পনের বিশ বছর আগের কথা। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল। বর্ষাকালের শেষে অথবা শরৎ কালে মামার বাড়ি যেতে ইচ্ছে হল। অনেক বছর যাওয়া হয়নি। নদী নালা খাল বিল ভরে গিয়ে মাঠ ঘাট প্লাবিত হয়ে বাড়ির পালান ভর্তি পানি হয়েছে খবর পেলাম। সেই সময় বৃষ্টি থাকে না। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। ছোট ছোট ঢেউ এসে বাড়ির ভিটায় আঘাত করে। দেখতে মন চায়। পুর্ণিমার রাত দেখে একটা তারিখ ঠিক করলাম মামা বাড়ি যাবো। ডিঙি নৌকা নিয়ে বিলের মাঝখানে লগি গেড়ে নৌকা বেঁধে পাটাতনের উপর খালি গায়ে চিত হয়ে শুয়ে পুর্ণিমার চাঁদ দেখবো। সমবয়সী মামাতো ভাই ফজলু ভাই ও কাদের ভাইর সাথে শৈশবকালের স্মৃতিচারণ করব। ডাহুক, কোড়া ও কুড়া পাখির ডাক শুনব। দূর থেকে বাউলের গান ভেসে আসবে। বিলের মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাবে।
একদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে ময়মনসিংহ থেকে রওনা দিলাম। বাসে করে কালিহাতি এসে নামলাম। কালিহাতি থেকে একটা লগি দিয়ে খোজ দেয়া ছইওয়ালা নৌকায় উঠলাম। নৌকার দুইজন মাঝি ছিল। খাল দিয়ে নৌকা চালাচ্ছিল। একজন লগি দিয়ে খালের দুইপাড়ে খোজ দিচ্ছিল। আরেকজন পিছনে দাঁড় ধরে বসেছিল। নৌকায় সাত-আট জন যাত্রী ছিল। সবাইকে এলাকার যাত্রী মনে হচ্ছিল। আমাকে তাদের থেকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। প্যান্ট শার্ট পরা । হাতে ব্রিফকেইস। সবাই ছইয়ের বাইরে পাটাতনে বসেছিল। আমিও নৌকার গুড়ায় বসলাম একটু খোলা মেলা হাওয়া খাওয়ার জন্য। মাঝি অনুরোধ করল “স্যার, ছইয়ের ভিতরে গিয়ে বহুন । আপনের গতরে নগির পানির ছিটা নাগতে পারে। আপনে বসা থাকলে আমিও ভাল ভাবে নগি দিয়া খোজ দিতে পারি না। তাছাড়া রৈদে বসলে আপনের জ্বর আইতে পারে।”
আমি ছইয়ের ভিতরে গিয়ে বসলাম। আমার জন্য পাতলা কাথা বিছানো ছিল। আমি মোজা খুলে আসন বিড়ায়ে বসলাম। ভিতরে আরেকজন লোক পেলাম শার্ট ও লুঙ্গী পড়া। ঠেংগের উপর ঠেং তুলে চিত হয়ে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। বেয়াদব বেয়াদব মনে হল। আমি কিছুটা অসস্থি বোধ করছিলাম। কিছুক্ষণ পর রৌদ্রের প্রখরতায় সবাই ছইয়ের ভিতরে এসে বসল । তারা গ্রাম্য সমস্যা নিয়ে কথা বলছিল। আমি ও বেয়াদব লোকটা শুধু শুনছিলাম। একসময় লক্ষ্য করলাম বেয়াদব লোকটার দুই হাতে দুইটি এবং দুই পায়ে দুইটি গোল্ডেন ব্রেসলেট পরা ।
একজন জিজ্ঞেস করলেন
-লোকে ব্রেসলেট পরে হাতে একটা। আপনি চার হাতপায়ে চারটি পড়েছেন কেন? -আমি কি এমনি এমনি পরেছি? আমার সমস্যার জন্য এগুলো পরেছি। বাতের জন্য এগুলো সাংঘাতিক উপকার দেয়। আমার ভাতিজা সৌদি আরব থাকে। সে জানতো আমার সারা শরীরে বাতের ব্যাথা। প্রথমে লোক মার্ফৎ আমার জন্য একটা ব্রেস্টলেট পাঠায়। এরপর উপকার পাওয়ার কথা শুনে পরপর আরো তিনটা পাঠায়। তাই চারটি ব্রেস্টলেট চার জায়গায় পরেছি। আমি এখন বাতমুক্ত।”
এরপর বাত রোগ নিয়ে সবাই যার যার মত প্রকাশ করতে লাগলো। নানান রকমের তেলেসমাতি চিকিৎসা পদ্ধতির কথাও শুনলাম নিরবে। একসময় প্রথম প্রশ্নকারী বললেন
-আপনার ভাতিজা তো সৌদি থাকেন। আমার জন্য একটা ব্রেসলেট আনিয়ে দেবেন? আমি টাকা দিয়ে দেব। আমার শরীরে খুব বাতের ব্যথা। -আপনার প্রয়োজন থাকলে এটা নিন। আমি ভাতিজাকে ফোন করে আনিয়ে নেব নি। -দাম কত দিব? -পাঁচশ টাকা দিন। এগুলোর দাম অনেক। খুব উপকারী ধাতু তো! -তা হলে আমাকে একটা দিন। -এই নিন। আপনার হাতে খুব মানিয়েছে। এর উপকার আগামীকাল থেকেই পেয়ে যাবেন।
আমরা সবাই দেখলাম। একটু পর আরেকজন বললেন
-ভাই, আপনাকে তো আনাতেই হবে। আমাকেও একটা দিন না। আপনার ভাতিজাকে দিয়ে আনিয়ে নিবেন। -এই নিন আপনি।
এইভাবে লোকটি চারজনের কাছে চারটি ব্রেসলেট আমাদের চোখের সামনে দুইহাজার টাকায় বেচে দিলাম। সামনের ঘাটে নৌকা ভিরালে বেয়াদব লোকটি ও প্রথম গ্রাহক নেমে পড়ল। এতক্ষণে আমরা রহস্য বুঝে ফেললাম। সবাই হাসাহাসি করলাম টাউটের টাউটামি বুঝে। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। মাঝি বলল “প্রথম গ্রাহকটা ঐ টাউটেরই লোক। ওকে দিয়ে বিক্রি শুরু করে। এরপর তারা আরেক নৌকায় উঠে এই কাজই করবে।”
আউলিয়াবাদ ঘাটে এসে এই নৌকা জার্নি শেষ হল । নেমে আরেকটি প্রাইভেট ডিঙি নৌকায় উঠলাম রৌহা মামাবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রৌহা কালিহাতি উপজেলায়। পুর্বদিকে বংশী নদীর কাছাকাছি ভর অঞ্চল বা ভাটি অঞ্চল। ছাতা ফুটিয়ে নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসলাম। দূর থেকে দেখা গেল দক্ষিণের পালান পারে মেঝ মামী দল বল নিয়ে আমাকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। নৌকা ঘাটে এসে ভিড়ল। ঘাটে নামলাম। মামী এগিয়ে এসে গায়ে আদর করে বললেন “সাদক আইছ, কত দিন পরে আইলা, বাজান।”
মামাতো ভাই কদ্দুছের বউ এক গ্লাস সরবত এনে দক্ষিণ ভিটার গাছের নিচে চেয়ার দিল বসতে। আমি সরবত খেয়ে শার্টের উপরের বোতাম খুলে দক্ষিণ মুখ করে বসলাম। সবার সাথে কুশল বিনিময় হল। দক্ষিণের বিস্তির্ণ জলরাশি থেকে মৃদুমন্দ বাতাস এসে বুকে লাগছিল। ছোট ছোট ঢেউ পায়ের কাছে এসে ভেংগে যাচ্ছিল। মৃদু মৃদু কুলু কুলু শব্দ হচ্ছিল। দূরে বিলের মাঝ খানে তিন কিশোর ডিঙি নৌকা নিয়ে খেলা করছিল। মুহুর্তে আমি হারিয়ে গেলাম আমার শৈশব কৈশোরে। মনে হলো যেনো আমি, ফজু ভাই ও কাদের ভাই ডিঙি নৌকা নিয়ে খেলা করছি । ১০/৩/২০১৮ খ্রি.
বরিশালের এই কোহিনূরকে আপনারা চিনবেন না। এই কোহিনূর একজন গরীবের মেয়ে। দেখতে ছিল রবি ঠাকুরের গানের কৃষ্ণকলির মতো। তার বাবার কাছে ছিল বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত মোগল সম্রাজ্ঞীর ব্যবহার করা পৃথিবীর সবচেয়ে দামী হীরা কোহিনূরের মতো। ত্রিশ বছরেরও বেশী আগে আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার হিসাবে। চিকিৎসা পেশার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা থাকায় দুঃসাহসিক ইচ্ছা নিয়ে আমি সেই গ্রামের জরাজীর্ণ টিনসেড হাসপাতালে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা দিতে থাকি। পাশে একটা পরিত্যক্ত সরকারি বাসস্থান ছিল মেডিকেল অফিসারের জন্য। ইতিপূর্বে কোন এমবিবিএস ডাক্তার সেখানে পোস্টিং হয় নি। আমিই প্রথম। ১০০ টাকা দামের চৌকি কিনে সেই বাসাতেই আমি থাকা শুরু করলাম। সাথে একটা রান্নাঘর ছিল। ওটার ভিতর কোহিনূরের বাবা ধানের ক্ষর রেখেছিলেন। আরেকটা বৈঠককখানা ছিল। ওটার ভিতর কোহিনূরের বাবা ধানের আটি রেখেছিলেন স্তুপ করে। বাড়ীর চারিদিকে পরিত্যক্ত সিমেন্টের খুটি ছিল টিনের বেড়ার। কিন্তু টিন ছিল না। একটা কামলা নিয়ে বাঁশ কিনে সেই খুটিতে বাঁশ বেঁধে বাঁশের উপর দিয়ে কলাপাতা ভাজ করে ঝুলিয়ে বেড়া তৈরি করালাম। বাড়ির পশ্চিমপাশ সংলগ্ন একটা বিরাট জমিদারি পুকুর ছিল। খুব স্বচ্ছ ছিল তার পানি। সেই পানিতে জ্যোৎস্নার আলো ঝলমল করতো। রান্নাঘর ও থাকার ঘরের গলি বরাবর পুকুরপাড়ে একটা শানবাঁধানো ঘাট ছিল। এইগুলি চরামদ্দির জমিদারদের ছিল। তারাই প্রজাদের জন্য বৃটিশ আমলে ডিসপেনসারি করেছিল। সেইটাই এখন হয়েছে সরকারি উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই বাড়ি বাংলাদেশের এক সময়ের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আহসানুল্লাহ সাহেবের শশুরবাড়ি ছিল। সেখানে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে। পুকুরের টলটলে পানিতে শানবাঁধানো ঘাটে আমি খালি গায়ে লুঙ্গী পরে গোসল করতাম। বয়স ছিল আমার ২৭ কি ২৮। দেখতে খুব সুদর্শন ছিলাম। খালি গা দেখে পুকুরের অপর দিকের মানুষ আমার দিকে চেয়ে থাকতো। তাই, শানবাঁধানো ঘাটে বাঁশ গেড়ে কলাপাতা ভাঁজ করে বেড়া দেওয়ালাম। ফার্মাসিস্ট এর সাথে পরামর্শ করে বৈঠকখানা খালি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোহিনূরের বাবাকে ডেকে বললাম “আমি সরকারি মেডিকেল অফিসার। এখানে অবস্থান করে আমি চাকরি করব। বিকেলে একটু প্রাইভেট প্রেক্টিশ করব। আপনি ধানের আটি গুলি সরিয়ে ফেলুন। এখানে চেম্বার বানাবো। রান্নাঘর থেকে ক্ষর সরিয়ে ফেলুন। এখানে রান্না করার ব্যবস্থা করব।” শুনে কোহিনূরের বাবা আমার দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইলেন। তার গায়ে জামা ছিল না। বুকের হার সবগুলি বের করা ছিল। পেট চিমটা লাগা ছিল। নাভীর নিচে লুঙ্গী পরা ছিল। লুঙ্গীর দুই পাশ খাটো করার জন্য দুই পাশে গুজে দেয়া ছিল। উপরের পাটির দাত উঁচু ছিল। দাঁত বের করার জন্য হাসতে হয় নি। অসহায় ভাবে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে। যেন এক জমিদারের সামনে প্রজা দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কোহিনূরের বাবা বললেন – সায়েব, আমি খুব গরীব মানুষ। জমি জমা কিচ্ছু নাই। অন্যের জমি চাষ করে কয়েকটা ধানের আটি পাইছি। এইগুলি রাখার জাওয়গাও নাই আমার। সংসারে বুড়া মা, বউ, আর দুগগা মাইয়া। আমি বাজার থাইক্কা ধান কিন্না আনি। সিদ্ধ কইরা শুকাইয়া ঢেকিতে পাড় দিয়া চাইল বানায় কোহিনূরের মায়। বেইচা যা অয় তাই দিয়া কোন মতে চালাইয়া নেই। আপ্নে যা কইছেন বুইজ্জি। – ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি কইরেন।
আমি দেখেছি কোহিনূরের মা ও বাপকে সব সময় এক সাথে কাজ করতে। তারা সবসময় হাসিখুসি থাকতেন। হাসপাতালের সামনের খালি জায়গায় ধান শুকাতেন। বৃষ্টি এলে হাসপাতালের বারান্দায় ধান উঠাতেন। বারান্দায় রেলিং-এ বসে কতো যে সুখের আলাপ তারা করতো! এতো সুখি দম্পতি খুব কমই দেখেছি। এত ভালো মানুষ আমি কমই দেখেছি।
পরেরদিন একজন পরিপাটি লোক এলেন। পরিচয় দিলেন ঢাকায় ডিসি অফিসে চাকরি করেন। খুবই ভদ্র। তিনি বললেন – পুকুরের দক্ষিণ পারের বাড়িটাই আমাদের। কোহিনূরের মা আমার ছোট বোন। গরীব ঘরে বিয়ে হওয়াতে বড় সমস্যায় আছি। আপনি যা করতে বলেছেন তা ঠিকই আছে। আমি ওদের বলেছি খুব শীগ্রি ঘর খালি করে দিতে। দেরী হলে ক্ষমা করে দিয়েন। – ঠিক আছে। আমি দেখব।
কোহিনূরের বাবা আমার ঘর খালি করে দিলেন। আমি পরিষ্কার করে চেয়ার টেবিল বসিয়ে চেম্বার বানিয়ে নিলাম। কোহিনূরের দাদী কোহিনূর ও তার ছোট বোনকে নিয়ে আমার থাকার ঘরে ঢুকে পড়লেন “দাদু, দাদু” করে ডাকতে ডাকতে। দেখলাম একটা দেড় দুই বছরের বাচ্চাকে পাতালি কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন বুড়ি। ব্লাউজ ছিল না তার গায়। গ্রামের এমন বুড়িরা ব্লাউজ প্রেটিকোট পরতেন না। শুধু ১৩ হাত সুতীর কাপড় এক পেচ দিয়ে পরতেন। তিনি বাচ্চাটাকে দুধ মুখে দিয়ে রেখেছিলেন প্রকাশ্যে। এজন্য আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম – একি ঘরের ভিতরে এলেন কেন? বাইরে থাকুন। – দাদু, আমি কোহিনূরের দাদী। খালের ঐ পাড়েই থাকি। এইটা আমার নাত্নী কোহিনূর। কোলেরটা কোহিনূরের ছোট। – নাত্নীকে কি কেউ দুধ খাওয়ায়। – ও আল্লাহ, দাদু, কি বুলায়। আমি বুড়া মানুষ। দুধ শুকাইয়া গেছে। অর মায় সারাক্ষণ কাম করে। আমার কোলে দিয়া রাখে। খালি কান্দে। তাই দুধের বোটা মুখে দিয়া রাখি। দুধ নাই। খালি বোটা চাটে। – আমারে দাদু বলছেন কেনো। আমি সরকারি অফিসার। – হেই ছোট কাল থাইকাই সায়েব দেইখা আইতাছি। এইহানেই বাড়ি। সবাই আমারে আপনা মানুষই ভাবছে। আপনের আগের সায়েব বুড়া মানুষ ছিল। এইখানে অনেকদিন ছিল। এইখান থাইকাই তার চাকরি শেষ অইছে। তারে আমি দাদু ডাকতাম। আপনেও আমার দাদু। – ঠিক আছে, এখন যান। – দাদু, এই মাইয়াউগগার একছের পাতলা পায়খানা অয়। – হাসপাতাল টাইমে আইসেন। – আমি যামু হাসপাতালে? আমি হাসপাতালে যাই না। দাদু আমাকে বাসায় থাইকাই ঔষধ দিয়া দিতেন। – খাবার সেলাইন লাগবে। আমার কাছে নাই। এখন যান। – আগের দাদুর সময় টিনের বেড়া গুলি অমুকে নিয়ে তার বাড়িতে লাগাইছে। চার দিক দিয়া বেড়া ছিল।
আমি ফার্মাসিস্ট-এর কাছ থেকে জেনে নিলাম কে এই টিনের বেড়া নিয়ে গেছে। তার সাথে পরামর্শ করে ডেকে এনে টিনগুলি উদ্ধার করে কলারপাতা ফেলে দিয়ে টিনের বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করলাম।
এরপর থেকে আমি বাসায় খাবার সেলাইন রাখতাম। কেউ পাতলা পায়খানার কথা বললে আমি সেলাইন দিয়ে দিতাম। কিন্তু কোহিনূরের কোন দিন পাতলা পায়খানা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানতাম যে তার দাদী পাতলা পায়খানার কথা বলে সেলাইন নেয়। কোহিনূরের বয়স তখন ৬ বছরের মতো ছিল। দাদীর সাথে আসতো। তার দিকে তাকালে চোখ নিচু করে মিষ্টি করে হাসতো। আমি জানতাম দাদী খাবার সেলাইন নিতেন নিজে খাওয়ার জন্য। খেয়ে তিনি শক্তি পেতেন। কোহিনূরের নাম ভাংগিয়ে নিতেন সেলাইন।
একা এক বাড়িতে থাকতাম। মাঝে মাঝে শুয়ে বিশ্রাম নিতাম। প্রকৃতি খুব শান্ত ছিল। মাঝে মাঝে কোহিনূরের বাবার কন্ঠের ডাক ভেসে আসতো “কনুরে…।” তার বাবা মা তাকে কোহিনূর না ডেকে কনুর ডাকতেন। এক বছর আমি চরামদ্দি চাকরি করেছি। শেষের চার পাচ মাস আমার ফ্যামিলি নিয়ে ছিলাম। কোহিনূরকে আমার স্ত্রী আদর করতো। কোহিনূরের মা আমার স্ত্রীর খোঁজ খবর নিতেন। আমার স্ত্রী তাকেও ভালবাসতো। এখনো আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে চরামদ্দির স্মৃতিচারণ করার সময় কোহিনূর, কোহিনূরের মা ও বাবার কথা বলে। বলে “তারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের জন্য মায়া হয়। তাদের বাড়ি যেতে খাল পার হতে হতো। খালের উপর দিয়ে একটা তালগাছ না কি গাছ যেনো ফেলে সাঁকো বানানো হয়েছিল।” ওটা আসলে ছিল তাল গাছ। জোয়ারের সময় খাল পানিতে ভরে যেতো। ভাটার সময় তলা দেখা যেতো।
সেই ১৯৮৯ সনে চরামদ্দি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিলাম। রেখে এসেছিলাম ভালো একটি প্রতিবেশী পরিবার। এর ঠিক ১০ বছর পর ১৯৯৯ সনে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে এক্সটারনাল হিসাবে পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে কির্তনখোলা নদী পার হয়ে কাউয়ার চর হয়ে রিক্সায় চরামদ্দি বেড়াতে গিয়েছিলাম, আমার স্মৃতি বিজড়িত কোহিনূরদের গ্রামে। সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম বরিশালে এই মেডিকেল কলেজে ৫ম বর্ষের ছাত্র আমার ভাতিজা শহিদুল্লাহ হুমায়ুন কবীরকে (এখন এনাস্থেসিওলজিস্ট)। ঘুরে ঘুরে আগের দিনের অনেক কিছুই দেখি। সেই টিনসেড হাসপাতাল নেই। বিল্ডিং হয়েছে। সেই পরিত্যক্ত বাড়ি নেই। কোয়ার্টার হয়েছে বহুতল। পুকুরের ঘাট সংস্কার করা হয়েছে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী মকবুল দফাদারের ছেলে মাসুদকে নিয়ে সব দেখলাম। তুলনা করলাম দশ বছর আগেকার চরামদ্দির সাথে। কত উন্নত হয়েছে আজ! কোহিনূরের বাবাকে পেলাম সামনে। সেই আগের হাসি। সেই আগের মতোই লুঙ্গী পরা খালি গায়। আমি বললাম “আপনার বাচ্চা দুইটিকে দেখতে চাই। কোহিনূরের মা কই?” তিনি খাল পেড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কোহিনূরের মা, একজন শাড়ী পরা কিশোরী ও একজন পাজামা পরা মেয়েকে নিয়ে এলেন। কোহিনূরের দাদী এলেন কি না আমার মনে নেই। ৩০ বছর আগের কথা তো! সব মনে করতে পারি না। আমি বললাম – কোহিনূর কই? – এইটাই তো কোহিনূর।
সেই শাড়ী পরা কিশোরীটিই কোহিনূর। আমি চমকে গেলাম। আমার দেখা সেই হাফ প্যান্ট পরা কোহিনূর কই? সেই কোহিনূর, যার গায়ে জামা থাকতো না। গলায় থাকতো ৪ আনা দামের সীসার রুপালী চেইন। যার চোখের দিকে তাকালে চোখ নত করে মিষ্টি হাসি দিতো। সেই কোহিনূর আমাকে দেখে একটু ঘোমটা টেনে পাশ ফিরে তাকালো। কারন, এখন সে ৬ বছরের শিশু নয়, এখন ১৬ বছরের এক গ্রাম্য কিশোরী, কোহিনূর। ৪/৮/২০১৯ খ্রি.
সামাদ স্যার ছিলেন আমার হাই স্কুল জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। আব্দুস সামাদ বিএসসি স্যার। ক্লাসে সাধারণ গণিত, নৈর্বাচনিক গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। এই তিনটি বিষয়েই আমি ভাল করতাম । তাই, স্যার আমাকে অন্যদের থেকে একটু বেশি স্নেহ করতেন। খুব সরল ছিলেন। সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। ১৯৭৫-৭৬ সনে ভালুকার বাটাজোর বিএম হাই স্কুলে স্যার আমাকে নবম ও দশম শ্রেনীতে পড়িয়েছেন। আমি এর আগে কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে পড়েছি । ১৯৭৫ সনে নবম শ্রেনীতে ওঠার পর কচুয়া স্কুলে আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক কেউ ছিলেন না । ১৯৭৪ সনে দেশের অবস্থা ভালো ছিল না । মানুষের মধ্যে অভাব অনটন ছিল । গ্রামের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিলো না । অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে চলে যায় । আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক ভীমচন্দ্র বিএসসি স্যারও নিরূদ্যেশ হলেন । জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম । আমাদের বিজ্ঞান ও গনিত বিষয় কেউ পড়ালেন না । কয়াদি স্কুলে আমার ফুফাতো ভাই আব্দুল মোত্তালেব তালুকদার (মতি ভাই) বিএসসি টিচার ছিলেন। হেড স্যার আমাকে পাঠিয়েছিলেন তাকে কচুয়া স্কুলে চলে আসার প্রস্তাব নিয়ে । তিনি রাজি হলেন না ।
আমার পড়ার উদ্যেশ্য ছিল ডাক্তার হওয়ার । না হতে পারলে ইঞ্জিনিয়ার । না হতে পারলে বিএসসি-এমএসসি হওয়ার। কিন্তু নবম শ্রেনীর তিন মাস হয়ে গেলো বিজ্ঞান পড়া শুরুই করতে পারলাম না । মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । চলে এলাম বাটাজোর স্কুলে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শওকত স্যার । তিনি ছিলেন সেই সময়ের এলাকার মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক । তিনি যে স্কুলেই প্রধান শিক্ষক হতেন সেই স্কুলই রাতারাতি উন্নত হয়ে যেতো । তার আগে বাটাজোর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মরহুম কুতুব উদ্দিন স্যার। তিনিও খুব শক্তিশালী হেড মাস্টার ছিলেন । তার অবদানেই বাটাজোর স্কুল অত্র এলাকার মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্কুল ছিল । তিনি রাজনীতি করতেন । শুনেছি, তিনি একাই আওয়ামী লীগের অনেক সংঠনের প্রধান ছিলেন । এজন্য ভেতরে ভেতরে তার অনেক শত্রু তৈরি হয় । এক রাতের অন্ধকারে তিনি শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন । সেই খুনের জের ধরে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাটাজোর এলাকায় খুনা-খুনি চলতে থাকে ।
শওকত স্যার ইংরেজি লিটারেচার পড়াতেন । প্রথম যেদিন তার ক্লাশ করলাম সেদিন তিনি ক্যাসাবিয়াংকা নামে একটা পয়েম (কবিতা) পড়াচ্ছিলেন । তিনি পাজামা-পাঞ্জাবি ও জিন্না-ক্যাপ পরতেন । বাম হাতে বই নিয়ে ডান হাত ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে মঞ্চের উপর হেটে হেটে কবিতা পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন । তিনি বলছিলেন “ক্যানন এট রাইট অব দেম, ক্যানন এট লেফট অব দেম, –“ । এমনভাবে অভিনয় করে করে পড়াচ্ছিলেন যে মনে হচ্ছিলো স্যারই কামানের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন । আমি তার পড়ানোর স্টাইল দেখে মুগ্ধ হলাম । আরেকদিন তিনি একটা কবিতা পড়াচ্ছিলেন । সেটা মেঘনায় বান কবিতার “শোন মা আমিনা, রেখে দেরে কাজ, তরা করে মাঠে চল, এখনি নামিবে দেয়া, এখনি নামিবে ঢল —“এর ইংরেজি ভার্সনের “ও মেরি, গো এন্ড কল দা ক্যাটল হোম —-” পড়াচ্ছিলেন । মেরি বানে ভেসে মারা গিয়েছিল । তার খোঁজে গিয়ে দেখতে পেলো মেরির চুল পানিতে ভাসছে । দেখে চুল না শেওলা বুঝা যাচ্ছিল না । কবিতায় ছিলো “ইজ ইট উইড?” স্যার এমনভাবে অভিনয় করে পড়ালেন যে, যেনো স্যার নিজের চোখে দেখছেন। স্যারের পড়ানোর স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করেছিলো । কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই স্যারকে এই স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে চলে যেতে হলো । আমরা আরেক শ্রেষ্ট প্রধান শিক্ষককে হারালাম ।
আমি ভর্তি হয়েছিলাম ২ এপ্রিল ১৯৭৫ সনে । দিয়েছিলাম ১ এপ্রিল । সেদিন এপ্রিল ফুল মনে করে কে যেনো ভর্তি হতে নিষেধ করেছিলেন । আমি সন্তুষ্ট হলাম । বিএসসি স্যার হিসাবে পেলাম আব্দুস সামাদ স্যার ও আব্দুর রউফ স্যারকে । আব্দুল বারী স্যার খুব সম্ভব আইএসসি, বিএ টিচার ছিলেন । সামাদ স্যার পড়াতেন গনিত ও পদার্থ বিজ্ঞান, রউফ স্যার পড়াতেন রসায়ন, বারী স্যার জীব বিজ্ঞান, জামাল স্যার বাংলা সাহিত্য, সামসুল হক স্যার বাংলা ব্যাকরন, বিল্লাল স্যার ইংরেজি গ্রামার এবং আনসার মৌলভি স্যার ইসলামীয়াত । শওকত স্যার চলে যাবার পর নতুন হেড স্যার আসেন আব্দুর রহমান স্যার । পরপর দুইজন হেড মাস্টার আসেন। দুইজনের নামই ছিল আব্দুর রহমান । যিনি হেড স্যার ছিলেন তিনিই ইংরেজি লিটারেচার পড়াতেন ।
যেহেতু আমি তিন মাস বিজ্ঞান ও অংক বিষয় ক্লাস করিনি সেহেতু আমি এই বিষয়গুলো ক্লাসে তেমন ফলো করতে পারছিলাম না । তাই, আমি স্যারদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারছিলাম না । আমি ক্লাসে অপরিচিত এক আগুন্তুক হিসাবে রয়ে গেলাম । আমি বিষন্ন থাকতাম ক্লাসে । ক্লাসে ফজলু ও দেলোয়ারের খুব নাম ছিল । অথচ কচুয়া স্কুলে থাকাকালিন ওদের মতোই আমি ছিলাম । ওরা এই স্কুলে আসে ক্লাস সেভেনে থাকতে । জামাল স্যার ফজলুকে বেশী স্নেহ করতো । আমার হিংসা হতো । এপ্রিলেই প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হলো । আমি পদার্থ বিজ্ঞানে দুই নম্বর কম পেয়ে ফেল করে বসলাম । জীবনে আমি থার্ড হইনি । সেই আমি একটা সাবজেক্টে ফেল করলাম! নিজেকে শান্তনা দিতাম এই বলে যে আমি গত তিন মাস কিছুই পড়ি নি । পাস মার্কের কাছাকাছি গিয়েছি, কম কিসের?
আমিই ফার্স্ট হবো এই সংকল্প নিয়ে পড়া শুরু করলাম । সব পাঠ্য বইয়ের নোট বই কিনে ফেললাম । পাঠ্যবই ভাল ভাবে পড়ি । তারপড় কিভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তা নোট বই দেখে শিখে নেই । কিভাবে অংক কষতে হবে নোট বই দেখে শিখে নেই । ক্লাসে ভালো করতে থাকি । মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে স্যারদের কথা শুনি । সামাদ স্যার ধীরে ধীরে সরল ভাষায় কথা বলে পড়াতেন । আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতাম । সামাদ স্যারের পড়ানোর ধরন আমার ভালো লাগে । আমি এটাকে স্টাইল না বলে ধরনই বললাম । আমি এমবিবিএস ক্লাসে স্টাইল করে পড়াই না । আমার পড়ানোর ধরন সামাদ স্যারের মতো । আমি জানি, আমি যেভাবে পড়াই ছাত্রদের বুঝার জন্য উপকারি । অল্প কিছু ছাত্রদের কাছে সেটা পছন্দ নাও হতে পারে । আমি মনে করি স্টাইল করার দরকার নাই, ভালোভাবে বুঝে ছাত্ররা ভা্লো ডাক্তার হলেই হলো ।
সামাদ স্যার ক্লাসে অংক করতে দিতেন । আমরা দ্রূত অংক করে মঞ্চে উঠে স্যারকে দেখাতাম । যে আগে দেখাতে পারতো স্যারের দৃষ্টি আকর্ষন করতো । আগের রাতে নোট দেখে চেপ্টারের সব অংক সল্ভ করা শিখে আসতাম । ক্লাসে অংক দেয়ার সাথে সাথে দ্রূত সমাধান করে ফার্স্টবয় ফজলুর আগে দেখাতে চেষ্টা করতাম । দ্রুত দেখাতে গিয়ে বেঞ্চের কোনায় আংগুলে ঠেলা লেগে গল গলি রক্ত পড়ে । আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না । আমার টারগেট ছিলো স্যারকে আগে অংক করে দেখানো । ক্লাসমেট মজনু আমাকে বলল “এই খুন হয়ে গেছো । আঙ্গুল কেটে রক্ত পড়ছে ।” বলার পর আমি দেখি গলগলি রক্ত পড়ছে আঙ্গুল কেটে । এমন ছিলো আমার জেদ । ফার্স্ট হতেই হবে । সামাদ স্যারের দৃষ্টি আকর্ষন করতেই হবে । এরপর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় দ্বিতিয় স্থান অধিকার করলাম । সব স্যারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো আমার প্রতি । সামাদ স্যারের কাছে হয়ে গেলাম এক নাম্বার অনুগত ভালো ছাত্র।
১৯৭৬ সনে টেস্ট পরীক্ষা শেষে আমাদের ক্লাস বন্ধ রাখা হয়। ভাল ভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমাদের ৩১ জন পরীক্ষার্থীকে স্কুলের হোস্টেলে রাখেন। এক রুমে অনেকজন রাখা হত। আমার পড়ায় ক্ষতি হতে পারে বলে জানালে স্যার আমাকে একাই এক রুমে রাখেন। আমাদের তত্বাবধান করার জন্য সামাদ স্যার ও বারী স্যার স্কুল বিল্ডিং-এ থাকতেন। মাঝে মাঝে বেত হাতে নিয়ে চুপি চুপি রাউন্ড দিতেন। এক দিন রাত ১২ টার দিকে স্যারগণ চুপি চুপি রাউন্ড দিচ্ছিলেন। ছাত্ররা ঐ সময় একটু দুষ্টুমি করছিল। বারী স্যার বললেন “এই তোরা কি শুরু করেছিস?” সুলতান একটু ফক্কর ছিল। সে ভিতর থেকে বলে উঠল “শুরু না স্যার, শেষের দিকে।”
আমাদের পাহারা দেয়া ছাড়া স্যারদের তেমন কাজ ছিল না। বারান্দায় বসে সারাক্ষণ দাবা খেলতেন সামাদ স্যার আর বারী স্যার। বন্ধুরা দুপুরে খেয়ে প্রায় সবাই দুই এক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিত। আমি দুপুরে খেয়ে ঘুমাতাম না। টেস্ট পেপার থেকে সামাদ স্যারকে একটা প্রশ্নপত্র পছন্দ করে দিতে বলতাম। স্যার যে কোন একটা প্রশ্নপত্র পছন্দ করে দিতেন। তখন শীতকাল ছিল। মাঠে বেঞ্চ বসিয়ে তার উপর বসে ঘড়ি ধরে বিকেল ২ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত পরীক্ষা দিতাম। একেক দিন একেক বিষয় পরীক্ষা দিতাম। সামাদ স্যার ও বারী স্যার খাতা দেখে নাম্বার দিতেন। বাংলা ও ইংরেজী ছাড়া সব বিষয়েই ৮০-র উপর নাম্বার পেতাম। ৮০-র উপর নাম্বার পেলে লেটার মার্ক বলা হতো । আমি তাই ৬ বিষয়ে লেটার পাবো বলে স্বপ্ন দেখতাম । খাতা দেখার জন্য স্যারগণ কোন ফি নেবার কল্পনাও করেন নি। বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষায় আমি ৪টা বিষয়ে লেটারমার্ক পেয়েছিলাম। সামাদ স্যারের সাবজেক্টগুলো বেশী ভাল করেছিলাম। সাধারণ গনিতে ৯৮, নৈর্বাচনিক গনিতে ৯৫ পদার্থবিদ্যায় ৯২ পেয়েছিলাম।
একদিন বিকাল ৩ টার দিকে আমি মাঠে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম । দেখলাম সামাদ স্যার লেট্রিন থেকে হারিকেন নিয়ে বের হচ্ছেন। টিনসেড কাঁচা পায়খানাঘর স্কুল ঘর থেকে ৪০-৫০ গজ দূরে ছিল। আমরা টিউবওয়েল থেকে বদনায় পানি নিয়ে কাঁচা পায়খানায় মল ত্যাগ করতাম। হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তাম। হারিকেন একটি বিশেষ ধরনের কেরোসিনের বাতি ছিল যার আলো কমানো-বাড়ানো যে্তো। আমাদের সবার রুমে এ্কটা হারিকেন ও একটা করে বদনা থাকত। স্যারের হাতের হারিকেন নেভানো অবস্থায় ছিল। এমন ফকফকা দিনের বেলায় স্যারের হাতে হারিকেন কেন আমি তা বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে গেলে আবার আমার পরীক্ষার ক্ষতি হয়। হাতে হারিকেন আছে, কিন্তু বদনা নেই। আরও জটিল মনে হচ্ছে। ফিরে আসার পর দেখি দুই স্যার হাসাহাসি করছেন। বুঝতে পারলাম দাবা খেলার নেশায় প্রকৃতির ডাকে যথাসময়ে সারা না দেয়ার কারনে জরুরী অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে বদনার পরিবর্তে হারিকেন নিয়ে স্যার লেট্রিনে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীরাও মাঝে মাঝে এমন আত্বভোলা হতেন। আমি পরীক্ষায় মনোনিবেশ করলাম।
১৯৭৭ সনের এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার পড় মাত্র একবার বা দুইবার স্যারের সাথে দেখা । তিনি ছেলের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ময়মনসিংহ আসেন আমার কাছে । স্যারের ছেলের নামও রেখেছেন আমার নামে ‘সাদেকুর রহমান’ । সে ময়মনসিংহ পড়ার সময় আমার সাথে দেখা করতো । দীর্ঘদিন স্যারের সাথে যোগাযোগ ছিল না । ২০১০ সনের দিকে অনেক কষ্ট করে স্যারের মোবাইল নাম্বার যোগার করে কল দেই । স্যারের কুশলাদি জানার পর আমি আমার অবস্থান জানাই । যানাই “আমার বড় মেয়ে কম্পিউটার সাইন্সে বিএসসি পাস করেছে। এখন এমবিএ পড়ে । ছোট মেয়ে এমবিবিএস পড়ছে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে । ওদের জন্য দোয়া করবেন ।“ শুনে স্যার বললেন “আমার জন্যও দোয়া করবে । আমি এখন শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় এমএ পড়ছি। আমার একটা আফসোস ছিল এমএ পাস করার। দেখি পাস করতে পারি কিনা।”
এরপর থেকে স্যারের সাথে আমার মাঝে মাঝে মোবাইলে যোগাযোগ হয় । স্যার গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। মোবাইল করলে খুশী হন। অনেক কথা বলেন। গত বছর বারবার স্যার বলছিলেন তার গ্রামে অনেক সম্পত্তি আছে। সেই সম্পত্তিতে একটা মেডিকেল কলেজ করবেন। তার অনেক ছাত্র ডাক্তার হয়েছে তারা সবাই সহযোগিতা করলে মেডিকেল কলেজ করা তার জন্য কঠিন না বলে তিনি জানান। আমি বলি গ্রামে মেডিকেল কলেজ করা সম্ভব না। স্যার বুঝতে চান না। আজও স্যারের সাথে কথা হয়েছে মোবাইলে। স্যার ভাল আছেন। আল্লাহ স্যারকে সুস্থ সুন্দর ধীর্ঘ জীবন দান করুন।
প্রথম লিখন – ৫/১০/২০১৭ খ্রি.
দ্বিতিয় সংস্করণ – ২৪/০৪/২০২০ খ্রি.
পুনশ্চঃ
আজো স্যারের সাথে কথা হয়েছে মোবাইলে । আমি বললাম
-স্যার, সকালে আপনাকে কল দিয়ে পাই নি । আপনাকে কল দেয়ার পর বারী স্যারকে কল দিয়েছিলাম । তিনি কল ধরেন নি ।
-বারী সাব ত ঢাকায় থাকেন । তার ছেলে এখন নৌবাহিনীর একটা জাহাজের প্রধান । খুব ভালো আছেন । ছেলে এতো বড় পদে চাকরি করে! আমার ছেলেও বিমান বন্দরে ভাল চাকরি করে ।
-স্যার, আমি ১৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখ থেকে পিআরএল-এ গেছি ।
-তুমি এলপিআর-এ গেছো?
-স্যার, ওটাই এখন পিআরএল। আমি ১৩ তারিখে রিলিজ নেয়ার পর করোনা ভাইরাস লক ডাউনে যে ঘরে প্রবেশ করেছি তারপর থেকে আর নিচে নামি নি ।
-ভালোই হয়েছে তোমার জন্য । এই বিপদের সময় হাসপাতালে যেতে হবে না । তা কিভাবে সময় কাটাও?
-স্যার, আমি তিনটা মেডিকেল জার্নাল এডিট করি ঘরে বসে অনলাইনে । আরেকটা জার্নাল দেখাশুনা করি এডিটরিয়াল বোর্ডের মেম্বার হিসাবে । গল্প লেখি । দুইটা গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে । আরও ৮-৯টা প্রকাশিত হবে ইনশা আল্লাহ । আপনাকে নিয়ে একটা গল্প লিখছি । আমার প্রিয়জনদের নিয়ে একটা স্মৃতিচারণমূলক বইয়ে এটা থাকবে । প্রকাশ পাওয়ার পর সব বই আপনাকে দেব, ইনশা আল্লাহ ।
-আমিও লেখা লেখি করি । আমি একটা উপন্যাস লিখছি । করোনা পরিস্থি চলে গেলে ওটা ছাপতে দেব । নাম দিয়েছি ‘চন্দ্রকলা’ । চাঁদের যেমন কলা আছে, বড় হতে হতে পূর্ণ হয়ে যায়, আবার ছোট হতে হতে শেষ হয়ে যায়, তেমন আরকি।
-প্রিন্ট হবার পর আমি নিব, স্যার। ইনশা আল্লাহ। দোয়া করবেন ।