First Posting Charamaddi Jogdan
প্রথম কর্মস্থলে যোগদান
সময়টা ১৯৮৮ সালের ২ জুলাই। পোস্টিং অর্ডার হাতে পেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথ কী হবে তার খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। এ ব্যাপারে সুলতান নামে আমার এক আত্মীয় তার সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে একটা রোড ম্যাপ করে দিল। সে ওখানে চাকরি করত।
বাসে করে সাতক্ষীরায় তার বাসায় গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে সেখান থেকে হুলার হাট গেলাম। একা জার্নি, খুব খারাপ লাখছিল। হুলার হাটে সস্তা একটা হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম।
বাথরুমের অবস্থা ভাল না থাকায় পায়খানার কাজে ওটা ব্যাবহার করলাম না। পায়খানার বেগ নিয়েই ভোর ৫ টায় রিক্সা নিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দিলাম।
ছিনতাই হবার ভয়ে ভীত ছিলাম। ঘাটে গিয়ে বসলাম। একজন দুইজন করে যাত্রী এসে বসতে লাগল।
আমি জীবনে তখনো লঞ্চ দেখিনি। আজ প্রথম লঞ্চ দেখার অভিজ্ঞতা হবে। বাসের মত কি আগে টিকিট করতে হবে? না উঠে টিকিট করতে হবে? এনিয়ে ছিল নানা দুশ্চিন্তা।
স্থির করলাম আমার মত প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্র যাত্রীরা যা করবে আমিও তাই করব। দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে একটা বড় নৌযান আসছে। উপরে লিখা “এম ভি বাপ্পী”। বুঝতে পারলাম এটাই লঞ্চ। ঘাটে ভিড়ল। দেখলাম দোতলা-নিচ তলা আছে। আমি ভদ্র লোকদের দেখাদেখি দোতলায় গিয়ে বসলাম।
বোকার মত এদিক সেদিক তাকালাম। বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলাম। লঞ্চ পূর্ব দিকে চলছিলো। পানি আর পানি। সীমাহীন পানি। জীবনে এত পানি দেখিনি। একটা লোক বেঞ্চে পা তুলে বেয়াদবের মত শুয়েছিলো। আমি তার প্রতি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এক লোক ব্রিফকেসে সুই দিয়ে খোদাই করে নাম লিখে দিচ্ছিল। আমিও পাঁচ টাকা দিয়ে নাম লিখালাম ‘সাদেক’। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
পানি দেখে খুব ভাল লাগছিল। পানিতে অনেক মহিষ দেখতে পেলাম। মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কী যেন খাচ্ছিল।
আমি জানতাম, মহিষ মাঠে ঘাস খায়। কিন্তু পানির নিচ থেকে কী খাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম “মহিষ পানির নিচ থেকে কি খাচ্ছে?”। লোকটি আমাকে অস্বাভাবিক মানুষ ভেবে উত্তর না দিয়ে সটকে পড়ল। বিপরীত দিকের বারান্দায় গিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও তাই করল।
আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ভেতরে এসে একজনকে বিষয়টি বলার পর সে বলল ”কেন? ঘাস খায়।“
আগের দুইজন তখন মনযোগ দিল। আমি জানতে চাইলাম
-পানির নিচে ঘাস জন্মায় কেমনে?
– এটাতো মাঠ। মাঠে ঘাস খাচ্ছে।
– আমি তো দেখছি সাগরের মত।
– আপনার বাড়ি কই?
(আমি ভরকিয়ে গেলাম)
– টাঙ্গাইল জেলায় সখিপুরে, পাহাড় অঞ্চলে।
পাশ থেকে একটু শিক্ষিত একজন বললেন
-আপনি বুঝি জোয়ারভাটা দেখেননি। এখন জোয়ার। ভাটার সময় মহিষ ঘাস খাওয়া শুরু করেছিলো, জোয়ারের পানিতে মাঠ ভরে গেছে, এখনো মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে।
– এখন বুঝতে পেরেছি। বইয়ে পড়েছি।
-আপনি কী করেন? কোথায় যাচ্ছেন?
– আমি ডাক্তার। সরকারি চাকরি হয়েছে। যোগদান করতে যাচ্ছি।
-এমবিবিএস ডাক্তার?
– জ্বী।
সবাই নড়েচড়ে বসে আমার দিকে মনযোগী হল। আমিও সাচ্ছন্দ্যবোধ করা শুরু করলাম। একে একে অনেকেই টুকটাক অসুখের কথা জানাল। আমি সমাধান দিলাম। আমি ওখানকার মধ্যমণি হয়ে গেলাম। যে লোকটি পা তুলে শুয়ে ছিল সেও পা নামিয়ে বসল। বলল “ডাক্তার সাব, আমার সারাক্ষণ পায়ের তলা জ্বালাপোড়া করে। কেন এমন হয়?” এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম কেন সে বেয়াদবের মত পা তুলে শুয়েছিল।
এভাবে সবার সাথে গল্প করতে করতে সকাল ১০টার দিকে বরিশাল এসে পৌঁছলাম।
সিভিল সার্জন অফিস থেকে কমিউনিকেশন লেটার নিয়ে বাসে চড়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে গেলাম। ইউএইচএফ পিওর নিকট পরিচয় দিলাম। পাশে একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ৫৪/৫৫ বছর বয়স্ক লোককে বললেন, ‘এই যে আপনার মেডিকেল অফিসার এসে গেছেন। আর চিন্তা নাই।’
আমি যোগদানপত্রে সই করে অফিস ত্যাগ করলাম। ওই লোকটি ছিল আমার সেন্টারের মেডিকেল এসিস্টেন্ট। আমরা চরামদ্দি সাব সেন্টারের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দিলাম। বরিশাল গিয়ে রাত্রিযাপন করে ছোট লঞ্চে করে পরদিন চরামদ্দি যেতে হবে। বাসে যেতে যেতে আলাপ হলো। ওখানে স্টাফদের কথা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ওখানে আছে একজন পাগলা ফার্মাসিস্ট। কোথায় থাকে, কী খায়, কী পরে তার ঠিক নাই। দেখলেই বুঝবেন। আরেকজন পিওন আছে। তাকে দিয়ে কিচ্ছু করাতে পারবেন না। কিছু বললে উল্টা আপনাকেই ভয় দেখায়ে দেবে। আপনি তো অনেক দূরের মানুষ। আপনি সামলাতে পারবেন কিনা। আপনার তো আবার নতুন চাকরি। অসুবিধা হবে না, আমি আছি না?’ শুনে আমার শরীর শিরশির করে উঠল।
সন্ধ্যার সময় আমাকে একটি কমদামি বোর্ডিংয়ে নিয়ে উঠালেন। চলে গিয়ে আবার ফিরে এলেন দুইজন চোখে সুরমা দেয়া যুবক নিয়ে। বললেন, ‘পরিচয় করে দিচ্ছি, ইনি আমার বন্ধু ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার…..!’
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! ভাবলাম এই ‘বন্ধুকে’ আমি নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে।
তাদের সাথে আলাপ হল। অনেক কথার পর তারা একটা কথা বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি না? অমুককে একটু ট্যাঁক্টফুলি ম্যানেজ করতে হবে।’
তারা চলে গেলে আমি একটু বারান্দায় বেরুলাম। দেখলাম তারা পাশের রুমে দুইটি মেয়ের সাথে কেমন কেমন যেন কথা বলছে। আমি লুঙ্গী পরে বাথরুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বাইরে থেকে দরজার করা নাড়ল।
– কে?
– আমি বোর্ডিংয়ের লোক। কিছু লাগবে, স্যার? আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
– আমার কিছু লাগবে না। আমি এখন ঘুমাব। ডিস্টার্ব করবেন না।
আমার বুঝতে দেরি হল না পাশের রুমের বোর্ডারদের কারবার।
মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে রেখে তার ভাইয়ের বাসায় থাকতে গিয়েছে। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। পায়খানার বেগ থেমে গেল। বের হবার সাহস পেলাম না। গত রাতেও পায়খানা করতে পারিনি। অমনি শুয়ে পরলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সকাল সাড়ে পাঁচটায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের ডাক শোনে ঘুম থেকে উঠলাম।
ছয়টায় বরিশাল থেকে ছোট লঞ্চে উঠলাম। নয়টার দিকে কাটাদিয়া ঘাটে নামলাম। ওখান থেকে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। দুই কিলোমিটার যেতে হল নৌকায়। খালের ধারের মানুষ আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো “সাহেব কে?”
– সাহেব আমাদের চরামদ্দির নতুন ডাক্তার। এমবিবিএস। এর আগে কেউ এমবিবিএস ছিলেন না।
– আমাদের সরকারি ডাক্তার?
– জ্বী।
-খুব ভাল।
দশটার দিকে নৌকা থেকে নামলাম। তিনি দেখিয়ে বললেন ‘এটাই আপনার হাসপাতাল।’
দেখলাম ডোয়াপাকা একটি পুরাতন টিনের ঘর। সামনে বারান্দা। হাসপাতালের সামনে প্রায় একশত জন লোক। একজন উস্কো খুসকো লোক কানে একটা বিড়ি আটকানো, গায়ে রান্নাকরার ছাই লাগানো শার্ট, মাঝে মাঝে বিড়ির আগুনে গোল গোল করে ছিদ্র করে পোড়া, পেছনে লুঙ্গীর কোছে বিড়ির প্যাকেট, আমার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল ‘সাহেব কে?’
মেডিকেল এসিস্টেন্ট বললেন, ‘ইনি আমাদের নতুন অফিসার, ময়মনসিংহ বাড়ী।’
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন
-আপনি এমবিবিএস?
– জ্বী।
লোকটি লাফ দিয়ে দুই ফুট উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট বললেন,‘ইনিই আপনার ফার্মাসিস্ট’।
ফার্মাসিস্ট নেতার ভঙ্গিতে জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিতে লাগলেন-
– ভাইসব, আপনারা শান্ত হউন। আমাদের এখানে জয়েন করতে এসেছেন যিনি তিনি এমবিবিএস, যা লন্ডন থেকে পাস করতে হয়!
তিনি আগামীকাল থেকে আপনাদের দেখবেন। আজ তিনি বিশ্রাম নিবেন।
এরপর সবাই শান্ত হলেন। তিনি সবাইকে বিদায় করে আমার কাছে আসলেন।
আমি জানতে চাইলাম
– আপনাদের লেট্রিন কোথায়?
– আমাদের তো লেট্রিন নাই!
-তাহলে আপনি কী ব্যবহার করেন?
– আমি কলার পাতা দিয়ে একটু ঘেরাও করে বানিয়ে নিয়েছি।
– এটা কী?
– এটা ফ্যামিলি প্লানিং ভিজিটরের অফিস।
– এখানে লেট্রিন নেই?
– আছে। পাকা সেনিটারি লেট্রিন।
শোনে আমার তিন দিনের জমানো পায়খানার বেগ ফারাক্কা বাধের উজানের শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ধেয়ে আসা শুরু করল।
– লেট্রিনের চাবি দিন।
– ওটা পিওনের কাছে।
– পিওন কই?
-বাজারে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
– ডাকেন তাকে।
তিনি দৌঁড়ে বাজারের দিকে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন-
-পেলাম না।
– ঠিক আছে, আপনারটাই ব্যবহার করব। এক বদনা পানি আনেন।
তিনি পানি আনতে চলে গেলেন। আশার আলো দেখে আমার ওইটার বেগ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। তিনি খাবার পানির এক জগ পানি নিয়ে এলেন। আমি বললাম
– আমি তো পানি খাব না, পায়খানায় ব্যবহার করব, বদনায় পানি আনেন।
– স্যার, আমার এই জগ ছাড়া আর কিছু নাই। এইটা দিয়েই পানি খাই, এইটা নিয়েই পায়খানায় যাই।
আমার রাগে, দুঃখে বেগ নিস্তেজ হয়ে পরল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মিটিমিটি হাসছিলো। আমি মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বললাম “আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাব কই?”
ফার্মাসিস্টকে বললাম,‘যান, আমার সামনে থেকে’।
তিনি ইডিয়টের মত হেসে চলে গেলেন।
পরে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট আমাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। আমি বললাম,
-আমি এখানে থাকতে পারব না।
– চলেন আমাদের বাড়ী। এখান থেকে ৩ কিলো দূরে হবে।
– চলুন তাই হউক।
বিকালে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টের বাড়ি গেলাম। তার গ্রামের নামটা এখন মনে করতে পারছি না। গিয়েই লেট্রিনের খোঁজ নিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দিলেন। পাকা লেট্রিন। তিন দিনের জমা রাখা জিনিসগুলি ত্যাগ করতে পেরে গোপাল ভাঁড়ের মত প্রশান্তি পেলাম।
তিনদিন গোসল করিনি। অত্যন্ত গরম আবহাওয়া ছিল। গোসল করতে চাইলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে নিয়ে গেলেন। বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি আর পানি। দখিনা মিষ্টি বাতাস আসছিল। আমি শার্ট গেঞ্জি খুলে কিছুক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগালাম। অমন মিষ্টি হাওয়া আর কোথাও পাইনি।
বিকালে ঘুম দিলাম। রাতে তার ভাইয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প হল। আবার ঘুমালাম রাতে।
দুপুরের খাবার পোলাও মাংস খেয়ে বরিশাল রওনা দিলাম। বিকেল ছয়টায় ঢাকার লঞ্চে উঠলাম। ঢাকা থেকে বাসে ফিরতে হবে বাসে। হিসাব করে দেখলাম টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই কেবিনে টিকিট না করে ৩০ টাকায় ডেকের টিকিট করলাম। ব্রিফকেস থেকে লুঙ্গী বের করে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য ব্রিফকেসের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লিখা কার্ডটা উল্টিয়ে লাগালাম। ব্রিফকেস মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।
চারদিনের জার্নির ঘটনাগুলি মনে করতে করতে এক সময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
—
তারিখঃ ১৪/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি