Category Archives: Writings

Ham Bangali

হাম বাঙালি হায়

(রম্যরচনা)

হেলাল ভাই (ছদ্মনাম) মোবাইল করলেন। আমি রিসিভ করে সালাম দিলাম। জিজ্ঞেস করলেন “কাইফা হালুকা?” আমি ভাবলাম বাঙালি হয়ে যখন বিদেশি ভাষায় প্রশ্ন করেছেন তাহলে আমিও বিদেশি ভাষায় উত্তর দেই। বললাম “হামলুক ভালো আছি হায়?”

হেলাল ভাই হেসে দিয়ে বললেন

সাদেক ভাই, আমি একবার বিদেশের মাটিতে হাটছিলাম। আমার পিছেপিছে এক মেয়েও হাটছিলেন। একবার লক্ষ্য করলাম মেয়েটি আমার হাত ধরে হাটছে। আমি মেয়েটির দিকে না তাকিয়ে ঝাকি মেরে হাত ছাড়িয়ে ফেললাম। আবার হাটতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আবার আমার হাতে ধরে হাটা শুরু করলেন। আমি আবারও হাত ছুটিয়ে হাটতে থাকলাম। এভাবে তৃতীয়বার যখন হাত ধরলেন, আমি ঝেংটা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটির দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। মেয়েটি মুচকি হেসে বললেন “দাদা, হাম বাঙালি হায়।”

আজকে আপনার হিন্দিতে “হামলুক ভালো আছি হায়” শুনে সেই ঘটনাটা মনে পড়লো।

এরপর থেকে আমার কাছে মনে হচ্ছে, রাস্তায় যত মেয়েকে ছেলেদের হাত ধরে হাটতে দেখছি এদের সবাই স্বামী-স্ত্রী নাও হতে পারে। আপনার কাছে কী মনে হয়?

সাদেকুল তালুকদার

৫ জুলাই ২০২৪ খ্রি.

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

First Joining

প্রথম মেডিকেল অফিসার পদে সরকারী চাকুরিতে যোগদান

১৯৮৮ সনের ৩ জুলাই আমি বরিশাল জেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রথম সরকারী মেডিকেল অফিসার পদে চাকরিতে যোগদান করি । সেই মজার স্মৃতি কথার গল্প আছে নিচের লিংকের গল্পে ।

External Links

অনেক সময় প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার রিচার্জ করার জন্য আমরা বিকাশ করি। কিন্তু টোকেন আসতে অনেক দেরী হয় । তখন সরাসরি টোকেন পাওয়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন ।

Machhere

মাছেরে

(টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক মাতৃভাষায় লেখা স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

গ্রামে আমরা কেউ ঘাস কাটতে গেলে তারে কইতাম ঘাসেরে গেছে। আর কেউ মাছ ধরতে গেলে কইতাম মাছেরে গেছে। চেংরাকালে আমি মাছেরে গেতাম। আংগ বাড়ি সখিপুরের পাহার অঞ্চলে। উনা মাসে পাহারে পানি থাকত না। তাই মাছও পাও যাইত না। ভর অঞ্চলে হারা বোছরই পানি থাকত। মাছও মারন গেত হারা বোছর। উনা মাসে পাহাইরারা য়াটে তিগা মাছ কিন্যা আইন্যা খাইত। ১৫/২০ মাইল দূরে তনে মাঝিরা মাছ কান্দে কইরা নিয়া আইত পাহারে য়াটের দিন অইলে। এতদুর আনতে আনতে মাছ কুইয়া বকবকা অইয়া গোন্দ উইঠা যাইত। হেইন্যা ফালাই দিয়ন নাগত। তাই উনা মাসে জিওল মাছ, মাগুর মাছ, কই মাছ, ছাইতান মাছ, টেংরা, বাতাসি, গুইটা বাজাইল ছাড়া আর কিছু পাও গেত না। পাহাইরা মাইনষে জিওল মাছ, মাগুর মাছ, কই মাছ, ছাইতান মাছ বুরকা- পাইল্যায় পানি দিয়া জিয়াইয়া য়াকত। কয়দিন ভইরা য়াইন্দা খাইত। পঁচা মাছ গুলাইনের পাতা দিয়া য়াইন্দা খাইলে গোন্দ করতো না। ইন্যা খাইয়া পেট ভাটভুট করলে গোন্দবাদাইলের পাতা দিয়া হাক য়াইন্দা খাইত। বাইস্যা মাসে পাহারের ধাইরা দিয়া য়াট বইত। হেনু ভৌরারা নানান জাতের মাছ নিয়াইত বেচপার নিগা। বেশিরভাগই ছিল নোরাফেকা মাছ। পদ্মা নদীর ইলসা মাছও এই সব য়াটে নিয়াইত নাইয়ারা।

আমি যেবা কইরা মাছ মারতাম হেইন্যা হুইন্যা আন্নের মোনয়ব আমি বোধকরি বালা ছাত্র আছিলাম না। আমি খুব বালা ছাত্র আছিলাম। হেসুমকার দিনে বাটাজোর বি এম হাই স্কুল অত্র অঞ্চলের মদ্যে সব তিগা বালা স্কুল আছাল। হেই স্কুল তিগা এস এস সি পাস করছি য়েকর্ড ভাইঙ্গা, মানে আগে যারা পাস করছাল তাগ চাইতে বেশি নম্বর পাইছিলাম, জামাল স্যার কইছেন। এহন পর্যায়ের নিহি কেউ আমার নাগালা বালা এজাল্ট করপায় নাই।

আমি স্কুল তিগা আইয়া চাইরডা খাইয়া মাছেরে গেতাম। পুশ মাস তিগা জৈস্টি মাস পর্যন্ত পাহারে পানি থাকত না। তাই মাছেরে যামু কুনু? পাহারে পানি আইলে পানির নগে মাছ আইত। মাছ আইলে মাছেরে গেতাম। জৈস্টি মাসের হেষের দিকে যেদিন বেশি বিস্টি অইত হেদিন চালার বেবাক পানি ঘোনা ঘুনিতে নাইমা বাইদ ভইরা গেত। বাইদের পানিতে জোরা ভইরা গেত। জোরা অইল বাইদের মইদ দিয়া চিকন খালের নাগালা। জোরার পানি গিয়া নামত চাপরাবিলে। চাপরা বিল পানি দিয়া ভইরা গেত। চাপরা বিল উনা মাসেও হুকাইত না। হেনুকার মাছ বেশি পানি পাইয়া উজাইতে উজাইতে আংগ বাইদে আইয়া পড়ত আন্ডা পারনের নিগা। চলাচলা পুটি, হেলাম পুটি, টেংরা, গোলসা, নোন্দা, হৈল, বোয়াল, পাত্যা, ছাইতান, আগ্যা, ইচা, নোন্দা, বাইং, এবা নানান জাতের মাছ পেট ভর্তি আন্ডা নই আইত পাহাইরা হোতের মইদ্যে আন্ডা পারনের নিগা। আমরা বিস্টিত ভিজা, ছাতি মাথায় দিয়া, কলাপাতা পাথায় দিয়া, নয় মাতইল মাথায় দিয়া মাছেরে গেতাম। ক্ষেতের বাতর যেনু পানি যাওনের নিগা কাইটা দিত হেডা কইত জোর। আমরা জোরের হোতের পানিতে জালি পাইত্যা খারই থাকতাম। পানির নিচে জালির নগে ঠ্যাং ঠেহাই য়াকতাম। জালিতে মাছ ঢুইকা যেসুম ঠ্যাংগের মদ্যে গুতা মারত হেসুম জালি উচা করতাম। জালি তিগা মাছ ধইরা খালুইর মদে য়াকতাম। খালুই ভইরা যাইত মাছে। হেই মাছের পেট বোজাই আন্ডা থাকত। হেই জোরের মইদ্যে য়াইতে ঠুই পাইত্যা য়াকতাম। সক্কালে বেলা ওঠনের সোম গিয়া ঠুই চাইতাম। ঠুইয়ের আগায় হেই মাছগুনা বাইজা থাকত। ক্ষেতের বাতরে ঠুই উল্টাইয়া মাছ বাইর করতাম। খালুই ভইরা যাইত। মাছের নগে চেকমেকা, কাকরা, কুইচ্যা, টেপা, হামুক, ইন্যাও বাজত। ইন্যা বাইচ্যা পানিত ঢেইল মাইরা ফালাই দিতাম। জৈস্টি মাসে জাংলাভর্তি জিংগা, পোড়ল অইত। বাড়ির পালানে ডাংগা অইত নশনশা। মা হেইন্যা দিয়া মাছ য়ান্না করতেন। ঢলের মাছ নতুন তরিতরকারি দিয়া এবা মজাই যে নাগ ত গো, খাইয়া পেট ডিগ ডিগ করত।

আষাঢ়, শাওন, ভাদ্দর মাসে খালি বিস্টি অইত। বাইদ বোজাই পানি থাকত। পাহারের পাগার, পুস্কুনি, কুয়া, জোরা পানিতে ভইরা থাকত। এইসুম মাছগুনা বাইদে ছড়াই ছিটাই থাকত। আর মাছের পোনা গুনা বড় অইতে থাকত। হেসুম খালি ঠুই পাইত্যা মাছ ধরতাম। ভাদ্দর মাসের হেষের দিকে যখন বিস্টি কইমা যাইত হেসুম বাইদের জমিতে আমন ধানের গোছা নাগাইত। আর আগে এই জমিগুনাতে ছিল আউশ ধান। বেশি ভাগই ছিল ভাতুরি ধান। ভাতুরি ধান কাটার পর ক্ষেতে য়াল বাইয়া কেঁদা বানাইহালত। ধানের গোছা দেওনের আগে মই দিয়া ক্ষেত হোমান করন নাগত। কেঁদা ক্ষেতে মই দেওনের সূম চংগের পাছের পানি হইরা গিয়া মাছ বাইরইয়া দাফ্রাইতে থাকত। এইন্যা ধইরা ধইরা আমরা খালই বোজাই করতাম। কোমরের পিছনে খালই ঝুলাইয়া বাইন্ধা নিতাম। দুই য়াত দিয়া ধরতাম, আর খালই মইদ্যে য়াকতাম। কই মাছ গুনা কেঁদার উপর কাতাইতে থাকত। কি মজাই যে নাগত! আমি, মজি ভাই, জিন্না ভাই, সিদ্দি ভাই, এবা অনেকেই দল ধইরা হেইন্যা ধরতাম। মজি ভাই মইরা গেছে গাড়ি এক্সিডেন্ট কইরা। পাহাইরা বাইদের মাটি খুব সারিল মাটি। কয়দিনেই ধানের গোছা মোটা য়ই গেত। ক্ষেতে হেসুম টলটলা পানি থাকত। হেই পানি দিয়া নানান জাতের মাছ দৌড়াদৌড়ি করত। দেহা গেত। আমরা ক্ষেতের বাতর কাইটা জোর বানাইয়া হেনু বাইনাতি পাইত্যা য়াকতাম। বাইনাতি বাঁশের বেতি দিয়া বুনাইয়া বানান নাগত। বাইনাতির সামন দিয়া ভাটার মাছ ঢোকার পথ আছে, আবার পিছন দিক দিয়া উজাইন্যা মাছ ঢোকার পথ আছে। মাছ ঢোকপার পায়, বাইরবার পায় না। দিনাপত্তি সকালে বাইনাতি চাওয়া য়ইত। বাইনাতি পাতার সুম মুখ কাঠের, নইলে বাঁশের কচি দিয়া বন্ধ কইরা দেও য়ইত। হেইডা খুইলা মাছ খালইর মদ্যে ঢাইল্যা দেও য়ইত। বেশি ভাগ বাইনাতিত গুত্তুম আর দারকিনা মাছ বাজত। ইন্যা পিয়াজ কাঁচা, মইচ, হৌষার তেল দিয়া ভাজা ভাজা কইরা খাইলে কিবা মজাই যে নাগত গ! যেনুকার বাতর মোটা আছাল, হেনুকার বাতর ভাঙ্গাও বড় বড় আছাল। হেনু বাইনাতি না পাইত্যা বড় বড় দোয়ারি পাতন নাগত। দোয়ারি বাইনাতির নাগালা দুইমুরা চোক্কা না। দোয়ারি অইল বাসকর মোত। ইন্যাও বাঁশের হলা দিয়া বুনাইয়া বানায়।

আশ্বিন মাসে বেশি বিস্টি অইত না। ধানের গোছাগুনাও মোটা মোটা অইত। হেইন্যার ভিতর দিয়া মাছ কপ কপ করত। য়ইদের তাপে ক্ষেতের পানি ততা অই গেত। মাছগুনা যেম্মুরা গাছের ছেওয়া পড়ত হেম্মুরা আই পড়ত। আমরা স্কুল তিগা আইয়া বশ্যি নিয়া মাছেরে গেতাম। বশ্যির আধার গাত্তাম খই, কুত্তাডেউয়ার আন্ডা, নয় চেরা দিয়া। চেরাগুনারে জির কিরমিরমির নাগালা দেহা গেত। উন্যারে গাছতলের ভিজা মাটি তিগা কোদাল দিয়া কোবাইয়া বাইর কইরা ছেনি দিয়া টুকরা টুকরা কইরা কাইট্যা নিতাম। বড় বড় পিপড়াগুনারে আমরা ডেউয়া কইতাম। কুত্তার মোত অইলদা য়োংগের ডেউয়ারে কইতাম কুত্তাডেউয়া। গজারি গাছের আগায় পাতা পেঁচাইয়া কুত্তাডেউয়ায় বাহা বানাইয়া আন্ডা পারত। হেই আন্ডা দিয়া বশ্যি হালাইলে বেশি মাছ ধরত। তরুই বাঁশ দিয়া বশ্যির ছিপ বানাইতাম। না পাইলে বৌরাবাঁশের কুইঞ্চা দিয়া ছিপ বানাইতাম। খালই বুনাইতাম তল্যা বাসের বেতি দিয়া। গোছা ক্ষেতে বশ্যি ফালাইলে বড় বড় আগ্যা মাছ ধরত। পানির মদ্যে বশ্যি নাচাইলে আগ্যা মাছ ফালাই ফালাই আইয়া বশ্যির আইংটায় বাইজা পড়ত। খোট্টা দিয়া টানে তুইল্যা হালাইতাম। কোন কোনডা ছুইট্টা গিয়া আড়া জোংগলে গিয়া পইরা হাটি পারতে থাকত। পাতা খুচখুচানির শব্দ হুইন্যা আগ্যা মাছের ঘারে ধইরা খালইর মইধ্যে ভইরা ফালাইতাম। মাছ যাতে তাজাতুজা থাহে হেইজন্য জগের মইদ্যে নয় বদনার মইদ্যে পানি দিয়া জিয়াই য়াকতাম। আগ্যা মাছ জাইরা আছে৷ বদনায় য়াকলে আগ্যা মাছ হাটি মাইরা বাইরই গেত দেইখা হিসার জগে য়াকতাম। শিক্ষিত মাইন্সে আগ্যা মাছরে রাগা মাছ কইত ফ্যারাংগি দেহাইয়া। ভৌরা মাইনষে আগ্যা মাছ খাইত না। তারা গুত্তুম মাছও খাইত না। বংশি-মান্দাইরা চুইচ্চা খাইত। তারা কাছিমও খাইত। কাছিম জোংগলেও থাকত। ইন্যা খুব বড় বড় ছিল। ইন্যারে কইত দুরা।

বাইদের পানির টান পরলে মাছগুনা পাগার, জোরায় গিয়া জরা অইত। আমরা হেইন্যারে খুইয়া, জালি, জাহি জাল, নয় ছিপজাল দিয়া মাইরা খাইতাম। বিষগোটা ছেইচ্ছা পাগারে ছিটাই দিলে মাছ গাবাই উঠতো। গাবাইন্যা মাছ ধইরা আরাম পায়ন গেত। পাগারের মাছ, জোরার মাছ ইন্যা পালা মাছ আছাল না। তাই যে কেউ ইন্যা মারতে পারত। আমরা চন্দের জোরা, আলম ঠাকুরের জোরা, ওহা বেপারির জোরা, খাজাগ জোরা, নাটুগ পাগার, কলুমুদ্দি তাওইগ পাগার তিগা ভরা মাছ মারছি। ঘাট চওনার জোরায় তনে ভরা ইচা মাছ মারছি খুইয়া দিয়া দোয়াইয়া। এনুকার পানি কইমা গেলে কেঁদার নিচে বাইং মাছ বই থাকত। কেঁদা পারাইলে পায়ের নিচে পিচলা নাগত বাইং মাছ। পায়ের নিচ দিয়া য়াত দিয়া কেঁদা হুইদ্যা বাইং মাছ টানে মেইল্যা মারতাম। য়াত দিয়া ধরতে গেলে বাইং মাছ পিচিল্যা যায় গা। একবার করছিলাম কি, এবা কইরা এডা মাছ কেদাসুদ্যা মেইল্যা মারছি, হেডা গিয়া পড়ল এডা ঝোপের ভিত্তরে। আমি ঝোপের ভিতর ফুস্কি দিয়া দেহি মেলা মাইনষের কংকাল, এহেবারে ঠেংগি দিয়া য়াকছে। ডরের চোটে তাত্তারি মাছ মারন বাদ দিয়া বাইত আই পরছি। য়াইতে হুইয়া হুইয়া বাবার নগে হেই কতা কইছি। বাবা কইল যে বংশি – মান্দাইরা কলেরা-বসন্ত হইয়া বেশি মানুষ মইরা গেলে চিতায় না পুইরা এবা ঝোপের মইদ্যে পালা দিয়া য়াকত। হেইন্যা মোনয় হুকাইয়া কংকাল অইছে।

কাতিমাসে বেশি মাছ মারন গেত। বাইদের ছোট ছোট গাতায় ভরা মাছ থাকত। টিনের থালি দিয়া হেই পানি হিচ্চা মাছ ধরতাম। এলকা পানি হিস্তে কষ্ট অইত। হেইজন্যে হাজা ধইরা হিচা মাছেরে গেতাম। পানি হিচা যে যেডি ধরাহারি হেডি ধইরা নিয়াইতাম। শাজাহান ঠিকমোত চোহে দেকত না। কেঁদার মইদ্যে খালি আতাপাতা করত। এই জন্যে যদি কইতাম “শাজাহান, হিচা মাছেরে যাবি নিহি?” শাজাহান কইত “ভাগে নিলে যামু।” আমি যে বোছর সেভেনে পড়ি, হেই ১৯৭৩ সোনে, হে ট্রাক্টরের চাকার নিচে পইরা মইরা গেছে। অহনো তার নিগা আমার পরণ পোড়ে। কেঁদার মইদ্যে মাছ ধরতে গেলে শইলে কেদা নাগত। যতই বালা কইরা গোসল করতাম কানের নতির পাছে কেদা নাইগাই থাকত ধলা অইয়া। খাবার বইলে পড়ে মা হেই কেঁদা আচল দিয়া মুইছা দিত।

কাতিমাসে পাহারের পানি হুকাই গেলে সব মাছ গিয়া চাপরাবিলে জরা অইত। মাছে বিল কপকপ করত। হুনিবার মোংগলবারে চাপরাবিলে মাছ মারনের নিগা মানুষ পিল্টা পরত। হেইডারে কইত বাওয়ার মাছ। বেশি মানুষ একবারে পানিত নামলে মাছ গাবাই উঠতো। তাই ধরাও পড়ত বেশি বেশি। এই জন্য সবাই বিলে মাছেরে যাওনের নিগা ডাহাডাহি পারত। অনেকে পরভাইত তিগাই শিংগা ফুয়াইত। শিংগার ফু হুইন্যা পাহাইরা মানুষ গুনা যার কাছে যেডা আছে হেডা নিয়া ভাইংগা চুইরা আইত চাপরা বিলে। এক নগে জাহইর দিয়া বিলে নামত নানান ধরনের জিনিস নিয়া। হেন্যা অইল মোন করুন চাবি, পলো, টেপারি, ফস্কা, কোচ, খুইয়া, জালি, ছিপজাল, ঝাকিজাল, চাকজাল আরও কত কী! ইলশা মাছ ছাড়া আর যত ধরনের মাছ আছে সব পাও গেত এই বিলে। খালইর চাইরমুরা পাটখরির মোঠা বাইন্দা দিত যাতে খালই পানিত ভাইসা থাহে। বড় বড় খালই ভইরা মাছ আইন্যা উঠানে ঢাইল্যা দিত। মেওপোলা মাইনষে হেইন্যা দাও বটি দিয়া কুইটা পাট খরিতে গাইতা দড়ি দিয়া ঝুলাইয়া অইদে হুকাইয়া হুটকি কইরা য়াকত নাইন্দার মইদ্যে। খাইত কয় মাস ধইরা। চাপরা বিলের আশে পাশের পাহাইরা গ্রামের মানুষ তিগা নিয়া হেম্মুরা হেই আংগারগাড়া পর্যন্ত মানুষ চাপরা বিলের মাছ মারতে আইত। হেই গেরামের নামগুনা আমি কইতাছি হুনুন – গবরচাহা, বৈলারপুর, য়ামুদপুর, বাঘেরবাড়ি, বেড়িখোলা, আন্দি, হুরিরচালা, চেল ধারা, নাইন্দা ভাংগা, গড়বাড়ি, বুড়িচালা, ইন্দাজানি, কাজিরামপুর, আদানি, ভাতগড়া,, ভুয়াইদ, পোড়াবাহা, ছিরিপুর, খুইংগারচালা, চটানপাড়া, ছোট চওনা, বড় চওনা, ঢনডইনা, হারাইসা, বাহার চালা, কাইলা, কৌচা, আড়াই পাড়া, ধলি, জামাল আটখুরা, দাইমা, ডাকাইতা, আরও ভরা গেরাম যেগ্নার কতা অহন মোনাইতাছে না। আমি হুনছি ভৌরারা চাপরা বিলে মাছেরে আইত না। আব ক্যা, তাগ কি মাছের অভাব আছে?

আংগ খালাগ বাড়ি মাইজ বাড়ি, আর বুগ বাড়ি অইল আমজানি। দুইডাই গাংগের পারে। বংশি নদীডারে আমরা গাং কই। আপারে আমরা বু ডাকতাম। জৈস্টি মাসের হেষের দিকে গাং পানিতে ভইরা যাইত। আমি বুগ বাইত গেলে, খালাগ বাইত গেলে বশ্যি নইয়া গাংগে মাছেরে গেতাম। আমজানির এবাদত ভাই, য়শি ভাই, হায়দার ভাই, আর মাইজ বাড়ির ইয়াছিন, ইসমাইল ভাইর নগে বশ্যি বাইতাম। ইয়াসিন ক্যান্সার অইয়া মইরা গেছে। তার নিগাও পরণ পোড়ে। আমার খালাত ভাই। বড় বড় নাইয়া বাইং, গুজা মাছ, হেলাম পুটি, বাইলা মাছ ধরত বশ্যিতে। ধরার আগে মাছে আধার ঠোকরাইত। হেসুম পাতাকাটি পানিতে নাচন পারত। তা দেইখা মোনের মইদ্যেও নাচন আইত। পাতাকাটি তল অইলে খোট্টা দিয়া মাছ তুইল্যা ফালাইতাম। বশ্যির মইদ্যে আটকাইয়া মাছ দাফরাইতে থাকত। কান্তা তিগা বশ্যি খুইলা মাছ খালইর মইদ্যে য়াকতাম। বুগ পাট ক্ষেতে চলাচলা পুটি মাছ দৌড় পাড়ত। হেইন্যা য়াত দিয়াই ধইরা ফালাইতাম। খালুই ভইরা যাইত পুটি মাছে। একটা আগ্যা মাছ ধরছিলাম দেইক্যা য়শি ভাই কয় “শালার পাহাইরায় আগ্যা মাছ ধরছে। আগ্যা মাছ মাইনষে খায়?” অশি ভাই দুলাভাইর চাচত ভাই। হেও মইরা গেছেগা। আগন পুষ মাসে গাংগের পানি কুইমা যাইত। কয়জনে মিল্যা গাংগে ঝার ফালাইত। হেই ঝারে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইর মাছ, চিতল মাছ জরা অইত। ডল্যা জাল, নয় ঝাকি জাল, নয় চাক ঝাল দিয়া হেইন্যা ধরত। দুলাভাইরা কয়জনে ভাগে গাংগে ঝার ফালাইছাল। হেই ঝার তনে একটা মস্ত বড় পাংকাশ মাছ

ধরছাল। হেইডা কাইটা ভাগ কইরা নিছাল দুলাভাইরা। হেসুম বু আংগ বাইত্যে আছাল। দুলাভাই হেন তিগা এক ভাগা আংগ বাইত্যে নিয়াইছাল। আমি হেসুম দুল্যা আছিলাম। পাংকাশ মাছের নাম হেদিন হুনলাম। হায়রে মজা নাগছাল হেইডা!

আংগ নানিগ বাড়ি অইল ভরে, য়ৌয়া গেরামে। শিক্ষিত মাইনষে কয় রৌহা। হেনু গিয়াও মাছেরে গেছি। য়াইত কইরা আন্ধাইরের মইদ্যে বোরো ধান ক্ষেতের বাতর দিয়া আইটা যাওনের সোম হলক ধরাই যাইতাম। হলকের আলো দেইখা হৈল মাছ আইগাই আইত। কাছে আইয়া চাই থাকত। হেসুম ফস্কা দিয়া ঘাও মাইরা ধইরহালতাম। যাগ ফস্কা না থাকত তারা পাট কাটনের বাগি দিয়া কোপ মাইরা হৈলের ঘার কাইটাহালত। হৈল মাছ, সাইতান মাছ এক ঝাক পোনা নিয়া ঘুরাঘুরি করত। হেই পোনা খুইয়া দিয়া খেও দিয়া মারতাম। পোনামাছ ভাজি খুব বাসনা করত। এহন বুঝি উগ্না মারন ঠিক অয় নাই।

বাইস্যা মাসে আমি, ফজু ভাই, কাদে ভাই, নজু ডিংগি নাও নিয়া হুক্নি বিলের মইদ্যে গিয়া বশ্যি ফালাইতাম। বড় বড় ফইল্যা মাছ ধরত। নজু আমার তিগা এক বোছইরা ছোট আছাল। হে ছোট বালাই য়ক্ত আমাশা অইয়া মইরা গেছে। আশিন মাসে পানি নিটাল অইয়া গেত। চামারা ধান ক্ষেতের ভিতর হল্কা মাছ খাওয়া খাইত। হেসুম পানিত ছোট ছোট ঢেউ উঠত। আমি আর ভুলু ভাই ডিংগি নাও নিয়া যাইতাম মাছেরে। আমি পাছের গলুইয়ে বইয়া নগি দিয়া নাও খোজ দিতাম। ভুলু ভাই সামনের গলুইয়ে কোচ নইয়া টায় খারই থাকত। বিলাইর নাগালা ছপ্পন ধইরা। মাছে যেই য়া কইরা কান্তা নড়াইত অবাই ভুলু ভাই কোচ দিয়া ঘাও দিয়া ধইরা ফালাইত। আমি পৌকের নাগাল পাছের গলুইয়ে বই থাকতাম। ভিয়াইল আংগ ফুবুগ বাড়ি। হেনু গিয়াও এবা কইরা মাছ মারতাম গিয়াস ভাই, মতি ভাই, সূর্যভাই, সামসু ভাই, জিয়াবুল ভাই, চুন্নু ভাইগ নগে। চুন্নু ভাই, জিয়াবুল ভাই মইরা গেছে। ভিয়াইল আংগ কাক্কুগ বাড়িও। হায়দর ভাইর নগেও এবা কইরা মাছ ধরছি। ভৌরা মাইনষে আশিন মাসে পানির দারার মইদ্যে বড় বড় খরা পাইত্যা নোড়া ফেকা মাছ মারত। ফুবার নগে গিয়া ভরা নোড়া ফেকা মাছ কিন্যা আনছি নায় চইরা। কাতি মাসে তালতলাগ বোগল দিয়া যে বিলগুনা আছাল হেইগ্নার যত মাছ গোলাবাড়ির খাল দিয়া আমজানির গাংগে গিয়া নামত। আংগ গেরামের মাইনষে হেই খালে ছিপ জাল পাইত্যা হেই মাছ ধরত। খালের পাড়ে মাচাং বাইন্দা বইয়া বইয়া ছিপজাল বাইত। এহাকজোনে বাইক কান্দে নইয়া এক মোন দের মোন গোলাবাড়ি তিগা মারা পুটিমাছ আইন্যা উঠানে ঠেংগি দিয়া ঢালত। এত মাছ কিবা কইরা মারে ইডা দেকপার নিগা আমি আর জিন্না ভাই এক নগে গোলাবাড়ি গিয়া য়াইতে মাচাংগে হুইছিলাম। যাওনের সুম দেহি হাইল হিন্দুইরা খালে গুদারা নাই। অহন পাড় অমু কিবায়? ঘাটে কোন মানুষ জোনও আছাল না। জিন্না ভাই কইল “তুই অম্মুহি চা।” আমি চাইছি। ঘুইরা দেহি জিন্না ভাই এক য়াতে কাপর উচা কইরা ধইরা আরেক য়াত দিয়া হাতুর পাইরা খাল পাড় অইতাছে। দিস্ কুল না পাইয়া আমিও কাপড় খুইলা এক য়াতে উচা কইরা ধইরা হাতুর পাইরা পার অই গেলাম। য়াসুইন না জানি। হেসুম পোলাপান মানুষ আছিলাম। কেউ ত আর আংগ দেহে নাই। শরমের কি আছে? গোলাবাড়ি গিয়া দেহি হারা খাল ভর্তি খালি ছিপ জাল। ষাইট সত্তুরডা জাল পাতছে ছোট্ট এডা খালে, ঘোন ঘোন, লাইন দইরা। বেক্কেই য়াইত জাইগা জাল টানে। দিনে বেশি মাছ ওঠে না। য়াইতে নিটাল থাকে দেইখা মাছ খালে নামতে থাহে। দিনে বেক্কেই ঘুমায়। আমি আউস কইরা কয়ডা খেও দিছিলাম। অত বড় জাল আমি তুলবার পাই নাই। তাত্তারি মাচাংগে গুমাই পড়ি। হেষ আইতে ঘুম ভাইংগা যায় জারের চোটে। কাতি মাস অইলে কি অব, য়াইতে জার পড়ত। দেহি য়াত পাও টেল্কায় শান্নিক উইঠা গেছে গা। বিয়ান বেলা কোন মোতে কোকাইতে কোকাইতে বাইত আই পড়লাম। এন্তিগা এবা সর্দি নাগল গ, এক হপ্তা পর্যন্ত সর্দি জ্বর বাইছিল। জ্বর নিয়া কাতি মাসে বিয়ানবেলা য়ইদ তাপাইতে বালাই নাগত। এক নাক ডিবি ধইরা বন্ধ অই থাকত। নজ্জাবতি ফুলের বোটা ছিড়া নাকে হুরহুরি দিলে বাদা আইত। হাইচ্চ দিলে নাক বন্ধ খুইলা গেত। জোড়ে জোড়ে নাক ঝাইরা পরিস্কার করতাম। আমি গোলাবাড়ি একবারই গেছিলাম।

গোলাবাড়ির মাছ মারা নিয়া এডা মজার কতা কই। একবার এডা মেওপোলা য়োগী নিয়া আইল এক বেটা আংগ এলাকা তিগা। কাগজপাতি ঘাইটা দেকলাম সখিপুর আর টাঙ্গাইল তিগা ভরা টেহার পরীক্ষা করছে। খালি টেহাই গেছে। আমি কইলাম “ভরাইত পরীক্ষা করছুইন।” বেটাডায় য়াগ কইরা কই উঠলো “আন্নেরা সখিপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিং য়োগীগ কাছ তিগা টেহা নিয়নের নিগা গোলাবাড়ির খালের মতো জাল ফালাইছুন ক্লিনিক কইরা। গোলাবাড়ির খালে যেবা উজান ভাটি সব জালেই হোমানে মাছ বাজে, হেবা আন্নেগ বেবাক ক্লিনিকেও গেরামের মাইনষের টেহা বাজে। বেটা মাইনষে বিদেশে কষ্ট কইরা টেহা কামাই কইরা দেশে পাঠাইতাছে, আর হেই টেহা আন্নেরা জাল পাইত্যা ছাইব্বা তোলতাছুইন। য়োগী বালা অওনের নাম নাই। খালি টেহা নিতাছুইন। ” আমি কইলাম “য়োগী ডাকতরেরা বালা করবার পাবনা। বেটির জামাইরে দেশে নিয়াই পড়ুন। দেকবাইন এবাই বালা অই যাবো গা। “

জারের দিনে নানিগ বাড়ির চহের পানি হুকাই গেত। পাগারের পানি পানায় ঢাইকা গেত। আমি আর ফজু ভাই হেই পানিত তিগা খুইয়া দিয়া দোয়াইয়া মাছ মারতাম। ফজু ভাই পানার নিচ দিয়া খুইয়া ঠেইল্যা দিত। পানা হুইদ্যা খুইয়া উচা কইরা ধরত। আমি খাবলাইয়া পানা হরাইয়া দিতাম। হেই খুইয়ায় খইলসা মাছ, চাটা মাছ, কই, জিওল, মাগুর মাছ উঠত। চাটা মাছ খইলসা মাছের নাগালা দেখতে, তে একটু ছোট। আমি চাটারে খৈলসা কইছিলাম দেইকা ফজু ভাই কইল “এই শালার পাহাইরা, চাটা মাছ চিনে না!” তিন আংগুল দিয়া মাথা আর ঘার পেইচা ঠাসি মাইরা ধরন গাগত জিওল মাছেরে। কাতা দেয় দেইকা আমি ডরে জিওল মাছ ধরহাইতাম না। একদিন সায়স কইরা ধরবার নিছিলাম। অবাই একটা কাতা খাইলাম। হায়রে বিষান নইল! বিষের চোটে উজা নাফ পারন নইলাম। কানতে কানতে নানিগ বাইত গেলাম। মামানি কাতা দিওন্যা যাগায় চুনা নাগাই দিলে বিষ কিছুডা কমল। তারপর বিষ নামাইন্যা ঝারা দিল এবা কইরা

আউরা জাউরা বিষের নাম,

কোন কোন বিষের নাম।

অ বিষ ভাটি ছাইড়া যাও।

যুদি ভাটি ছাইরা উজান ধাও,

মা পদ্মার মাথা খাও।

অ বিষ ভাটি ছাইরা যাও।

ঝারা দেওনের ভরাক্ষোন পরে বিষ কোমলে ঘুমাই পড়ি। আমি আর কূন্দিন কাতা খাই নাই। কাতা খাইয়া এডা উপুকার অইছে। য়োগিরা যেসুম কয় “য়াত পাও এবা বিষায় জানি জিওল মাছে কাতা দিছে। ” হেসুম আমি বুঝি কিবা বিষায়।

শাওন ভাদ্দর মাসে আমজানি দুলাভাইগ পালানের পাট কাটার পরে কোমর তুরি পানি থাকত। হেই পানিত চেলা, মলা, ঢেলা, বাতাসি, তিতপুটি, এবা ভরা মাছ থাকত। দুলাভাইর নগে মুশুরি টাইনা হেইন্যা ধরতাম হিসার পাইল্যা বোজাই কইরা। হিসার পাইল্যা পানিত ভাইসা থাকত। মাছ ধইরা পাইল্যায় য়াকতাম।

চৈত বৈশাখ মাসে পানি হুকাই যাইত। নানিগ বোরো ক্ষেতে হিচা দিয়া পানি হিচপার নিগা গাড়া কইরা মান্দা বানাইত। হেই মান্দা হিচা মাছ ধরতাম। অইদের তাপিসে কাঠের নাও হুকাইয়া বেহা ধইরা গেত দেইখা ইন্যারে পুস্কুনির পানিতে ডুবাই য়াকত। নায়ের পাটাতনের নিচ দিয়া মাছ পলাই থাকত। আমরা দুই তিন জোনে মিল্যা ঝেংটা টান মাইরা নাও পারে উঠাই ফালাইয়া নাও তিগা মাছ ধরতাম। মামুরা পুস্কুনিতে ডল্যা জাল টাইনা বড় বড় বোয়াল মাছ ধরত। জালে মইদ্যে বাইজ্যা হেগ্নায় হাটিহুটি পারত। মামুগ কান্দের উপুর দিয়া নাফ দিয়া যাইত গা বড় বড় বোয়াল। পুস্কুনির পাড়ে খারইয়া আমরা তামসা দেখতাম।

মাছ মারনের এবা ভরা কতা লেহন যাবো। কিন্তু এত সোময় আমার নাই। আন্নেরা ত জানুইনই আমি একজোন ডাকতর মানুষ। ডাকতরে গ কি অত সোময় আছে? একটা হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান আমি। দিনাপত্তি বিয়ানবেলা সারে আটটা তিগা বিকাল আড়াইডা পর্যন্ত হেনু কাম করন নাগে। বৈকাল চাইরডা তিগা য়াইত নয়ডা পর্যন্ত নিজের প্রাইভেট ল্যাবরেটরিতে কাম করি। হেনু গেরামে তিগা মেলা লোক আহে। তাগ নগেও কতা কওন নাগে। শুক্কুরবারে বন্ধ থাহে। হেদিন য়াবিজাবি কাম করি। চাইরডা মেডিকেল জার্নাল সম্পাদনা করন নাগে আমার। বই লেহি। কম্পিউটারের সফটওয়্যার বানাই বিক্রি করি। ছাদবাগান করি। অনলাইনে ক্লাস নেই। জুমে মিটিং করি। ইউটিউব ভিডিও বানাই। মেয়াগ নগে, নাতি নাত্নিগ নগে, বন্ধুগ নগে, শালা সুমুন্দি গ নগে ভিডিও কলে কতা কইতে য়য়। এবা আরবিলের মইদ্যে থাকি। আন্নেগ নগে মাছ মারা নিয়া আর লেহনের সোময় নাই। অহন চেম্বারে যামু, থাইগ্যা। দোয়া করুইন জানি।

১৩/৭/২০২১ খ্রি.

ময়মনসিংহ

Dipok

আমাদের ফার্স্ট বয় দীপক


দীপক। দীপক কুমার ধর। ডা. দীপক কুমার ধর। ডক্টর দীপক কুমার ধর, পিএইচডি। আমাদের এমবিবিএস ক্লাসে সব পরীক্ষায় যে ফার্স্ট হতো তার কথা মনে পড়ছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফার্স্টবয় মানে হলো অত্যন্ত মেধাবী। আমাদের সময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের গুরত্ব ছিল ঢাকার পরেই  । বড় বড় নাম করা চিকিৎসক এই কলেজ থেকেই বেরিয়েছে। আমরা ছিলাম ১৭ নাম্বার ব্যাচের। বলা হয় এম-১৭। আমাদের আগের এম-১৬ নাম্বার ব্যাচের ফার্স্টবয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল স্যার ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তী শিক্ষক। অনেকগুলি পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রী তিনি অর্জন করেছিলেন। খ্যাতির চুরান্ত সীমায় পৌছে অল্প বয়সেই ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। হিসাব করলে দেখা যাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অনেক মেধাবী ছাত্র পরবর্তীতে চিকিৎসক হয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। এই মেডিকেল কলেজে শুধু চিকিৎসা শিক্ষাই চর্চা হতো না, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপেও এখানকার ছাত্ররা বেশ পারদর্শী ছিল। এখানকার ছাত্ররা বাংলাদেশ রেডিও ও টেলিভিশনে অনেকেই ভালো পারফর্ম করে থাকে। অনেকেই ভালো কবি সাহিত্যিক। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বেশ উর্বর। সরকারি দলেরই হোক আর বিরোধী দলের পক্ষেরই হোক, এই কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক নেতারাই মুলত বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। শুধু দেশেই না, বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা ডাক্তার হয়ে রাজনীতি করে এম পি মিনিস্টার হয়ে গেছেন। ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ লোটে শেরিন এম-২৮ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দর্জিও এম-২৪ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে খোদ বাংলাদেশেরই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান এম পি এম-৩০ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। আমি আরো স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি অচিরেই আরো অনেকে এম পি মন্ত্রী হবেন প্রাক্তন এমএমসিয়ানদের থেকে। এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একজন ফার্স্ট বয় ছিল আমাদের দীপক।

দীপককে আমি প্রথম চিনলাম তার এনাটমি কার্ডে বেশী বেশী মার্ক পাওয়ার জন্য। সব সময় সে সবার থেকে বেশী মার্ক পেতো কার্ড পরীক্ষায়। আরেকটা বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করলো। সেটা হলো তার সুন্দর ঝড়ঝড়ে হাতের লেখা। একবার সদর উদ্দিন  এক বড় ভাইকে দেখিয়ে বলল “ইনি ফাইনাল ইয়ারের ফার্স্ট বয়। প্লেস করা ছাত্র। আমাদের ক্লাসের দীপকের বড় ভাই দীলিপ কুমার ধর ।” দুইজনই তুখুর ছাত্র। সেই দীলিপ দা এখন অবসর নিয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে। তিনি সেই মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছিলেন। বেশ কিছুকাল তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আমিও প্রায় ১৪ বছর এই মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছি। দীপকের ক্লাসমেট হিসাবে আমাকে বেশ স্নেহ করতেন তিনি। ক্লিনিক্যাল সেমিনারগুলিতে দীলিপ দা বেশ বিজ্ঞ ভুমিকায় অংশ গ্রহণ করতেন। তার উপস্থিতিতে সেমিনার সমৃদ্ধ হতো।
দীপক আর আমি বাঘমারার হোস্টেলের একই বিল্ডিং-এ ছিলাম প্রায় ৫ টি বছর। বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন সময় থাকলেও শেষের দিকে আমরা একই ফ্লোরে কাছাকাছি ছিলাম। দুই জনের কক্ষ দুই পাশে ছিলো। মাঝখানে ছিল ৩/৪ টি কক্ষ । তার রুমের সামনে একটা ফাকা যায়গা ছিলো। সেখানে একটি ভাংগা টেবিল ছিলো। শীতের দিনে সেখানে বসে আমরা গল্প করতাম। পড়া নিয়েও করতাম, পড়া ছাড়াও করতাম। তখন আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। দীপক কি যেন এক সিনেমা দেখেছিলো যেটা আমি দেখি নি। সেই সিনেমা দেখার পর সে আমাকে দেখেই বলতো “তালুকদার বানগিয়া।” আমি বললাম “কি সব বলছো, তালুকদার বানগিয়া।” সে বললো “আমরা একটা সিনেমা দেখেছি সেখানে নায়িকা শাবানা সুইপারের অভিনয় করে। ভিলেন খুবই পাঁজি একজন তালুকদার। শাবানার কমন একটা ডায়ালগ ছিলো তালুকদারকে উদ্যেশ্য করে “তালুকদার বানগিয়া।” তালুকদারটা পাঁজিও ছিলো। হায়রে পাঁজি! তোমাদের পুর্বপুরূষ তো তালুকদারি করেছে। তারাও কি এমন পাঁজি ছিলো?” এইভাবে কত গল্প করে সময় কাটিয়েছি দীপকের সাথে। দীপক হালকা গিটার বাজাতে পারতো। পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তো তখন সে সেই খালি জায়গায় বসে গিটারে সুর বাজাতো। গিটারের টুংটাং সুর শুনে আমিও আকৃষ্ট হয়ে তার কাছে এসে বসতাম। সে বলতো “সাদেইক্কা, নাক বাজাও।” আমি নাক দিয়ে মিউজিক বাজাতে পারতাম। কেউ না দেখলে সেই মিউজিককে গিটার অথবা সাঁনাইয়ের মিউজিক মনে করতো। এই নাক আমি স্কুল কলেজে অনুষ্ঠানে অনেকবার বাজিয়েছি। পুরস্কারও পেয়েছি। এখনো পুরনো বন্ধুরা অনেকদিন পর দেখা হলে বলে “আরে, নাকের বাঁশী, কেমন আছো?”

দীপক গিটার বাজাতো। গিটারের ফাকে ফাকে গিটারের সুরে আমি নাক বাজাতাম। জমতো ভালো। দীপককে শুধু একটি গানই বারবার গাইতে ও বাজাতে শুনেছি। রবীন্দ্রসংগীত। গানটির সম্পুর্ন কখনো গাইতে বা বাজাতে তাকে শুনি নি। হয়তো প্রথম লাইন একবার, দুইবার, তিনবার বা কয়েকবার গাইলো। পরে শেষের অংশ কয়েকবার অথবা মাঝের অংশ কয়েকবার গাইলো। গাইতো কিন্তু নিচু স্বরে। দূর থেকে শুধু গিটারই শুনা যেতো।
একবার গাইতো
“দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে
আমার বাটে বটের ছায়ায়
সারা বেলা গেলো খেলে
আ আ আ আ হা আ…..।।। ”
কিছুক্ষণ বাজিয়ে আবার হয়তো গাইলো
“গাইলো কি গান
সেই তা জানে
সূর বাজে তার আমার প্রাণে।
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে।।
আ আ আ আ হা আ।।”
কিছুক্ষণ আমি বাজানোর পর ও হয়তো গাইলো
“আমি যবে জিগাই তারে
কি তোমারে দেবো আনি?
সে শুধু কয় আর কিছু নয়
তোমার গলার মালা খানি।
দেই যদি তো, কি দাম দেবে?
যায় বেলা সেই ভাবনা ভেবে।
ফিরে এসে দেখি ধুলায়
বাঁশীটি তার গেছে ফেলে। ”

আমি শুনতে শুনতে কল্পনা করতাম “রবি ঠাকুর কাছারির বেলকনিতে বসে বসে গল্প-কবিতা লিখছেন। কাছারির পাশের বটের ছায়ায় বসে গ্রামের রাখাল বাঁশী বাজাচ্ছে রাখালিয়া সূরে, যেমনটি আমি কৈশোরে শুনতাম আমাদের গ্রামে বটের তলায় অথবা জয়না গাছের গোড়ায়। অথবা পলাশতলীর হিজল তমালের নিচে। আমার সেই রাখালির সূর প্রাণে বাজতো। রবি বাবু সেই সূরের কথা কিছু বুঝতে পারতেন না। কিন্তু সেই সূর তার কানে বাজতো। যেমন বাজে আমার প্রাণে। কল্পনায় রবি বাবু বাঁশীটি চেয়েছিলেন, বিনিময়ে সে তার গলার মালাটি চেয়েছিলো। ভাবতে ভাবতে বেলা শেষ। শেষে দেখা গেলো বাঁশীটা সে ধুলায় ফেলে গেছে।” এইসব ভাবতাম গান শুনে। একসময় রুমে গিয়ে আবার পড়া শুরু করতাম মেডিসিন, সার্জারি , গাইনি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে দোতলা থেকে স্বপন, নজরুলরাও এসে যোগ দিতো আমাদের সাথে। তখন গান বাদ দিয়ে নাটক, সিনেমা ও উপন্যাস নিয়ে আলাপ হতো। স্বপন ছিল প্রথম দিকে আমাদের মধ্যে থার্ডবয়। শেষের দিকে সে সেকেন্ড ছিলো। ডা. মিজানুর রহমান স্বপন। এমবিবিএস পাস করেই মেডিসিনে এফসিপিএস করেছিলো। পরে কার্ডিওলজিতে এম ডি করেছে। সে এখন খুলনায় আছে। স্বপনের বৈশিষ্ট্য ছিল সে সব সময় শুয়ে শুয়ে পড়তো, খুব বিনোদনমুলক ম্যাগাজিন পড়তো এবং কিছু আনন্দের সংবাদ শুনলেই বলতো “দোস্তো, চলো তাইলে প্রেস ক্লাবে বিরিয়ানি খাই।” স্বপন সব পরীক্ষায়ই ঢাকা ইউনিভারসিটিতে প্লেস করেছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হয়। আমাদের সময় ৪ টি প্রফেশনাল পরীক্ষা ছিলো এমবিবিএস কোর্সে। মেধা তালিকায় প্রথম ১০ জনকে প্লেস দেয়া হয় রেজাল্টে। স্বপন ও দীপক সবগুলিতেই প্লেস করেছিলো। কোন বিষয়ে ৮০% বা তার উপরে নম্বর পেলে অনার্স মার্ক বলা হয়। দীপক, জামিল, স্বপন ওরা অনেকবার অনার্স মার্ক পেয়েছে। শেষ পরীক্ষায় প্রয়াত নাজমা গাইনিতে অনার্স মার্ক পেয়েছিলো। প্লেস পেয়েছিলো কি না জানি না। আরো কেউ প্লেস বা অনার্স পেয়েছিলো কিনা এখন আমি মনে করতে পারছি না।
জামিল ছিলো প্রথম দিকে সেকেন্ড বয়। প্লেস করতো এবং অনার্স মার্ক পেতো। ডা. হোসাইন লিসান জামিল। ক্লাসে (মরহুম) প্রফেসর আব্দুল হক স্যার প্রায়ই পড়া ধরতেন “এই, লিসান জামিল কই, লিসান বলো।” যেমনটি আমি বলে থাকি “এই মোশারফ বলো।” অথবা বলে থাকতাম “এই বাশার বলো”, “এই সাব্বির বলো”, “এই জ্যোতি বলো”, “এই সালমান বলো”, “এই লাইজু বলো” ইত্যাদি। জামিল পাস করেই কানাডা প্রবাসী হয়। আর তার সাথে দেখা হয় নি আমার। তবে কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছি।
১৯৮৫ সনের নভেম্বরে এমবিবিএস পাস করে ১৯৮৬ সনের নভেম্বরে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে আমরা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ি। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না। তাই প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমরা। আমাদের আগ পর্যন্ত যারা পাস করেছে তাদেরকে সরকার সাথে সাথে চাকরি দিয়েছে। আমাদের সময় থেকে সরকার সাথে সাথে চাকরি দিতে অপারগ হলো। বিচ্ছিন্ন ভাবে আন্দোলন করে কিছুই করা গেল না প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত। শেষে সারা দেশে দুর্বার আন্দোলন করে সব বেকার ডাক্তার এডহক ভিত্তিতে মেডিকেল অফিসার হিসাবে সরকারী চাকরি পেলাম। এদিকে এই দেড় বছরে অনেকে হতাস হয়ে অথবা ভালো ক্যারিয়ারের অথবা সুখে থাকার জন্য অথবা নিরাপদে থাকার জন্য দেশ ত্যাগ করে ইউকে, ইউএসএ, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমাল। আমি ছিলাম ঘর কোণো মানুষ। আমি এসবের চিন্তাও করতে পাড়ি নি। ইনসার্ভিস ট্রেইনিং করার সময় একটা বেতন পেতাম। সেই বেতন থেকে বাবাকেও কিছু দিতাম। মহা সংকটে পড়ে গেলাম বেকার হয়ে। এখন তো বাবার কাছে টাকা চাওয়া যাবে না। কি করব ভাবছিলাম। ঘাটাইলের কদমতলীর কাছে ছিলো আমার শশুর বাড়ী। কদমতলী বাজারে ফার্মাসিস্ট নজরুল ভাইর একটা ফার্মেসী ছিলো। তিনি অনুরোধ করে আমাকে বসালেন প্রেক্টিস করতে। ভালোই জমছিলো। কিন্তু ইচ্ছে হলো শহরে কিছু করার। তাই, একদিন কাজের সন্ধানে বের হলাম। প্রথমে গেলাম টাঙ্গাইলে এনজিও পরিবার পরিকল্পনা সমিতি হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার ব্যাচের অন্য মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা এক মেডিকেল অফিসার। তিনি ছিলেন দিনাজপুরের বর্তমান বিএমএ লিডার ডা. আহাদ ভাই। আলাপ করে বুঝলাম এখানে চাকরি নেয়া সম্ভব না। পাশেই ছিল আকুর টাকুর পাড়ায় এক মাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল নাহার নার্সিং হোম। সেখান থেকে জানিয়ে দিলেন পোস্ট খালি নেই। বায়োডাটা জমা দিয়ে যেতে বলায় একটা বায়োডাটা জমা দিয়ে চলে গেলাম মীর্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে। দেখলাম ওখানে আমাদের এম -১৭ এর ডা. সেবাব্রত ও ডা. সফি চাকরি করছে। শুনলাম যে ডা. দীপকও আছে এখানে। ঐসময় দীপকের ডিউটি না থাকায় দেখা হলো না তার সাথে। জানতে পেলাম এখানে চাকরিতে প্রবেশ করা সম্ভব না। প্রথম দিকে যোগাযোগ করার প্রয়োজন ছিলো। আফসোস নিয়ে ফিরে এলাম। ধুমছে প্রেক্টিস করলাম কদমতলীতে। দুই আড়াই মাস পর নাহার নার্সিং হোমের পরিচালক খোকা ভাই এলেন আমার কদমতলীর চেম্বারে। রোগীর ভীর দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে নিয়ে মেডিকেল অফিসারের চাকরি দিলেন। থাকার জন্য বাসা দিলেন। চাকরির পাশাপাশি বটতলায় প্রাইভেট প্রেক্টিশও করতাম। কিছুদিন পর হাসপাতালের মালিক মোয়াজ্জম হোসেন ফারুখ ভাই কাজে মুগ্ধ হয়ে আমাকে মেডিকেল ডাইরেক্টর বানিয়ে দিলেন। ১৯৮৮ সনে জুলাই মাসে সরকারি চাকরি হবার আগ পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। এক বছর বরিশালে বাকেরগঞ্জের চরামদ্দি গ্রামের সাব সেন্টারে চাকরি করেছি, আড়াই বছর নকলা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে চাকরি করে দেড় বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি করে ঢাকার শাহবাগের তদানিন্তন আইপিজিএমআর-এ এম ফিল (প্যাথলজি) কোর্স করছিলাম। এত দিনে অনেক ক্লাসমেটদেরকে ভুলতে বসেছি। বেশীভাগের সাথে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং-এর পর আর দেখা হয় নি। ১৯৯৪ কি ৯৫ সন হবে। খুব দ্রুত বেগে পিজিতে ক্লাস করতে যাচ্ছি। হঠাৎ ক্যাম্পাসের বটতলায় দীপক সামনে পড়লো। বললো
– কি, সাদেইক্কা না?
– কি, দীপইক্কা না? কই থাকো? কই থেকে এলে? কেমন আছো? সেই ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে আলাদা হলাম, নয় দশ বছর হয়ে গেলো। কেউ কারো খবর নিলাম না। আমি ক্লাসে ঢুকব, বল তাড়াতাড়ি, কি খবর?
– আমি তো কুমুদিনী হাসপাতালে প্রথম ছিলাম। ওখান থেকে মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান যাই। ওখান থেকে এমডি ও পিএইসডি করে একটি হাসপাতালে চাকরি করছি। এখানে এসেছি একটা প্রজেক্ট-এর আন্ডারে লেপারোস্কোপির উপর একটা ট্রেইনিং দেওয়াতে। আমারও সময় নেই, দোস্তো। দেখা হবে।

দীপক মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান গিয়েছিলো। আমি কোন বসুই চিনতাম না। চিনলে হয়তো আমিও  স্কলারশিপ নিয়ে জাপান যেতাম। না গিয়ে ভালো করেছি, না মন্দ করেছি, সে হিসাব এখন করছি।

তারপর অনেকদিন কেউ কারো খোজ নেই নি। এম ফিল পাস করে আমি ১৯৯৬ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ফিরে এলাম প্রভাষক পদে। ১৯৯৮ সনের মে মাসে সহকারী অধ্যাপকের পদ পেলাম। আমি এই ২১ বছর বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে এই সহকারী অধ্যাপক (প্যাথলজি) হিসাবেই আছি। ১৯৯৯ সন থেকে ইন্টার্নেট সংযোগ পাওয়ায় দীপকের সাথে আমার রেগুলার ইমেইলে যোগাযোগ হতে থাকে। ২০০২ সনের দিকে হঠাৎ দীপক ঢাকায় এসে মোবাইল করে। সে ময়মনসিংহ এসে সবার সাথে দেখা করবে বলে আমাকে যোগাযোগ করতে বলে। সে দীলিপদার বাসায় উঠে বউ বাচ্চা নিয়ে। সকালে আমার সাথে দেখা করে। সে আমার জন্য জাপান থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে আসে। বলে “আমি জানি, তুমি যেরকম ডিজিটাল হয়ে গেছো তোমার জন্য এখন ডিজিটাল ক্যামেরা দরকার।” আমি তাকে অশেষ ধন্যবাদ দিলাম। আমাদের মার্কেটগুলোতে তখন ডিজিটাল ক্যামেরার বেশ দাম ছিলো। মোবাইলে ক্যামেরা ছিলো না।

অফিস টাইমে দীপককে নিয়ে ঘুরলাম কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসে। ঘুরতে ঘুরতে জাপানের কালচার জানা হলো তার থেকে। জানা হলো জাপানে তাদের লাইফ স্টাইল। আরাম আছে প্রচুর। নিরাপত্তা আছে । নানান বিষয়ে যেগুলোতে আমার জানার আগ্রহ ছিল তা নিয়ে দীপকের সাথে হাটতে হাটতে জেনে নিলাম। সবার সাথে তো সব কথা নিয়ে আলাপ করা যায় না! বিএমএ অফিসে গিয়ে বসলাম। ওখানে দশ-বারোজন বসে গল্প করলাম। এম-১৭ ব্যাচের হাফিজ উদ্দিন রতন প্রবেশ করলো। দীপককে ইশারা দিলাম কিছু না বলতে। রতন বসে বসে অনেক্ষণ কথা বললো আর দীপকের দিকে আড়চোখে তাকালো। একসময় আমি বললাম “রতন, ওরকম আড়চোখে তাকাও কেন? মেহমানকে চিনেছো?” রতন বললো “আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেনো দেখেছি!” সবাই এক যোগে হেসে দিলো। আমি বললাম “আরে ব্যাটা, এটা দীপক।” রতন “আরে ব্যাটা, দীপক?” বলে জড়িয়ে ধরলো দীপককে। বললো “এরকম ফ্রেন্স কাটিং দাড়ি রাখছো বইলাই চিনতে পারি নি।” তারপর চললো আমাদের হৈ হল্লা। সিদ্ধান্ত হলো সন্ধায় আমরা দীপকের আগমন উপলক্ষে ইয়াংকিং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট-এ একটা পার্টি দেব এম-১৭ ব্যাচ ও তাদের ফ্যামিলি নিয়ে। আমি সবাইকে মোবাইলে ইনফর্ম করলাম, কারন আমার কাছে সবার নাম্বার ছিলো। সন্ধায় ২১ জন ব্যাচমেট সহ ৫৩ জনের একটা পার্টি হলো চাইনিজ রেস্তোরায়। দীপক বউ-বাচ্চা সাথে নিয়ে এসেছিলো। বেশ আনন্দ হলো আমাদের মধ্যে। দীপকের বাচ্চাদেরকে দেখলাম আঙ্গিনায় খেলছে। তারা নিজেদের মধ্যে জাপানী ভাষায় কথা বলছে খেলার সময়। পার্টি শেষে ফটোসেসন করে যার যার বাসায় ফিরলাম। একদিন পর গজনীতে ময়মনসিংহ বিএমএ-র পক্ষ থেকে পিকনিক ছিলো। আমি দীপককে অনুরোধ করে নিয়ে গেলাম। দীপকের ফ্যামিলি কোন কারনবশত যেতে পারলো না। আমার মেয়ের পরীক্ষা থাকার জন্য আমার ফ্যামিলিও নিতে পারলাম না পিকনিকে। ফলে আমি সারাদিন দীপককে সময় দিতে পারলাম। দীপকও আমাকে সারাদিন সময় দিতে পারলো। কত রকম আলাপ যে করলাম! দীপক জানালো যে পৃথিবীতে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় জাপানে। সেই অপারেশনে ৯ জন সার্জন অংশ গ্রহন করেন। তাদের মধ্যে দীপক একজন। তার বেশ কিছু ইন্টার্ন্যাশনাল পাবলিকেশন আছে। সে জানালো। আরো জানালো যে সে বড় বড় দামী জার্নালের অনলাইন রিভিউয়ার। বাংলাদেশে বসেও সে আর্টিকেল রিভিউয়ের কাজ করছে। আমি জানালাম যে আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ জার্নাল চেষ্টা করে প্রফেসর শাহ আব্দুল লতিফ স্যারের সহোযোগিতায় পাবমেডে ইন্ডেক্স করিয়েছি। এবং এটার ইন্টারনেট ভার্সন আমি সম্পাদনা করি। তখনি আমার প্রায় ৫০ টির মতো পাব্লিকেশন ছিলো। আমার পারফর্মেন্স শুনে সে মুগ্ধ হলো। সারাদিন আমাদের পিকনিকের হৈ হল্লা দেখে সে আবেগে আপ্লুত হলো। আমার হাত ধরে বললো
– সাদেক, তোমাদের এই আনন্দের পরিবেশ দেখে সত্যি ভালো লাগছে। আমার জাপানে থাকতে ভালো লাগছে না। যতোই সুখ থাকুক। ওটা আমার দেশ না। ঐ কালচারে বাচ্চারা থাকবে এটা আমি চাই না। আমাকে এখনই সরে আসতে হবে জাপান থেকে।
– তুমি কি আসলেই ফিরে আসতে চাচ্ছ?
– রিয়েলি বলছি। আমি যদি বাংলাদেশে নাও ফিরতে পারি তবে ইউকে অথবা ইউএসএ-তে চলে যাবো। জাপানে থাকবো না। সাদেক, তুমি আমাকে বিএসএমএমইউ-তে ঢোকার একটা ব্যাবস্থা করে দাও। যদি না পারো সিবিএমসি অথবা অন্য কোন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে এলেও ক্ষতি নাই।
– ঠিক আছে, যাকে ধরলে কাজ হবে তাকে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি চেষ্টা করলে ঢুকতে পারবে।
আমি তাকে বুঝিয়ে দিলাম কাকে ধরলে তার কাজটা হবে।

কয়েকবছর পর দীপক আবার ময়মনসিংহ এলো অল্প সময়ের জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে ফিরে আসা হলো না কেন। সে বললো “আমি অনেক চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে ঢোকার জন্য। তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে। ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট কাটতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে আমি সিএনজি অটোরিক্সায় করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার দুই পাশ থেকে দুইজন লোক উঠে চাকুর মাথা দেখিয়ে ভয় দেখিয়ে চোখে মরিচের গুড়া ঘষে দিলো। আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছিলো। কিছুই দেখতে পেলাম না। রিক্সা আমাকে নিয়ে ঘুরতে থাকলো আর ওরা আমার পকেটে যা ছিলো সব নিয়ে একসময় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে গেলো। আমি রাস্তায় পড়ে অন্ধ মানুষের মতো সাহায্য চাইলাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। রাস্তার মানুষ আমাকে রিক্সায় তুলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো। সেখানে আমার চিকিৎসা হয়। দেশের জন্য যে টুকু টান ছিলো চোখে মরিচ ডলা খেয়ে তাও চলে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ইউকেতে সেটল্ড হবো।”

তারপর ধীর্ঘদিন তার খবর নেই নি। একসময় জানলাম যে সে ইউকে-তে থাকা শুরু করেছে। তার টেলিফোন নাম্বার নেয়া হয় নি। যোগাযোগ করাও হয় নি। গত দুবছর আগে জানতে পারি দীপকের পরিবার ইউকেতে থাকে। কিন্তু দীপক চাকরি করে সৌদিআরব। শুনে আমার কাছে বেখাপ্পা মনে হলো। শুনলাম সৌদি থেকে দীপক তেমন যোগাযোগ রাখেনা বন্ধুদের সাথে। তার ফেইসবুকও নেই। গত বছর এম-১৭ ব্যাচের লিটনের নিকট থেকে জানতে পেলাম দীপক সৌদি থেকে ঢাকায় এসেছিলো অসুস্থ মাকে দেখতে। কিন্তু ঢাকায় এসে তার স্ট্রোক হয়ে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলে। বন্ধুদেরকে চিনতে পারেনা। অসংলগ্ন কথা বলে। লন্ডন থেকে তার স্ত্রী এসে দীপককে নিয়ে যায়, যেন তারা তাদের কাছে থেকে সেবা পায়। বাংলাদেশে রাখতে তারা নিরাপদ বোধ করছে না। শুনে মনটা আমার খারাপ হয়ে যায়। আর কি দীপকের সাথে কথা বলা যাবে না? ফোন করলে কি আমাকে কোনদিন চিনবে না? আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

গত ৭ই ফেব্রুয়ারি বৃ্হস্পতিবার সকাল থেকে দীপককে খুব মনে পড়ছিল। আমি এম-১৭ ব্যাচের ৭/৮ জন বন্ধুর কাছে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে দীপকের কন্টাক্ট চাইলাম। অনেকেই ‘জানে না’ লিখে জানিয়ে দিলো। স্বপন লিখলো দীপকের টেলিফোন নাম্বার। লিখলো যে দীপকের ফেইসবুক নেই। তারপর মোবাইল করে বললো
– সাদেক, তুমি লিটন ও রেজা-ইরির সাথে যোগাযোগ করতে পারো। তারা দীপকের খবর রাখে। রেজা মাঝে মাঝে লন্ডন যায়। সে দীপকের সাথে দেখা করে। শুনেছি, দীপকের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। আর তুমি ঐ নাম্বারে ফোন দিয়েও দেখতে পারো।”
আমি লিটনকে ফোন দিলাম। সে জানালো “এক বছর আগের খবর জানি। এখন কেমন আছে জানি না।” বিকেলে একঘন্টা পরপর তিনবার ফোন করলাম দীপকের নাম্বারে। ফোন রিসিভ হলো না। রাত ১২ টায় ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর ছয়টার আগে দীপকের নাম্বার থেকে কল আসায় ঘুম ভাংলো। দীপকের সাথে কথা হলো। কথা শুনে মনে হলো আমি ৭/৮ বছরের একজন বালকের সাথে কথা বলছি। শিশুসুলভ কন্ঠে ধীরগতিতে কথা বলছিল। আমার ফ্যামিলি টাঙ্গাইল বেড়াতে গিয়েছিল। কয়েকদিন আমি একা ছিলাম। একা থাকলে আমি মানষিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হই। রাজ্যের যতো স্মৃতি এসে ভির করে মাথায়। বন্ধুদের কথা মনে করে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে চায় এখনই যদি নাছিমকে ছুঁতে পারতাম! কিভাবে ছুঁব? সেতো থাকে আমেরিকা। এখনই যদি মনিরকে ছুতে পারতাম! কিভাবে ছুঁব? সেতো থাকে লন্ডনে। স্ত্রী স্বপ্না যখন কাছে থাকে তখন এসব মনে করার সময় পাই না। শুক্রবার ভোরেও একা ছিলাম। মোবাইল কানের কাছেই ছিল। মোবাইলের রিং শুনেই ঘুম ভাংগে। স্ক্রিনে দেখি Dipak M-17 calling.
– হ্যালো, আমি ময়মনসিংহ থেকে ডা. সাদেক বলছি। দীপক বলছো?
– কে?
– সাদেক, সাদেক তালুকদার, এম সেভেন্টিন ব্যাচের সাদেক। সাদেক, নজরুল, সদর ছিলাম টাঙ্গাইলের । মনে আছে?
– ও, সাদেইক্কা?
– হে, হে, সাদেক তালুকদার।
– তুমি কোথায়?
– আমার পোস্টিং কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক-এর কাছে বাড়ী করেছি। ময়মনসিংহ থেকে বলছি।
– আমাদের পুর্বের বাড়ী কিন্তু কিশোরগঞ্জ ছিলো। ওখানে যাওয়া হয় না। নজরুইল্লার কি খবর?
– নজরুল এফসিপিএস করেছে। টাংগাইল সদর হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের কনসাল্টেন্ট। বেশ নাম করেছে। টাঙ্গাইলে মেডিকেল কলেজ হয়েছে।
– বা বা!
– সদর টাঙ্গাইল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক।
– বা বা!
– ফারেজ ওখানে শিশু বিভাগের কনসাল্টেন্ট।
– বা বা! তোমরাতো ভালোই আছো!
– আমারে মনে আছে?
– আছে, আছে?
– বলতো, আমার দুই একটি ঘটনার কথা।
– তুমি নাক দিয়ে বাঁশী বাজাতে। মনে থাকবে না। অসুস্থ হওয়ার পর মনে করতে পারতাম না। এখন মোটামুটি মনে করতে পারি।
– তুমি জাপান থেকে আমার জন্য একটা গিফট এনেছিলে, মনে আছে?
– কি জেনো?
– ডিজিটাল ক্যামেরা।
– বা বা! সেটা তো অনেক দামী ছিলো!
– স্বপন খুলনা আছে। তার বড় ছেলে ডাক্তার হয়েছে। তোমার ছেলে মেয়েদের খবর কি?
– আমার মেয়েটা বড়। ও মেডিকেলে পড়ছে এখানে। আর একবছর পর ডাক্তার হবে। ছেলেটা (কি বললো ভালো বুঝা গেলো না)।
– আমি গতকাল ৩ বার কল করেছিলাম। রিসিভ কর নাই।
– এটাতো মোবাইল ফোন। কাছে ছিলো না।  কল লিস্টে মিস কল দেখে কল ব্যাক করলাম।
– এটা মোবাইল?
– হা।
– তা হলে ম্যাসেজ দিলে যাবে?
– হে, আসবে।
– তোমার ফেইসবুক নাই?
– না, নাই।
– ফেইসবুক থাকলে সহজে যোগাযোগ করা যায়। আমরা সবাই ফেইসবুকে যোগাযোগ করি। তুমি ফেইসবুক করে ফেলো।
– ফেইসবুক একাউন্ট করতে হবে।
– ইমেইল আছে?
– আছে।
– আমি এসএমএস করে আমার ইমেইল এড্রেস দিব। ইমেইল কইরো।
– এখন কয়টা বাজে তোমাদের ওখানে।
– রাত ২টা।
– এত রাতে ঘুমাও না? বৌদি কোথায়?
– ও ঘুমাচ্ছে।
– তুমিও ঘুমিয়ে পড়। পরে কথা হবে। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

কথা শেষ করে এসএমএস দিলাম আমার মোবাইল, ইমেইল, ফেইসবুক ও ওয়েবএড্রেস লিখে। মনটা কিছুটা প্রশান্তি পেলো দীপকের সাথে কথা বলতে পেরে। সারাদিন দীপক ও অন্যান্য পুরনো বুন্ধুদের কথা নতুন করে মনে পড়লো। সকাল ১০ টার দিকে স্বপনকে ফোন দিলাম। ধরলো না। জুম্মার নামাজ পড়ে এসে দেখি স্বপনের মিসকল উঠে আছে। কলব্যাক করলাম।
– সরি সাদেক, আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে সেমিনারে ছিলাম। তোমার কল শুনতে পাই নি।
– সমস্যা নেই। আমি নামাজে গিয়েছিলাম। তোমার কল ধরতে পারিনি। আমি গতকাল দীপকের নাম্বারে ৩ বার কল দিয়ে পাই নাই। আজ ভোর পৌনে ছয়টায় সে কল করেছিল। অনেক কথা হলো। চিনতে পারে। মনে আছে তার অনেক কিছু।
(বিস্তারিত বললাম)।
এরপর লিটনকে কল দিয়ে দীপকের কলের বিস্তারিত জানালাম।
রাত দশটার দিকে ফেইসবুক পোস্ট চেক করছিলাম । দেখলাম আমাদের ব্যাচের নাসিম তার প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেছে। আবারও তাকে ছুঁতে ইচ্ছে হলো। হায়! কিন্তু সে তো আমেরিকায়! ফেইসবুক পোস্ট দেখে জানতে পারলাম বড় ভাই ডা. এম এন আমিন অভিনিত টিভিতে একটা নাটক হচ্ছে । টিভি অন করে টিভি দেখা শুরু করলাম । নাটকের চেনেল খুজতে গিয়ে একেক চেনেলে একেক অনুষ্ঠানের কিছু কিছু অংশ দেখতে দেখতে নাটকের সময়ই শেষ হয়ে গেলো। সুইচ অফ করে স্বপ্নাকে মোবাইল করে শুতে গেলাম বিরক্তি নিয়ে। দোয়া পড়ে শুলাম। আল্লাহ্‌র শোকর করলাম। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, বিদ্যা অর্জন করিয়েছেন, চিকিৎসক বানিয়েছেন, প্যাথলজি বিষয়ে তখনকার উচ্চ ডিগ্রি এম ফিল অর্জন করিয়েছেন (১৯৯৫ সন), ২১ বছর আগে সহকারী অধ্যাপকের মর্যাদা দিয়েছেন, ২৭ বছর মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছেন, প্রায় ৪ হাজার ডাক্তারের শিক্ষক হবার মর্যাদা দিয়েছেন, ৮৪টি সাইন্টিফিক পাব্লিকেশন করার ক্ষমতা দিয়েছেন, অর্থ সম্পদ দিয়েছেন যথেষ্ট, পারিবারিক সুখ দিয়েছেন প্রচুর। মেধাবী গুণবতী ২ জন সন্তান দিয়েছেন। আরো কত কিছু দিয়েছে! আমি যদি ২০ বছর আগেই সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতাম! আমি যদি বিদেশ পাড়ি দিতাম! না, তা ঠিক হতো না। প্রবাসে থাকলে আমি ইচ্ছা করলেই আমার আপনজনদের পেতাম না। গত সপ্তাহেও বাড়ী গিয়ে গরীব দেখে দেখে তাদের হাতে কিছু দিয়ে এসেছি। তারা চায় নি। তারা শুধু আমার মুখের দিকে চেয়েছে। তাতেই আমি বুঝে নিয়েছি। বিদেশে থাকলে কি তা করতাম? এইসব নানাবিধ চিন্তা এসে ভির করল মাথায়। স্বপ্না পাশে থাকলে হয়তো এগুলো মাথায় আসতো না। মনে হলো গান বাজাই। চিন্তা দূর হয়ে যাক। দীপককে মনে পড়লো। তার বাজানো রবীন্দ্রসংগীত মনে পড়লো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইউটিউব-এ সার্চ দিতে লিখলাম “দূর দেশী সে”। সাজেশন আসলো “দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে”। ক্লিক করলে বেজে উঠলো “দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে, আমার বাটে বটের ছায়ায়, সারাবেলা গেলো খেলে…..। ” শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমাবার আগে শুনেছেলিম “ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশীটি তার গেছে ফেলে।”
 ৯/২/২০১৯ খ্রি.

পুনশ্চ:
আমার এই লেখাটা ফেইসবুকে প্রকাশ পাওয়ার পর অনেক বন্ধু ফোনে এবং মেসেঞ্জারে আমার সাথে কথা বলে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি দীপক তার অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মাকে দেখতে ঢাকার ভাইয়ের বাসায় আসে। এখানে এসে দীপকের কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে (হার্ট বন্ধ) ব্রেইন ডেমেজ হয় কিছুটা। বেচে উঠলেও সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। পুরাতন স্মৃতি মনে আছে তার কিন্তু নতুন স্মৃতি (রিসেন্ট মেমোরি) মনে থাকে না। ঢাকার বন্ধুদের সহায়তায় তার স্ত্রী এসে তাকে লন্ডনে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে একা চলতে পারে না। বাইরে রাস্তায় বেরুলে বাসায় ফিরতে পারবে না। কারন, তার বাসা কোন দিকে কত নাম্বার তার মনে থাকে না। কিন্তু পুরাতন কোন ঘটনা নিয়ে কথা বললে সে সব মনে করে কথা বলতে পারে। দিনে ঘুমায়। রাতে ঘুমায় না। এই জন্যই সে আমাকে রাতে কল করেছিল। আমার এই লেখার কথা দীপকের স্ত্রীকে আমার বন্ধু জামিল জানায়। বউদি লেখাটা পড়ে সেইভ করে পেন্ড্রাইভে করে নিয়ে গিয়ে বাইরের দোকান থেকে প্রিন্ট করে এনে দীপককে পড়তে দেয়। কারন দীপক ফেইসবুক চালাতে পারে না। দীপক লেখাটি পড়ে আবেগপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু আগের রাতে যে আমার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে এটা তার মনে নেই। কারন, তার ব্রেইনের রিসেন্ট মেমোরি সেন্টার লজ হয়েছে। যদি কোন দিন শুনতাম যে দীপকের রিসেন্ট মেমোরি সেন্টার ফিরে পেয়েছে!
৩/৯/২০১৯ খ্রী.

prepaidmeter

Prepaid Electricity Meter

Dr. Sadequel Islam Talukder

প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার, টোকেন নাম্বার, ভেন্ডিং এমাউন্ট, টোকেন এমাউন্ট, মিটার রিচার্জিং, ব্যাল্যান্স চেক ইত্যাদি জেনে নিন সহজ কথায়
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
Know prepaid electricity meter, token number, vending amount, token amount, meter recharging, balance check etc. in simple words
Dr. Sadequel Islam Talukder

প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার বিল মাসের প্রথম বিকাশে এত টাকা বেশী কাটে কেন এবং কেমনে?
সহজে হিসাব জেনে নিন

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

Why and how much money is spent on the prepaid electricity meter bill in the first development of the month?
Know the account easily

প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটারের ডিসপ্লে পড়ে পড়ে বিদ্যুৎ বিলের বিভিন্ন বিষয় সহজে বুঝে নিন
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
Read the display of the prepaid electricity meter and understand the various aspects of the electricity bill easily
Dr. Sadequel Islam Talukder

Surzo-banur-chheleti

সূর্যবানুর ছেলেটি


সূর্যবানু ছিল নাহার নার্সিং হোমের আয়া। তখন টাংগাইল শহরে তথা টাংগাইল জেলায় মাত্র একটি প্রাইভেট ক্লিনিক ছিল এই নার্সিং হোম। এটা ছিল আকুরটাকুর পাড়ায় একটা বড় পুকুরের পাড়ে। আশেপাশে বড় বড় আমগাছ ও নারিকেল গাছ ছিল। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে হলেও এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল সুন্দর, মনোরম । ক্লিনিকের মালিক ছিলেন টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত কাইয়ামারার নিঃসন্তান মোয়াজ্জেম হোসেন ফারুক ভাই। তিনি তার স্ত্রী নাহারের নামে এই ক্লিনিক করেন পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া জমির উপর তিন তলা বিল্ডিং-এ। পাশেই আগে থেকেই পুরাতন আধাপাঁকা একটা ঘর ছিল তাদের । সেই বাড়িটা চিকিৎসকের থাকার কাজে ব্যবহার হতো । আমি ফ্যামিলি নিয়ে সেই বাসায় থাকতাম। বাসা ভাড়া দিতে হতো না। সর্ব সাকুল্যে মাসিক বেতন ছিল আমার ১,৮৫০ টাকা। ১৯৮৮ সনের জুলাই মাসে সরকারি চাকুরি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি এক বছর এই ক্লিনিকে চাকরি করেছিলাম। আমার কর্তব্যনিষ্ঠা ও দক্ষতায় মুদ্ধ হয়ে ফারুক ভাই ছয় মাসের মাথায়ই আমাকে ক্লিনিকের মেডিকেল ডাইরেক্টর বানিয়ে দেন। তিনি ছিলেন জীবন বীমা কোম্পানির ম্যানেজার। অফিস ছিল ঢাকায়। থাকতেন ঢাকায়। প্রতিদিন তিনি আমাকে ফোন করে ক্লিনিকের খোঁজ খবর নিতেন। প্রথম দিকে ক্লিনিকে লোকশান হতো। আমি লোকশান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখিয়েছিলাম। লাভের টাকা তার হাতে তুলে দিলে তিনি টাকা ফেরৎ দিয়ে বললেন “আমার ক্লিনিক থেকে লাভ নেয়ার দরকার নেই। লাভের টাকা দিয়ে ক্লিনিকের উন্নয়ন করতে পারলেই হবে।” আমি সেই টাকা দিয়ে ক্লিনিকের রিপেয়ারিং-এর কাজ করিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশী ছিলেন আমার প্রতি। আমার সরকারি চাকরি হলে তিনি আমাকে দ্বিগুণ বেতন অফার করেছিলেন রেখে দেয়ার জন্য। আমি সেই অফার গ্রহণ করিনি।

ফারুখ ভাইর  ছোট ভাই খোকা ভাই ও তার শ্যালক দীপু ভাই ছিলেন প্রথম দিকে ক্লিনিক পরিচালনার দায়িত্বে। কর্মচারীদের বেশীরভাগই ছিল ফারুক ভাইর  প্রতিবেশী ও আত্বীয়। সামসু ও ফজলু ছিল ওয়ার্ডবয় কাম পাহারাদার। এলেঙ্গার মোতালেবকে আমি নিয়োগ দিয়েছিলাম পরে। আমীর হামজা ছিলেন রিসেপসনিষ্ট। এলেঙ্গার মজিদকে ম্যানেজার পদে আমি রিক্রুট করেছিলাম। সূর্যবানু, হ্যাপির মা (নূরজাহান) ও সাহিদা ছিল আয়া। এই তিনজনই ছিলো স্বামী-হারা অসহায় মহিলা। তাই তারা ফারুক ভাইর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। হ্যাপির মার হ্যাপিকে অল্প বয়সেই বিয়ে দেয়া হয়। তাকে আমি দেখিনি। হ্যাপির পরই এক ভাই ছিলো। তাকে নিয়ে হ্যাপির মার খুব অশান্তি ছিলো। হ্যাপির আরেকটা ভাই ছিলো ছোট ছয়-সাত বছর বয়সের। হ্যাপির মা সন্তান নিয়ে ক্লিনিকে আসতোনা। সাহিদার কোন সন্তান ছিল না। সূর্যবানুর স্বামী মারা গিয়েছিল। একমাত্র সন্তান ছিল তার ছেলে আল-আমীন। সবাই ডাকতো আলামিন। সূর্যবানু ছেলে আলামিনের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাকী জীবন বিয়ে করবে না। সূর্যবানু কাজে কর্মে ও রোগীদের প্রতি দরদী ছিলো। আমাদের বাসায় যেতো। আমার স্ত্রী তাকে পছন্দ করতো। আমার স্ত্রীর কাছে সে ছিলো ভালো মানুষ। আমার স্ত্রী ভালো মানুষ চিনতে সাধারণত ভুল করে না। সময় সময় আমার স্ত্রীকে সূর্যবানুর সাথে গল্প করতে দেখেছি।

আলামিনের বয়স ছয় কি সাত বছর ছিলো। চেহারায় মায়া মায়া ভাব ছিলো। আদর করতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু প্রকাশ্যে আদর করতাম না। কারন, আমি জানি, শিশুরা আদর করলে মাথায় উঠে। হয়তো দেখা যাবে স্টেথোস্কোপটা আমার গলায় থেকে খুলে নিয়ে তার কানে ঢুকাবে। অথবা আমার অনুপস্থিতিতে আমার চেয়ারে বসে দোল খাবে। অথবা মুল্যবান যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলা করবে। অথবা মিষ্টি ঔষধ নিজের মনে করে খেয়ে ফেলবে।  ফারুক ভাইর সামনে আলামিন পড়লে সূর্যবানুকে ধমক দিয়ে বলতেন “এই সূর্যবানু, আমি কতবার বলেছি না, যে বাচ্চা নিয়ে ডিউটিটে আসবি না।” সূর্যবানু মাথা নিচু করে থাকতো। ফারুক ভাই আমার দিকে চেয়ে বলতেন “ডাক্তার সাব, আপনি মানা করেন নাই সূর্যবানুকে বাচ্চা না নিয়ে আসতে?” আমি সূর্যবানুর দিকে চেয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে বলতাম “এই সূর্যবানু, আমি কতবার বলেছি তুমি আলামিনকে নিয়ে ডিউটিতে আসবা না। তুমি আমার কথাই শুনছো না।” সূর্যবানু মনে মনে বলতো “আপনি অমন নিষ্ঠুর হতেই পারেন না। বলবেন কি করে?” আসলে বাবা-হারা মাসুম আলামিন কি মাকে ছেড়ে একা বাড়িতে থাকতে পারে? তাই, আমি কোন দিন সূর্যবানুকে মানা করিনি। আলামিন সব সময় মায়ের কাছাকাছি থাকতো। কোন জিনিসে হাত দিত না। কোন জিনিস নষ্ট করতো না। কেউ কেউ তাকে দিয়ে ফুট ফরমায়েস করাতো। আমি করাতাম না। কারন, চাকরি করতো তার মা, সে তো না।

আলামিনের একটা মাত্র শার্ট ছিলো। হাল্কা আকাশী রঙের হাফ হাতা হাওই শার্ট। সে বেশী সময়ই ঠিক ঘরে বোতাম লাগাতে পারতো না। এক ঘরের বোতাম আরেক ঘর পর লাগাতো। তাতে শার্টের নিচের দিকে একপার্ট নিচু আরেক পার্ট উচু থাকতো। আমি বলতাম “আলামিনের শার্ট নিচের দিকে সমান না। ক্যাঁচি দিয়ে কেটে সমান করে নিও।” আলামিন বুঝতে পেড়ে সুন্দর দাঁত বের করে মুচকি হাসতো।

আলামিনকে দিয়ে বেশী ফরমাইস করাতো আজিজ ভাই। আজিজ ভাই ছিলেন প্যাথলজি ল্যাবের টেকনোলজিস্ট। ক্লিনিকের নিচ তলায় ল্যাবরেটরি ছিলো। আলামিন এই ল্যাবে যাতায়াত করতো। একদিন দেখা গেলো ল্যাবের মূল্যবান একটি কাঁচের যন্ত্র ভেঙ্গে মেঝেতে পড়ে আছে। আজিজ ভাই জোড়ে সোড়ে বলছিলেন “আমার দামী নিউবার কাউন্টিং চেম্বারটা ভাংলো কে?” সারা ক্লিনিক জুড়ে তোলপাড় করতে লাগলেন। প্রফেশনাল ঝাড়ুদারের প্রতিই সবার সন্দেহ। কিন্তু সে ভগবানের নামে কসম খেয়ে বলছিলো যে সে ভাংগেনি। একদিন পর্যন্ত সন্দেহের দৃষ্টি ঝাড়ুদারের উপরই ছিল। ঝাড়ুদার বলছিলো “বাবু, হামি গারীব হোতে পারি, হামি মিছা কথা কইতে পারিনেক।” আমি আজিজ ভাইকে মানা করে দিলাম ঝাড়ুদারে প্রতি সন্দেহ না করতে। এবার আজিজ ভাইর সন্দেহ পড়লো আলামিনের প্রতি “আলামিনই ভাংছে। এই জন্যই বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে ডিউটিতে আসা ঠিক না।” আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এবার ফারুক ভাই শুনলে আলামিনকেসহ সূর্যবানুকে তাড়াবে। আজিজ ভাই ল্যাবে এসেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করতে থাকেন “নিউবার কাউন্টিং চেম্বার ছাড়া আমি রক্ত পরীক্ষা করব কিভাবে? আমি যেনো কালকে থেকে আলামিনকে না দেখি।” আলামিনকে নানা ভাবে জিজ্ঞেস করে বের করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু না সে ভাংগেনি। সেও খুব চিন্তিত ছিল যে এবার থেকে সে তার মায়ের সাথে আসতে পারবে না। সূর্যবানুও চিন্তিত ছিলো। আমি লাঞ্চ করতে বাসায় এসেছিলাম। বাসা আর ক্লিনিক পাশাপাশি ছিল। আজিজ ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন “কেউ স্বীকার করছে না যে সে ভেংগেছে। তাইলে ভাংলো কে? তাইলে কি ভূমিকম্প হয়েছিলো?” আমি জানালা দিয়ে চিৎকার করে উত্তর দিলাম “হ্যা, হ্যা, দুই দিন আগে রাতে ভূমিকম্প হয়েছিলো। সারাদেশ কেঁপে উঠেছিলো। চিটাগাং দুইটা ভবন ধ্বসে গেছে ভূমিকম্পে। আপনার টেবিলে ঝাকুনি খেয়ে কাউন্টিং চেম্বার পড়ে গিয়ে ভেংগে গেছে।” সবাই শুনে দৌড়িয়ে এলো আজিজ ভাইর কাছে। বলাবলি হাসা হাসি হচ্ছিলো। ঝাড়ুদার ও আলামিন অভিযোগ থেকে রক্ষা পেলো। খুশীতে আমি একটু বেশীই খেলাম।

একবার কোন একটা কারনে আমি এবং ফারুক ভাই মিলে একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু সূর্যবানু বুঝতে না পেড়ে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তাতে ক্লিনিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে থাকে। আমি সূর্যবানুর উপর ক্ষেপে গিয়ে উচ্চস্বরে ধমকাতে থাকি। সূর্যবানু নিরবে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে। আলামিন সাথেই ছিলো। সে তার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে ফোঁফাতে থাকে। হটাৎ আমার দিকে আঙুল নির্দেশ করে সিনেমার নায়কের স্টাইলে বলতে থাকে “এই আমার মায়েরে কিছু কবিনা।” শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। বুঝতে পারি সন্তানের সামনে মাকে অপমান করা ঠিক হয়নি। শুধু বললাম “যাও।” আলামিন মাকে টেনে নিতে নিতে বললো “নও, মা, এনে চাকরি করবা না।” সূর্যবানুর বিদ্রোহের কথা ফারুক ভাইর কানে গেলে ফারুক ভাই নির্দেশ দিলেন সূর্যবানুকে বরখাস্ত করতে। সবাই সূর্যবানুকে পরামর্শ দিলো তোমার চাকরি থাকতে পারে যদি আমি তাকে ক্ষমা করে দেই। আমারও ইচ্ছা ছিলো তাকে রাখবো। আমি বাসায় ছিলাম বিশ্রামে। সুর্যবানু বাসায় এসে অনেকক্ষণ অনুনয় করে ক্ষমা চাইলেন। আমি কোন কথা বললাম না। আমার স্ত্রী সূর্যবানুকে বললো “যাও, কাজ করোগে। তোমার স্যার তোমাকে মাফ করে দিয়েছে।” সূর্যবানু বুঝতে পারলো যে আপার কথাই স্যারের কথা। পরদিন সব কিছু সাভাবিক নিয়মে চললো। আলামিনকে আশ্বস্ত করার জন্য তার মাথায় হাত বুলালাম। বললাম “তোমার শার্টের উচু নিচু অংশটা ক্যাঁচি দিয়ে কেটে সমান করে নাও।” আলামিন মুচকি হাসলো।

এবার রোজা হবে গ্রীষ্মককালে। ৩০ বছর আগে সেবারও রোজা হয়েছিল গ্রীষ্মকালে। প্রচুর আম ধরেছিলো ক্লিনিকের দক্ষিণ-পূর্ব কোণার আম গাছে। কঁচি কঁচি আম। ঝোকা ঝোকা ঝুলছিলো। ছাদে উঠলে হাতের কাছেই ছিলো। পেড়ে খেতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু গাছটা ক্লিনিকের বাইরের সীমানায় ছিলো। তাই, এই আম আমাদের ছিড়তে মানা। আমি ইফতার করার জন্য বাসায় গিয়েছিলাম। সবাই যার যার মতো করে ইফতার করছিলো। সূর্যবানুও দক্ষিণ পাসের দোতলা এক রুমে ইফতার করছিলো। আলামিন ছোট মানুষ। তাই রোজা রাখেনি। আলামিন মায়ের সাথে ছিলোনা। আমি মাত্র আজান দেয়ার সাথে ইফতার মুখে দিয়েছিলাম। ধরাম করে একটা শব্দ হলো ক্লিনিকের দিক থেকে। ‘আলামিন’ বলে সূর্যবানু চিৎকার করে থেমে গেলো। আমি ইফতার রেখে দৌড়িয়ে গেলাম ক্লিনিকের পূর্ব পাশে। দেখি আলামিন উপুর হয়ে পড়ে আছে চার হাত পা ছড়িয়ে কংক্রিটের রাস্তার উপর নিস্তেজ হয়ে। মুষ্ঠিতে আমের ডাল সহ আম। বুঝতে দেরী হলো না যে সবাই যখন ইফতারে ব্যস্ত আলামিন সেই সুযোগে ছাদে গিয়েছিলো আম চুরি করে ছিড়তে। আমের ঝোকা ধরে টান দিলে আমের ডালেও তাকে  বিপরীত দিকে টান দিয়েছিলো। আমের ডাল ছিড়ে আলামিনও পড়ে গিয়েছিল তিন তলা বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে। অর্থাৎ চার তলা থেকে। চার তলা থেকে সিমেন্ট-এর পাকা রাস্তায় পড়ে কেউ কি বাঁচার কথা? আলামিনের পালস ও রেস্পাইরেশন পেলাম না। দু’হাত দিয়ে কোলে করে নিয়ে গেলাম দোতলার অপারেশন থিয়েটারে। ওটি টেবিলে শুইয়ে কৃত্তিম শ্বাস প্রশ্বাস দিলাম।  বুকে হার্টের উপর মাসাজ দিলাম। পালস ফিরে এলো। শ্বাস ফিরে এলো আলামিনের। অক্সিজেন চালু করে দিলাম আলামিনের নাকে। আসার সময় দেখেছিলাম সূর্যবানু বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। শব্দ শুনে জানালা দিয়ে আলামিনকে পড়ে থাকতে দেখে সূর্যবানু এক চিৎকারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে দোতলার বারান্দায়। তাকেও ওটিতে এনে চিকিৎসা দেয়া হলো। অনেক্ষণ পর মা-ছেলের জ্ঞান ফিরে এলো। সারারাত পর্যবেক্ষণে রাখলাম। পরীক্ষা করলাম। বুকের এক্স-রে করা হলো। আল্লাহ্‌র রহমতে কোথাও কোন হাড় ভাংগা পাওয়া গেলো না। উভয়েই সুস্থ হয়ে উঠলো। মহল্লাবাসী ও সাংবাদিকরা যেন না জানতে পারে সে জন্য সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হলো। সাংবাদিকরা যদি জানতে পাড়তো তাহলে হয়তো খবর বের হতো “৪ তলা থেকে পড়ে গিয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে আলামিন নামে এক ছেলে।” শোকজ খেত ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ।

কিছুদিন পর থেকে দেখলাম আলামিন তার মায়ের সাথে আসছে না। আলামিনের কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সূর্যবানু জানালো যে তাকে খোকা ভাইর ভাইয়ের ফাস্ট ফুডের দোকানে নিয়ে গেছে।
– ওখানে কি তাকে চাকরি করতে দিলে?
– না। এতো ছোট ছেলে, চাকরি করবে কেন? তাকে নাকি খোকা ভাইর ভাইয়ের মতো মনে হয় তাই তারা নিয়ে নিয়েছে। কাজ শিখুক। বড় হয়ে তো কাজ করেই খেতে হবে।

যে ছেলে সব সময় মায়ের সাথে থাকতো সে ছেলে এখন ফাস্টফুডের দোকানে ফুট ফরমায়েশ করবে। শুনে আমার কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো।

একদিন পুরান বাস স্ট্যান্ড-এ একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলাম কিছু কিনতে। দেখি একটা টুলে আনমনে বসে আছে আলামিন। শরীরটা শুকিয়ে গেছে। সেই জামাটি গায়। কিন্তু সোজা করে বোতাম লাগানো আছে। সেলসম্যান ধমক দিয়ে আলামিনকে বললো “এই ছেরা, ঝিম ধরে বসে আছস ক্যান, পানি দে।” আলামিন বিনম্র ভাবে উঠে গিয়ে কাস্টমারকে পানি দিলো। ঘুরে আমাকে দেখে একটা কাষ্ঠ হাসি দিলো। আমার অন্তরে কোথায় যেনো ব্যাথা অনুভূত হলো।

তারও কিছুদিন পর দেখি ভিক্টোরিয়া রোডে হ্যাপির মার ছোট ছেলে ও আলামিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ফেরী করে চা বিক্রি করছে। একটা বড় ফ্লাস্কে রেডিমেড চা নিয়ে কাপে ভরে বিক্রি করছে। হ্যাপির মার ছেলের হাতে ফ্লাস্ক আর আলামিনের হাতে জগ, কাপ, গ্লাস ও টোস্ট বিস্কুট। আমাকে দেখে ইশারা দিয়ে সালাম দিয়ে দুইজনই মিটি মিটি হাসছিলো। আমিও মিটিমিটি হাসছিলাম।
– তোমরা কি করছো?
– আমরা ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করি। মায় টাকা দিছে দোকান করতে। ভালোই লাভ হয়। আমরা দুইজনে ভাগে দোকান করি।
(বুঝলাম তারা স্বাধীন ব্যবসা উপভোগ করছে)
– তোমরা পড়তে যাওনা?
– না। পইড়া কি হইব? স্যার, চা খাইন।
– না। চা খাব না।
– খাইন স্যার, একটা।
তারা দুইজনই আমাকে খুব করে ধরলো চা খেতে। আমি এক কাপ চা খেয়ে বললাম
– খুব ভালো হয়েছে।
– আরেক কাপ দেই, স্যার?
– আরে, না।
তারা দুইজনই খুব খুশী আমাকে চা খাওয়াতে পেরে। আমি পকেটে হাত দিতেই সমস্বরে দুইজন বলে উঠলো “দাম লাগবে না, স্যার। এমনি দিয়েছি।”

আমি কিছুতেই দাম দিতে পারছিলাম না। পরে বললাম যে এটা চায়ের দাম না এটা এমনি দিলাম তোমাদেরকে কিছু খাওয়ার জন্য। কত দিয়েছিলাম তা মনে নেই। তবে তখন আমার পকেটে বেশী টাকা থাকতো না। সারামাসের বেতন ছিলো মাত্র ১,৮৫০ টাকা।
তবে এটাই মনে হয় আলামিনের সাথে আমার শেষ দেখা। সেদিন তার গায়ে সেই শার্ট ছিল অসমানে লাগানো বোতাম। হাফ হাতা হাল্কা আকাশী হাওই শার্ট।

সূর্যবানু আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বেড়াতো। কোন সময় ধাওয়া কান্না শুরু করলে সূর্যবানু এসে কোলে নিতো। তার কোলে সে চুপ হয়ে যেতো। ছোট্ট মেয়েটাকে সে বুড়ি বলে ডাকতো। বেজার হয়ে থাকলে নানান ভঙ্গী করে হাসাতে চেষ্টা করতো। সরকারি চাকরি নিয়ে চলে আসার পর আমার স্ত্রী সুর্যবানুকে নিয়ে কথা বলতো। “আবার টাঙ্গাইল গেলে সূর্যবানুকে দেখে আসব” বলে মন্তব্যও করেছে অনেকবার। মাঝে মাঝে আমরা নাহার নার্সিং হোমে বেড়াতে গিয়ে সূর্যবানুকে দেখে আসতাম। সব সময়ই সুর্যবানু আমার মেয়েরা কেমন আছে কি করছে খোঁজ নিতো। আমি কখনো আলামিনের খোঁজ নেইনি। বহু বছর হয়ে গেছে সূর্যবানুর খোঁজ নেনি। বেঁচে আছে কিনা তাও জানিণনা। বেঁচে থাকলেও বয়সের ভারে তার শরীর ভেংগে যাওয়ার কথা। আলামিনের বয়স তো এখন ৩৬ সের উপরে হবে। সেকি তার মাকে কামাই করে খাওয়াচ্ছে? যে ছেলের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে। যদি কোনদিন আলামিনের সাথে দেখা হয় তবে নিশ্চয়ই আমি আগের আলামিনকে পাবো না। পাবো কি সেই মাসুম শিশু, হাল্কা আকাশী রংগের হাফ হাতা হাওই শার্ট গায়ে অসমান বোতাম লাগানো, যেমনটি দেখেছিলাম শেষবারে ভিক্টোরিয়া রোডে আলামিনকে, সূর্যবানুর ছেলেটিকে!

২৪/২/২০১৯ খ্রি.
ময়মনসিংহ- কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ জার্নি

biopsy-tissue

মানুষের মাংস কি ফ্রিজে রাখা যায়? সহজ স্বাস্থ্য কথা | Human meat can be kept in the refrigerator?

Dr. Sadequel Islam Talukder
sadequel@yahoo.com

tissue #biopsy #humansample

From this video you can learn a common mistake in keeping or storing human tissue or biopsy sample in refrigerator. histopathology test, biopsy test, cancer test etc.

How I became Journal Editor

যেভাবে মেডিকেল জার্নালের এডিটর হলাম:

১৯৯৫ সনে তদানিন্তন আইপিজিএম আর (পিজি হাসপাতাল) থেকে এম ফিল প্যাথলজি পাস করে ১৯৯৬ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্যাথলজি বিভাগের প্রভাষক পদে পদায়ন পাই। আমার এম ফিল থিসিসটি আর্টিকেল আকারে লিখে বাংলাদেশ জার্নাল অব প্যাথলজিতে সাবমিট করি। ঐ বছরই ওটা প্রকাশিত হয়। একই বছর আরও দুটি আর্টিকেল ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সনের মধ্যে ৫/৬ টি আর্টিকেল বিএমডিসি স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হলে ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নাল এর এডিটরিয়াল বোর্ডে আমাকে এডিটর করে নেন। চিফ এডিটর ছিলেন প্রফেসর ডাঃ শাহ আব্দুল লতিফ। আমি লতিফ স্যারকে এটিটিং কাজে সহযোগিতা করতে থাকি। আমি ইন্টারনেট ও ডিজিটাল কন্টেন্ট এর উপর বেশ পারদর্শী হয়ে উঠি। পাব মেড ফ্যাক্ট শীট গুলো ডাউনলোড করে এর উপর পড়াশোনা করে পাব মেড ইন্ডেক্স করার উপর জ্ঞান অর্জন করে ফেলি। ২০০০ সনেই ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নালকে পাব মেডে ইন্ডেক্স করাতে সক্ষম হই। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে

অভিনন্দন জানিয়ে আমি অনেক ইমেইল পাই। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী চিকিৎসকরা আমাদের দেশের একটি জার্নাল আন্তর্জাতিক মান পাওয়ায় আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে। আমি অনুপ্রানিত হয়ে আরও সায়েন্টিফিক কাজ কর্ম করতে থাকি। তারই ফলে এপর্যন্ত আমার ৮৭ টি রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে।

২০০৮ সনে সরকার জনস্বার্থে আমাকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে বদলি করে। ওখানে ছিলাম পূর্ণ ৮ বছর। ২০০৮ সনে কলেজটির বয়স ১৭ বছর ছিল। কলেজের কোন জার্নাল ছিল না। প্রিন্সিপাল ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম। তিনি একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং এ বললেন “আমি যখন মালয়েশিয়ায় ছিলাম তখন কোথাও গেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নালটি হাতে নিয়ে যেতাম। গর্ব করে বলতাম এটি আমাদের বাংলাদেশের পাব মেড ইন্ডেক্স জার্নাল। এই কাজটি সম্ভব হয়েছে ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার এর এক্সপার্টনেসের জন্য। আমরা তাকে এখানে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। এই সুযোগ আমরা কাজে লাগাবো।” সেদিনই আমাকে এক্সিকিউটিভ এডিটর করে দিনাজপুর মেডিকেল জার্নাল এর আত্মপ্রকাশ হয়। সেটির নাম পরিবর্তন হয়ে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ জার্নাল হয়েছে। আমি একটানা ১৬ বছর যাবত সেই জার্নাল এডিট করছি। মরহুম অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল স্যারের সহযোগিতায় ২০১৫ সনের ডিসেম্বরে আমি বদলি হয়ে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ফিরে আসি। দুর্ভাগ্যক্রমে মনছুর খলিল স্যার আমি ফিরে আসার পরপরই হন্তেকাল করেন। প্রিন্সিপাল হন অধ্যাপক ডাঃ রুহুল আমীন খান। তখন কলেজটির বয়স ৫ বছর। ওখানেও জার্নাল ছিল না। একইভাবে আমাকে এডিটর করে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ জার্নাল নামে একটি জার্নাল আত্মপ্রকাশ করলো। একটানা ৮ বছর যাবত সেই জার্নাল আমিই এডিট করছি। মাঝখানে কয়েক বছর আমি বাংলাদেশ জার্নাল অব প্যাথলজি এর এডিটরিয়াল বোর্ডের মেম্বারও ছিলাম। ২০১৭ সনে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ একাডেমি অব প্যাথলজি এর অফিসিয়াল জার্নাল জার্নাল অব হিস্টোপ্যাথলজি এন্ড সাইটোপ্যাথলজির। একটানা ৭ বছর ধরে এই জার্নালটি এডিটিং এর দায়িত্ব আমিই পেয়েছি। এদিকে ২০১৯ সনে আমি আবার ফিরে আসি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। আবার দায়িত্ব পাই ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নাল এডিটরিয়াল বোর্ড মেম্বার হিসাবে। ছিলাম ২০২১ সন পর্যন্ত। এতগুলো জার্নাল এডিট করতে গিয়ে শত শত রিসার্চসার আমার ফ্যান হয়ে গেছে। এর মাঝে আমি জীবনের এক ধরনের আনন্দ ও স্বার্থকতা খুজে পাই।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

sadequel@yahoo.com

Digital World

What is Mobile Pocket Router?

মোবাইল পকেট রাউটার কি এবং তার কি ব্যবহার তার একটা ভিডিও দেখুন।