Author Archives: talukderbd

ssc

আমার এস এস সি রেজাল্ট

আমি ভালুকা উপজেলার বাটাজোর বি এম হাই স্কুল থেকে ১৯৭৭ সনে এস এস সি পাস করেছি । এই পরীক্ষার রেজাল্ট সংগ্রহ নিয়ে যে কাহিনী হয়েছিল তা আজ আমি লিখব। এস এস সি রেজাল্ট বের হবার ঘোষনা রেডিওতে দিয়েছে তিন দিন হয়। ডাকযোগে স্কুলে রেজাল্ট পৌছতে সময় লাগার কথা দুই দিন । কিন্তু তিন দিন হয়ে গেল কিছুই জানতে পারলাম না। চিন্তায় পরে গেলাম। চতুর্থ দিন বাড়ী থেকে বের হলাম। বলে গেলাম কচুয়া যাচ্ছি। কচুয়া বাজারে একটি খোলা খালি ঘরে বেঞ্চে আমি, ফজলু, দেলোয়ার  ও কিসমত বসে কিভাবে এস এস সি পরীক্ষার ফল পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলাপ করলাম। কেউ একজন বলল যে করটিয়া একটি ক্লাব ঘরে পাচ টাকা করে নিয়ে রেজাল্ট দিচ্ছে। আমরা চারজন রওনা দিলাম করটিয়ার উদ্দেশ্যে।

একটু এদেরকে পরিচয় করিয়ে দেই। ফজলু এখন নামকরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে বি এস সি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা। ঢাকায় থাকে। দেলোয়ারও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন যুব উন্নয়নের ডেপুটি ডাইরেক্টর। ডাকায় থাকে। কিসমত কি যেন পাস করার পর দেশের বাইরে চলে যায়। তার খোজ রাখতে পারিনি। আমরা সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কচুয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই। ফজলু দেলোয়ারের চাচাত ভাই। কিসমত বয়সে বড়, ওদের চাচা হয়। তাই আমিও চাচা ডাকি। আপনি বলি। সেভেনে উঠার সময় ফজলু ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড, লুৎফর থার্ড, মোসলেম ফোর্থ, দেলোয়ার ফিফথ ও কিসমত সিক্সথ হয়, খুব সম্ভব। লুৎফর এখন পি এইচ ডি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সসিটির নাটক বিভাগের প্রফেসর। মোসলেম এস এস সি পাস করে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল।

সেভেনে উঠে ভাল ভাল ছাত্ররা এলাকার সবচেয়ে ভাল স্কুল বাটাজোর বি এম হাই স্কুলে চলে যায়। এতে ছিল ফজলু, দেলোয়ার, কিসমত সহ আরও অনেকে। আমি এই কচুয়া স্কুলেই থেকে যাই। প্রতিযোগী ভাল না থাকার জন্য আমি আস্তে আস্তে নিম্ন মানের হতে থাকি। তাছাড়া একমাত্র বিজ্ঞানের শিক্ষক ভীম চন্দ্র স্যার নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আমি নিরুপায় হয়ে ১৯৭৫ সনে এপ্রিল মাসে বাটাজোর চলে যাই। এত দিন বিজ্ঞান ক্লাশ করতে না পারায় আমি নবম শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরিক্ষায় ফিজিক্স এ খারাপ করি। আমার মাথায় জ্যাদ চেপে যায়। উন্নতি হতে হতে প্রিটেস্ট পরীক্ষায় ফার্স্ট বয় ফজলু থেকে মাত্র দুই নাম্বার কম পাই। টেস্ট পরীক্ষায় তার থেকে দুই নাম্বার বেশী পেয়ে আমি ফার্স্ট হই। তার মানে, আমিই বাটাজোর স্কুলের শেষে ফার্স্টবয় ছিলাম।

আমরা রেজাল্ট আনার উদ্দেশ্যে কচুয়া থেকে পশ্চিম দিকে পাহাড়ি পথে হাটা শুরু করলাম। খুব সম্ভব জুলাই মাস। ১৯৭৭ সন। শালগ্রামপুর গিয়ে ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকায় বসে কার রেজাল্ট কেমন হতে পারে তা নিয়ে কথা বললাম। আমি বললাম যে আমার ফার্স্ট ডিভিশন ছয়টি লেটার থাকতে পারে। ফজলুও তাই বলল। দেলোয়ার বলল যে তার দুই তিনটিতে লেটার থাকতে পারে। কিসমত চাচা বললেন যে তার রেজাল্ট আমার মতই হতে পারে। তিনি আমার পিছনেই সিট পেয়েছিলেন পরীক্ষার হলে।

আকাবাকা খাল, বিস্তির্ন বিল পারি দিয়ে বেলা ডোবার আগ দিয়ে করটিকা পৌছলাম। জমিদার বাড়ীর পশ্চিম পাশে একটি ক্লাব ঘর থেকে কাগজের টুকরায় রুল নাম্বার লিখে বেড়ার ছিদ্র দিয়ে ভিতরে দিলে ভিতর থেকে রেজাল্ট লিখে দেয়া হয়। সময় নেই। বেলা ডোবার পর বন্ধ করে দেয়া হবে।

ফজলু আগে স্লিপ ঢুকালো। রেজাল্ট দেখে কাপতে কাপতে পড়ে গেল। আমরা ধরাধরি করে ইদারা কুয়ার পারে নিয়ে বালতি দিয়ে পানি তুলে তার মাথায় দিতে লাগলাম। আমরা গ্রামে থেকে এভাবেই অজ্ঞান রুগী চিকিৎসা করতাম। আমি পানি তুলি, দেলোয়ার মাথায় পানি ঢালে। কিসমতও রেজাল্ট পেয়ে কাপতে কাপতে হয়ে পরে গেল। একি রেজাল্টএর মড়ক লাগল নাকি! এখন রইলাম আমি আর দেলোয়ার। দুইজনকে দুইজনে পানি ঢালি। ক্লাব ঘর থেকে আওয়াজ আসছে আরো কেউ আছে নাকি, বন্ধ করে দিলাম। দেলোয়ার বলে তুমি যাও আগে, আমি বলি তুমি যাও আগে। দেলোয়ার আগে গেল, কিন্তু অজ্ঞান হল না। আমি রেজাল্ট পেয়ে অজ্ঞান হলাম না। আমি পেয়েছি ফার্স্ট ডিভিশন চার লেটার, দেলোয়ার পেয়েছে ফার্স্ট ডিভিশন দুই লেটার। এবার ফজলুর স্লিপ দেখলাম। সে পেয়েছে ফার্স্ট ডিভিশন দুই লেটার। কিসমত চাচাকে বললাম “চাচা, এত ভেংগে পড়লে চলবে? সবাই কি লেটার পায়? কত মানুষ যে ফেল করে?”
চাচা বললেন “আমি ফেল করেছি গো। হু হু হু “।

আমি ফজলুকে, আর দেলোয়ার কিসমত চাচাকে ধরে নিয়ে মেইন রোডের দিকে হাটলাম। কচুয়ার সিনিয়র ফজলু ভাইর সাথে দেখা হল। তিনি ওখানে সাদত কলেজে অনার্স পড়তেন। কি হয়েছে জানতে চাইলে বিস্তারিত বললাম। আমরা চলে যেতে চাইলাম। তিনি জোড় করে তার হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। ওখানেই থাকলাম। তিনি আমাকে বিশেষ যত্ন নিলেন। এখন তিনি হাই স্কুলের শিক্ষক। ফোনে আমার খোজ খবর নেন। আমিও নেই।

সকালে নাস্তা করে নৌকা ভাড়া করে শাল গ্রামপুর পৌছলাম। মুশলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। থামার লক্ষণ ছিল না। চারজন বন্ধু ভিজে ভিজে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। ১০/১২ কিলোমিটার পায়ের পিছলা পথ। দৌড় দিলাম। এক দৌড়ে বাড়ী পৌছলাম। বাড়ী পৌছলে বৃষ্টি আরও জোরে নামল। গতকাল বাড়ীতে জানিয়ে যাইনি। মা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন।
-কই গেছিলি বাজান? কইয়া জাস নাই কেন?
– রেজাল্ট আনতে গেছিলাম।
– আনছ?
– আনছি। ফার্স্ট ডিভিশন চারটি লেটার পাইছি।
– কই? দেও।
– পরে দিব। শুক্না জামা পরে নেই।
মা আঁচল দিয়ে আমার শরীর মুছে দিলেন।

মহা খুশীতে রওনা দিলাম বাটাজোর গিয়ে সব স্যারের সাথে দেখা করতে। রাস্তায় যাকে দেখি তাকেই সালাম দেই। সালাম দিলেই জিগায় ” সাদেক, কি খবর?” আমি বলি “ফার্স্ট ডিভিশন চারটা লেটার।”

স্যারগণ আমাকে দেখে মহা খুশী। কোন এক স্যার বললেন “বেটা, আমাদের স্কুলে রেকর্ড ভেংগেছিস।” আমি টেস্টিমোনিয়াল হাতে পেয়ে বললাম “স্যার, মুল সার্টিফিকেট কবে পাব?”
– ওটা বোর্ড থেকে এক দেড় বছর পর স্কুলে পাঠাবে। এসে নিয়ে যাবে।
– যদি এর আগে দরকার পড়ে?
– তখন দরখাস্ত করে উঠান যাবে।
পাস করলাম আজ। সার্টিফিকেট দিবে দেড় বছর পর!
বাড়ী এসে একটা সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখলাম ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবরে যে বিশেষ কারনে আমার এস এস সি সার্টিফিকেট জরুরী প্রয়োজন। দুই আনা দিয়ে খাম কিনে ডাকে দরখাস্ত পাঠালাম।

সাতদিন পর ডাকে একটি চিঠি আসল। লিখা “আপনার মুল সার্টিফিকেট ডাক যোগে স্কুল বরাবরে পাঠানো হয়েছে। আপনি উহা সংগ্রহ করুন – পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক “

আমি চলে গেলাম স্কুলে। সব স্যার একটি চিঠি দেখছেন। লিখা আছে “সাদেকুল ইসলাম তালুকদারের মুল সার্টিফিকেট পাঠানো হল। উহা জরুরীভাবে সরবরাহ করুন – পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক “।

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বিস্তারিত জানালাম।
– তুমি এমন করেছে কেন?
– আমার ইচ্ছা হল, স্যার।
দেখলাম সার্টিফিকেটটা একটা শক্ত খামে অতি যত্নসহকারে ভরা হয়েছে। ভাজ হয়নি। আমি ওটা নিয়ে বাড়ি এসে মাকে দেখালাম। বললাম “এই যে আমার সার্টিফিকেট ।”
এর দুই বছর পর মা ইন্তেকাল করেন। সাভাবিক নিয়মে সার্টিফিকেট আসলে কি মা দেখে যেতে পারতেন?

১৭/৬/২০১৭ ইং

#স্মৃতিকথা #স্মৃতিচারণ #Memory #SSC #sadequel

kirtonkhola

কীর্তনখোলা নদীতে বোটিং, ১৯৯৯ সন

পুরনো হার্ড এলবাম থেকে।

১৯৯৯ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে এক্সটার্নাল এক্সামিনার হিসাবে পরীক্ষা নিতে গিয়ে এই নদীতে বোটিং করি।

বরিশালের কীর্তনখোলা নদী:

কীর্তনখোলা নদী বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এবং স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবহন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নদীটি আড়িয়াল খাঁ নদীর একটি শাখা এবং দক্ষিণে পায়রা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

এই নদী বরিশালের প্রধান নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার উপর দিয়ে প্রতিদিন শতাধিক লঞ্চ, ট্রলার ও কার্গো চলাচল করে। বর্ষাকালে নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য হয়ে ওঠে। নদী তীরবর্তী এলাকা শহরের বাসিন্দাদের কাছে বিনোদনের জায়গা হিসেবেও জনপ্রিয়।

সংক্ষিপ্ত তথ্য:

অবস্থান: বরিশাল শহর

দৈর্ঘ্য: প্রায় ২০ কিলোমিটার

ব্যবহার: নৌপরিবহন, মাছ ধরা, পর্যটন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: তীরবর্তী সবুজ বন, সূর্যাস্ত দৃশ্য

foys-lake

Fay’s Lake

ফ-এস লেক, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিসাবে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়ের পার্ট হিসাবে। ডা: নজরুল ইসলাম (চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ) এবং আমার মাঝে যে শিশুকে দেখা যাচ্ছে, ও হচ্ছে আমার ভাতিজা ডা: শহীদুল্লাহ্ হুমায়ুন কবির তালুকদার (অজ্ঞান বিশেষজ্ঞ)। ও তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তো।
(পুরনো হার্ড এলবাম থেকে)

চট্টগ্রামের ফ-এস লেক: এক নজরে

চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থল জিইসি মোড় থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত একটি মনোরম প্রাকৃতিক লেক হলো ফ-এস লেক (Foy’s Lake)। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ আমলে এটি খনন করা হয় শহরের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। পরে এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। চারপাশে সবুজ পাহাড় আর হ্রদের নীল পানি মিলে তৈরি করেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

এখানে রয়েছে বোট রাইড, এমিউজমেন্ট পার্ক, রিসোর্ট, কেবল কার ও নানা বিনোদনের ব্যবস্থা। ফ্যামিলি পিকনিক, বন্ধুবান্ধবের আড্ডা বা কাপলদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

প্রবেশের জন্য টিকিট লাগলেও এটি সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।

ফ-এস লেকে একদিন মানেই শহরের কোলাহল ভুলে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়া

prothom-chakri

বরিশালের গ্রামে প্রথম চাকরির স্মৃতিকথা

বন্ধু বিচ্ছিন্ন

ডাঃ নজরুল ইসলাম। বর্তমানে টাংগাইলের নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ এফসিপিএস সার্জন। তার সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব শুরু হয় ১৯৭৭ সনে কালিহাতির আউলিয়াবাদে আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই। হোস্টেলে পাশাপাশি রুমে থাকতাম। একসাথে বেড়াতাম, মন খুলে গল্প করতাম। পালাকরে গান গাইতাম। ওদের বাড়ীতেও গিয়েছি। খালাম্মার হাতে রান্নাও খেয়েছি।

বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হল যখন আমরা দুইজনই ১৯৮০ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চাঞ্চ পেলাম। থাকা শুরু হল একই রুমে। এক সাথে খেতাম, পড়তাম, ঘুরতাম, সিনেমা দেখতাম, ঘুমথেকে উঠতাম, ক্লাশে যেতাম, ছুটিতে বাড়ী যেতাম। একই রকম জামা পরতাম। ক্লাশমেটরা বলত দুই ভাই। একই রকম রেজাল্ট করতাম। রিক্সা ভাড়া শেয়ার করতাম। তাই, হাত খরচ কম লাগত। এই রকম প্রায় সব কিছুতেই আমাদের দারুণ মিল ছিল।

১৯৮৫ সনে দুইজনই এমবিবিএস পাস করে দুইজনই সার্জারিতে বিশেষ ইন্টার্নশীপ ট্রেইনিং নিলাম ভবিষ্যতে সার্জারি বিশেষজ্ঞ হবার আশায়। কিন্তু বাস্তবে সে আজ চক্ষু বিশেষজ্ঞ আর আমি প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ।

ইন্টার্ন ট্রেইনিং শেষ করে দুই জনই বেকার হয়ে গেলাম। দুই জনই মেডিকেল অফিসার হিসাবে টাংগাইলের একমাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল নাহার নার্সিং হোমে কাজ শুরু করলাম।

১৯৮৮ সনে শুনলাম আমাদের মেডিকেল অফিসার হিসাবে সবারই সরকারি চাকরির অর্ডার হয়েছে। আমাদের দুইজনকেই খুলনা বিভাগে ন্যাস্ত করা হয়েছে। জুলাইর ১ তারিখে আমরা এক সাথে খুলনা গেলাম। রাত ১১ টায় খুলনা পৌছলাম। সকাল ১০ টায় স্বাস্থ্য বিভাগের ডিভিশনাল ডাইরেক্টর অফিসে গেলাম। দেখলাম পোস্টিং অর্ডার সাইন হয়ে গেছে। আমাকে দিয়েছে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন সাব সেন্টারে। নজরুলকে দিয়েছে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার কোন এক সাব সেন্টারে। অর্ডার হাতে পেয়ে দুই বন্ধু বিমর্ষ ভাবে তাকিয়ে রইলাম। কেউ একজন বললেন “দেরী না করে তাড়াতাড়ি যোগদান করে ফেলুন। প্রথম সরকারী চাকরি, একই দিনে সবাই যোগদান না করলে সিনিয়র জুনিয়র সমস্যা হবে। বিকেল বেলায় আমরা দুইজন দুইদিকে রওনা দিলাম। আমি পুর্ব দিকে গেলাম, নজরুল পশ্চিম দিকে গেল। এই যে দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন হলাম এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন

অবস্থায় আছি। কথা হয়, দেখা হয়, মোবাইল হয়, ফেইসবুক হয়, চেট হয়।


তারিখঃ ১২/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

প্রথম কর্মস্থলে যোগদান


সময়টা ১৯৮৮ সালের ২ জুলাই।  পোস্টিং অর্ডার হাতে পেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথ কী হবে তার খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। এ ব্যাপারে সুলতান নামে আমার এক আত্মীয় তার সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে একটা রোড ম্যাপ করে দিল। সে ওখানে চাকরি করত। 

বাসে করে সাতক্ষীরায় তার বাসায় গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে সেখান থেকে হুলার হাট গেলাম। একা জার্নি, খুব খারাপ লাখছিল। হুলার হাটে সস্তা একটা হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম। 

বাথরুমের অবস্থা ভাল না থাকায় পায়খানার কাজে ওটা ব্যাবহার করলাম না। পায়খানার বেগ নিয়েই ভোর ৫ টায় রিক্সা নিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। 

ছিনতাই হবার ভয়ে ভীত ছিলাম। ঘাটে গিয়ে বসলাম। একজন দুইজন করে যাত্রী এসে বসতে লাগল। 

আমি জীবনে তখনো লঞ্চ দেখিনি। আজ  প্রথম লঞ্চ দেখার অভিজ্ঞতা হবে। বাসের মত কি আগে টিকিট করতে হবে? না উঠে টিকিট করতে হবে? এনিয়ে ছিল নানা দুশ্চিন্তা। 

স্থির করলাম আমার মত প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্র যাত্রীরা যা করবে আমিও তাই করব। দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে একটা বড় নৌযান আসছে। উপরে লিখা “এম ভি বাপ্পী”। বুঝতে পারলাম এটাই লঞ্চ। ঘাটে ভিড়ল। দেখলাম দোতলা-নিচ তলা আছে। আমি ভদ্র লোকদের দেখাদেখি দোতলায় গিয়ে বসলাম। 

বোকার মত এদিক সেদিক তাকালাম। বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলাম। লঞ্চ পূর্ব দিকে চলছিলো। পানি আর পানি। সীমাহীন পানি। জীবনে এত পানি দেখিনি। একটা লোক বেঞ্চে পা তুলে বেয়াদবের মত শুয়েছিলো। আমি তার প্রতি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এক লোক ব্রিফকেসে সুই দিয়ে খোদাই করে নাম লিখে দিচ্ছিল। আমিও পাঁচ টাকা দিয়ে নাম লিখালাম ‘সাদেক’। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 

পানি দেখে খুব ভাল লাগছিল। পানিতে অনেক মহিষ দেখতে পেলাম। মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কী যেন খাচ্ছিল। 

আমি জানতাম, মহিষ মাঠে ঘাস খায়। কিন্তু পানির নিচ থেকে কী খাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম “মহিষ পানির নিচ থেকে কি খাচ্ছে?”। লোকটি আমাকে অস্বাভাবিক মানুষ ভেবে উত্তর না দিয়ে সটকে পড়ল।  বিপরীত দিকের বারান্দায় গিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও তাই করল। 

আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ভেতরে এসে একজনকে বিষয়টি বলার পর সে বলল ”কেন? ঘাস খায়।“

আগের দুইজন তখন মনযোগ দিল। আমি জানতে চাইলাম

-পানির নিচে ঘাস জন্মায় কেমনে?
– এটাতো মাঠ। মাঠে ঘাস খাচ্ছে।
– আমি তো দেখছি সাগরের মত।
– আপনার বাড়ি কই?
 (আমি ভরকিয়ে গেলাম)

– টাঙ্গাইল জেলায় সখিপুরে, পাহাড় অঞ্চলে।
পাশ থেকে একটু শিক্ষিত একজন বললেন
-আপনি বুঝি জোয়ারভাটা দেখেননি। এখন জোয়ার। ভাটার সময় মহিষ ঘাস খাওয়া শুরু করেছিলো, জোয়ারের পানিতে মাঠ ভরে গেছে, এখনো মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে।
– এখন বুঝতে পেরেছি। বইয়ে পড়েছি।
-আপনি কী করেন? কোথায় যাচ্ছেন?
– আমি ডাক্তার। সরকারি চাকরি হয়েছে। যোগদান করতে যাচ্ছি।
-এমবিবিএস ডাক্তার?
– জ্বী।

সবাই নড়েচড়ে বসে আমার দিকে মনযোগী হল। আমিও সাচ্ছন্দ্যবোধ করা শুরু করলাম। একে একে অনেকেই টুকটাক অসুখের কথা জানাল। আমি সমাধান দিলাম। আমি ওখানকার মধ্যমণি হয়ে গেলাম। যে লোকটি পা তুলে শুয়ে ছিল সেও পা নামিয়ে বসল। বলল “ডাক্তার সাব, আমার সারাক্ষণ পায়ের তলা জ্বালাপোড়া করে। কেন এমন হয়?” এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম কেন সে বেয়াদবের মত পা তুলে শুয়েছিল।

এভাবে সবার সাথে গল্প করতে করতে সকাল ১০টার দিকে বরিশাল এসে পৌঁছলাম। 

সিভিল সার্জন অফিস থেকে কমিউনিকেশন লেটার নিয়ে বাসে চড়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে গেলাম। ইউএইচএফ পিওর নিকট পরিচয় দিলাম। পাশে একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ৫৪/৫৫ বছর বয়স্ক লোককে বললেন, ‘এই যে আপনার মেডিকেল অফিসার এসে গেছেন। আর চিন্তা নাই।’

আমি যোগদানপত্রে সই করে অফিস ত্যাগ করলাম। ওই লোকটি ছিল আমার সেন্টারের মেডিকেল এসিস্টেন্ট। আমরা চরামদ্দি সাব সেন্টারের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দিলাম। বরিশাল গিয়ে রাত্রিযাপন করে ছোট লঞ্চে করে পরদিন চরামদ্দি যেতে হবে। বাসে যেতে যেতে আলাপ হলো। ওখানে স্টাফদের কথা  জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ওখানে আছে একজন পাগলা ফার্মাসিস্ট। কোথায় থাকে, কী খায়, কী পরে তার ঠিক নাই। দেখলেই বুঝবেন। আরেকজন পিওন আছে। তাকে দিয়ে কিচ্ছু করাতে পারবেন না। কিছু বললে উল্টা আপনাকেই ভয় দেখায়ে দেবে। আপনি তো অনেক দূরের মানুষ। আপনি সামলাতে পারবেন কিনা। আপনার তো আবার নতুন চাকরি। অসুবিধা হবে না, আমি আছি না?’ শুনে আমার শরীর শিরশির করে উঠল।

সন্ধ্যার সময় আমাকে একটি কমদামি বোর্ডিংয়ে নিয়ে উঠালেন। চলে গিয়ে আবার ফিরে এলেন দুইজন চোখে সুরমা দেয়া যুবক নিয়ে। বললেন, ‘পরিচয় করে দিচ্ছি, ইনি আমার বন্ধু ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার…..!’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! ভাবলাম এই ‘বন্ধুকে’ আমি নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে।

তাদের সাথে আলাপ হল। অনেক কথার পর তারা একটা কথা বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি না? অমুককে একটু ট্যাঁক্টফুলি ম্যানেজ করতে হবে।’ 

তারা চলে গেলে আমি একটু বারান্দায় বেরুলাম। দেখলাম তারা পাশের রুমে দুইটি মেয়ের সাথে কেমন কেমন যেন কথা বলছে। আমি লুঙ্গী পরে বাথরুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বাইরে থেকে দরজার করা নাড়ল।
– কে?
– আমি বোর্ডিংয়ের লোক। কিছু লাগবে, স্যার? আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
– আমার কিছু লাগবে না। আমি এখন ঘুমাব। ডিস্টার্ব করবেন না। 
আমার বুঝতে দেরি হল না পাশের রুমের বোর্ডারদের কারবার। 

মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে রেখে তার ভাইয়ের বাসায় থাকতে গিয়েছে। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। পায়খানার বেগ থেমে গেল। বের হবার সাহস পেলাম না। গত রাতেও পায়খানা করতে পারিনি। অমনি শুয়ে পরলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের ডাক শোনে ঘুম থেকে উঠলাম। 

ছয়টায় বরিশাল থেকে ছোট লঞ্চে উঠলাম। নয়টার দিকে কাটাদিয়া ঘাটে নামলাম। ওখান থেকে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। দুই কিলোমিটার যেতে হল নৌকায়। খালের ধারের মানুষ আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো “সাহেব কে?” 
– সাহেব আমাদের চরামদ্দির নতুন ডাক্তার। এমবিবিএস। এর আগে কেউ এমবিবিএস ছিলেন না। 
– আমাদের সরকারি ডাক্তার?
– জ্বী।
-খুব ভাল।

দশটার দিকে নৌকা থেকে নামলাম। তিনি দেখিয়ে বললেন ‘এটাই আপনার হাসপাতাল।’
দেখলাম ডোয়াপাকা একটি পুরাতন টিনের ঘর। সামনে বারান্দা। হাসপাতালের সামনে প্রায় একশত জন লোক। একজন উস্কো খুসকো লোক কানে একটা বিড়ি আটকানো, গায়ে রান্নাকরার ছাই লাগানো শার্ট, মাঝে মাঝে বিড়ির আগুনে গোল গোল করে ছিদ্র করে পোড়া, পেছনে লুঙ্গীর কোছে বিড়ির প্যাকেট, আমার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল ‘সাহেব কে?’
মেডিকেল এসিস্টেন্ট বললেন, ‘ইনি আমাদের নতুন অফিসার, ময়মনসিংহ বাড়ী।’
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন

-আপনি এমবিবিএস?
– জ্বী।

লোকটি লাফ দিয়ে দুই ফুট উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট বললেন,‘ইনিই আপনার ফার্মাসিস্ট’।
ফার্মাসিস্ট নেতার ভঙ্গিতে জনগণের উদ্দেশে  ভাষণ দিতে লাগলেন-
– ভাইসব, আপনারা শান্ত হউন। আমাদের এখানে জয়েন করতে এসেছেন যিনি তিনি এমবিবিএস, যা লন্ডন থেকে পাস করতে হয়!
তিনি আগামীকাল থেকে আপনাদের দেখবেন। আজ তিনি বিশ্রাম নিবেন।
এরপর সবাই শান্ত হলেন। তিনি সবাইকে বিদায় করে আমার কাছে আসলেন।
আমি জানতে চাইলাম
– আপনাদের লেট্রিন কোথায়?
– আমাদের তো লেট্রিন নাই!
-তাহলে আপনি কী ব্যবহার করেন?
– আমি কলার পাতা দিয়ে একটু ঘেরাও করে বানিয়ে নিয়েছি।
– এটা কী?
– এটা ফ্যামিলি প্লানিং ভিজিটরের অফিস।
– এখানে লেট্রিন নেই?
– আছে। পাকা সেনিটারি লেট্রিন। 

শোনে আমার তিন দিনের জমানো পায়খানার বেগ ফারাক্কা বাধের উজানের শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ধেয়ে আসা শুরু করল।
– লেট্রিনের চাবি দিন।
– ওটা পিওনের কাছে।
– পিওন কই?
-বাজারে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
– ডাকেন তাকে।

তিনি দৌঁড়ে বাজারের দিকে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন-
-পেলাম না।
– ঠিক আছে, আপনারটাই ব্যবহার করব। এক বদনা পানি আনেন।

তিনি পানি আনতে চলে গেলেন। আশার আলো দেখে আমার ওইটার বেগ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। তিনি খাবার পানির এক জগ পানি নিয়ে এলেন। আমি বললাম
– আমি তো পানি খাব না, পায়খানায় ব্যবহার করব, বদনায় পানি আনেন।
– স্যার, আমার এই জগ ছাড়া আর কিছু নাই। এইটা দিয়েই পানি খাই, এইটা নিয়েই পায়খানায় যাই।

আমার রাগে, দুঃখে  বেগ নিস্তেজ হয়ে পরল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মিটিমিটি হাসছিলো। আমি মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বললাম “আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাব কই?”
ফার্মাসিস্টকে বললাম,‘যান, আমার সামনে থেকে’।
তিনি ইডিয়টের মত হেসে চলে গেলেন। 

পরে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট আমাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। আমি বললাম,

-আমি এখানে থাকতে পারব না। 
– চলেন আমাদের বাড়ী। এখান থেকে ৩ কিলো দূরে হবে।

– চলুন তাই হউক। 

বিকালে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টের বাড়ি গেলাম। তার গ্রামের নামটা এখন মনে করতে পারছি না। গিয়েই লেট্রিনের খোঁজ নিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দিলেন। পাকা লেট্রিন। তিন দিনের জমা রাখা জিনিসগুলি ত্যাগ করতে পেরে গোপাল ভাঁড়ের মত প্রশান্তি পেলাম। 

তিনদিন গোসল করিনি। অত্যন্ত গরম আবহাওয়া ছিল। গোসল করতে চাইলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে নিয়ে গেলেন। বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি আর পানি। দখিনা মিষ্টি বাতাস আসছিল। আমি শার্ট গেঞ্জি খুলে কিছুক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগালাম। অমন মিষ্টি হাওয়া আর কোথাও পাইনি। 

বিকালে ঘুম দিলাম। রাতে তার ভাইয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প হল। আবার ঘুমালাম রাতে।

দুপুরের খাবার পোলাও মাংস খেয়ে বরিশাল রওনা দিলাম। বিকেল ছয়টায় ঢাকার লঞ্চে উঠলাম। ঢাকা থেকে বাসে ফিরতে হবে বাসে। হিসাব করে দেখলাম টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই কেবিনে টিকিট না করে ৩০ টাকায় ডেকের টিকিট করলাম। ব্রিফকেস থেকে লুঙ্গী বের করে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য ব্রিফকেসের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লিখা কার্ডটা উল্টিয়ে লাগালাম। ব্রিফকেস মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। 

চারদিনের জার্নির ঘটনাগুলি মনে করতে করতে এক সময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।


তারিখঃ ১৪/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

প্রথম কর্মস্থলের ভয়াবহ দিনগুলি


১৯৮৮ সনে ৩ জুলাই বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করে প্রস্তুতিমুলক ছুটি নিয়ে টাংগাইল এসেছিলাম। দুই একদিন কাটিয়ে বেডিংপত্র, একটি হারিকেন, একটি ছোট রেডিও ও এক সেট পাতিল নিয়ে কর্মস্থলে থাকার উদ্দেশ্যে দুপুরের দিকে টাংগাইল থেকে রওনা দিলাম। পরেরদিন সকাল ১০ টায় চরামদ্দি পৌছলাম। কাটাদিয়া বাজার থেকে একটা রেইনট্রি গাছের চৌকি কিনলাম ১০০ টাকা দিয়ে। হাসপাতালের পিছনেই মেডিকেল অফিসার থাকার বাড়ী। ডোয়াপাকা তিনটি টিনের ঘর। একটি থাকার ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি বৈঠকখানা কাম চেম্বার। বাজারের ভাতের দোকানে কন্ট্রাক্ট করলাম তিনবেলা খাবার দিয়ে যেতে। একটু দুরেই পুরাতন জমিদার বাড়ী। সেই জমিদাররা কেউ থাকে না। তাদের রায়তরা থাকে।

বাড়ির সাথেই বিরাট পুকুর। শুক্না কলার পাতা বাশের উপর ভাজ করে পুকুর ঘাটে বেড়া দিলাম। হেলথ ভিজিটরের লেট্রিনের চাবি নিয়ে নিলাম। শোবার, খাবার, লেট্রিনের এবং গোসলের ব্যবস্থা হয়ে গেল। এক মাস্তান যুবক ৫/৬ জন সাংগ নিয়ে হাজির হল। বললো
– আমার নাম অমুক। আপনার কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন। কোন হালার পো আপনাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। ডাক্তার সাব, আমাকে কিন্তু আগের ডাক্তার সাব তিন মাস অন্তর একটি করে রগে দেয়ার সেলাইন দিতেন হাসপাতাল স্টোর থেকে। আমি ওটা মদের সাথে মিশিয়ে খাই। তাতে তিন মাস চাংগা থাকি। দিবেন কিন্তু।

মেডিকেল এসিস্টেন্ট চোখ ইশারা দিয়ে রাজি হতে বললেন। আমি রাজি হলাম। চলে গেলো সে।
কিছুক্ষণ পর একজন এলেন। পরিচয় দিলেন তিনি পাশের বাড়ীর মকবুল দফাদার।
– আমি মকবুল দফাদার। সব সময় আমাকে কাছে পাবেন। আপনার আগের অফিসারের সাথে আমি প্রায় সব সময় থাকতাম।

শুনে আমি তেমন কিছু বললাম না।

রাত হলো। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব ছিল। চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। আমি একা একটা পুরাতন ঘরে। এই বাড়ি বৃটিশ আমলের। হাসপাতাল বৃটিশ আমলের। মনে হলো এখানে ভুত পেত্নি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। হারিকেন নিভিয়ে শুইয়ে পরেছিলাম। ঘুম আসছিল না। চারদিক নিরব ছিল। ভুত এসে মাথার উপর সিলিং দিয়ে হাটা শুরু করল। আমার বুক কাপা শুরু করল। পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সাইন্স জ্ঞান কোন কাজে আসল না। কাপড় দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম। ভুতের হাটা থামছিলো না। এক সময় সাহস করে উঠে বসলাম। মনে হলো যেন আমার মাথার উপর তিনি পা রাখবেন। থরথরি কাপছিলাম। হারিকেন ধরালাম। উপর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। দেখলাম তিনি জ্বল জ্বল করে আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। সারা শরীর কাল, শুধু চোখ দেখা যায়। চিনতে চেষ্টা করলাম। তিনি বললেন “মিয়াও”। স্বস্থি পেলাম। একজন সংগি পেলাম।

পরেরদিন সকাল নয়টায় প্রথম অফিস করতে গেলাম। মেডিকেল এসিস্টেন্ট থেকে ঔষধের চার্জ হ্যান্ড ওভার লিস্ট নিলাম। এই হ্যান্ডওভার লিস্টটা আমার পুর্বের অফিসার দিয়ে গেছেন মেডিকেল এসিস্টেন্টের নিকট। মার্মাসিস্টের নিকট থেকে চাবি নিয়ে স্টোর খুললাম। ঔষধ গুনে লিস্টের সাথে মিলালাম। চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বৃটিশ আমলের শক্ত কাঠের হাতল-ভাংগা চেয়ার। ভারি মোটা কাঠের টেবিল। মেডিকেল এসিস্টেন্ট পরামর্শ দিলেন
– আপনি তো আমাদের অফিসার। পুরুষ রুগী গুলি বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলি আপনি দেখুন। পাশের রুমে বসে আমি মহিলা রুগী দেখব।
– পুরুষ মহিলা সবার জন্য আমাকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। সবাইকে দেখতে হবে।
– আপনি একা এত ঝামেলায় জড়াবেন না।

মনে পরল ইউএইচএফপিও সাহেব বলে দিয়েছেন “মেডিকেল এসিস্টেন্ট এলাকার অভিজ্ঞ লোক, তার পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে সমস্যা হবে না। ” আমি রাজি হলাম। অনেক রুগী আসে। আমি পুরুষ রোগী দেখি, তিনি দেখেন মহিলা রুগী। তিনি পিয়নকে দায়িত্ব দিলেন স্লিপ দেখে ঔষধ বিতরণ করতে। আমি অফিস শেষে পিয়নকে বললাম “স্লিপগুলি নিয়ে আস।” সে নিয়ে আসল। আমি রেখে দিতে বললাম। সে ওগুলি পুকুরে ফেলে দিল।

বিকেলে হাটতে গিয়ে একটি ঔষধের দোকানে গিয়ে বসলাম। ওখানে এলাকার অনেকের সাথে পরিচয় হল। পরেরদিন এক মুদির দোকানের সামনে বসা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার, গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ও হাই স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে আড্ডা হল। এই ভাবে প্রতিদিন বিকেলে তাদের সাথে গল্প করে কাটালাম। বাসায় সকাল বিকাল প্রাইভেট প্রেক্টিস করলাম। বেশ রুগী হয়। ঘনঘন মারামারির রুগী আসত। সাথে মাস্তানরা আসত ইনজুরি সার্টিফিকেটের জন্য তদবির করতে। আমি সার্টিফিকেটের ধারাগুলি বুঝতাম না। দফাদার আমাকে বুঝিয়ে দিতেন।

একদিন মুদির দোকানের সামনে চেয়ার ফেলে বসে আমরা গল্প করছিলাম। গল্প বলার মধ্যমণি ছিলাম আমি। আমি মজার মজার গল্প বলতাম আর সবাই মনযোগ গিয়ে শুনতেন। মুদির দোকানদার হা করে শুনছিল। হটাৎ সে বলে বসল “স্যার, আপনার কাছে ভালো মানুষ যায় না।” আমি শুনেও না শুনার ভান করে গল্প বলা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেলাম। ভাবলাম মারামারির কেসের দালাল ও মাস্তানরা যেহেতু আমার চেম্বারে ঘুরাফেরা করে লোকটি হয়ত তাদের মিন করে বলছে ভাল মানুষ আমার কাছে যায় না। কিছুক্ষণ পর লোকটি আবারো ঐ কথা বলে বসলো। তখন আর ধৈর্য ধরতে পাড়লাম না। বললাম “ঐ মিয়া, ফাইজলামি কথা বলবেন না। ভালো মানুষ কি শুধু আপনার কাছে আসে?”
– স্যার, রাগ করছেন, ক্যা? আমি অনেকবার আপনার বাসায় গিয়েছি একটু খোজ খবর নিতে। সব সময় দেখেছি রুগী আর রুগী, একজনও ভাল মানুষ না।
– ও তাই বলুন।

একদিন বিকেলে বাজারে এক ঔষধের দোকানে বসে গল্প করছিলাম। একজন যুবক ১০/১২ জন সাংগ নিয়ে আসল। দোকানদার তার পরিচয় ও ক্ষমতা বর্ননা করে আমার পাশে বসাল। কথাবার্তায় বেশ ভদ্র। শিক্ষিত যুবক। বললেন
– কেমন চলছে আপনার হাসপাতাল?

 আমি আমার হাসপাতালের ভালদিকগুলি তার কাছে তুলে ধরলাম।

– আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্ট পাবলিকের হাতে মাইর খাবে।
– কেন? কি করেছে?
– খুব খারাপ? আপনি পুরুষ রুগী আর উনি মহিলা রুগী দেখছেন কেন?
– এমনি, ভাগ করে নিয়েছি, সুবিধার জন্য।
– মহিলা রুগী আপনার সেবা পাওয়ার অধিকার আছে না? বুদ্ধিটা তো আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্টের। ও বেটা মহিলাদের থেকে টাকা পয়সা, ডিম সব্জি ইত্যাদি নিয়ে বেশী করে ঔষধ দেয়। সেদিন আমার ভাবীর কাছ থেকে ১২ টাকা নিয়েছে। নিজে যা বুঝবেন তাই করবেন। ও বেটার বুদ্ধিতে চলবেন না।
– আচ্ছা আমি দেখব। আপনারা কিছু কইরেন না।

পরদিন হাসপাতালে রুগী দেখছিলাম। এগারটা বেজে গেল। মেডিকেল এসিস্টেন্ট এলেন  না। মহিলা রুগীগুলি গেঞ্জাম শুরু করে দিল। কেউ একজন এসে আমাকে বলল “বাসায় যান, সমস্যা আছে”।

আমি বাসায় দিয়ে দেখি উঠুনে মেডিকেল এসিস্টেন্ট খালি গায়ে শুয়ে গোংরাচ্ছে। সারা শরীরে ফাটা ফাটা মাইরের দাগ। আমি বললাম
– কে মেরেছে, কি দিয়ে মেরেছে?
– দুইটি স্কুল পড়ুয়া ছেলে রাস্তা দিয়ে আসার সময় আচমকা কাউল্ফা গাছের ডাল দিয়ে বেদম পিটিয়েছে। আমি ব্যাথা সহ্য করতে পারছি না।

আমি নিজেই তার সারা শরীরে ব্যাথানাশক মলম লাগিয়ে দিলাম। আমি আবারো কিংকর্তব্য বিমুড় হলাম। আমি জিগালাম
– উপরের লেভেলে কাউকে জানাব?
– না স্যার, এরা এলাকার ছেলে, আরো ঝামেলা বাড়তে পারে।

পিওনকে দিয়ে তাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম। সব রুগী বিদায় করে দিলাম।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুইটার সময় এক অপরিচিত লোক এলেন। আমাকে বললেন “ইনি এলাকার লোক, এলাকার ছেলেরা মেরেছে, আমরাই এর মিমাংসা করে দিতে পারব। আপনি উপরে কাউকে জানাইয়েন না।” এক ঘন্টা পর আরেকজন এসে একই কথা বলে গেলেন। আমি অপরিচিত লোকদের সাথে কি কথা বলে কোন বিপদে পড়ি ভেবে লুকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করলাম। থাকার ঘরে দুইটি দরজা ছিল। এক দরজা দিয়ে বেড় হয়ে তালা লাগালাম। আরেক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে কপাট লাগিয়ে দিলাম। বুঝালাম ডাক্তার তালা লাগিয়ে চলে গিয়েছে। চৌকিতে শুয়ে রইলাম। জুলাই মাস প্রচন্ড গরম পড়েছিল। বাইরে কয়েকজন লোকের আওয়াজ পেলাম। বলাবলি করছিল
-ডাক্তার মনে হয় ভয়ে পালিয়েছে।
-মনে হয় ভিতরেই আছে।
-ডাক্তার সাব, আমি অমুক উপজেলার একাউন্ট অফিসার, এলাকায়ই বাড়ী। ভিতরে থাকলে দরজা খুলুন।
এই বাচ্চা বেড়ার নিচ দিয়ে দেখো তো ভিতরে কোন মানুষ দেখা যায় কিনা।

আমি কাথা দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে লম্বা হয়ে মরা লাশের মত নিথর পড়ে রইলাম।

-মনে হয় একটা মানুষ কাথা মুরু দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
-এই, এত ঘরমের মধ্যে কেউ কাথা গায় দেয়?

তারা বিফল হয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যা হল, রাত্রি হল, হারিকেন লাগালাম। ফার্মাসিস্টকে কোন দায়িত্ব না দেওয়াতে সে ফ্রি স্টাইলে ঘুরে বেড়াত। আমার কাছ দিয়েও আসত না। আমি একদম একা। আমি হারিকেনের সামনে ঝিম মেরে বসে আমার পরিনতি কি হতে পারে তার বিভিন্ন রকম কল্পনা জল্পনা করছিলাম।

রাত প্রায় ১২ টা। বাইরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আশে পাশে কেউ নেই। আমি অসহায় একজন একাকি একটি ভুতুরে বাড়ীতে বসে আছি। হটাৎ উত্তর পাশের জানালা দিয়ে নিচু স্বরে একটি শব্দ আসল “ঘুম আসে না, স্যার?” আমি চমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখি জানালা খোলা।
– কেক, কেক, কে ওখানে?
লোকটি ফস করে মেচ দিয়ে কুপি বাতি ধরিয়ে মুখের পাশে ধরে এক ঝাকা দাত বেড় করে বললেন
– আমি আপনার ফার্মাসিস্ট, স্যার।
– আপনি এখানে কি করছেন? জানালা দিয়ে উকি মারছেন কেন? চলে যান।
– আপনাকে একা রেখে কি চলে যাওয়া যায়?
-আপনি একটা আস্তা পাগল।
– পাগল আমি না, স্যার, পাগল আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্ট । সে তো মাইর খাইছে ওর পিওন বেটাও মাইর খাবে। আপনি দানবীরের মত এক মাসের ঔষধ দুই তিন দিনে বিতরন করে শেষ করে ফেলেছেন। আগামীকাল ঔষধ দিতে না পাড়লে পাবলিক আপনার উপরও চড়াও হবে। আপনার আগের অফিসার ঔষধের লিস্ট দিয়ে গেছেন মেডিকেল এসিস্টেন্টের কাছে, আর ঔষধের স্টোরের চাবি দিয়েছেন আমাকে। এখন বুঝুন কে পাগল। বাচতে চাইলে ঔষধের চাহিদা দিন। আমি আগামীকালই নিয়ে আসি।
– মেডিকেল এসিস্টেন্ট বলেছে ঔষধ আনতে ৪০০ টাকা ঘুষ দিতে হবে। এই টাকা নাকি আমার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। আমি পারব না।
– নাউজুবিল্লাহ, ও বেটা একটা বেআক্কেল। কেউ কি অফিসার থেকে ঘুষ নেয় নাকি। অফিসারকেই ঘুষ দিয়ে চলতে হয়। ঘুষ দিতে হলে আমিই আমার পকেট থেকে দিব। আপনে জানবেন কেন?
– আপনি নাকি আগের স্টেশনে এলাকার লোকদেরকে পিটায়েছিলেন?
– ওখানে ওরা আমার অফিসারকে তাপ্পর মেরেছিল। স্যার আমার সামনে কাঁদছিলেন। আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আমি তাদেরকে আন্দাগুন্দা পিটিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। ওখান থেকে এখানে আমাকে বদলি করা হয়েছে। অফিসারের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিব। স্যার, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?

আমি দরজা খুলে তাকে ভিতরে এনে বসালাম। তিনি তার জীবনের অনেক কাহিনী শুনালেন। তিনি আমাকে অনেক নিয়ম কানুন শিখালেন। আমি তার ভিতর মেধা খুজে পেলাম। তার উপর ভরসা আসল। তিনি ঔষধের চাহিদা প্রস্তুত করে আমার সই নিলেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন আমি যেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে পরের দিন একটি মতবিনিময় সভা করি। আমি ঘুমিয়ে পরলাম। ভোরে তিনি ঔষধের জন্য বরিশাল সিভিল সার্জন অফিস চলে গেলেন এবং সন্ধায় চাহিদার ঔষধ নিয়ে ফিরে এলেন। কোন রকম ঘুষ ছাড়াই। আমি একটা সাদা কাগজে নোটিশ লিখে পিওন দিয়ে হেড, মাস্টার, ব্যাংক ম্যানেজার, দফাদার এবং আরো কয়েকজন লোক নিয়ে হাসপাতালে মিটিং করলাম। মিটিং-এ এক যুবক হটাৎ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল “ডাক্তার সাব, আমার ব্লাড প্রেসারটা একটু মেপে দেন না।” আমার ভিতরে রাগ উঠে গেল। কিন্তু তা প্রকাশ হতে দিলাম না। সামনের দাতের অর্ধেক বের করে হাসির ভান করে বললাম “এখন তো মিটিং চলছে, মিটিং শেষে মেপে দিব।” মিটিং-এ মেডিকেল এসিস্টেন্টের বড়ভাই উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হল এক দিন পর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে স্কুল ভবনে এর বিচার হবে।

বিচার বসল। হেডমাস্টার ভুমিকা ভাষণ দেয়ার সাথে সাথে যেই যুবকের ইংগিতে মাইর দেয়া হয়েছে সেই যুবক বলে উঠলেন “আমার ভাগ্না অন্যায় করেছে তার বিচার আমিই করছি।” বলেই একটা পাতলা বেত দিয়ে হাল্কা করে একটা আঘাত করলেন তার দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া ভাগ্নাটাকে। সাথে সাথে হেডমাস্টার তাকে উদ্ধার করে সরিয়ে ফেললেন। বললেন “বাচ্চা, মানুষ অন্যায় করে ফেলেছে, তাকে তো মেরে ফেলা যায় না।” সবাই তাতে রায় দিলেন। বিচার শেষ হল।

একদিন পর মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে নিয়ে উপজেলায় গেলেন। উপজেলা কর্মকর্তাসহ আমরা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে সিভিল সার্জন ও ডেপুটি সিভিল সার্জনের সামনে ঘটনা তুলে ধরলাম। এক সময় অফিস কক্ষে একা ডাকলেন। বসা ছিলেন সিভিল সার্জন (সি এস) ও ডেপুটি সিভিল সার্জন(ডিসিএস)। সিএস আমার সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা জেনে নিলেন। বললেন
– তুমি যেখানে আছো, তার ছয় কিলো মিটার চতুরদিকে কোন এম বি বি এস ডাক্তার নেই। ওখানে তুমি অবস্থান করে প্রাইভেট প্রাক্টিস করবে। অনেক রুগী পাবে। এলাকার লোকজন ভাল। ভাল ডাক্তারের সাথে তারা ভাল আচরণ করবে। তোমার চিন্তা নাই। তোমার মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বদলি করে ওএসডি করে রাখব। তোমার সাথে অন্য কোন মেডিকেল এসিস্টেন্ট দিব না। তোমার বর্তমান পিওন বদলি করে ভাল একজন দিব।
– স্যার, আমি অফিস টাইমের বাইরে প্রাইভেট রুগী দেখি।
– অফিস টাইমেও সরকারি ফ্রি রুগী দেখার ফাকে ফাকে প্রাইভেট রুগী দেখবে। তারা অনেক দূর থেকে নৌকা নিয়ে তোমার কাছে আসবে, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করালে বিরক্ত হবে। ওরা ধনি মানুষ। ওদের সাথে গরীবরা রাগ করবে না। তোমার প্রতি গরীবরা রাগ করবে না। ঝামেলায় ফেললে ধনিরাই ফেলবে। হাসপাতালের ঔষধ গরীব-ধনি সবার জন্য। কাজেই, প্রাইভেট রুগীর প্রেস্ক্রিপশনের ঔষধ যদি হাসপাতালে থাকে তবে তাদের দিবে। হিসাবের খাতায় ঔষধের খরচ লিখে রাখবে। ঐ খাতা বাসায় নিয়ে যাবে। বাসায় ঔষধ রাখবে। ওখান থেকেও ঔষধি দিয়ে খাতায় লিখে রাখবে। তুমি তো এটা বেচে দিচ্ছ না। ফার্মাসিস্ট পাগল হলেও ভাল মানুষ। তার কাছেও কম দামের কিছু ঔষধ রাখবে। সেও অল্প স্বল্প প্রাক্টিস করে।

ডিসিএস বলনেন
– আমার বাড়ীও ওখানে। সিএস স্যার যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। আপনি যখনি চাহিদা পাঠাবেন আমি এক কার্টুন ঔষধ বেশী দিব।

আমি নির্বাক হয়ে শুনছিলাম। ভাবলাম আবার যে কোন বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

দুই একদিন পর নতুন এক অত্যন্ত ভাল পিওন এসে গেল। পাড়ার একজন প্রাক্তন পিওন এসে তার ছেলেকে আমার খেদমতে দিয়ে গেলেন। দফাদার আমার সিকিউরিটি বন্ধু। সিএস ও ডিসিএস স্যারগনের পরামর্শ মত সব ঠিক ঠাক মত চলল। পাগলা ফার্মাসিস্ট-এর সাথে কত যে মজার মজার আলাপ হয়েছে! তার কাছ থেকেই বেশির ভাগ অফিসিয়াল নিয়মকানুন আমার শেখা। জানি না সে এখন বেচে আছে কিনা।

তারিখঃ ১৬/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

floating-hotel

বুটিগঙ্গায় ভাসমান হোটেলে ৬ মাস

(লুতফর হাসানের জীবনের গল্প থেকে)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

কবি, গীতিকার, লেখক, কণ্ঠশিল্পী লুতফর হাসান আর জে কিবরিয়ার সাথে এক ভিডিও প্রোগ্রামে তার বিচিত্র জীবনের গল্প শুনিয়েছেন। আমি সেই গল্প শুনেছি। তার থেকে কিছু অংশ এই পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

এর আগের পর্বে আমি তুলে ধরেছি বিসিএস-এর পরীক্ষার প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি ঢাকায় থেকে একটা প্রাইভেট ফার্মে মাসিক তিন হাজার টাকার বেতনে কাস্টোমারদের ঠিকানা সংগ্রহ করে দিতেন। থাকতেন বন্ধুদের ভাড়া করা ফ্লাটবাড়ির রুমের বারান্দায়। একটা প্রিন্টিং প্রেসে অল্পদিন ছোট একটা চাকরিও করেন। তার এলাকার এক বড় ভাই বসিলায় একটা ইটভাটায় ম্যানেজার ছিলেন। তার কাছে একটা চাকরি চাইলে তিনি তাকে দৈনিক তিন ঘন্টার জন্য একটা কাজ দেন সেই ইটভাটায়। কাজটা ছিল এই রকম – কয়টা ট্রাক এলো, কয়টা ট্রাক গেলো এবং কয়টা ইট বিক্রি হলো, এটা খাতায় লিখে রাখা। বাকী সময়টা নষ্ট করেন না। দেখা হলো আরেক বাস মালিকের সাথে। তার কাছে একটা চাকরি চাইলে তিনি তাকে বাসের টিকিট বিক্রির চাকরি দেন। শেওড়া পাড়া ওভারব্রিজের নিচে বসে বাসের টিকিট বিক্রির চাকরি ছিলো সেটা। অল্প টাকা পেতেন সেখান থেকে। আরও কিছু ছোট খাটো কাজ তিনি করতেন, তা তিনি মিডিয়ায় বলতে চান না। বললে তার মা শুনে অনেক কষ্ট পাবেন। তাই তিনি বলেন না। কবির মা আর জে কিবরিয়ার অনুষ্ঠানের ভক্ত। তাই, বলতে চান না। বললে মা শুনে কষ্ট পেয়ে কাদবেন। পাগল হয়ে যাবেন।

তিনি তখন থাকতেন বুড়ীগঙ্গা নদীতে ভাসমান হোটেলে। আহসান মঞ্জিল বরাবর বুড়িগঙ্গা নদীতে কিছু ভাসমান নৌকা আছে যেগুলি ব্যবহার করা হয় ভাসমান হোটেল হিসাবে। নৌকার মাঝ দিয়ে করিডোর রেখে দুইদিকে সারিবদ্ধভাবে ছোট ছোট রুম করে আবাসিক হোটেল করেছে। এখনো এগুলো আছে। এগুলোর প্রতিরুমের ভাড়া ছিলো তিন বেলা খাবার সহ মাত্র ৫০ টাকা।

লুতফর হাসান এখানে থেকেছেন ৬ মাস। নৌকায় শুয়ে শুয়ে তিনি রাতের আকাশ দেখতেন। দেখতেন আকাশের বিশালতা। দেখতেন খা খা চাদের আলো। দেখতেন আকাশে মেঘের খেলা। ডুবে যেতেন কল্পনার জগতে। হয়ে উঠেন কবি, লেখেন গান। সেই গান খোলা গলায় খোলা আকাশের নিচে নিজেই গান। তখন তিনি লিটন হাফিজের মাধ্যমে বাংলা ভিসন টিভিতে কাজ পান। ২০০৫ সনে সালমার কন্ঠে “তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি, মধ্যে চিত্রা নদী” গানটি জনপ্রিয়তা পায়। রিংকুর কন্ঠে তার লেখা “কানার হাট বাজার” গানটি জনপ্রিয়তা পায়। ক্লোজ আপ তারকা রাজীবের কন্ঠে তার লেখা “আমি একলা মানুষ দোকলা খুজি” গানটিও জনপ্রিয়তা পায়। এভাবে তার গানের জগতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু হয়।

তিনি সকালে ভাসমান হোটেল থেকে সদর ঘাট হয়ে বসিলার ইটের ভাটায় চাকরি করতে যেতেন। সেখানকার কাজ শেষ করে যেতেন শেওড়া পাড়া বাসের টিকিট বেচার চাকরি করতে। সন্ধায় আসতেন শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে। এই মার্কেটে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা যাতায়াত করেন। এখান থেকে তিনি ফিরে গিয়ে ঘুমাতেন বুড়িগঙ্গায় ভাসমান হোটেলে।

আজিজ সুপার মার্কেটে পরিচয় হয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের টিচার রেজা আরিফ ও শরীফ সাহেবের সাথে। তিনি ভাসমান হোটেল ছেড়ে তাদের সাথে কাঠাল বাগানের এক বাসায় উঠেন। রেজা আরিফ তাকে রাতে আন্তর্জাতিক মানের ক্লাসিক সিনেমা এবং নাটক দেখাতেন এবং অভিনয় গুলোর ক্লাসিকাল দিক বিশ্লেষণ করে বুঝাতেন। এভাবে তিনি সিনেমা এডিটিং করা শুরু করেন। সেই সময় তার জীবনে প্রেম আসে।তিনি বলেন “আমি যখন জীবনযুদ্ধ করছি তখন মেয়েটি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিচ্ছে। সেই সময় তার সাথে আমার প্রেম হয়। কিন্তু তাকে আমি বিয়ে করতে পারিনি। সেই জন্য হয়তো আমার জীবনে ধ্বস নেমেছে।” কেন বিয়ে করতে পারেননি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সেটা পারিবারিক ভাবে একটা বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।” বলে তিনি কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে চুপ থাকেন।

২৮ জুন ২০২৫ খৃ.

#জীবনেরগল্প#গল্প#লুতফর_হাসান

(সুত্র: আর জে কিবরিয়া : ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ইউটিউব ভিডিও, স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লি: কবি লুতফর হাসানের জীবনের গল্প: সব বলা যাবে তো?)

introductory-speech

Sample Introductory Speech by a Junior Faculty in Clinical Meeting

Here is an introductory speech script for a junior Faculty to deliver at the Weekly Clinical Meeting on “Basic Concepts of Clinical Dentistry” organized by the Dental Unit of Community Based Medical College Bangladesh (CBMCB):


Assalamu Alaikum and a very good morning to everyone.

Honourable Principal, Vice Principal and Dirctor Sir, Teachers, colleagues and  interns.

It is indeed a great pleasure and privilege for me to welcome you all to today’s Weekly Clinical Meeting, organized by the Dental Unit of Community Based Medical College Bangladesh.

Today, we gather here to explore and enrich our understanding of a subject that serves as the bedrock of dental practice – “Basic Concepts of Clinical Dentistry.”

Chairperson of today’s session is  Dr. Khaleed Muhammad Islam and  Speaker is Dr. Farzana Anar.

As healthcare providers, we all understand that sound clinical knowledge is essential – not just for diagnosis and treatment, but for gaining the trust and confidence of our patients. The fundamentals of clinical dentistry – including patient examination, diagnostic protocols, infection control, and treatment planning – form the backbone of safe and effective dental care.

To guide us through this important topic, we are honoured to have with us Dr. Farzana Anar, a promising and dedicated member of our dental faculty, who will be sharing her insights and experiences in this area.

We are also deeply privileged to have Dr. Khaleed Muhammad Islam with us today as the Chairperson of this session. His leadership and guidance have always inspired us to uphold academic excellence.

I thank everyone for their presence, attention, and commitment to continuing professional development. I believe today’s session will be highly informative and thought-provoking for all of us.

With that, I would now like to humbly invite our honourable Chairperson, Dr. Khaleed Muhammad Islam, to give his opening remarks and formally begin today’s session.

Thank you.

dudher-ghran

দুধের ঘ্রাণ

(জীবনের গল্প। কবি, গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক লুতফর হাসানের জীবনের গল্প থেকে)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

কবি লুতফর হাসান তখন ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি পাস করে ঢাকায় থেকে জীবন চালানোর জন্য ছোট খাটো একটা চাকরি করছিলেন। বেতন ছিলো মাত্র ৩ হাজার টাকা। চাকরিটা ছিলো এমন – মোশাররফ নামে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার কাজ ছিলো জানালার পর্দা সরবরাহ করা। তাকে কাজ দিলেন এমন যে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে যত নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে তার মালিকের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা, ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের কন্টাক্ট নাম্বার সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীকে দেয়া। ব্যবসায়ী তাদের কাছে প্রডাক্ট বিক্রি করতেন। প্রডাক্ট বিক্রির লাভের ১০% লুতফর হাসান পেতেন। এই কাজের জন্য তিনি লেখালেখি বন্ধ করে দিলেন। নিজের পেট খরচ শেষে যা বেচে যেতো তা তিনি মায়ের জন্য পাঠাতেন।

তার চার বন্ধু ঢাকায় একটি ফ্লাট ভাড়া করে থাকতেন। তারা লুতফর হাসানকে ফ্রি থাকতে দিলেন তাদের বারান্দায়। কবি একটা বিছানার চাদর বারান্দার গ্রীলের সাথে বেঁধে রাতে এসে ঘুমাতেন। ভোরে উঠে চলে যেতেন কাজে। বাইরে খেতেন। বাসায় আসতেন শুধু বারান্দায় ঘুমাতে। এভাবে প্রায় চার মাসের মতো থাকলেন, কাজ করলেন। দেখলেন যে, যে বেতন পান তাতে কিছুই হয় না। বাড়ি থেকে তার মা বুঝতেন যে ছেলের কষ্ট হচ্ছে। মা লিখতেন যে তিনি ছেলের জন্য টাকা পাঠাতে চান। মা চান যে ছেলে বি সি এস দিয়ে চাকরি নিক। ইউনিভার্সিটি পাস করে সবাইতো চায় বিসিএস অফিসার হতে। তার মাও তাই চান।

বন্ধুরা তাকে তাচ্ছিল্য করতেন তা তিনি বুঝতে পারতেন। একদিন অকারনে রুমের এক বন্ধু বলে ফেললেন, “আমরা তোকে টিভিতে দেখলাম। তুই টিভিতে গান করস আমাদের বলবি না!” কবি বুঝতে পারেন যে বন্ধুরা তাকে টিটকারি দিয়ে কথাগুলো বলছে, তাকে খেপাবার জন্য । আরেকটা কারনে তার অনেক খারাপ লাগে। বন্ধুরা প্রতিদিন রুমে দুধ ঝাল দিয়ে খান। রুম থেকে দুধের ঘ্রাণ বারান্দায় কবির নাকে আসে। কোন দিন বন্ধুরা তাকে এক কাপ দুধ খেতে বলেন নি। এতে তার খুব খারাপ লাগে। তিনি বলেন, “বাবা, আমাকে সবসময় টাকা দিতেন প্রতিদিন এক কাপ করে দুধ খাওয়ার জন্য। আমি সেই দুধ খাওয়ার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখতাম। আমার বন্ধুরা রুমে দুধ খাচ্ছে আমি বারান্দায় শুয়ে তার ঘ্রাণ পাচ্ছি। তারা একটিবারও আমাকে এক মগ দুধ খেতে বলে না। আক্ষেপ করে এখান থেকে চলে যাই।”

২৫ জুন ২০২৫

(সুত্র: আর জে কিবরিয়া : ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ইউটিউব ভিডিও, স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লি: কবি লুতফর হাসানের জীবনের গল্প: সব বলা যাবে তো?)

scabies

স্ক্যাবিস: ধামা বা চুলকানির এক ছোঁয়াচে রোগ

স্ক্যাবিস: ধামা বা চুলকানির এক ছোঁয়াচে রোগ

ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

খুবই সাধারণ কিন্তু উপেক্ষিত ও ছোঁয়াচে চর্মরোগ স্ক্যাবিস
বাংলায় একে আমরা বলি ধামা, অনেকেই বলেন খাউস চুলকানি, পাচড়া, বা গোট বসা রোগ
এই রোগটি যেমন কষ্টদায়ক, তেমনি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাও রাখে।
আসুন, আমরা বিস্তারিতভাবে জানি – এই রোগ কী, কেন হয়, কীভাবে ছড়ায়, এবং এর প্রতিকার কী।


রোগটি কী?

স্ক্যাবিস হলো একটি ছোঁয়াচে চর্মরোগ, যা একটি ক্ষুদ্র জীবাণু—Sarcoptes scabiei নামের মাইট বা পরজীবী কীট দ্বারা হয়ে থাকে।
এই পরজীবীটি মানুষের ত্বকের ভেতরে গর্ত করে ডিম পাড়ে, এবং এর ফলে শুরু হয় তীব্র চুলকানি ও ত্বকে ফুসকুড়ি।
এই রোগটি গরিব, গরম ও ঘিঞ্জি পরিবেশে বেশি দেখা যায়, তবে যেকোনো বয়স ও শ্রেণির মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে।


কীভাবে ছড়ায়?

স্ক্যাবিস খুব সহজেই ছড়ায়:

  • রোগীর সঙ্গে ঘন শারীরিক সংস্পর্শে এলে
  • একই বিছানা, কাপড়, তোয়ালে, পোশাক ব্যবহার করলে
  • শিশুরা একসাথে ঘুমালে বা খেলার সময় সংক্রমিত হতে পারে

একটি পরিবারে একজন আক্রান্ত হলে, খুব দ্রুত অন্য সদস্যরাও আক্রান্ত হতে পারে। তাই এটা একক রোগ নয়—একটি পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত স্বাস্থ্য সমস্যা।


লক্ষণসমূহ

স্ক্যাবিসের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো:

  1. তীব্র চুলকানি – বিশেষ করে রাতে
  2. ছোট ছোট গুটি বা ফুসকুড়ি – হাতের আঙুলের ফাঁকে, কবজি, কনুই, নাভির চারপাশ, কোমর, বুকের নিচে, পায়ের আঙুল, বা যৌনাঙ্গে
  3. স্ক্র্যাচ মার্ক বা ঘষার দাগ
  4. ঘুমে ব্যাঘাত – চুলকানির জন্য

শিশুদের ক্ষেত্রে:

  • মুখ, মাথার ত্বক, হাত-পা—সব জায়গাতেই গুটি দেখা যেতে পারে
  • কখনো কখনো জ্বর ইনফেকশন-ও হতে পারে

জটিলতা

চুলকানির জায়গা বারবার ঘষে ঘষে খোলস উঠে গেলে তাতে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে, যাকে বলে সেকেন্ডারি ইনফেকশন
এর ফলে হতে পারে:

  • ঘা
  • পুঁজ জমা
  • পানি পড়া ফোসকা
  • শিশুদের ক্ষেত্রে: সেলুলাইটিস বা গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস নামক মারাত্মক কিডনি সমস্যা

তাই স্ক্যাবিসকে ছোট রোগ ভাবলে চলবে না।


করনীয় / চিকিৎসা

  1. নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
  2. সাধারণত ব্যবহৃত ঔষধ:
    • পারমেথ্রিন (Permethrin) 5% ক্রিম: পুরো শরীরে ঘুমানোর আগে লাগিয়ে সকালে ধুয়ে ফেলতে হয়
    • আইভারমেক্টিন (Ivermectin) ট্যাবলেট: ওজন অনুসারে ডোজ, কিন্তু গর্ভবতী ও শিশুরা গ্রহণ করতে পারে না
    • অ্যান্টিহিস্টামিন: চুলকানি কমাতে
    • অ্যান্টিবায়োটিক: ইনফেকশন হলে
  3. পরিবারের সবাইকে একসাথে চিকিৎসা দিতে হবে, না হলে বারবার ফিরে আসবে।

🧺 পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা প্রতিরোধ

  • ব্যবহৃত বিছানার চাদর, বালিশ, কাপড়, তোয়ালে গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে
  • ৩ দিন ব্যবহৃত পোশাক বন্ধ ব্যাগে রেখে তারপর ধুতে হবে
  • নিজের নখ কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে
  • স্কুল-হোস্টেল-আবাসিকে সচেতনতা বাড়াতে হবে
  • নিজে চিকিৎসা নিয়ে গোপন রাখা যাবে না – সবাইকে জানাতে হবে

শেষ কথাঃ

স্ক্যাবিস একটি নিরাময়যোগ্য রোগ, কিন্তু অবহেলা করলে এটি পরিবার বা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো – নিজে সুস্থ থাকা, এবং আশপাশের মানুষকে সচেতন করা।

anal-disease

পায়ুপথের রোগগুলো

আপনি কি জানেন পায়খানার রাস্তার সমস্যাগুলো একে অন্যের সাথে জটিলভাবে জড়িত?”
👉 এনাল ফিসার মানে পায়খানার রাস্তায় ছোট ফাটল। এটি কোষ্ঠকাঠিন্যে হয়ে থাকে, যন্ত্রণা ও রক্তপাত হতে পারে।
👉 ফাটলে ইনফেকশন হলে জমে পুঁজ – একে বলে পেরিএনাল অ্যাবসেস বা ফোড়া।
👉 ফোড়ার মুখ বাইরে খুলে গেলে হয় পেরিএনাল সাইনাস
👉 আর সেই মুখ যদি পায়খানার রাস্তায় গিয়ে মিশে যায় – তখন একে বলে ফিস্টুলা ইন এনো – এটি প্রায়ই সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
👉 অন্যদিকে, পাইলস হলো পায়খানার রাস্তায় ফোলা রক্তনালি – যা ব্যথা ছাড়াও রক্তপাত করতে পারে।
🎯 “সবগুলো রোগই গুরুত্বপূর্ণ, তাই প্রাথমিক উপসর্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।”
📌 স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন!
🎥 ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকাদার, তালুকদার প্যাথলজি ল্যাব, চরপাড়া, ময়মনসিংহ

guddi

গুড্ডি

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ঘুড়িকে আমরা বলতাম গুড্ডি। গুড্ডি তৈরি করতে কাগজ, বাঁশের বাতি, আঠা ও সুতা লাগতো। শক্ত কাগজ লাগতো। আমরা এই কাগজকে বলতাম বাঁশ তাও। আমরা জানতাম বাঁশ তাও বাঁশ থেকে তৈরি হয়। এই কাগজের রঙ বাদামী ছিল। ডিজাইন করে বাঁশ তাও কেটে আঠা দিয়ে বাঁশের ফ্রেমে আটকানো হতো। ঘুড়ি উড়ানোর মৌসুমে অর্থাৎ জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে বল গোটা পাকতো। এগুলো বন্য ফল। আবেদ আলী কাক্কুদের বাড়ির উত্তর পাশে একটা বল গোটা গাছ ছিলো। আমরা বড়বাইদপাড়ার প্রায় সবাই এই গাছের বল গোটা তুলে এর আঠা দিয়ে গুড্ডি বানাতাম। বড় বড় গুড্ডির মাথায় বা ঘারে বেত বাঁধা হতো, বলা হতো বেত আলা গুড্ডি। বর্গা হাটে বেত উঠতো। এই বেত দিয়ে হস্ত শিল্পের কাজ করা হতো। ছাত্র পিটাতেও এই বেত ব্যবহার করা হতো। এই বেতের বাকল মিহি করে ছিলিয়ে পাতলা ফিতার মতো করে গুড্ডির বেত বানানো হতো। বাঁশের বাতিতে টাইট করে বেঁধে ধনুকের মতো করে গুড্ডিতে লাগানো হতো। গুড্ডি ওড়ার সময় বাতাস লেগে বেত গুণ গুণ করে বাজতে থাকতো। এই ধরনের বেত আলা গুড্ডি বড়রা উড়াতো।

আকার আকৃতি অনুযায়ী গুড্ডির বিভিন্ন ধরনের নাম ছিলো। সহজ ও কম খরচে বানানো হতো পতিঙ্গা। পতঙ্গের মতো দেখতে। ছোট এবং পাতলা ছিলো। এটার নিচের দিকে ছোট ছোট দুটো লেজ ছিল। গুড্ডি সুতার সাথে বেঁধে বাতাসে উড়াতে হয়। গুড্ডির সাথে তিনটা সুতা লাগানো থাকে। উপরের দিকে দুইটা, নিচের বা পেটের দিকে একটা। উপরের দুইটা নিচের থেকে খাটো।সাপের মতো ডিজাইন করে যে গুড্ডি বানান হতো তার নাম ছিলো সাপা। অনেকে বলতো হাপা। চার কোনা আয়তকার গুড্ডিকে বলা হতো চং। বড় সাইজের গুড্ডি যার লেজ ছিলো ফিংগে বা ফেইচ্চা পাখির লেজের মতো তাকে বলা হতো ফেইচ্চা গুড্ডি। বড় বড় গুড্ডি যার লেজ ছিল ভাতের পাতিল বা পাইল্যার মতো তার নাম ছিলো পাইল্যা গুড্ডি। বড় বড় চং, ফেইচ্চা গুড্ডি ও পাইল্যা গুড্ডির ঘারে বেত বেঁধে দেয়া হতো ভন ভন করে বাজানোর জন্য। সন্ধ্যার সময় ঝোপে ঝারে এক যোগে শত শত ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতো। আর আকাশে অনেকের বেতা আলা গুড্ডি ডাকতো। দুই ধরনের ডাক মিলে এক অপুর্ব নৈসর্গিক সুর তৈরি হতো। সেই সুর আজও কানে বাজে। এখনো গ্রামের বাড়ি গিয়ে রাত্রিযাপন করি। সন্ধ্যা নেমে আসলে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে পাই। কিন্তু গুড্ডির ডাক শুনতে পাই না।

গুড্ডি উড়ানো হতো দখিনা বাতাসে। আমাদের বাড়ির দক্ষিনে বাইদের ওপারে সড়াসিয়া গ্রাম। বড়বাইদপাড়া গ্রামের দক্ষিনেও সাড়াসিয়া গ্রাম আবার পূর্বেও সাড়াসিয়া গ্রাম। চটানের বাইদ সাড়াসিয়া গ্রামকে দুইভাগে ভাগ করেছে – উত্তর সাড়াসিয়া এবং দক্ষিণ সাড়াসিয়া। চটান বাইদের দক্ষিন পাড়ে নুরজাহা ভাইদের বাড়ি এবং উত্তর পাড়ে জাফর ভাইদের বাড়ি। দুই জনের বাড়িই আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ওনারা সমবয়সী ছিলেন। দুই জনই বিবাহিত যুবক ছিলেন। আমি তখন কিশোর। দুই জনই পাল্লা দিয়ে গুড্ডি উড়াতেন। দুই জনের ঘুড্ডিতেই বড় বড় বেত বাঁধা থাকতো। ওনাডের গুড্ডির সুতা এত লম্বা ছিলো যে বাতাস কমে গেলে গুড্ডিগুলো আমাদের বাড়ির কাছাকাছি নেমে আসতো। আমি চালায় একাকি বসে বসে ঘুড্ডি উড়া উপভোগ করতাম। আমি বাবার কাছে তেমন কিছু আব্দার করতাম না। বাবার যদি কষ্ট হয়! তাই। বাবা আমার ইচ্ছাটা বুঝতে পেরে নিজ হাতে একটা বিনা ভাড়া গুড্ডি বানিয়ে দেন। কিন্তু সেটা দেখতে ভালো ছিলো না। আমার পছন্দ হয়নি। খসরু কাক্কু ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “তোর বাপের বানানো বিনাভাড়া, হে, হে, হে।” আমি তারপর থেকে ওটা আর উড়াইনি।

আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বাইদের বাতরে (আইলে) বসে জাফর ভাই ও নুরজাহা ভাইর ঘুড্ডি উড়া দেখতাম। বাবা এলেন কাছে। আমি একটু লজ্জিত হলাম। বাবার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “বাজান, আমি তোমারে ভালা একটা পাইল্যা গুড্ডি কিন্যা দিমু। নও ইদ্দুগ বাইত যাই।” বাবা, আকবর ভাই ও আমি উত্তর সাড়াসিয়া গ্রামের ইদ্দু ভাইদের বাড়ি গেলাম গুড্ডি কিনতে। ইদ্দু ভাই গুড্ডি তৈরির একজন ভালো কারিগর ছিলেন। মনের আনন্দে ইদ্দু ভাইর কাছ থেকে কেনা গুড্ডি বেশ কিছু দিন উড়ালাম। ঐ গুড্ডিতে বেত বাঁধা ছিলো। আমি ঘরেও সুতা ধরে গুড্ডি মাথার উপর ঘুরাতাম ভন ভন করে ডাক শোনার জন্য। এক দিন বাবা ঘরে প্রবেশ করেছেন এই দময় আমি বাবাকে দেখতে পাইনি। যেই গুড্ডি ঘুরান মেরেছি অমনি ওটার চোক্ষা মুখ বাবার মাথায় লেগে চামড়া ছিদ্র হয়ে রক্ত বের হয়ে গেলো। বাবা মাথায় হাত দিয়ে হাতে রক্ত দেখতে পেয়ে রাগে আমার গুড্ডি ভেঙ্গে চুরমার করে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আমি কয়েকদিন শোক কাটালাম। আবার ক্ষেতের বাতরে বসে বসে জাফর ভাইর গুড্ডি উড়া দেখা শুরু করলাম। আমার কষ্ট বুঝতে পেরে বাবা আমাকে আরেকটা গুড্ডি কিনে দিলেন ইদ্দু ভাইর কাছ থেকে।

এবার ঘটলো আরেক ঘটনা। আমাদের একটা দামী টেপাটেপা গাভিন ছাগল ছিলো। আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে বারচা ক্ষেতে হাচার দিয়ে পাহারা দিতাম। কারন, পাশের গজারি বনে বাস করতো শেয়াল মশাইরা। একদিন গুড্ডি উড়াতে উড়াতে আমি চলে গিয়েছি বড়বাইদের কুয়ারপাড়ের ক্ষেতের বাতরে। এদিকে একা পেয়ে শেয়াল মশাই ছাগলের গলা দাঁত দিয়ে ছিদ্র করে দিয়েছে। ছাগলটা মারা গেছে। তিনি রাতে টেনে নিয়ে জংগলে নিয়ে ধীরে ধীরে ভক্ষন করবেন। এই দৃশ্য দেখে বাবা রাগে ফেটে পড়ে খুঝতে খুঝতে আমাকে কুয়ার পাড়ের ক্ষেতের বাতরে গুড্ডি উড়ানো অবস্থায় পেলেন। কোন কথা নেই। গুড্ডিটা নামালেন। মট্টশ করে ভেঙে দিয়ে চলে গেলেন। আমি বাড়ি গেলাম। দেখলাম বিশাল দেহি গাভীন প্রিয় ছাগলটা আমাদের ছনপাওড় ক্ষেতে মরে পরে আছে। আমি শোকে ভেঙ্গে পড়লাম। টেনে মরা ছাগলটাকে বাড়ির উঠানে নিয়ে রাখলাম এই ভেবে যে শিয়ালকে এই ছাগল খেতে দেব না।

কয়েকদিন ছাগল ও গুড্ডির শোক এক সাথে পালন করলাম। বাবা আমার কষ্টের কথা ভেবে আবার আরেক বেতায়ালা গুড্ডি ইদ্দু ভাইর কাছ থেকে কিনে দিলেন।

ইদ্দু ভাই, জাফর ভাই, নুরজাহা ভাইরা কি বেচে আছেন। তোমরা কিশোররা, যারা বড়বাইদপাড়ায় থাকো তারা কি গুড্ডি উড়াও? আবেদ আলী কাক্কুগ বাড়ির পিছনের বলগোটা গাছটি কি এখনো আছে?

২৪ জুন ২০২৫ খ্রি