Category Archives: Literature

tiner thali

টিনের থালি

টিনের থালি

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ টিনের থালাবাসন ব্যবহার করতো। গরীবরা ব্যবহার করতো পোড়ামাটির থালাবাসন। থালা, বাটি ও ডিস ছিলো টিনের তৈরি। সানকি, বাটি ও গামলা ছিলো পোড়ামাটির তৈরি। ধনি বাড়িতে অল্প কিছু পোরসেলিনের বা চিনামাটির থালাবাসন ছিলো। এগুলোকে করইর বাসনও বলা হয়। এগুলো সাধারণত সিকায় তুলে রাখা হতো। মেহমান এলে করইর থালায় খাবার পরিবেশন করা হতো। এগুলোর সাথে পিতলের চামচ ব্যবহার করা হতো।

টিনের থালির উপর দিয়ে সাদা রংগের প্রলেপ দেয়া থাকতো যাতে জং (মরিচা) না ধরে। থালি পুরান হলে ঘসায় ঘসায় রং উঠে গিয়ে জং ধরে যেতো। জং ধরলে থালি ছিদ্র হয়ে যেতো। আমরা বলতাম ছেন্দা। অন্য এলাকার মানুষ বলতো কানা। ছেন্দা থালি বড় চওনা হাটে নিয়ে মেকার দিয়ে ঝালাই করে আনা হতো। রং উঠে গেলে বলা হতো কালাই উইঠা গেছে। বারবার ঝালাই করলে খালিতে ভাত খাওয়ার অনপোযুক্ত হয়ে যেতো। এমন থালি দিয়ে ভৌরা (নিচু এলাকার) মানুষ নায়ের (নৌকার) পানি হিচতো (সেচতো)। মেয়েরা ছাই ফেলতো বা ছাই রেখে জিয়লমাছ (শিং মাছ) কাটতো। পাহাইড়া (পাহাড় এলাকার) মানুষ মান্দা হিচতো।

ফকিররা (ভিক্ষুক) ভিক্ষার থলেতে একটা টিনের থালি রাখতো। কেউ খাবার দিলে এই টিনের থালিতে নিয়ে খেতো। ভিক্ষা নিতো আইচায় করে। আইচার ভিক্ষা থলের চাউলের সাথে মিশিয়ে নিতো।

এখন গ্রামে বা শহরে টিনের থালি চোখে পড়ে না। আমি কয়েকমাস আগে ময়মনসিংহের স্বদেশী বাজারে কাঁচের বৈয়ম কিনতে গিয়ে এই থালির দেখা পাই। সখ করে একটা থালি কিনে আনি। আজ ভাগনে ফারহানকে দেখিয়ে বলি “এমন টিনের থালিতে আগের দিনে বেশী ভাগ মানুষ ভাত খেতো। এখন এগুলো দেখা যায় না।” ফারহান বললো “আমি যেনো কোথায় দেখেছি। মনে পড়েছে, ভিক্ষুকের হাতে দেখেছি।” শুনে সবাই হা, হা করে হেসে দিলো। আমি এরপর আমার এই স্মৃতি কথাটি লিখে ফেললাম।

ময়মনসিংহ

২৩ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি.

#memoryofsadequel

haque-sir-fnac

Introduced by Haque Sir

হক স্যারের কারনে পরিচিতি পেলাম

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

সময়টা খুব সম্ভব ১৯৯৭ বা ৯৮ সন। ডাঃ ফজলুল হক পাঠান ভাই ময়মনসিংহ বিএমএ-র জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলার ডাক্তারদের নিয়ে একটা বিরাট সম্মেলন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে আমি একটা সাইন্টিফিক পেপার প্রেযেন্ট করেছিলাম। প্যাথলজির প্রফেসর, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, সাবেক অধ্যক্ষ, সাবেক বিএমএ প্রেসিডেন্ট ডাঃ আব্দুল হক স্যার সেদিন অন্যতম লিজেন্ড হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার বকৃতায় সম্মেলন আয়োজকদের ভুয়সী প্রশংসা কনেন। বিশেষ করে সাইন্টিফিক পর্বের প্রতি বেশ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন “সাইন্টিফিক প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিষয়গুলো জানতে পারি। যেগুলো এখনো বইয়ে আসেনি। আমার এক ছাত্র ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার সুন্দর করে প্রেজেন্ট করেছে। সে প্যাথলজি বিভাগের হিস্টোপ্যাথলজির পাশাপাশি সাইটোপ্যাথলজি বিশেষ করে এফ এন এ সি ও পেপস স্মিয়ার করা হচ্ছে তা সুন্দর করে প্রেজেন্ট করেছে। এফ এন এ সি পরীক্ষার কথা তো আমার জানাই ছিলো না। আমার এক আত্মীয় কয়েকদিন আগে হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। আমি দেখে অনুমান করি তার ক্যান্সার হয়েছে। বায়োপসি পরীক্ষা করতে হবে ডায়াগনোসিস করার জন্য। কয়েকদিন সময় লাগবে। বিকেলে আমার বাসায় ওরা খবর নিয়ে এলো যে পরীক্ষায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আমি বললাম যে আমাদের এখানে বায়োপসি পরীক্ষা করতে ৩ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। আজকেই কিভাবে পরীক্ষা করলো। ওরা বললো, দুই ঘন্টার মধ্যেই রিপোর্ট দিয়েছেন। আমি বললাম যে রিপোর্ট নিয়ে আসো। রিপোর্টে দেখি ঠিকই ক্যান্সার ডায়াগনোসিস করেছেন আমারই ছাত্র, সম্প্রতি পিজি থেকে এম ফিল পাস করে এসেছেন ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার। তারপর এনিয়ে প্রফেসর মীর্জা হামিদুল হকের সাথে কথা বললাম। জানতে পারলাম এফ এন এ সি করে এখানে দ্রুতই ক্যান্সার ডায়াগনোসিস করা যাচ্ছে……।”

স্যারের বকৃতা শুনে অন্যান্য জেলার চিকিৎসকগণও জেনে গেলেন এফ এন এ সি ও পেপ্স স্মিয়ার পরীক্ষার গুরুত্ব এবং আমিও পরিচিতি পেয়ে গেলাম বৃহত্তর ময়মনসিংহের সকল ডাক্তারদের কাছে। প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ হিসাবে ডাক্তারদের সাথে পরিচিতি পেলে যে কি লাভ তা ডাক্তারগণ জানেন। কাজেই ময়মনসিংহে ডাক্তারদের মাঝে পরিচিতি পেতে আমার সরাসরি শিক্ষক প্রফেসর ডাঃ আব্দুল হক স্যারের বিরাট অবদান আছে। আমি স্যারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

১০ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি

ময়মনসিংহ

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ম-১৭ ব্যাচ (১৯৮৫ এম বি এম এস)

সাবেক বিভাগীয় প্রধান, প্যাথলজি

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ

#memoryofsadequel

Haque-sir-er-basay

Haque Sir-er Basay

হক স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

প্রফেসর ডাঃ আব্দুল হক স্যার তখন অবসর জীবন যাপন করছিলেন। ময়মনসিংহের চরপাড়ার লাশকাটা ঘরের বিপরীত দিকের রাস্তায় তিনি বাড়ি করে থাকতেন। ১৯৯৭ সনের পরে হবে। বাংলাদেশ জার্নাল অব প্যাথলজি-তে আমার প্রথম দুটি সাইন্টিফিক রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশিত হলো। এগুলো ছিলো ঢাকার শাহবাগে ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (আইপিজিএম আর)-এ এম ফিল কোর্স করার সময় আমার থিসিস। পাকস্থলীর ক্যান্সারের সাথে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি জীবাণুর সম্পর্কে গবেষণা করছিলাম। আমার গবেষণার ফলাফল জার্নালে প্রকাশ পাওয়ায় খুব আনন্দিত ছিলাম। এই আনন্দ সবার সাথে শেয়ার করা যায় না। সবাই এর মর্জাদা বুঝে না। ঢাকার হোটেল শেরাটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সোসাইটি অব প্যাথলজিস্ট-এর সম্মেলনে জার্নাল বিতরণ করা হয় নিবন্ধিত মেম্বারদের মাঝে। আমি আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ডাঃ আব্দুল হক স্যারকে প্রদান করার জন্য অতিরিক্ত দুটি কপি সংগ্রহ করেছিলাম। হক স্যার ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যক্ষ। তিনি ময়মনসিংহ বিএমএ-এর এক সময় প্রেসিডেন্টও ছিলেন।

আমি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের লেকচারার ছিলাম। অফিস থেকে বের হয়ে সকাল আনুমানিক ১০ টার দিকে জার্নাল দুটি হাতে নিয়ে স্যারের বাসার দিকে গেলাম। গেইটে করা নাড়ায় স্যার নিজেই দরজা খুলে দিলেন। আসেন আসেন বলে স্যার খুব খুশি হয়ে আমাকে তার বেড রুমে নিয়ে গিয়ে বাসালেন। সিম্পল একটা খাটে সাধারণ বিছানা পাতা। মশারীর দুই কোণা বাঁধা আছে। অন্য দুই কোণা বিছানার অর্ধেক পর্যন্ত কভার করে আছে। বাসায় অন্য কেউ আছে বলে মনে হলো না। স্যারের স্ত্রী ঢাকার বাসায় থাকেন। মেয়েরাও ঢাকায় থাকে। বাসার পরিবেশ দেখে মনে হলো আমি সেই হাজার বছর আগের দিনের কোন এক দার্শনিকের কাছে এসেছি। স্যার জার্নাল দুটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। আমি আমার আর্টিকেল বের করে দিয়ে বললাম “স্যার, এ দুটি আমার প্রথম আর্টিকেল।” স্যার আমাকে

অভিনন্দন জানিয়ে আনন্দিত চোখে পড়া শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পড়ার পর বললেন “খুব ভালো হয়েছে। তবে বেশ কিছু গ্রামার ভুল আছে।” আমি বললাম

– স্যার গতকাল আমাদের সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলন ছিলো। সেখানে সবাইকে এই জার্নাল দিয়েছে। আমি আপনার জন্য দুটি নিয়ে এসেছি।

– খুব ভালো করেছেন। সাদেক, কেউ এখন দায়িত্ব নিয়ে খোঁজ খবর নেয় না। অথচ, দেখেন, আমি এই সোসাইটির আজীবন সদস্য। একটা চিঠিও পাই না। আপনি আমার কথা মনে করে জার্নাল নিয়ে এসেছেন, এজন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি আরও পেলে আমার জন্য নিয়ে আসবেন। নতুন কিছু জানতে হলে জার্নাল পড়তে হবে। এই যে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি জীবাণু যে স্টোমাকে থাকে কজনে জানেন? আপনি স্টোমাক থেকে জীবাণু আইসোলেট করেছেন এবং তার সাথে যে ক্যান্সারের এসোসিয়েশন আছে তার প্রমাণও করেছেন।

স্যার ছোট বড় সবাইকে আপনি করে বলতেন। আমি স্যারের ছাত্র হলেও তিনি আমাকে আপনি করে বলতেন। অনেক্ক্ষণ তিনি অনেক স্মৃতিচারণ করে কথা বললেন। বিশেষকরে তিনি যখন ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সে ছিলেন সেই সময়ের স্মৃতি কথা বলছিলেন। আমার ক্লাস আছে বলে উঠতে চাইলে স্যার বললেন “সাদেক, একটু বসেন। চা দিচ্ছি” বলে দ্রুত ভিতরের রুমে গিয়ে নিজেই চা বানিয়ে আমার জন্য নিয়ে এলেন।” আমি বিনয়ের সাথে বললাম “স্যার, আপনি কষ্ট করে চা বানালেন!” স্যার, হালকা হেসে বলেলেন “এই সামান্য এক কাপ চা, আর কি, খান। এভাবেই কেটে যাচ্ছে। “

৯ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি

ময়মনসিংহ

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ম-১৭ ব্যাচ

সাবেক বিভাগীয় প্রধান

প্যাথলজি বিভাগ

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ

#memoryofsadequel

Jummaghor

Jummaghor

আমাদের গ্রামের জুম্মাঘর

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমি বুঝমান হয়েই দেখেছি আমাদের বড়বাইদপাড়া গ্রামের আজিম উদ্দিন সিকদার বাড়ির কেন্দ্রীয় মসজিদটি। আমরা বলতাম জুম্মাঘর। এটার চালের ছাউনি ছিলো ঢেউ টিনের। বেড়া ছিল চেপটা টিনের। মেঝে ছিল কাঁচা। চট বিছিয়ে নামাজ পড়তাম। ঐ বাড়ির মানুষ জুম্মা ঘরে পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করতেন আজান দিয়ে। গ্রামের মুছুল্লিরা শুধু শুক্রবার জুম্মার নামাজ জামাতে আদায় করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার কাক্কী (জয়নাল ভাইর মা) জুম্মাঘরের মাইঝাল (মেঝে) ও পিড়া (ডোয়া) হাইল মাটি (বাইদের মাটি) দিয়ে লেপে দিতেন।

আজিম উদ্দিন সিকদার দাদা বহরমপুর থেকে এসে এখানে বাড়ি করে একটা পুকুর খনন করেন সেই ব্রিটিশ আমলে। পুকুরের পশ্চিম পাশে তিনি এই জুম্মাঘর নির্মাণ করেন গ্রামের মানুষের নামাজ আদায় করার জন্য। উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া, পূর্বপাড়া, তালুকদার বাড়ি, নওপাড়া ও চনপাড়ার সব মুছুল্লিরা এই মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মিলন মেল হতো। মসজিদ প্রাঙ্গণে বড় আম গাছ ছিলো। সেই আমগাছের নিচে একটা বাঁশের মাচাং ও দুইটা ঘোড়া কাঠ ছিলো। নামাজ শুরুর আগে ও পরে এখানে বসে যুকক ও কিশোর বয়সের মুছুল্লিরা খোস গল্প করতো। গ্রামের মানুষের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে বড়রাও আলাপ আলোচনা করতেন। গ্রামের মাতবর ছিলেন কোরবান আলী সিকদার কাক্কু ও কাশেম তালুকদার কাক্কু (মিয়াকাক্কু)। মাতবরের মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারতো না।

এই মসজিদের ইমাম ছিলেন শিরিরচালার হাছেন ক্কারীসাব। তিনি শুক্রবারের জুম্মার নামাজে ইমামতি করতেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে মিলাদ পড়ে দোয়া করে বখসিয়ে দিতেন। আমাদের শমে কাক্কুও মিলাদ পড়াতেন। আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন তালেবে ইলিম হিসাবে।

আমগাছ তলায় মাঝে মাঝে মাসআলা নিয়ে অল্প বয়সের যুবকদের মধ্যে তর্ক লেগে যেতো। মিয়া কাক্কু এগিয়ে এসে থামিয়ে দিয়ে সঠিক মাসআলা কি হবে বলে দিতেন। মিয়া কাক্কুর উপরে কেউ কোন মাসআলা বলতে সাহস পেতো না। মাসআলা বলার পরে এটা পাকাপোক্ত করার জন্য ইমাম সাবকে জিজ্ঞেস করতেন “তাই না হুজুর?” হুজুর ইতস্তত করে গোল টুপিটা ডান হাত দিয়ে হালকা ঘুরান মেরে বলতেন “ঐত্য।” তারপর টুপিটা মাথা থেকে খুলে ফু দিয়ে গোল করে আবার মাথায় পরে দ্রুত চলে যেতেন জুম্মা ঘরের ভিতর। ‘ঐত্য’ কথাটি একটি হালকা সম্মতিসরূপ একটি শব্দ। আমার মেয়ে দুটি যখন ছোট ছিলো তখন দুজনে মাঝে মাঝে তর্কে করে কার কথা ঠিক এটির সমাধান নিতে আমার কাছে এলে আমিও বলে দিতাম “ঐত্য। তোমাদের জন্য আজ কি যেনো আনত হবে?”

ইমাম সাব ছিলেন ক্কারী। অল্প কিছু মাস আলা জানতেন। অল্প কিছু বয়ান করতেন খুতবার আগে অথবা নামাজের পর দোয়ার আগে। দোয়াকে মুছুল্লিরা খুব প্রয়োজন মনে করতেন। শেষ দোয়া না করে কেউ বের হতে চেতেন না। জুম্মার নামাজ শেষ হতে প্রায় দুটো বেজে যেতো। মুছুল্লিদের ক্ষুধা পেতো। হুজুর দোয়া করার আগে কিছুক্ষণ বয়ান করতেন। মুছুল্লিরা কেউ কেউ বলে উঠতেন “হুজুর, দোয়া কইরা দেইন।” হুজুর বলতেন “মুক্তাছার করতাছি। আর এটু বহুন।” মুক্তাছার মানে কি আমি জানি না। তবে বুঝে নিয়েছি ‘সংক্ষিপ্ত’। হুজুর হাছেন ক্কারী সাব ছিলেন মুক্তার আলী মাস্টার স্যারের বড় ভাই। উভয়ই খুব ভালো মানুষ।

আয়েন উদ্দিন সিকদার দাদার ছেলে হাছেন সিকদার কাক্কু খুব নিয়মিত মুছুল্লি ছিলেন। তিনি সবার আগে এসে প্রথম কাতারে ইমাম সাবের পিছনেই বসতেন। সবার শেষে তারাহুরো করে উপস্থিত হতেন ওহাদালী কাক্কু (ওয়াহেদ আলী)। ওহাদালী কাক্কু অল্প লেখাপড়া জানলেও সুর করে ভালো পুথি পড়তে পারতেন। আমি মাঝে মাঝে কাক্কুদের বাড়ি গিয়ে পুথি পড়তে বলতাম। কাক্কু বারান্দায় জলচৌকিতে বসে আমাকে পুথি পড়ে শুনাতেন। আমরা পুথিকে বলতাম কিতাব। এটা ছিলো জংগে কারবালার কিচ্ছা। কাক্কু চৌকিতে কিতাব খুলে রেখে সোজা হয়ে বসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিনয় করে কিতাব পাঠ করতেন। “ঘোরায় চড়িয়া মর্দ চলিতে লাগিলো ” বলার সময় মনে হতো যেনো কাক্কুই চড়ে তলোয়ার হাতে ছুটে চলেছেন। “শত শত মারা গেলো মর্দ কাতারে কাতার” শুনে মনে হতো কাক্কুর সামনেই শত শত সৈন্য শহীদ হয়ে পড়ে আছে। কিতাবের করুণ পংতিগুলো কাক্কু এক গালে হাত রেখে করুণ শুরে বিলাপ করে পড়তেন “ও সিমার সিমাররে……। “

জুম্মার নামাজের কোন টাইম টেবিল ছিলো না। সব মুছুল্লিরা চলে এলেই নামাজ শুরু হতো। সব মুছুল্লিরা চলে এলেও অনেক সময় মাদবর কাক্কুরা আসা পর্যন্ত হুজুর অপেক্ষা করতেন। ওহাদলী কাক্কু সবার শষে তারাহুরো করে এসে অজু করে টুপিটা মাথায় ঢুকাতে ঢুকাতে জুম্মাঘরে প্রবেশ করতেন। হাছেন সিকদার কাক্কু বলতেন ” হুজুর, নামাজ শুরু করুন। ওহাদালী আইপড়ছে।” হাছেন কাক্কু খুব ফক্কর ছিলেন। তিনি খালি হাসাতেন। একবার জুম্মায় আগে আসার গুরুত্ব নিয়ে মুক্তাছার বয়ান করছিলেন “জুম্মার নামাজে আগে আইলে বেশী লাভ। যেমন ধরুন, যে অজ প্রথম আইলো, হে পাইল একটা উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব, যে তারপর আইল, হে পাবো একটা গরু কোরবানি করার সমান ছোয়াব, তারপর যে আইলো হে পাবো একটা ছাগল কোরবানি করার সমান ছোয়াব, এভাবে কমতে কমতে সবার শেষে যে আইলো হে পাইলো একটা মুরগি কোরবানি করার সমান ছোয়াব।” হাছেন কাক্কু হেসে বলেন “হুজুর, মুরগি কোরবানি করার ছোয়াবটা তাইলে ওহাদালী পাবো।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কথা কইন না জানি কেউ।” আমি মনে করলাম “উট কোরবানি করার সমান ছোয়াবটা হাছেন কাক্কুই পেলেন।” অথচ ওয়াদালী কাক্কুর বাড়ি কিন্তু জুম্মাগরের কাছেই ছিলো। তারপরও উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করতে পারেননি।

আরেকদিন আল্লাহর নিয়ামত ও কুদরত নিয়ে হুজুর জুম্মাঘরে বয়ান দিতেছিলেন “আল্লাহ কত নিয়ামত আমাদেরকে দিয়েছেন! কত সুস্বাদু ফল দিয়েছেন আমাদের জন্য! কাঠাল, আম, জাম, কলা, লিচু, আনারস, এমন অনেক কিছু।” হাছেন কাক্কু খুশি হয়ে বলে উঠলেন “হুজুর, আর তেঁতুল। ঐডাই ত মজা বেশি। মনে অইয়াই জিলবায় পানি আই পড়ছে।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কতা কইন না জানি।”

আমাদের বাড়ি জুম্মা ঘর থেকে বেশ দূরে ছিলো। প্রায় আধা কিলোমিটার হবে। পাঞ্জেগানা নামাজ জামাতে আদায় করা সম্ভব হতো না। বাড়িতেই পড়ে নিতাম। উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করার ইচ্ছা থাকলেও আগে যেতে পারতামনা। তালুকদার বাড়ির বড় ছোট সব মুছুল্লিরা একত্র হতে সময় লাগতো। দল বেধে মুরুব্বিদের পিছনে হেটে যেতে হতো জুম্মায়। তাই একটু দেড়িতে পৌছতে হতো জুম্মায়। রমজান মাসে তারাবি নামাজে যেতে হতো রাতের অন্ধকারে সরু পথ দিয়ে। বুইদ্যা চালা ও জুয়াদালী কাক্কুদের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। সাপ ও জংলী শুকুরের ভয় ছিলো রাস্তায়। তাই দলবেধে হারিকেন, চুঙ্গাবাতি (মশাল), দোয়াত (কুপি বাতি), বদনাবাতি, বা পাটখড়ির (সোলা) আগুন জ্বালিয়ে এই দুর্গম পথে যেতে হতো তারাবি নামাযে। এই পথে ৪ টা ঘোনাও পারি দিতে হতো। ঘোনার পিচলা বাতর (আইল) থেকে অনেকেই কাদা ক্ষেতে অন্ধকারে পড়ে যেতাম। এমন কষ্ট করে যেতে হতো আমাদের জুম্মায়।

আমাদের মক্তবে যারা প্রথম কোরআন পড়ার উপযুক্ত হতেন তারা জুম্মার দিন জুম্মায় গিয়ে সবার সামনে কোরআন হাতে নিতেন। সবাই দোয়া করতেন। মিষ্টি বিতরন করা হতো এ উপলক্ষে। আমি ও এছাক ভাই একসাথে এই জুম্মায় এসে সবার সামনে কোর আন হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষক ছিলেন নোয়াখালী নিবাসী আব্দুল কদ্দুস ক্কারী সাব। তিনি পরে পাইন্নাবাইদ গ্রামে স্থায়ী হন। খুব ছোট ছিলাম। এত ছোট কাউকে কেউ কোরআন হাতে নিতে দেখেননি। তাই, সবাই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিলেন।

জুম্মায় আনন্দও ছিলো। একবার সবে ক্কদরের রাত জেগে ইবাদত করতে আমরা জুম্মাঘরে একত্র হয়েছিলাম। মাওলানা সালাউদ্দিন দুলাভাই এটার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। একটা খাসি জবাই করা হয়েছিলো। জুম্মাঘরের উত্তর পাশে মাটি কেটে চুলা করা হয়েছিলো। কয়েকজনে মিলে রান্না করছিলেন। বাকীরা জুম্মাঘরে বসে ইবাদতে মসগুল ছিলেন। আমার ভাগে পড়েছিলো দুই পাড়া কোরআন পড়া। একেক জনে একেক রকম ইবাদত করছিলেন। কোরআন পড়া শেষ করে আমি রান্না দেখতে গেলাম। এক জনে বললেন যে যারা রান্না করছে তারাও ইবাদতের ছয়াব পাবেন। ফিরে গিয়ে দেখি মাওলানা দুলাভাই বয়ান করছেন। আমি প্রবেশ করা মাত্রই দুলাভাই বললেন “এই যে, সাদেকই বলতে পারবে। সাদেক, বলতো চাঁদে কে কে পৌছেছিলো?” আমি একটু স্টাইল করে কথা বলে উত্তর দিলাম “নীল আর্মস্ট্রং, এড উইন ই অল্ড্রিন এন্ড মাইকেল কলিন্স।” তিনি বললেন “হে, সাদেক ঠিক বলছে। ও বিজ্ঞান জানে। কাজেই আমরা যে রকম দেখি চাঁদ সে রকম না। আল্লাহ চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সব সৃষ্টি করেছেন……….। “

আমাকে ১৯৭৫ সন থেকে পড়শুনা ও চাকরি করার জন্য গ্রামের বাইরে থাকতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে গ্রামে আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। সেহেতু ঐ কেন্দ্রীয় মসজিদে আমার আর যাওয়া হয় না। নওপাড়া ও চনপাড়ার মুছুল্লিদের সুবিধার্থে দুইপাড়ার সংযোগ স্থলে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তালুকদার বাড়ির মুসুল্লিদের সুবিধার্থে তালুকদার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানের পশ্চিম পাশে শিরিরচালা – সারাসিয়া রাস্তার ধারে আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আমি বাড়ি গিয়ে তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদে জুমআর নামাজ পড়ি। ইচ্ছা থাকলেও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও চনপাড়া জামে মসজিদে যেতে পারিনা। যদি যাই, তবে নিন্দুকেরা বলবে “ডাক্তরে নিজের বাড়ির মসজিদে না গিয়ে অন্য পাড়ার মসজিদে গেছে।” বস্তুত তিনটি মসজিদই আমাদের। তিনটি মসজিদেই গ্রামের মানুষের আর্থিক সহযোগিতা আছে। নামাজে মুছুল্লিদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। শুধু মসজিদ না, গ্রামের সবার সহযোগিতায় মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। একটা জিনিসের অভাব আছে, সেটা হলো পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা করার এখতিয়ার গ্রামের মানুষের নেই। এটা সরকারি অর্থায়নের কাজ। সরকার দেশের মেঘা মেঘা রাস্তার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। একদিন হয়তো পাকা রাস্তা হবে। সেদিন হয়তো আমরা থাকবোনা। ঘুমিয়ে থাকবো চির নিদ্রায় রাস্তার ধারের তালুকদার বাড়ি পারিবারিক গোরস্থানে বাবা-মার পাশে আসাদুজ্জামান তালুকদার মুকুলের মতো। পথচারীরা সালাম দিয়ে যাবে। মসজিদের মুছুল্লিরা জুমআর নামাজ শেষে দোয়া করবে “ইয়া, আল্লাহ, মেহেরবানী করে করববাসীদেরকে মাফ করে দিন।”

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

বড়বাইদপাড়া, সখিপুর, টাঙ্গাইল।

১৮ নভেম্বর ২০২২ খ্রি.

ময়মনসিংহ

এমন স্মৃতি কথা আরও পড়তে নিচের হ্যাস ট্যাগ শব্দের উপর ক্লিক করুন

#memoryofsadequel

ads banner:

baba

আমার বাবা

(স্মৃতিকথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমার বাবার নাম দলিল উদ্দিন তালুকদার। জন্মগ্রহণ করেন কালিহাতির ভিয়াইল গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় তালুকদার বাড়ি। আমার দাদা ছিলেন মোকছেদ আলী তালুকদার। বাবার ডাক নাম ছিল দলু । বাবার শরীরে ইমুনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ছিল। তাই, ঘনঘন অসুস্থ্য হতেন । অসুস্থ থাকার কারনে বাবা পরিশ্রমের কাজ করতে পারতেন না। একজন কৃষক হয়েও কৃষিকাজ তেমন করতেন না। যার দরুন অনেক জমি জমা থাকলেও তিনি তেমন সচ্ছল ছিলেন না।

বাবা বেশিরভাগ সময়ই ঘুরে বেড়াতেন। লাইলি বুবু ও আকবর ভাইর জন্মের পরই দাদা বাবাকে পাঠিয়ে দেন পাহাড় অঞ্চলের জমি দখল করে আবাদ করার জন্য। বাবা ঢনডনিয়া গ্রামের বড়বাইদ পাড়া এসে বাড়ি করেন। মা আমাকে গর্ভে করে নিয়ে আসেন আমাদের নতুন বাড়িতে। তাই, আমার জন্ম হয়েছে এই গ্রামে আনুমানিক ১৯৫৮ সনে । তখন এটা কালিহাতি থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন এটা পড়েছে সখিপুর উপজেলার অধীন।

বাবাকে দেখেছি ঘনঘন ভিয়াইল যেতে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন “তোমার দাদাগো বাড়ি গেছিলাম। তোমার ফুফুগ বাড়ি গেছিলাম।” অল্প বয়সেই আমার দাদী অন্ধ হয়ে যান। আমার দাদার স্বভাবও উড়াটে ধরনের ছিলো। আমার বড় ফুফু খুব বুদ্ধিমতি ছিলেন। অল্প বয়সেই ভাই বোনদের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। আমার বাবা-চাচার একজন নির্ভরযোগ্য বোন ছিলেন আমার বড় ফুফু। তাই তিনি ফুফুর কাছে চলে যেতেন। ফুফুর বিয়েও হয়েছিল ভিয়াইল গ্রামের উত্তর পাড়ার তালুকদার বাড়ি। মফিজ উদ্দিন তালুকদার ছিলেন আমার ফুফা।

বাবা জমিতে ফসল তেমন ফলাতে পারতেন না। তাই, তালুকের জমি বিক্রি করে বাজার সদায় করে খেতেন। বাবার কাছে আমাদের কিছু চাইতে হয়নি। আমাদের যার যখন যা কিছু লাগতো বাবা জমি বেচা টাকা দিয়ে কিনে আনতেন।

বাবা খুব পাড়া পেড়াতেন। খেয়ে কুলি ফেলতেন নওপাড়া গিয়ে। জিতাস্বরি পাড়ার হাতু কাক্কু, দলু তাঐ ও বুর্জু কাক্কুর সাথে বাবার খুব খাতির ছিলো। তারাও বাবার মতো অলস ছিলেন। তাদের সাথেই বেশি সময় কাটাতেন। বর্ষাকালের অর্ধেক সময় নৌকায় কাটাতেন। ভিয়াইলের মধ্য পাড়ার তোমজ বেপারির ছেলে হাসান বেপারি আমাদের দাদা হতেন। আমাদের কাছে হাছেন দাদা নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি তায়েজ উদ্দিন কাক্কুর বাবা। হাছেন দাদা আমাদের খুব আদর করতেন। আমাদের জন্য জিলাপি নিয়ে আসতেন। কিন্তু আমরা তাকে পছন্দ করতাম না। কারন হলো, তিনি বাবাকে আমাদের থেকে নিয়ে যেতেন তার সাথে ব্যবসা করতে। তিনি পাট ও কাঠের ব্যবসা করতেন। তার বিরাট নাও (নৌকা) ছিলো। নাওয়ের সামনের অংশ প্রসস্থ ছিলো। এই অংশে মালামাল বোঝাই করা হতো। পিছনের অংশে ছই ছিল। এই ছইয়ের নিচে বসে হাছেন দাদা, বাবা ও হাছেন দাদার বড় ছেলে কদ্দুস কাক্কু গল্প করতে করতে হুক্কা খেতেন। আমি মাঝে মাঝে এই নায়ে বাবার সাথে ছোট চওনা ঘাট থেকে উঠে ভিয়াইল গিয়েছি। ছোট চওনা ঘাট থেকে গজারি কাঠের গুড়ি অথবা পাট কিনে নায়ে ভরে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে বিক্রি করার উদ্যেশ্যে রওনা দিতেন। চারজন মাল্লায় এই নাও বেয়ে নিতেন। সামনে দুই পাশে দুইজন, পিছনে দুইপাশে দুইজন মাল্লা লগি দিয়ে খোজ দিতেন এক সাথে। ভারী নাও ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতো। বাবা অথবা কদ্দুস কাক্কু পিছনের গলুইয়ে বসে হাল ধরে থাকতেন। আমি বাবার টোনায় বসে বাবার সাথে হাল ধরে মজা পেতাম। খাল ও নদী দিয়ে যাওয়ার সময় মাল্লারা পাড় দিয়ে হেটে হেটে গুন টেনে যেতেন। গুনের কাঠি কাঁধে নিয়ে বাঁকা হয়ে আঁকা বাঁকা শুকনো ও কাঁদা পথে হাটতেন মাল্লারা। তাদের কষ্টের কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনি। পথে রাত হয়ে যেতো। হাছেন দাদা মাটির চৌকায় রান্না করতেন। ভাতে বেগুন সিদ্ধ দিয়ে খাস (সরিষা) তেল দিয়ে ভর্তা করতেন। চামারা চাউলের গরম ভাত দিয়ে খেতে কি যে স্বাদ পেতাম! খেয়ে নায়ের গুড়ায় বসে পানিতে প্রশ্রাব করে ছইয়ের নিচে বেতের পাটিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমের ভিতরেই বাবা আমাকে কোলে নিয়ে নাও থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেন।

বাবা যখন নায়ে যেতেন তখন একটানা ১০-১৫ দিন কাটিয়ে আসতেন। ঐসময় আমার মন খারাপ থাকতো। আমি হাছেন দাদার প্রতি বিরক্ত থাকতাম। মাও বিরক্ত হতেন হাছেন দাদাকে দেখে। তিনি বলতেন “অইজে আবার আইছে, তোমার বাবাকে নিয়ে যেতে।” বড় হয়ে আমার হাছেন দাদার প্রতি অভিযোগ ছিলনা। আমি বুঝতে পেরেছি আয় রোজগার করতে বাড়ি ছেড়ে থাকতে হয় অনেকদিন। হাছেন দাদাই ছিলেন বাবার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।

বাবাকে বিদায় দেয়ার জন্য মা অনেকদূর পিছে পিছে যেতেন। আমিও মার সাথে গিয়েছি। আমার চোখের পানি গাল বেয়ে পড়তো। বাবা গামছা দিয়ে মুছে দিতেন। কোলে নিয়ে আদর করে বলতেন “বাজান, কাইন্দো না, কয়দিন পরই আই পরমু।” মার কোলে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বাবা বুইদ্দাচালার সরু পদ দিয়ে আড়াল হয়ে যেতেন। আমি নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকতাম। চারদিক নিরব হয়ে যেতো। সবুজ গাছের আড়াল থেকে থেকে-থেকে ঘুঘু ডেকে উঠতো। আমার মনে হতো বাবা চলে গেলেন বলেই ঘুঘুরা কাঁদছে। অন্যদিন অত ডাক শুনিনি।

আমার কপালের এক পাশে, গাল ও চোখ সহ প্রতিবছর শীতকালে ব্যাথা করতো। তীব্র ব্যাথা। যন্ত্রনায় কান্না করতাম মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে, কপাল দু’হাতে ধরে। এটাকে বলা হতো আধকপালে মাথার বিষ। আমার কষ্টে বাবাও কষ্ট পেতেন। বাবা বড় চওনা ও কচুয়া হাট থেকে বড়ি এনে দিতেন। পানি দিয়ে খেতাম। কোন কাজ হয়নি। একজন বললেন যে, ভুয়াইদের এক মান্দাই মহিলা কবিরাজ আধকপালে মাথার বিষের চিকিৎসা জানেন। বাবা আমাকে কাঁধে নিয়ে ভুয়াইদ গেলেন। মহিলা বিধান দিলেন “সকালে উদিয়মান সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাটিতে সেজদা দিতে হবে কিছুক্ষণ করে কয়েকদিন।” তাতে কোন কাজ হলো না। ছোট দাদা জয়নাল আবেদীন তালুকদার শুনে বললেন ” মুসলমানের পোলা হয়ে হিন্দু কবিরাজের কথায় সূর্যপূজা করতাছ? বাড়ির পাশেই কবিরাজ থাকতে গেছস ভুয়াইদ! আমিই তো আধকপালে বিষের চিকিৎসা জানি।” এই বলে তিনি গাছান্ত বেটে বটিকা বানিয়ে দিলেন। আমি প্রতিদিন সকালে বিষ ওঠার শুরুতেই ঐ বটিকা খেতাম। ওটা এমন ঝাল লাগতো যে বিষের যন্ত্রনার চেয়ে ঝালের তীব্রতাই বেশি ছিল। দাদার ঔষধ বাদ দিলাম। বাবা খবর পেলেন বাঘেরবাড়িতে একজন আধকপালী মাথা বিষের ভালো কবিরাজ আছেন। বাবা আমাকে পর পর তিন দিন কাঁধে করে নিয়ে গেলেন ঝার ফুক দিতে। কোন কাজ হলো না। প্রতিবছর আমার এমন রোগ হতো। আমি কষ্ট পেতাম। কোন চিকিৎসা নেইনি। মেডিকেল কলেজে ৩য় বর্ষে পড়ার সময় শিখলাম যে ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়াতে এমন কপালের এক পাশে ব্যাথা হয়। এর ঔষধ কি তাও বই পড়ে জেনে নিলাম। আমি নিজের বুদ্ধিতেই ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনে কাউকে না জানিয়ে সকালে খেয়ে নিলাম। শুরু হলো সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা। বুঝতে পেলাম। ভুল করেছি। ভুল চিকিৎসা করেছি নিজের উপর। অসহ্য যন্ত্রণায় বিছানায় ছটফট করলাম। বিছানা থেকে উঠতে পারলাম না। কাউকে আমার বোকামির কথা বললাম না। মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হলাম। কিন্তু আল্লাহ বাচিয়ে দিলেন। এরপর নাক-কান-গলা বিভাগের আউটডোরে মেডিকেল অফিসারকে দেখালাম। তিনি আর এস ডাঃ সিরাজুল আরেফিন স্যারের কাছে রেফার্ড করলেন। তিনি আমার সব ইতিহাস শুনে এবং নাক-কান-গলা দেখে বললেন “তোমার প্রতিবছর শীতকালে সাইনোসাইটিস রোগ হয়। তোমার সাইনোসাইটিস রোগ হয়েছে।” তিনি সাইনোসাইটিস সম্পর্কে বিস্তারিত আমাকে শিখিয়ে দিলেন। তারপর থেকে আমার আর সাইনোসাইটিসের ব্যাথার কষ্ট হয় নি। আলহামদুলিল্লাহ।

বাবা আমাকে প্রথম হাট দেখিয়েছেন। বড় চওনা, কচুয়া, ইন্দ্রজানী, বর্গা ও পলাশতলীর হাট বাবাই আমাকে প্রথম দেখিয়েছেন। বাবার সাথেই আমি প্রথম বাসে উঠি। বাবাই আমাকে প্রথম সিনেমা দেখান। বাবার পেটের নাভীর কাছে ব্যথা করতো। তীব্র ব্যাথায় অনেক রাতে পেট ধরে কাঁদতে দেখেছি। হাট থেকে বোতলের ঔষধ এনে খেতেন। কোন কাজ হতো না। একবার, তখন আমি খুব ছোট, আমি মার সাথে রৌহার মামাবাড়ি ছিলাম। বাবা কোথাও যাচ্ছিলেন। আমি বললাম

– বাবা, কুনু যাবাইন?

– তোমার হাছেন দাদার সাথে সয়ার হাটে যামু। তোমার দাদা একটা গরু কিনবেন।

– আমি যামু।

– দুর আছে। মোটরে চইড়া যাইতে অয়।

– ভোঁ মোটর সাইকলে?

– না, মোটর গাড়িতে।

– আমি মোটরে চরমু।

– এখন না। বড় অইলে নিয়া যামুনি।

– না, আইজকাই যামু।

বলে কান্না শুরু করে দিলাম। বাধ্য হয়ে বাবা আমাকে সাথে নিতে রাজি হলেন। মা আমার গায়ে একটা হাওই শার্ট পরিয়ে দিলেন। কালিহাতির রাজাফৈরের কাছে গেলে ভোম ভোম রকম শব্দ পেলাম। বাবা বললেন “এইটা মোটরের শব্দ।” চামুরিয়া পাড়ি দিলে ফটিকজানি নদীর উপর ব্রিজ দেখিয়ে বললেন “ঐযে দেখ কত বড় পুল।” পুলের উপর তাকাতেই দেখা গেলো বিরাট এক কাছিমের মতো জিনিস পুলের উপর দিয়ে চলে গেলো। আমি বললাম “ওঠা কি গেলো?” বাবা বললেন “ওঠা, প্রাইভেট কার। বড় লোকেরা ওডায় চড়ে।” এরপর বড় একটা কিছু যাচ্ছিল। বললেন “এইডা মোটর গাড়ি।” কালিহাতি বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাড়ালে ময়মনসিংহ থেকে একটা মোটর গাড়ি এসে থামলো। কাঠবডি বাস। কাঠের জানালা। সীট খালি নেই। আমরা দাড়িয়েই গেলাম। সয়া গিয়ে নেমে পড়লাম। কালিহাতি ও এলেঙ্গার মাঝামাঝি হলো সয়ার হাট। ঘুরে ঘুরে গরু কিনতে রাত হয়ে গেলো। রাতে আমরা চলে গেলাম বাগুনডালি গ্রামে। সেই গ্রামে একজন কবিরাজ ছিলেন। সেই বাড়ি গিয়ে রাত কাটালাম। কবিরাজ বাবার পেটের ব্যাথার ঔষধ দিলেন। ঔষধ দেখতে লোহার করাতের গুড়ার মতো। খেলে ব্যাথা ভালো হয়। পরেরদিন সকালে ঐ বাড়িতে নাসতা করে আমরা পা পথে গরু নিয়ে ভিয়াইল চলে আসি। সেই ঔষধ খেয়ে বাবা ভালো থাকতেন। এরপরও কয়েকবার বাবা সেই ঔষধ এনে সেবন করেছেন। কিন্তু ঔষধের দাম খুব বেশি ছিল। আমি এখন মনে করি ওগুলো আসলেই করাতের গুড়া। করাতে থাকে এলুমিনিয়াম। এই এলুমিনিয়াম পাকস্থলির হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে এসিডকে নিউট্রাল করে দিয়ে পেট ব্যাথা তথা পেপ্টিক আলসার ভালো করে। বাবা এরপর খোঁজ পান খাওয়ার সোডা বেকিং পাউডার। বাবা বেকিং পাউডার খেয়ে পেপ্টিক আলসারের ব্যাথা থেকে উপসম হতেন। আমি ডাক্তার হবার পর আর বাবাকে বেকিং পাউডার খেতে হয় নি।

বাবা আমাকে কোনদিন কোন কাজ করতে বলেন নি। বাবা না বললেও আমি সংসারের অনেক কাজ করেছি। বাবা আমাকে কোনদিন পড়তে বলেননি। কারন, তিনি জানতেন সাদেককে পড়তে বলতে হবে না। আল্লাহ সাদেককে ও গুণটি দিয়েই তৈরি করেছেন। আমি যখন দোয়াত জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তাম বাবা আমার পাশেই শুয়ে শুয়ে মশা মেরে দিতেন এবং বিচুন দিয়ে বাতাস দিতেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। প্রাইমারির পড়া বুঝিয়ে দিতেন। বাবার অনেক বিষয়ে ভালো সাধারণ জ্ঞান ছিলো। তিনি কোন নিতিকথা শিখাননি। কারন, তার বিশ্বাস ছিল সাদেক কোন অনৈতিক কাজ করতে পারে না।

১৯৭৯ সনে যখন মা মারা যান তখন বাবার বয়স হয়তো ৫৫ বছর। ঘটকরা চেষ্টা করেছিলেন বাবাকে পুনরায় বিয়ে করিয়ে দিতে। আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমরা বিয়ের ব্যাপারে হা না কিছু বলিনি। বাবা বিবেচনা করে দেখেছেন যে সংসারের আমাদের নতুন মা এলে আমাদের শান্তি বিগ্নিত হতে পারে। তাই তিনি ধৈর্য ধরেন।

আমি ডাক্তার হবার পর বাবাকে সতর্ক করে দেই যে এখন থেকে তিনি জমি বিক্রি করে খেতে পারবেন না। আমি সংসারের জন্য যতটুকু পারি করে যাবো। তারপর থেকে তিনি আর জমি বিক্রি করেননি। তিনি ঘনঘন জ্বরে আক্রান্ত হতেন। আমি তখন আমার এম ফিল কোর্সের পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাবার জন্য সময় দিতে পারিনি। এম ফিল শেষ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে যোগদান করে বাবাকে আমার বাসায় রাখলাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে বাবাকে জেল খানায় বন্দী করে রেখেছি। বাবার সাথে সময় দেয়ার কেউ ছিল না। বাবা ঘনঘন বাড়ি চলে যেতেন। আমি বুঝতে পারি বাবা এখন গ্রামময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বন্ধুদের সাথে গুপ ছেড়ে হেসে হেসে গল্প করছেন। তাই আমি শহরে এসে থাকতে বাবাকে পিড়াপিড়ি করিনি।

২০০১ সনের দিকে বাবা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় বাবার প্যানসাইটোপেনিয়া আছে। অর্থাৎ সব রক্তকণিকা কম আছে। এজন্যই ঘনঘন ইনফেকশন হয়। ইনফেকশনের জন্যই জ্বর হয়। বাবাকে অনেকদিন হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হয়। ভাতিজা আব্দুল মান্নান তালুকদার তখন কলেজে পড়তো। ওর পড়াশোনা ক্ষতি করে বাবার সাথে থাকে অনেক দিন। এরপর ধরা পড়লো বাবার লিভারে সিরোসিস হয়েছে। এরোগ ভালো হবার নয়। ৭৫ বছর বয়সে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করাও ঠিক হবে না মনে করলাম। যতটুকু সম্ভব সাধারণভাবে চিকিৎসা করে যেতে লাগলাম। বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী বাড়িতে রাখলাম। সুবিধা ছিল, ভাই, ভাবী, মান্নান ও আফ্রোজা বাবার ঠিকমতো যত্ন নিতে পারবেন নিজ বাড়িতে। তখন ছিল অক্টোবর মাস। আবহাওয়া ছিল দুর্যোগপূর্ণ। বাড়ির চারিদিকে ছিল কাদা আর কাদা। এমন একটি দিনে ২০০১ সনের ২০ অক্টোবর বাবার ইন্তেকালের সংবাদ পেলাম। কার নিয়ে ছুটে গেলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। দুই কিলোমিটার দুরে পাকা রাস্তায় নেমে কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে হেটে গিয়ে বাবার মৃতদেহের কাছে উপস্থিত হলাম। দেখলাম আমার নিস্পাপ বড় ভাই আকবর হোসেন তালুকদার বাবার কাছে বসে বাবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। আনুমানিক ৭৫ বছর বয়সে বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। বাবাকে ছেড়ে মা চলে গিয়েছেন পরপারে ২০ বছর আগে। আল্লাহ আমার ধৈর্যশীল বাবার জন্য বেহেস্ত নসীব করুন।

১৫/৪/২০২০ খ্রি.

ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

#memoryofsadequel

Jibito Uddhar

Mohilake Jibito Uddhar

মহিলাকে জীবিত উদ্ধার

(স্মৃতি কথা)

ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছিলাম লঞ্চে ১৯৮৮ সনে। রাতের খাবার খেয়ে ডেকে বিছানার চাদর বিছিয়ে ব্রিফকেস মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গভীর রাতে যাত্রীদের কোলাহল শুনে ঘুম ভেঙে গেলে চমকে গেলাম। তখন মাঝে মাঝে লঞ্চে ডাকাতি হতো যাত্রীদের মাথায় হাতুড়ি পেটা করে। সেই ইঞ্জুরির চিকিৎসা চরামদ্দিতে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমিই করেছিলাম। কি ভয়াবহ সেই হাতুড়ির আঘাত! তাই, ডাকাতির কথা মনে হলেই আমি আঁতকে উঠতাম। উঠে দাঁড়ালাম। না, এটা ডাকাতের ঘটনা নয়। দেখলাম সবাই লঞ্চের ডান কিনারে জড়ো হয়ে নদীর পানিতে কী যেনো দেখছে। আমিও দেখতে গেলাম। দেখলাম কেউ একজন শ্রোতোশ্বনি নদীর পানিতে ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাত উচু করে দেখাচ্ছে। দেখতে দেখতে সব যাত্রী যখন লঞ্চের ডান কিনারে জড়ো হলো লঞ্চ কাত হয়ে পানি প্রবেশের উপক্রম হলো। আমরা দৌড়ে এক যোগে বাম কিনারে চলে গেলাম। লঞ্চ বাম দিকে কাত হলো। ভয়ে দৌড়ে ডান কিনারে চলে গেলাম। এভাবে ডান-বাম খেলা চলো কয়েকবার। এবার মানুষটাকে লঞ্চের খালাসিরা নদী বক্ষ থেকে উঠাতে সমর্থ হলো। রাখা হলো ডেকের মাঝখানে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। আমিও পেছন থেকে উকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। এক নজর দেখেই চোখ নত করে চলে এলাম। দেখলাম উদ্ধারকৃত মানুষটি একজন মধ্য বয়সি মহিলা, একজনে গরম কাপড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন। মহিলা মৃত মানুষের মতো পড়েছিলেন। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে জীবন মরণ চেষ্টা করে বেচে ওঠা মানুষ উদ্ধার হবার পর এভাবেই সাধারণত অবসাদগ্রস্ত হয়ে নিস্তেজ পড়ে থাকে। সবাই যার যার বিছানায় ফিরে এসে নৌকাডুবি নিয়ে নানান কাহিনী বলতে লাগলো। শুনলাম মহিলা সুস্থ আছেন। এখান থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উজানে তারা নৌকাডুবির কবলে পড়েন। তারা এক নৌকা ভর্তি করে আটরশির পীরের খানেকায়ে যাচ্ছিলেন। সেই নৌকা পদ্মা নদী বক্ষে ডুবে যায়। শ্রোতের টানে মহিলা ভাসতে ভাসতে এপর্যন্ত এসে পড়েছেন। হালকা সাতার কেটে তিনি পানির উপর ভেসে থাকেন। পাহাড়ি মানুষ হলেও আমি সাতার কাটতে জানি। যেভাবে লঞ্চ একবার ডান দিকে এবং বাম দিকে কাত হচ্ছিলো, যদি লঞ্চডুবি হতো আমাকেও হয়তো এভাবে ভেসে সাতার কেটে বরিশালের দিকেই যেতে হতো।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ময়মনসিংহ

৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি.

#momoryofsadequel#charamoddisadequel

Bag Niye Nadite Jhap

Bag Niye Nadite Jhap

ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে নদীতে ঝাপ দিলো

(স্মৃতি কথা)

ঢাকা থেকে বরিশাল ফিরছিলাম লঞ্চে কর্মস্থল চরামদ্দি ইউনিয়ন হেলথ সাব-সেন্টারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রতিমাসেই একবার এভাবে লঞ্চে রাতে যাতায়াত করতে হতো বরিশাল-ঢাকা-বরিশাল ১৯৮৮-৮৯ সনে। সরকারি বেতন মাসে ছিলো ১৮৫০ টাকা। লঞ্চের কেবিন ভাড়া ছিলো ৬০০ টাকা। তাই, সবসময় কেবিনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বেশি সময় লঞ্চের ডেকে শুয়ে যাতায়াত করতাম। ব্রীফকেসে একটা লুঙ্গি ও একটা তোয়ালে রাখতাম। বিকাল ৬ টা বা ৭টায় লঞ্চ ছাড়তো এদিকে ঢাকার সদরঘাট থেকে, ওদিকে বরিশাল সদরঘাট থেকে। সবাই একটা করে সিংগেল বিছানার চাদর সাথে রাখতো। এই চাদরে যতটুকু জায়গা দখল করা যায় ততটুকু জায়গা যাত্রীর অধীন ছিলো। ভাড়া ছিলো ৩০ টাকা। আমি ৩০ টাকার টিকিট কিনতাম। বরিশালের মানুষ আমাকে চিনত না। তাই, অতি সাধারণ ভাবে চলাফেরা করতে আমার লজ্জাবোধ হতো না। লঞ্চের হোটেলে ইলিশের ডিম দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে রাত আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম লুঙ্গি পরে, বিছার চাদর বিছিয়ে ব্রিফকেসের উপর মাথা রেখে। ব্রিফকেসের উপর তাওয়েল বিছাতাম। লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দে ভালো ঘুম হতো। ছেলে বা মেয়ে আগে উঠলে আগে যে যেখানে জায়গা পেতো সেখানেই চাদর বিছিয়ে জায়গা দখল করতো। পরিচয় যাতে কেউ জানতে না পারে সেজন্য সহযাত্রীদের সাথে তেমন আলাপ করতাম না। ব্রিফকেসের উপরের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লেখা নেইম কার্ডটি উল্টিয়ে রাখতাম। যখন বাসে যাতায়াত করতাম তখন নেইম কার্ডটি সোজা করে রাখতাম। কারন, ডাক্তার পরিচয় পেলে সহযাত্রীরা সম্মান করে ৩/৪ ইঞ্চি জায়গা ফাঁক করে দিতো। নিজের পরিচয় প্রকাশ করার জন্য আমি নিজেই সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করতাম “ভাই, কি করেন?” সহযাত্রী উত্তর দিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করতেন “ভাই, আপনি কি করেন?” আমি ডাক্তার পরিচয় দিলে একটু নড়ে চড়ে বসে ৩/৪ ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দিতো। আমি কাছে এসে বসুন বললে আরও বেশি করে জায়গা ছেড়ে দিতো।

যাহোক, লঞ্চের কথায় আসি। মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত একটা নির্দিষ্ট এলাকা নিয়ে বিছানা পারতো। ঐ এলাকাটার চারিদিকে চাদর ঝুলিয়ে পর্দা করে দিতো। তারা ঘুমাতো কিনা জানি না। যতক্ষণ আমি চেতন থাকতাম তাদেরকে গল্পসল্প, হৈহল্লা করে কাটাতে শুনতাম। এদের সংখ্যা সাধারণত ১২/১৪ জন হতো। এমনি এক লঞ্চ জার্নির সময় আমার শিতানের দিকে শুয়েছিলেন এক ভদ্রমহিলা ও তার পাশের জায়গায় শুয়েছিলো এক যুবক ছেলে। গভীর রাতে হঠাৎ সেই যুবক ভদ্রমহিলার ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে মাঝ নদীতে ঝাপ দিলো। যাত্রীদের কোলাহল শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। লঞ্চ থামতে থামতে ছেলেটি অনেক দূরে পড়ে গেলো। লঞ্চ ছেলেটিকে ধরার জন্য পেছাতে লাগলো। ততক্ষণে ছেলেটি নদীর কিনারে কাঁশবনে উঠে পড়লো। ওখানে আগে থেকেই তার সহকর্মীরা তাকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তারা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে কাঁশবনে হারিয়ে গেলো। আমার ব্রিফকেস কেউ ছিন্তাই করতে পারেনি। কারন, ওটা থাকতো আমার মাথার নিচে। নিলেও সমস্যা ছিলো না। টাকা রাখতাম আন্ডারওয়্যারের নিচের পকেটে।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ময়মনসিংহ

১ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি.

#memoryofsadequel #charamoddisadequel

এমন গল্প আরও পড়তে হ্যাস্ট্যাগ শব্দে ক্লিক করুন।

charamoddi Jogdan

First Posting Charamaddi Jogdan

প্রথম কর্মস্থলে যোগদান

সময়টা ১৯৮৮ সালের ২ জুলাই।  পোস্টিং অর্ডার হাতে পেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথ কী হবে তার খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। এ ব্যাপারে সুলতান নামে আমার এক আত্মীয় তার সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে একটা রোড ম্যাপ করে দিল। সে ওখানে চাকরি করত। 

বাসে করে সাতক্ষীরায় তার বাসায় গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে সেখান থেকে হুলার হাট গেলাম। একা জার্নি, খুব খারাপ লাখছিল। হুলার হাটে সস্তা একটা হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম। 

বাথরুমের অবস্থা ভাল না থাকায় পায়খানার কাজে ওটা ব্যাবহার করলাম না। পায়খানার বেগ নিয়েই ভোর ৫ টায় রিক্সা নিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। 

ছিনতাই হবার ভয়ে ভীত ছিলাম। ঘাটে গিয়ে বসলাম। একজন দুইজন করে যাত্রী এসে বসতে লাগল। 

আমি জীবনে তখনো লঞ্চ দেখিনি। আজ  প্রথম লঞ্চ দেখার অভিজ্ঞতা হবে। বাসের মত কি আগে টিকিট করতে হবে? না উঠে টিকিট করতে হবে? এনিয়ে ছিল নানা দুশ্চিন্তা। 

স্থির করলাম আমার মত প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্র যাত্রীরা যা করবে আমিও তাই করব। দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে একটা বড় নৌযান আসছে। উপরে লিখা “এম ভি বাপ্পী”। বুঝতে পারলাম এটাই লঞ্চ। ঘাটে ভিড়ল। দেখলাম দোতলা-নিচ তলা আছে। আমি ভদ্র লোকদের দেখাদেখি দোতলায় গিয়ে বসলাম। 

বোকার মত এদিক সেদিক তাকালাম। বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলাম। লঞ্চ পূর্ব দিকে চলছিলো। পানি আর পানি। সীমাহীন পানি। জীবনে এত পানি দেখিনি। একটা লোক বেঞ্চে পা তুলে বেয়াদবের মত শুয়েছিলো। আমি তার প্রতি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এক লোক ব্রিফকেসে সুই দিয়ে খোদাই করে নাম লিখে দিচ্ছিল। আমিও পাঁচ টাকা দিয়ে নাম লিখালাম ‘সাদেক’। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 

পানি দেখে খুব ভাল লাগছিল। পানিতে অনেক মহিষ দেখতে পেলাম। মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কী যেন খাচ্ছিল। 

আমি জানতাম, মহিষ মাঠে ঘাস খায়। কিন্তু পানির নিচ থেকে কী খাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম “মহিষ পানির নিচ থেকে কি খাচ্ছে?”। লোকটি আমাকে অস্বাভাবিক মানুষ ভেবে উত্তর না দিয়ে সটকে পড়ল।  বিপরীত দিকের বারান্দায় গিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও তাই করল। 

আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ভেতরে এসে একজনকে বিষয়টি বলার পর সে বলল ”কেন? ঘাস খায়।“

আগের দুইজন তখন মনযোগ দিল। আমি জানতে চাইলাম

-পানির নিচে ঘাস জন্মায় কেমনে?
– এটাতো মাঠ। মাঠে ঘাস খাচ্ছে।
– আমি তো দেখছি সাগরের মত।
– আপনার বাড়ি কই?
 (আমি ভরকিয়ে গেলাম)

– টাঙ্গাইল জেলায় সখিপুরে, পাহাড় অঞ্চলে।
পাশ থেকে একটু শিক্ষিত একজন বললেন
-আপনি বুঝি জোয়ারভাটা দেখেননি। এখন জোয়ার। ভাটার সময় মহিষ ঘাস খাওয়া শুরু করেছিলো, জোয়ারের পানিতে মাঠ ভরে গেছে, এখনো মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে।
– এখন বুঝতে পেরেছি। বইয়ে পড়েছি।
-আপনি কী করেন? কোথায় যাচ্ছেন?
– আমি ডাক্তার। সরকারি চাকরি হয়েছে। যোগদান করতে যাচ্ছি।
-এমবিবিএস ডাক্তার?
– জ্বী।

সবাই নড়েচড়ে বসে আমার দিকে মনযোগী হল। আমিও সাচ্ছন্দ্যবোধ করা শুরু করলাম। একে একে অনেকেই টুকটাক অসুখের কথা জানাল। আমি সমাধান দিলাম। আমি ওখানকার মধ্যমণি হয়ে গেলাম। যে লোকটি পা তুলে শুয়ে ছিল সেও পা নামিয়ে বসল। বলল “ডাক্তার সাব, আমার সারাক্ষণ পায়ের তলা জ্বালাপোড়া করে। কেন এমন হয়?” এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম কেন সে বেয়াদবের মত পা তুলে শুয়েছিল।

এভাবে সবার সাথে গল্প করতে করতে সকাল ১০টার দিকে বরিশাল এসে পৌঁছলাম। 

সিভিল সার্জন অফিস থেকে কমিউনিকেশন লেটার নিয়ে বাসে চড়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে গেলাম। ইউএইচএফ পিওর নিকট পরিচয় দিলাম। পাশে একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ৫৪/৫৫ বছর বয়স্ক লোককে বললেন, ‘এই যে আপনার মেডিকেল অফিসার এসে গেছেন। আর চিন্তা নাই।’

আমি যোগদানপত্রে সই করে অফিস ত্যাগ করলাম। ওই লোকটি ছিল আমার সেন্টারের মেডিকেল এসিস্টেন্ট। আমরা চরামদ্দি সাব সেন্টারের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দিলাম। বরিশাল গিয়ে রাত্রিযাপন করে ছোট লঞ্চে করে পরদিন চরামদ্দি যেতে হবে। বাসে যেতে যেতে আলাপ হলো। ওখানে স্টাফদের কথা  জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ওখানে আছে একজন পাগলা ফার্মাসিস্ট। কোথায় থাকে, কী খায়, কী পরে তার ঠিক নাই। দেখলেই বুঝবেন। আরেকজন পিওন আছে। তাকে দিয়ে কিচ্ছু করাতে পারবেন না। কিছু বললে উল্টা আপনাকেই ভয় দেখায়ে দেবে। আপনি তো অনেক দূরের মানুষ। আপনি সামলাতে পারবেন কিনা। আপনার তো আবার নতুন চাকরি। অসুবিধা হবে না, আমি আছি না?’ শুনে আমার শরীর শিরশির করে উঠল।

সন্ধ্যার সময় আমাকে একটি কমদামি বোর্ডিংয়ে নিয়ে উঠালেন। চলে গিয়ে আবার ফিরে এলেন দুইজন চোখে সুরমা দেয়া যুবক নিয়ে। বললেন, ‘পরিচয় করে দিচ্ছি, ইনি আমার বন্ধু ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার…..!’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! ভাবলাম এই ‘বন্ধুকে’ আমি নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে।

তাদের সাথে আলাপ হল। অনেক কথার পর তারা একটা কথা বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি না? অমুককে একটু ট্যাঁক্টফুলি ম্যানেজ করতে হবে।’ 

তারা চলে গেলে আমি একটু বারান্দায় বেরুলাম। দেখলাম তারা পাশের রুমে দুইটি মেয়ের সাথে কেমন কেমন যেন কথা বলছে। আমি লুঙ্গী পরে বাথরুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বাইরে থেকে দরজার করা নাড়ল।
– কে?
– আমি বোর্ডিংয়ের লোক। কিছু লাগবে, স্যার? আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
– আমার কিছু লাগবে না। আমি এখন ঘুমাব। ডিস্টার্ব করবেন না। 
আমার বুঝতে দেরি হল না পাশের রুমের বোর্ডারদের কারবার। 

মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে রেখে তার ভাইয়ের বাসায় থাকতে গিয়েছে। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। পায়খানার বেগ থেমে গেল। বের হবার সাহস পেলাম না। গত রাতেও পায়খানা করতে পারিনি। অমনি শুয়ে পরলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের ডাক শোনে ঘুম থেকে উঠলাম। 

ছয়টায় বরিশাল থেকে ছোট লঞ্চে উঠলাম। নয়টার দিকে কাটাদিয়া ঘাটে নামলাম। ওখান থেকে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। দুই কিলোমিটার যেতে হল নৌকায়। খালের ধারের মানুষ আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো “সাহেব কে?” 
– সাহেব আমাদের চরামদ্দির নতুন ডাক্তার। এমবিবিএস। এর আগে কেউ এমবিবিএস ছিলেন না। 
– আমাদের সরকারি ডাক্তার?
– জ্বী।
-খুব ভাল।

দশটার দিকে নৌকা থেকে নামলাম। তিনি দেখিয়ে বললেন ‘এটাই আপনার হাসপাতাল।’
দেখলাম ডোয়াপাকা একটি পুরাতন টিনের ঘর। সামনে বারান্দা। হাসপাতালের সামনে প্রায় একশত জন লোক। একজন উস্কো খুসকো লোক কানে একটা বিড়ি আটকানো, গায়ে রান্নাকরার ছাই লাগানো শার্ট, মাঝে মাঝে বিড়ির আগুনে গোল গোল করে ছিদ্র করে পোড়া, পেছনে লুঙ্গীর কোছে বিড়ির প্যাকেট, আমার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল ‘সাহেব কে?’
মেডিকেল এসিস্টেন্ট বললেন, ‘ইনি আমাদের নতুন অফিসার, ময়মনসিংহ বাড়ী।’
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন

-আপনি এমবিবিএস?
– জ্বী।

লোকটি লাফ দিয়ে দুই ফুট উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট বললেন,‘ইনিই আপনার ফার্মাসিস্ট’।
ফার্মাসিস্ট নেতার ভঙ্গিতে জনগণের উদ্দেশে  ভাষণ দিতে লাগলেন-
– ভাইসব, আপনারা শান্ত হউন। আমাদের এখানে জয়েন করতে এসেছেন যিনি তিনি এমবিবিএস, যা লন্ডন থেকে পাস করতে হয়!
তিনি আগামীকাল থেকে আপনাদের দেখবেন। আজ তিনি বিশ্রাম নিবেন।
এরপর সবাই শান্ত হলেন। তিনি সবাইকে বিদায় করে আমার কাছে আসলেন।
আমি জানতে চাইলাম
– আপনাদের লেট্রিন কোথায়?
– আমাদের তো লেট্রিন নাই!
-তাহলে আপনি কী ব্যবহার করেন?
– আমি কলার পাতা দিয়ে একটু ঘেরাও করে বানিয়ে নিয়েছি।
– এটা কী?
– এটা ফ্যামিলি প্লানিং ভিজিটরের অফিস।
– এখানে লেট্রিন নেই?
– আছে। পাকা সেনিটারি লেট্রিন। 

শোনে আমার তিন দিনের জমানো পায়খানার বেগ ফারাক্কা বাধের উজানের শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ধেয়ে আসা শুরু করল।
– লেট্রিনের চাবি দিন।
– ওটা পিওনের কাছে।
– পিওন কই?
-বাজারে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
– ডাকেন তাকে।

তিনি দৌঁড়ে বাজারের দিকে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন-
-পেলাম না।
– ঠিক আছে, আপনারটাই ব্যবহার করব। এক বদনা পানি আনেন।

তিনি পানি আনতে চলে গেলেন। আশার আলো দেখে আমার ওইটার বেগ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। তিনি খাবার পানির এক জগ পানি নিয়ে এলেন। আমি বললাম
– আমি তো পানি খাব না, পায়খানায় ব্যবহার করব, বদনায় পানি আনেন।
– স্যার, আমার এই জগ ছাড়া আর কিছু নাই। এইটা দিয়েই পানি খাই, এইটা নিয়েই পায়খানায় যাই।

আমার রাগে, দুঃখে  বেগ নিস্তেজ হয়ে পরল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মিটিমিটি হাসছিলো। আমি মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বললাম “আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাব কই?”
ফার্মাসিস্টকে বললাম,‘যান, আমার সামনে থেকে’।
তিনি ইডিয়টের মত হেসে চলে গেলেন। 

পরে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট আমাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। আমি বললাম,

-আমি এখানে থাকতে পারব না। 
– চলেন আমাদের বাড়ী। এখান থেকে ৩ কিলো দূরে হবে।

– চলুন তাই হউক। 

বিকালে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টের বাড়ি গেলাম। তার গ্রামের নামটা এখন মনে করতে পারছি না। গিয়েই লেট্রিনের খোঁজ নিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দিলেন। পাকা লেট্রিন। তিন দিনের জমা রাখা জিনিসগুলি ত্যাগ করতে পেরে গোপাল ভাঁড়ের মত প্রশান্তি পেলাম। 

তিনদিন গোসল করিনি। অত্যন্ত গরম আবহাওয়া ছিল। গোসল করতে চাইলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে নিয়ে গেলেন। বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি আর পানি। দখিনা মিষ্টি বাতাস আসছিল। আমি শার্ট গেঞ্জি খুলে কিছুক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগালাম। অমন মিষ্টি হাওয়া আর কোথাও পাইনি। 

বিকালে ঘুম দিলাম। রাতে তার ভাইয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প হল। আবার ঘুমালাম রাতে।

দুপুরের খাবার পোলাও মাংস খেয়ে বরিশাল রওনা দিলাম। বিকেল ছয়টায় ঢাকার লঞ্চে উঠলাম। ঢাকা থেকে বাসে ফিরতে হবে বাসে। হিসাব করে দেখলাম টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই কেবিনে টিকিট না করে ৩০ টাকায় ডেকের টিকিট করলাম। ব্রিফকেস থেকে লুঙ্গী বের করে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য ব্রিফকেসের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লিখা কার্ডটা উল্টিয়ে লাগালাম। ব্রিফকেস মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। 

চারদিনের জার্নির ঘটনাগুলি মনে করতে করতে এক সময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।


তারিখঃ ১৪/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

Haturi Peta

Haturi Peta

হাতুড়ি পেটা

(স্মৃতি কথা)

প্রথম পোস্টিং ছিল বরিশালের চরামদ্দি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে। ১৯৮৮ সনে এক বছর সেখানে ছিলাম। প্রচুর মারামারির রোগী আসতো। তাদেরকে চিকিৎসা করে ইনজুরির সার্টিফিকেটও দিতে হতো। একবার এক রোগী এলো হাতুড়ি পেটা খেয়ে। বিস্তারিত শুনলাম রোগীর কাছ থেকে। ঢাকা থেকে লঞ্চ যোগে তারা আসছিলো বরিশালে। লঞ্চগুলো সাধারণত রাতে যাতায়াত করতো। বরিশালের অনেক যাত্রী রাতের লঞ্চে ঢাকায় গিয়ে দিনের বেলা অফিসের কাজকর্ম বা মার্কেটিং করে আবার রাতের লঞ্চে ফিরে আসতো। প্রায়ই পথিমধ্যে ডাকাতের কবলে পড়তো। এমনি একটা অভিজ্ঞ ডাকাত পার্টি ছিলো হাতুড়ি পেটা করার। গভীর রাতে ফেরার সময় যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো তখন চার পাঁচ জনের অল্প বয়সি ডাকাত পার্টি অতর্কিতে হামলা চালাতো হাতুড়ি দিয়ে। রাইফেল ওয়ালা আনসারের মাথার পেছনে হাতুরি দিয়ে পিটুনি দিলে আনসার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতো। আনসারের রাইফেল কেড়ে নিয়ে লঞ্চের চালকের মাথার উপর তাক করে ধরে রাখতো ঠিকঠাক মতো চালিয়ে নিতে। অন্য ডাকাতরা সামনে যাকে পেতো তাকেই মাথার চান্দিতে হাতুড়ি পেটা করতো। দুই চার জনকে এভাবে মাথায় পিটুনি দিলে অন্য যাত্রীরা ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে মাথা নিচু করে লুকিয়ে উবুত করে বসে থাকতো। আশে পাশে কি হচ্ছে কেউ তা বুঝতে পারতো না। দুই চারজন যাত্রীর মাথায় পিটুনি দিয়ে শত শত যাত্রীকে অকেজো করে রাখতো কয়েকজন ডাকাতে। এ অবস্থায় যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও স্বর্নালংকার কেরে নিতো। কানের অলংকার খুলে না নিয়ে ঝেংটা টান মেরে ছিড়ে নিতো। লুট করা টাকা ও অলংকার পোটলায় ভরে সুবিধাজনক চর এলাকায় লঞ্চ ভিড়িয়ে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যেতো কাঁশবনের ভেতর। এদিকে যাত্রীরা অনেক্ষণ পর্যন্ত মাথা নিচু করেই বসে থাকতো। লঞ্চের চালক এসে তাদেরকে ইনফরমেশন দিতো এই বলে যে ডাকাতরা চলে গেছে আপনারা মাথা তুলুন।

রোগীর মুখে এমন বিভৎস কাহিনী শুনে আমিও আতংকগ্রস্ত ছিলাম। কারণ, আমাকেও মাসে একবার এমন লঞ্চে রাতে আসা-যাওয়া করতে হতো। সরকারি বেতন মাসিক ১৮৫০ টাকা ছিলো। প্রথম চাকরি। প্রথম মাসের টাকা ঠিকই পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় মাস থেকে আমাকে বেতন দেয়া হয় না। আমি ভাঙ্গা একটা ডোয়াপাকা টিনের ঘড়ে থাকতাম। অর্থ অফিসের দাবী ছিলো আমাকে নিয়ম অনুযায়ী ৩৫% বাড়ি ভাড়া কাটতে হবে। আমি ভাঙ্গা ঘরের ভাড়া কাটতে রাজি ছিলাম না। তাই, বেতন বন্ধ ছিলো। ২০ টাকা করে প্রাইভেট রোগী দেখে খাওয়া খরচ করে যা থাকতো তা থেকে বাবার জন্য কিছু টাকা মানি অর্ডার করে পাঠাতাম। আর যা থাকতো তা নিয়ে টাঙ্গাইল বাসায় আসতাম প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে। যাহোক, চার মাস পরে এক সাথে বাড়ি ভাড়া সহ বেতন পেয়েছিলাম। সেই টাকায় বাবার ইচ্ছানুযায়ী বাড়ির পাশের ১২.৫ শতাংশ জমি কিনেছিলাম। লঞ্চে উঠে আতংকে মাথা হাতাতাম কখন এসে ডাকাতরা আমার মাথায় হাতুড়ি পিটায়। তারা তো আর আমি ডাক্তার কি না তা জিজ্ঞেস করে না। তখন, ডাকাতরা ডাক্তার ও পুলিশকে সমিহ করতো।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ময়মনসিংহ

৩০ আগস্ট ২০২২ খ্রি.

#memoryofsadequel

#charamoddisadequel

এমন গল্প আরও পড়তে হ্যাস্ট্যাগ শব্দে ক্লিক করুন।

Khur Die Poch Mara

Khur Die Poch Mara

খুর দিয়ে পোঁচ মারা

(#memoryofsadequel)

১৯৮৮ সনের কথা। বরিশালের বাকেরগঞ্জের চরামদ্দি ইউনিয়ন সাবসেন্টারে যখন চাকরি করতাম, তখনকার কথা। ঐ এলাকায় প্রচুর ছিন্তাই হতো। অল্প বয়সের দুই তিন জন ছেলে ছোরা ও খুর নিয়ে রাতের বেলায় রাস্তার ধারে ওৎ পেতে থাকতো। সুযোগ বুঝে পথচারীদের সামনে দাঁড়িয়ে ছোরা দেখিয়ে সাথে যা যা আছে, সব দিয়ে দিতে বলতো। সামান্য একটু বিলম্ব হলেই খুর দিয়ে পোঁচ মেরে দিতো। এসব পোঁচ খাওয়া রোগী আমার কাছে নিয়ে আসতো।

আমি অপারেশন টেবিলে শোয়ায়ে বুকের শার্টের বোতামগুলি খুলে দেখতে পেতাম গলার নিচে থেকে শুরু করে বুকের মাঝের হাড়ের উপর দিয়ে সোজা নেমে এসেছে খুরের পোঁচ পেটের উপর পর্যন্ত। তেমন কিছু না, মাত্র ৫০ টাকা বা ১০০ টাকা কেড়ে নেয়ার জন্য এই পোঁচ। এখানকার চামড়ার নিচে চর্বি থাকে না। তাই, কাটা চামড়া দুই দিকে সড়ে গিয়ে হা হয়ে থাকতো। বিভৎস দেখা যেতো সেই ক্ষত। মহিলা, শিশু ও দুর্বল চিত্তের পুরুষরা দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়তো। আমিও খুব আতংকগ্রস্ত ছিলাম এই ভেবে যে কবে আমার বুকেই এমন খুরের পোঁচ মেরে দেয়।

আমি ইন-সার্ভিস-ট্রেইনিং এর সময় সার্জারিতে বিশেষভাবে ৬ মাস ট্রেনিং করেছিলাম। তাই, ভালো সেলাই করতে পারতাম। আমি ক্ষতস্থান জীবাণুমুক্ত করে সিল্কের সুতা দিয়ে সুন্দর করে সেলাই করে দিতাম। ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে দিতাম। ৭ দিনের ঔষধ লিখে দিতাম। ৭ দিন পর ব্যান্ডেজ খুলে সেলাই কেটে দিতাম।

আমি ১৯৮৯ সনে বদলি হয়ে চলে আসি বরিশাল থেকে। এখনো কি ওখানে এমন খুরের পোঁচের প্রচলন আছে? আমার গল্পের পাঠকদের মধ্যে কি কেউ এমন খুরের পোঁচ খেয়েছেন বা মেরেছেন?

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ময়মনসিংহ

২৯ আগস্ট ২০২২ খ্রি.

in-feed-ads: