এফএনএসি রিপোর্টের অর্থ
(স্বাস্থ্য কথা)
ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
শরীরের টিউমার বা সন্দেহ জনক ক্যান্সার অথবা ক্ষতস্থান থেকে এক সুঁই পরিমান নমুনা নিয়ে প্রসেস করে মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়াকে এফএনএসি পরীক্ষা বলা হয়। এর পূর্ণনাম হলো ফাইন নিডল এসপাইরেশন সাইটোলজি। এই পরীক্ষাটা করেন প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। নমুনা কালেকশন ক্লিনিশিয়ানও করতে পারেন। তবে একই প্যাথলজিস্ট কালেকশন ও পরীক্ষা করলে রোগ ডায়াগনোসিস করা বেশী সঠিক হয়। এই রিপোর্টে মাইক্রোস্কোপিক ফাইন্ডিং বিস্তারিত লেখা থাকে। তবে যিনি রিপোর্ট দেখেন তিনি সাধারণত কমেন্ট বা ডায়াগনোসিস সেকশনটাই দেখে থাকেন। কমেন্ট সেকশনে “প্লিজ, সি দা ডেস্ক্রিপশন” লেখা থাকলে সব সেকশন পড়ে দেখেন। তবে সাধারণ মানুষও তার নিজের এফএনএসি রিপোর্ট-এর অর্থ বুঝতে চান। তাই আমি আজ সাধারনের জন্য এফএনএসি রিপোর্ট-এর কয়েকটা নমুনা কমেন্ট লেখে তার অর্থ লেখার চেষ্টা করছি। কোন কোন এলাকার সাধারণ লোকের মধ্যে ইংরেজি টার্ম-এর অর্থ নিয়ে সমস্যা আছে আমি তা লক্ষ্য করেছি। আমরা জানি নর্মাল মানে স্বাভাবিক। কিন্তু এমনও লোক আছে তারা নর্মালকে “ভালো না” মনে করে। যেমন বলে “তার বাবার অবস্থা নর্মাল।” বুঝাতে চায় তার বাবার অবস্থা ভালো না। কাজেই কমেন্টে নর্মাল লিখলে তিনি মনে করবেন এবনর্মাল। নেগেটিভ মানে নাই। নিল মানে নাই। পজিটিভ মানে আছে। পজিটিভ ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। তেমনি, নেগেটিভ ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। দেখতে হবে কী পজিটিভ বা কী নেগেটিভ। আমি একবার একটা এফএনএসি রিপোর্ট-এ নেগেটিভ ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল লিখেছিলাম। রোগীর স্বামী রিপোর্ট পড়ে মন খারাপ করে বললেন
– নেগেটিভ হয়েই গেলো!
– হ্যা, নেগেটিভ।
– আমার ভাগ্যটাই খারাপ। প্রথম বউটা সন্তান ডেলিভারি হবার সময় মারা গেলো। এই বউটাও নেগেটিভ।
– তাতে, মন খারাপের কি আছে?
– নেগেটিভ মানে তো মাইনাস। তার মানে আমার স্ত্রী নেগেটিভ। তাই না?
– না, তা না। মানে আপনার স্ত্রীর ক্যান্সার নেগেটিভ, মানে, ক্যান্সার নাই।
এমনি অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী মানুষ আমাদের সমাজে আছে।
ক্লিনিসিয়ান যখন রোগী পাঠান এফএনএসি করাতে তখন এডভাইসে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস লিখে দেন সাধারণত। যাতে প্যাথলজিস্ট সেই বিষয়ের উপর বিশেষভাবে খেয়াল করেন মাইক্রোস্কোপি করার সময়। ক্লিনিসিয়ানের ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস এবং প্যাথলজিস্ট-এর প্যাথলজিকাল ডায়াগনোসিসের সমন্বয়ে ফাইনাল ডায়াগনোসিস হয়। কাজেই প্যাথলজিস্ট-এর কাছে ক্লিনিক্যাল ইনফর্মেশন থাকা ভালো। তাতে পরীক্ষার পর প্যাথলজিস্ট রোগীকেও তার রোগের পরিণতি কি হতে পারে তার একটা ধারনাও দিতে পারেন।
এফএনএসি পরীক্ষা হিস্টোপ্যাথলজি (বায়োপ্সি) পরীক্ষার সমান সঠিক না। হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করা হয় টিস্যুর নমুনা নিয়ে। আর এফএনএসি পরীক্ষা করা হয় টিস্যু থেকে মাত্র কিছু সেলের (কোষ) নিয়ে। হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল ডায়াগনোসিস-এর একুরিসি প্রায় ১০০% এর কাছাকাছি হয়। কিন্তু এফএনএসির একুরেসি তা হয় না, একটু কম হয়। তাই চিকিৎসা দেয়ার আগে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা, বিশেষ করে ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, করে নেয়া হয়।
কমেন্টে “পজিটিভ ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল” লিখার মানে হল “এফএনএসি পরীক্ষা অনুযায়ী এটা ক্যান্সার।” সেরূপ
নেগাটিভ ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল = ক্যান্সার সেল পাওয়া যায়নি। ক্যান্সার থাকতেও পারে, তবে পাওয়া যায় নি। আকাশে চাঁদ দেখা যায়নি বলে কি আকাশে চাঁদ নেই? থাকতে পারে, দেখা যায়নি হয়ত।
সাসপিসিয়াস ফর ম্যালিগন্যান্ট সেল = যে সেলগুলো পেলাম সেগুলোকে ক্যান্সার সেল বলে সন্দেহ হলো। তবে আমি নিশ্চিত না। তয় কি করা যায়? ক্লিনিক্যাল ডাটার সাথে মিলিয়ে দেখেন। মিলে গেলে ক্যান্সার। না মিললে ক্যান্সার না। হিস্টোপ্যাথলজি করে সন্দেহ দূর করা যেতে পারে।
সাজেস্টিভ অব ম্যালিগন্যান্ট সেল = সেলগুলো দেখে মনে হলো ক্যান্সার। তবে সিউর না। ক্লিনিক্যাল ডাটার সাথে মিলে গেলেই নিশ্চিত ক্যান্সার।
পসিবিলিটি অব ম্যালিগন্যান্ট সেল = ক্যান্সার সেল হওয়ার সম্ভাবনা। তবে মনের জোড় কম। ক্লিনিসিয়ান সিদ্ধান্ত নিবেন কী করবেন। আরেকবার এফএনএসি করাতে পারেন। অথবা হিস্টোপ্যাথলজি করাতে পারেন।
ইনফ্লামেশন বা প্রদাহজনিত রোগাক্রান্ত স্থান থেকে এফএনএসি করলে ইনফ্লামেটরি সেল পাওয়া যায়। বেশী ভাগ সেল নিউট্রোফিল থাকলে কমেন্টে লিখা হয় “একুট ইনফ্লামেটরি লেসন।” বেশীভাগ সেল লিম্ফোসাইট হলে কমেন্টে লিখা হয় “ক্রনিক নন-স্পেসিফিক ইনফ্লামেশন।” তবে স্মল লিম্ফোসাইটিক লিম্ফোমা এবং নন-হজকিন নামক ক্যান্সার এফএনএসি পরীক্ষায় ধরা নাও পড়তে পারে। ক্লিনিক্যালি ক্যান্সার সন্দেহ হলে বায়োপ্সি করাই ভালো। অনেক ইপিথেলিওয়েড সেল পাওয়া গেলে কমেন্টে লেখা হয় “গ্রানুলোমাটাস ইনফ্লামেশন।” এই ধরনের ইনফ্লামেশনের অনেক কারন আছে। আমাদের দেশের কমন কারন হলো টিউবারকুলোসিস। একই সাথে ইপিথেলিওয়েড সেলস, ল্যাংহ্যান্স টাইপ জায়ান্ট সেল ও ক্যাজিয়েশন নেক্রোসিস পেলে কমেন্টে লেখা হয় “কনসিস্টেন্ট উইথ টিউবারকুলোসিস।” তবে কনফার্ম না। কনফার্ম লিখতে গেলে টিউবারকিউলোসিস-এর জীবাণু পেতে হবে। ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রির সাথে মিলে গেলে অথবা এম টি পরীক্ষাও পজিটিভ হলে কনফার্ম টিউবারকিউলোসিস। ইপিথেলিওয়েড সেলস এবং ল্যাংহ্যান্স টাইপ জায়ান্ট সেল পেলেও “কনসিস্টেন্ট উইথ টিউবারকিউলোসিস।” এমনকি ইপিথেলিওয়েড সেলস এবং ক্যাজিয়েশন নেক্রোসিস পেলেও “কনসিস্টেন্ট উইথ টিউবারকিউলোসিস।” শুধু মাইক্রোস্কোপিক ফাইন্ডিং দিয়ে সাইটলজিক্যাল ডায়াগনোসিস করা না গেলে ক্লিনিসিয়ানের ডাগনোসিসের পক্ষে মাইক্রোস্কোপি ফাইন্ডিং-এর মিল থাকলে তখন লেখা হয় “কম্পাটিবল উইথ…..। ” যেমন “কম্পাটিবল উইথ টিউবারকুলোসিস।” এমন অনেক টার্ম আছে এফএনএসি রিপোর্ট-এ। এই টার্মগুলোর সঠিক অর্থ বুঝতে না পাড়ার কারনে অনেক রোগী প্যাথলজি রিপোর্ট নিয়ে ভুল বুঝে থাকে। আমার এই লেখাটা পড়লে আশা করি সেই ভুল বুঝাবুঝি কমে যাবে।
১২/১০/২০১৯ খ্রি.
পড়ে কেমন লাগলো তার উপর ভিত্তি করে নিচের ফাইফ স্টারে ভোট দিন ক্লিক করে