আমার বড় ফুফু
আমি বুঝমান হয়ে দুইজন ফুফু পেয়েছিলাম। আমার আরও দুইজন ফুফু ছিলেন। চাচা পেয়েছিলাম একজন। আরও নাকি একজন চাচা ছিলেন। তারা বিয়ের বয়সে উপনিত হবার পর ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে একই বছর মারা গেছেন। বাবারও একই সময় জ্বর হয়েছিল। ম্যালেরিয়ায় বাবাকে মারতে পারে নাই। তাই আমরা বাবাকে পেয়েছি। তারপর থেকেই বাবা রোগা রোগা হয়ে বেচেছিলেন। কম বয়সেই আমার দাদী অন্ধ হয়েছিলেন। তাই বড় ফুফুর উপর আমার বাবা চাচা ও ফুফুদের অনেক দায়ীত্ব পড়ে। বড় ফুফুর নাম ছিল মেহারন (মেহেরুন্নেসা) আর ছোট ফুফুর নাম ছিল তাহারন (তাহেরুননেসা)। বড় ফুফুর শশুরবাড়ি নিজ গ্রাম ভিয়াইলের উত্তর পাড়া তালুকদার বাড়ি। বাবার বাড়ি ভিয়াইলের দক্ষিণ পাড়ার তালুকদার বাড়ি। ছোট বেলায় আমার একটা প্রশ্ন ছিল আমার দাদা মোকসেদ আলী তালুকদার তার এই সুন্দরি মেয়েটাকে একটি কালো ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন কেন? ফুফার নাম ছিল মফিজ উদ্দিন তালুকদার। ফুফার বড় ভাই ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন তালুকদার কালিহাতি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তার ছেলে সফিকুল ইসলাম তালুকদার বাচ্চু ভাই, রফিকুল ইসলাম তালুকদার দুদু ভাই, আতিকুল ইসলাম তালুকদার নার্গিস ভাই ও তারিকুল ইসলাম তালুকদারকে আপনারা অনেকেই চেনেন। ফুফা ও ফুফার জমজ ছোট ভাই আন্তাজ আলী তালুকদার (আন্তা তালুকদার) গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। তার ছেলে চুন্নু ভাই, সেন্টু ভাই ও মিল্টনকে আপনারা অনেকেঞ্চেনেন। ফুফু ১২-১৩ জন সন্তান জন্ম দেন । তারমধ্যে ৯ জন টিকে থাকে। প্রথম ৬ জন ছেলে আর শেষের ৩ জন মেয়ে। এরা হলেন গিয়াস উদ্দিন তালুকদার বিএ, আঃ বাসেত তালুকদার সুর্য বি এ, আঃ মোত্তালেব তালুকদার মতি বি এস সি, সামসুল হক তালুকদার ইঞ্জিনিয়ার, আবুল হোসেন তালুকদার বাবলু বিএ, আসাদুজ্জামান তালুকদার জিয়াউল এমএ। আমার ফুফাতো বোনদের সবারই এসএসসি পাস করার পর বিয়ে হয়ে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারা হলো সুফিয়া, জাহানারা ও সেলিনা। ফুফুর সন্তান অনেকগুলি হলেও তার সন্তানদের সন্তান মাত্র দুই একজন করে। ফুফুর নাতী নাত্নীরা প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত, গ্রাজুয়েট অথবা পোস্টগ্রাজুয়েট। ফুফা গ্রামের মানুষ হলেও তার ৯ জন সন্তানের সবাইকে এক যোগে লেখাপড়া করিয়েছেন তখনকার যুগে। মার কাছে শুনেছি ফুফারা ছিলেন ৪ আনার তালুকদার। আর আমরা ছিলাম ২ আনার তালুকদার। সমাজে ফুফাদের বংশ মর্যাদা বেশী ছিল। ফুফার চেহারা ফুফুর সাথে ম্যাচ না করলেও দাদা মেয়ে বিয়ে দিতে রাজী হন। তাছাড়া ফুফার বাবা ফুফুকে অনেক টাকা পণ দেন এবং ১৭ রকমের দামী দামী স্বর্নের গহনা দেন।
আমার জন্ম সখিপুরের ঢনডনিয়া গ্রামের বাড়িতে। আমাকে পেটে নিয়েই মা ভিয়াইল থেকে এই বাড়িতে মাইগ্রেশন হয়ে আসেন। দাদা বেশী সময়ই আমাদের ভিয়াইলের মুল বাড়িতে থাকতেন। বাপের বাড়ি হিসাবে বড় ফুফু ভিয়াইলের বাড়িতে নাইয়র যেতেন। নিঃসন্তান ছোট দাদা ছোট ফুফু তাহারনকে মেয়ের মতো করে লালন করেছিলেন। তাই ছোট ফুফু ছোট দাদা জয়নাল আবেদীনের বাড়িতে আসতেন। এই দাদার বাড়ি আমাদের বাড়ির সাথেই ছিল। তাহারন ফুফু নাইয়র এসে আমাদের বাড়িতেই বেশী কাটাতেন। ছোট্ট বেলায় জানতাম যে আমাদের আরেকজন ফুফু আছে। তিনিই বড়। তার অনেক সন্তান। এতগুলি সন্তান নিয়ে এতদুর আসেন না। বাবার বাড়ি হিসাবে ভিয়াইলের বাড়িতেই যাতায়াত করেন। বাবা ঘনঘন ভিয়াইল যেতেন। আমি বাবাকে মিস করতাম। ফিরে এলে জিজ্ঞেস করতাম
-বাবা, কোথায় গিয়েছিলেন?
-ভিয়াইল।
-কার বাড়ি?
-তোমার দাদাবাড়ি, তোমার বড় ফুফুর বাড়ি। তোমার দাদাবাড়িতে তোমার চাচা বেলাল উদ্দিনও থাকে। সেখানে গিয়েছিলাম।
-আমি বড় ফুফুকে দেখব। বড় ফুফু আসে না কেন?
-এত দূরে আসতে চায় না। এবার মাঘ মাসে যখন তোমার নানী বাড়ি (রৌহা) যাবে সেখান থেকে তোমাকে তোমার ফুফুর বাড়ি নিয়ে যাব।
মাঘ মাসের শীতে মার সাথে নানী বাড়ি গেলাম। প্রতি মাঘেই মা বাপের বাড়ি যেতেন। সিবাহ মামা (মেঝ) এসে আমাদের নিয়ে যেতেন। একদিন বাবা এলেন তার শশুর (আমীর উদ্দিন) বাড়ি। মা আমাকে গোসল করিয়ে গায়ে তেল মেখে হাফ শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরিয়ে মাথার চুল আচরিয়ে দিলেন। বাবার সাথে রওনা দিলাম ফুফুর বাড়ি। ভিয়াইল ও রৌহার মাঝে একটা ছোট বিল আছে। এটার নাম নোকাইল। এর উপর দিয়ে এখন পাকা ব্রিজ হয়েছে। আমাকে কাঁদে বসিয়ে বাবা নোকাইল বিলের হাটু পানি পাড় হয়ে গেলেন। গিয়ে উঠলেন আমার দাদার বাড়ি। কাক্কি (চাচী) আমাকে পেয়ে খুশী হলেন। কোলে নিলেন। হায়দর আলী তালুকদার আমার চাচাতো ভাই। তিনি আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড়। তার সাথে কিছুক্ষণ কাটালাম। দেখলাম দাদাবাড়িতে লোহার একটা সিন্ধুক, কারুকাজ করা স্টিলের চেয়ার, কারুকাজ করা কাশার তৈরি বান্ধা হুক্কা, কাশার প্লেট, গ্লাস, বাটি ডিস, লোটা, বদনা, কলসি ইত্যাদি। চেয়ারেবসে পাইপ দিয়ে দাদা বান্ধা হুক্কায় ধুমপান করতেন নবাবী স্টাইলে। পক্ষান্তরে আমাদের বাড়িতে ছিল মাটি, সীসা ও চিনামাটির (পোরসেলিন) তৈরি ক্রোকারিস। পোরসেলিনের তৈরি থালা-বাসঙ্কে আমরা বলতাম করইর থালা-বাসন । এক সময় বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “এগুলো আমাদের নাই কেন?” উত্তরে বাবা বলেছিলে “এগুলির মালিক তোমার দাদা।” দাদার মৃত্যুর পর এগুলো মালিক হয়ে যান বেলাল উদ্দিন চাচা। একারনে আমাদের বাড়িতে তালুকদারির ঐতিহ্য নেই।
বিকেলে আমি ও বাবা ফুফুর বাড়িতে গেলাম। পাড়ার ভিতর দিয়ে বাড়ি পেড়িয়ে চলে গেলাম ফুফুর বাড়ি। পথে তায়েজ উদ্দিন কাক্কুদের বাড়িতে কিছুক্ষণ সময় কাটানো হয়। তায়েজ উদ্দিন কাক্কুর বাবা হাছেন দাদার সাথে বাবা কাঠের ব্যবসা করতেন। এই বাড়ির সাথে বাবার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু হাছেন দাদাকে ছোট বেলা আমি পছন্দ করতাম না। কারন, তিনি বাবাকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য নারায়নগঞ্জ যেতেন বড় বড় নৌকা ভর্তি কাঠ ও পাট নিয়ে। বড় হয়ে বুঝতে পেরে আমি তাকে খুব মুল্য দিতাম। তায়েজ কাক্কুকেও।
আমার বহুদিনের প্রতিক্ষিত ফুফুর বাড়িতে ঢুকলাম দক্ষিণ দিক থেকে। ফুফুর ঘরটা ছিল পুর্ব ভিটায় পশ্চিম মুখী। উঠানের দিকে বারান্দা দিয়ে উঠে বড় দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। উত্তর দিকের ছোট খিরকি দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ফুফু বাইরের মাটির চুলায় আমার জন্য খেজুর গুড়ের খির রান্না করছিলেন। আমাদের দেশে শীতের দিনে ঘরের বাইরে রান্না করা হতো। আমি আসবো ফুফু তা জানতেন। আগের দিন এসে বাবা বলে গিয়েছিলেন। বাবা ফুফুকে দেখিয়ে বললেন “এইটাই তোমার বড় ফুফু।” ফুফু শুনে পিছন দিকে ঘুরে উঠে পরলেন। “বাজান, আইছ?” বলে আমাকে কোলে নিলেন। বাম কোলে নিয়ে ডান হাতে ফুটুন্ত খির নাড়তে লাগলেন। সেলিনা সবার ছোট। তাকে দেখলাম ঘরের পিড়া বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। বাবা তাকে কোলে নিলেন। সেলিনা আমার সবচেয়ে ছোট ফুফাতো বোন। ডা. শরীফুল ইসলাম রানার মা। এদিকে খিরে বলক উঠে উপচিয়ে পড়ে ফসফস করতে লাগলো। ফুফু ফু দেন আর নাড়েন। ফু-এ কি আর ফসফস থামে?
রান্না ঠান্ডা হবার পর আমি খির খেতে বসলাম। আমি তাড়াতাড়ি খেতে পারতাম না। ধীরে ধীরে স্বাদ নিয়ে নিয়ে খেতাম। সবাই বলত আমি নাকি নালাইয়া নালাইয়া খাই। নালাইয়া নালাইয়া খির খেলে থালায় পানি জমে যেতো।
দেখলাম গিয়াস ভাই বারান্দায় ২২ জোড়া কবুতর পালেন। কবুতরের বাকুম বাকুম ডাক আমাকে মুগ্ধ করে। গিয়াস ভাই আমাকে খুব করে আদর যত্ন করলেন। বাবা অনেকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই খুশী আমাকে দেখে। তারাও আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন অন্যদের কাছে। কেউ বলেন “এটা পঁচুর ছোট পোলা।” কেউ বলেন “এটা দলুর ছোট ছেলে।” এরপর আমি রেগুলার ফুফুর বাড়ি যাতায়াত করতে থাকি। ফুফুকে জোড় করে ধরলাম আমাদের বাড়ি চেতে। তিনি রাজী হলেন বর্ষাকালে নৌকায় যাবেন বলে। বর্ষাকালে নৌকা যোগে তার ৯ জন সন্তান নিয়ে আমাদের বাড়ি এলেন। খুব আনন্দ হলো। নানা রকম পিঠা ও নারিকেল চিড়া পাড় খাওয়া হলো। ৬ ফুফাতো ভাই আমাদের পাড়ার চাচাতো ভাইদের সাথে হেসে খেলে কাটালেন। বিদায়ের দিন ফুফু আমাকে কোলে নিয়ে অনেকদূর গেলেন। আঁচলে চোখ মুছে মুছে কাঁদলেন। আমিও ফুফিয়ে ফুফিয়ে ফুফুর কোলে কাঁদলাম। ফুফু আঁচল থেকে কয়েকটি কয়েন আমার হাতে দিয়ে বললেন “বাজান, কিছু কিনে খেও।” সেখানে ছিল ১২ আনা। ১৬ আনায় এক টাকা হতো। তখন ৮ আনা শের (লিটার) দুধ ছিল। ১২ আনায় অনেক কিছু খাওয়া যেতো।
আমি সেই পয়সা মা-বাবাকে দেখিয়ে শীকায় ঝুলানো একটা মাটির খুটীর ভিতর রেখে দিলাম। সাবধান করে দিলাম যেন এই কয়েন কেউ না নেয়। প্রায় বছর খানি এই কয়েন ছিল সেই খুটীতে। একদিন ভাংতি পয়সার প্রয়োজনে বাবা সেই কয়েন নিয়ে নিলেন আমাকে না জানিয়ে। মার কাছে জানতে পারলাম এই সংবাদ। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়লাম। হুমকি দিলাম “আমার ফুফুর দেয়া কয়েন আমাকে ফেরৎ দিতে হবে। না হলে খাদ্য স্পর্শ করব না।” এইভাবে আমার অনশন প্রোগ্রাম শুরু হল। বাবা সেই কয়েন তো খরচ করে ফেলেছেন। ফেরৎ ফিবেন কেমনে? তিনি বেশ কিছু কাগজের নোট সাধলেন। বললেন “আরো দিব।” কিন্তু আমি আমার দাবীতে অটল। সারাদিন না খেয়ে থাকলাম। কিছু পয়সা সাথে নিয়ে সারাসিয়ার দিকে গেলাম। এক দইওয়ালা যাচ্ছিল টক দই নিয়ে। চার আনা দিয়ে এক ডুপি দই কিনে পেট ভরে খেলাম। সন্ধ্যা হলো। বাড়ি ফিরলাম। সবাই জানে আমি অনশনে আছি। কিন্তু আমার পেট দইয়ে ভরা। বু (বুবু/আপা) আমাকে বুঝিয়ে বললেন “তুমি যখন থেকে না খেয়ে আছো তখন থেকে মা না খেয়ে আছে। মার পেটবেদনা আছে। ক্ষুদা সহ্য করতে পারে না। মাকে কষ্ট দেয়া ঠিক? বাবাতো ঐ কয়েন আর ফিরে পাবেন না। ভাই, তুমি মাকে নিয়ে খাও।” আমার বুঝতে আর দেরী হলো না। আমি খেলাম।
প্রাইমারী স্কুল জীবনে অনেকবার ফুফুর বাড়ি গিয়েছি। বড় হবার সাথে সাথে পড়ার চাপ বাড়তে থাকে তাই বেশী যাওয়া হয় নি। মনে আছে বর্ষাকালে নৌকাযোগে বড় ফুফুর বাড়ি যাবার কথা। প্রতি বর্ষাতেই যেতাম বাবার সাথে। পায়ে হেটে মঙ্গলবারে ইন্দাজানী হাটে যেতাম। হাটের জিলাপি খেতে খুব স্বাদ পেতাম। রাতে নৌকায় গিয়ে বসতাম। নূরে (নুর মোহাম্মদ) কাক্কু মনোহারী দোকান করতেন। বিরাট দোকান। নৌকায় মালামাল নিয়ে আসতেন ইন্দাজানী হাটে। ফিরে যেতেন অবশিষ্ট মালামাল নিয়ে রাতে। চাপড়া বিল পর্যন্ত গেলে চৌকায় রান্না চরাতেন। ভাত ও খাসীর মাংশ রান্না হতো নৌকার চৌকায়। আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরতাম ছইয়ের নিচে। নুরে কাক্কু বাবার বাল্য বন্ধু ছিলেন। নৌকায় আরো লোক থাকতেন যারা বাবার বাল্যবন্ধু। তারা মজা করে গল্প কতেন। এক সময় বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। আমার চোখের পাতা প্রসারিত হতে চাইতো না। চোখ ঘষে ঘষে ঘুম ভাংতাম। বিলের পানি দিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে মজা করে চৌকায় রান্না গরম ভাত ঝাল খাসীর মাংশ দিয়ে খেয়ে হা হু করতাম। ঝাল না হলে নাকি খাসীর মাংশ ভালো লাগে না। আপনি যদি সেই রান্না খেতেন তা হলে বুঝতেন খাসীর মাংসের স্বাদ কাকে বলে। খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম নৌকায়। গভীর রাতে নামতাম ফুফুর বাড়ি।
বুধ থেকে রবিবার পর্যন্ত থাকতাম ফুফুর বাড়ি। ফুকা পিঠা (তেলের পিঠা) ও খির খেতাম ফুফুর হাতের। বিকেল বেলা ডিঙি নৌকা নিয়ে ভাইদের সাথে মাছ ধরতে যেতাম বরশি ও ফস্কা দিয়ে। ফুফার সাথে খরায় গিয়ে নোড়া-ফেকা মাছ নিয়ে আসতাম। সেন্টু ভাইর সাথে লুডু খেলতাম। মাঠ ভরে বাড়ির উঠান পর্যন্ত পানি এসে যেতো। বিলের দিকে তাকিয়ে কত বাদাম ওয়ালা নৌকা যে দেখতাম! রবিবারে হাটুরাদের সাথে নৌকায় চড়ে চলে যেতাম পলাশতলীর হাটে। সেখান থেকে হেটে বাড়িতে। রাস্তায় পড়তো হামিদপুর, দিঘীর চালা, নাইন্দাভাংগা, তেল ধারা, ছোট চওনা, ঢনডনিয়া ও জিতাশ্বরি।
মাঘ ফাল্গুনেও ফুফুদের বাড়ি যেতাম। ফুফুর হাতের মুঠা পিঠা, তেলের পিঠা, পাটি শাপ্টা পিঠা ও সাওই (সেমাই) পিঠা খেয়েছি। সন্ধার সময় ভাইদের সাথে ছেই (খেসারী কলাই) ও বুট (ছোলা) পোড়া খেয়েছি কাড়াকাড়ি করে, আনন্দ করে করে। ফুফুদের পালানের ক্ষেতে মিষ্টি আলুর চাষ হতো। আমি ছেনি (নিড়ানি) নিয়ে গিয়ে কঁচি আলু তুলে কচকচিয়ে খেতাম। কচি আলুর অন্য রকম স্বাদ পেতাম। বাড়ির সামনের পুকর থেকে ডল্লা জাল দিয়ে বড় বড় বোয়ালমাছ ধরতাম ভাইদের সাথে। পুকুরে ডুবা নৌকা টান দিয়ে নৌকা সেঁচে চলা চলা পুটি, পাবদা ও ছাইতান (লাটি) মাছ ধরতাম। ফুফু খুব স্বাদ করে রান্না করতেন।
আশির দশকের শেষের দিকে স্ট্রোক করে ফুফুর এক পাশ প্যারালাইজড (অবশ) হয়ে যায়। এমন একজন কর্মঠ মানুষ খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে যান। বাড়ির হাল ধরেন বড় ভাবী ডা. শহীদুল্লাহ হুমায়ুন কবীরের (এনাস্থেসিওলজিস্ট) মা। তিনি যখন এ বাড়ির বউ হয়ে আসেন তখন মাত্র ক্লাস ফোরে পড়েন। মনে আছে এই কারনে যে আমি যখন ভাবীকে দেখলাম ভাই বলছিলেন যে ভাবী আমার ক্লাসমেট। আপনারা জানেনই তো প্যারালাইসিস রোগের তেমন ভালো চিকিৎসা নেই। এই সুযোগে কবিরাজরা নানান কেরামতি দেখিয়ে থাকেন। ১৯৭৯ সনে ফুফুকে আমাদের বাড়িতে আনা হয় কবিরাজি চিকিৎসার জন্য। গফরগাঁও থেকে এক ভাঁওতাবাজ কবিরাজ আনা হয় ঝাড়ফুঁক দেয়ার জন্য। অনেক খরচ করিয়ে অনেক টাকা নিয়ে সেই কবিরাজ ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে আমি ফুফুকে দেখতে যেতাম ভিয়াইল। ইতিমধ্যে সব ভাইয়েরা পড়াশুনা শেষ করে বিয়ে করে শহরে থাকা শুরু করেছেন। এই সময় ফুফু ছেলেদের বাসায় বাসায় নাতী নাত্নীদের নিয়ে আনন্দে কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু প্যারালাইসিসের কারনে সেই স্বপ্ন পুরন হলো না। এই অবস্থায় নিজ গ্রামের বাড়িতেই তিনি থাকতে পছন্দ করেন। আমি ফুফুকে দেখতে যেতাম ডাক্তার হিসাবে এবং ভাইপো হিসাবে। ১৯৯৪ সনে ফুফু ইন্তেকাল করেন। তখন আমি ঢাকার আইপিজিএমআর (পিজি)-এ এম ফিল পড়ায় মহা ব্যস্ত। আমি জানাজায় যেতে পারি নি।
ফুফুদের বাড়িতে আমি সর্বশেষ যাই ২০১৭ সনের ১ লা মে। সবার ছোট ভাই আসাদুজ্জামান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সবার আগে চলে গেলেন। মে দিবসে সকল যানবাহন বন্ধ ছিল। আমি নানা ভাবে কষ্ট করে মময়মনসিংহ থেকে ভিয়াইল গিয়ে জানাজা ধরি। জুম্মার নামাজে অংশগ্রহণ করি। সেখানে দেখলাম কেউ কেউ আমাকে দেখে বলা বলি করছে “পঁচু ভাইর ছেলে, দলুর ছেলে, ময়মনসিংহের ডাক্তার।” তাই, আমি উঠে দাঁড়িয়ে আমার পরিচয় দিলাম “আমি এই গ্রামেরই ছেলে, আমার বাবা দলিল উদ্দিন তালুকদার। আমার দাদা মোকছেদ আলী তালুকদার ও দাদী এই গোরস্থানেই শায়িত……।” এরপর অনেকের সাথে অনেক আলাপ হলো। মনে হলো বারবার আসা উচিৎ ছিল আমার বাবার স্মৃতি বিজড়িত এই ভিয়াইল গ্রামে।
গত কালের আগেরদিন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রদের ভাইবা পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। আমার পকেটে হাত দিয়ে একটা এক টাকার কয়েন পেলাম। ছোট বেলায় কাগজের নিচে কয়েন রেখে পেন্সিল দিয়ে কিভাবে যেন ঘষে কয়েন আঁকতাম। আমি চেষ্টা করলাম কিন্তু আঁকতে পারলাম না। কয়েনটা আমার প্রিয় পরীক্ষার্থী মোশারফকে দিলাম। বললাম “এই নাও এক টাকার একটা কয়েন। আমার স্মৃতি সরূপ রেখে দিও।” এমনি এমনি বললাম হাল্কা ভাবে। বলার পড়ে অনেক কিছু মনে পড়লো। মনে পড়লো বড় ফুফুর দেয়া ১২ আনা কয়েনের কথা। ফুফুদের কথা। মনে পড়লো আজ আমার স্ত্রী স্বপ্নাকে একটা কয়েন কম দেয়া হবে। ওটা মোশারফকে দিয়েছি। আমার সব কয়েন স্বপ্না নিয়ে নেয়। স্বপ্না নূহার বড় ফুফু। অনেকদিন থেকেই স্বপ্না নূহাকে কয়েন দেয়। কয়েন দিয়ে সুখ পায়। আমি বলি “নূহা এখন বড় হয়েছে। ও কয়েন নেয়া পছন্দ করে?” স্বপ্না বলে “নুহা বড় হয়েছে নাকি?” আমি জানি ফুফুর কাছে কেউ বড় হয় না। গতকাল ফুফুর কথা খুব মনে পড়লো। সন্ধায় গিয়াস ভাইকে ফোন দিলাম। জানলাম ভাই বাড়িতে একা। ভাবী গিয়েছেন মেয়ে রানুর বাসায়। ভাবীর তিন ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে ডা. শহীদুল্লাহ হুমায়ুন কবীর বক্ষব্যধি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ এনাস্থেসিওলজিস্ট। ছেলে বউ কৃষিবিদ সরকারি অফিসার। তারা ঢাকায় থাকে। মেঝছেলে টুটুল আমেরিকা প্রবাসী। ছোট ছেলে লিপনও ঢাকায় থাকে, কোম্পানির ম্যানেজার। মেয়ে রানুও ঢাকায় থাকে। ভাবীকে তারা জোড় করে তাদের বাসায় নিয়ে রাখে। ভাইকে বেশী সময়েই বাড়িতে একা থাকতে হয়। গিয়াস ভাই ১৯৬৮ সনে বিএ পাস করেও চাকরি করেন নি স্বাধীন থাকার জন্যে। তিনিই এখনো ফুফুর বাড়ি ধরে রেখেছেন। তারও বয়েস হয়েছে। তার সমবয়সী চুন্নু ভাই গত কিছুদিন আগে চলে গিয়েছেন। মনে হলো আজ রাতে গিয়াস ভাই সেই বিরাট বাড়িটিতে কিভাবে একাকী কাটাচ্ছেন। যে বাড়িতে প্রথম আমি শুনেছিলাম ২২ জোড়া কবুতরের বাকুম বাকুম ডাক। যে বাড়িতে থাকার কথা ছিল ফুফুর ৬ ছেলের ছয় নং চুয়ান্ন জন সন্তানের নাতীর বসবাস। সেই বাড়িতে আছেন একজন একা। আছে সেই পুকুর, আছে সেই পালানের ক্ষেত, নেই সেই মানুষগুলো, নেই আমার ফুফা, নেই আমার ফুফু। আমার ফুফুর বাড়ি!
২৭/১১/২০১৮ খ্রি.
ময়মনসিংহ -ঢাকা-ময়মনসিংহ জার্নি