আমীর আলীর শেষ বিদায়
(স্মৃতি কথা)
সাগরদিঘি পর্যন্ত এলেই আমীর আলীর ফোন এলো। কুশল বিনিময় হলো।
– কোথায় তুমি?
– আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসতেছি। ঢনঢনিয়া পর্যন্ত এসে গেছি।
– কোন সমস্যা হইছে?
– না, এমনিতেই তোমার সাথে দেখা করতে আসতেছি।
– তা, তুমি আসবে, আমাকে জানিয়ে আসবে না? ১৪/১৫ কিলোমিটার পথ হেটে এসে এখন ফোন করছো? আমি তো চলে যাচ্ছি ময়মনসিংহ। প্রাইভেট কারে যাচ্ছি। সাগরদিঘি পর্যন্ত এসে গেছি। ময়মনসিংহ গিয়ে অফিস ধরতে হবে। পরে একদিন দেখা করবো, ইনশাআল্লাহ। তুমি আমাদের বাড়ি যাও। আমি ভাতিজা মান্নান তালুকদারকে বলে দিচ্ছি তোমাকে আমার লেখা স্মৃতি কথার বইগুলো দিয়ে দিতে।
মান্নান আমীর আলীকে বই প্রদানের ছবি তুলে আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়।
এর বেশ কিছু দিন পর আমীর আলী ফোন করে। কিন্তু তার কথা ভালো করে বুঝা যাচ্ছিল না। তার ছেলে আমাকে বুঝিয়ে বললো যে, তার বাবার জিহবার এক কিনারায় বিড়াট একটা ঘা হয়েছে, জিহবা নাড়াতে পারেন না। খেতেও পারেন না, কথা বলতেও পারেন না। এরপর যতবার ফোন করেছে আমি আমির আলীর কথা তেমন বুঝতে পারিনি। আমি অনুরোধ করে আমীর আলীকে ময়মনসিংহ আনালাম। দীর্ঘ বছর পর আমার বাল্য বন্ধুর সাথে দেখা হলো। আমি তাকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। কেউ কথা বলছিলাম না। একে অপরের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। ছেড়ে দিয়ে আমীর আলীর জিহবার ঘা দেখলাম। আমার মনে হলো ক্যান্সার হয়েছে। আমি নিজেই তার এফএনএসি পরীক্ষা করলাম। ক্যান্সারই ধরা পরলো। চিঠি লিখে মুখ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ শমরেস কুন্ডু দাদার কাছে পঠালাম। দাদা বায়োপসি করে আমার কাছে সেম্পল পাঠালেন। আমীর আলী বাড়িতে চলে গেলো। তিন দিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট দিলাম, ক্যান্সার।
আমীর আলীকে আবার এনে ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ আমিনুল ইসলাম ভাইকে দেখালাম। চিকিৎসা শুরু হলো। ব্যয়বহুল চিকিৎসা। আমীর আলীর আর্থিক অবস্থা ভালো না, আমিনুল ভাইকে জানালাম। আমিনুল ভাই রোগীর ছেলেকে দিয়ে অনুদানের জন্য একটা ফরম পূরণ করালেন। কিন্তু অনুদানটি পাওয়ার আগেই আমীর আলী আমাদের ছেড়ে ইহজগৎ ত্যাগ করলো। আমার জন্য রেখে গেলো এক দীর্ঘ স্বাস। মাঝে মাঝে আমীর আলীকে মনে পড়ে। চোখের কোনে পানি জমে। সে পানি টপ করে টেবিলে পড়ার আগেই মুছে ফেলি। ফ্যাল ফ্যাল করে উপর দিকে চেয়ে থাকি। চোখ মুছে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
আমীর আলী ছিলো আমার বাল্য বন্ধু। সাড়াসিয়ার আমীর আলী, মুক্তার, আবুবকর সিদ্দিক, আমি এক সাথে আনন্দ করতে করতে ঘোনারচালা প্রাইমারি স্কুল এবং কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে যাতায়াত করতাম। সেই স্মৃতি কথা আমার “কচুয়া স্কুলের পথে” গল্পে লেখা আছে। আমার নামের পর গল্পের নাম লিখে সার্চ দিয়ে বের করে পড়ে নিতে পারেন। ১৯৭৫ সনে ক্লাস নাইনে উঠে আমি চলে যাই বাটাজোর বি এম হাই স্কুলে, আমীর আলী চলে যায় বড়চওনা হাই স্কুলে। সেই থেকে আমাদের মধ্যে আর দেখা হয়নি। বিয়ে করার পর সে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় আউলিয়াবাদে। ওখানে বাড়ি করে বসবাস করে। তাই, দেখা হয়নি। সেই দেখা হলো, কিন্তু শেষ বেলায়।
কিছুদিন আগে তার ছেলে এসেছিলো রোগী নিয়ে। জিজ্ঞেস করেছিলাম
– অনুদানের পঞ্চাশ টাকা কিভাবে খরচ করেছো?
– বাবার পঞ্চাশ হাজার টাকার সাথে আমি আরও টাকা ভরে গ্রামে একটা এতিমখানা মাদ্রাসা করেছি যাতে তারা আমার বাবার জন্য দোয়া করে।
আল্লাহ আমীর আলীকে বেহেশতবাসী করুন।
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রি.
এমন গল্পের জন্য নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করুন