরকম
হেবা -সেরকম
হেডা – সেটা
মইদ্যে – মধ্যে
টেলকা – ঠান্ডা
ভাষা কথা – শুদ্ধ ভাষায় কথা
ছাইন্যা – ছুয়ে
বাদাইম্মা – বখাটে
কুনকার – কোথাকার
তুইতি – তুই
ঠেটাম – তরকাতরকি
বিয়া – বিয়ে
আলানে – আংগিবায়
পালানে – বাড়ির সামনের ক্ষেত
গোয়াইল ঘর – গুরুর ঘর
নিদারুণ – নিষ্ঠুর
নইছেন – নিয়েছেন
পংখী – পাখি
নাও – নৌকা
Rate on this writing:
Online book shop of Dr. Sadequel Islam Talukder
http://www.daraz.com.bd/shop/talukder-pathology-lab/