Haque Sir-er Basay
হক স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম
(স্মৃতি কথা)
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
প্রফেসর ডাঃ আব্দুল হক স্যার তখন অবসর জীবন যাপন করছিলেন। ময়মনসিংহের চরপাড়ার লাশকাটা ঘরের বিপরীত দিকের রাস্তায় তিনি বাড়ি করে থাকতেন। ১৯৯৭ সনের পরে হবে। বাংলাদেশ জার্নাল অব প্যাথলজি-তে আমার প্রথম দুটি সাইন্টিফিক রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশিত হলো। এগুলো ছিলো ঢাকার শাহবাগে ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (আইপিজিএম আর)-এ এম ফিল কোর্স করার সময় আমার থিসিস। পাকস্থলীর ক্যান্সারের সাথে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি জীবাণুর সম্পর্কে গবেষণা করছিলাম। আমার গবেষণার ফলাফল জার্নালে প্রকাশ পাওয়ায় খুব আনন্দিত ছিলাম। এই আনন্দ সবার সাথে শেয়ার করা যায় না। সবাই এর মর্জাদা বুঝে না। ঢাকার হোটেল শেরাটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সোসাইটি অব প্যাথলজিস্ট-এর সম্মেলনে জার্নাল বিতরণ করা হয় নিবন্ধিত মেম্বারদের মাঝে। আমি আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ডাঃ আব্দুল হক স্যারকে প্রদান করার জন্য অতিরিক্ত দুটি কপি সংগ্রহ করেছিলাম। হক স্যার ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যক্ষ। তিনি ময়মনসিংহ বিএমএ-এর এক সময় প্রেসিডেন্টও ছিলেন।
আমি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের লেকচারার ছিলাম। অফিস থেকে বের হয়ে সকাল আনুমানিক ১০ টার দিকে জার্নাল দুটি হাতে নিয়ে স্যারের বাসার দিকে গেলাম। গেইটে করা নাড়ায় স্যার নিজেই দরজা খুলে দিলেন। আসেন আসেন বলে স্যার খুব খুশি হয়ে আমাকে তার বেড রুমে নিয়ে গিয়ে বাসালেন। সিম্পল একটা খাটে সাধারণ বিছানা পাতা। মশারীর দুই কোণা বাঁধা আছে। অন্য দুই কোণা বিছানার অর্ধেক পর্যন্ত কভার করে আছে। বাসায় অন্য কেউ আছে বলে মনে হলো না। স্যারের স্ত্রী ঢাকার বাসায় থাকেন। মেয়েরাও ঢাকায় থাকে। বাসার পরিবেশ দেখে মনে হলো আমি সেই হাজার বছর আগের দিনের কোন এক দার্শনিকের কাছে এসেছি। স্যার জার্নাল দুটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। আমি আমার আর্টিকেল বের করে দিয়ে বললাম “স্যার, এ দুটি আমার প্রথম আর্টিকেল।” স্যার আমাকে
অভিনন্দন জানিয়ে আনন্দিত চোখে পড়া শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পড়ার পর বললেন “খুব ভালো হয়েছে। তবে বেশ কিছু গ্রামার ভুল আছে।” আমি বললাম
– স্যার গতকাল আমাদের সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলন ছিলো। সেখানে সবাইকে এই জার্নাল দিয়েছে। আমি আপনার জন্য দুটি নিয়ে এসেছি।
– খুব ভালো করেছেন। সাদেক, কেউ এখন দায়িত্ব নিয়ে খোঁজ খবর নেয় না। অথচ, দেখেন, আমি এই সোসাইটির আজীবন সদস্য। একটা চিঠিও পাই না। আপনি আমার কথা মনে করে জার্নাল নিয়ে এসেছেন, এজন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি আরও পেলে আমার জন্য নিয়ে আসবেন। নতুন কিছু জানতে হলে জার্নাল পড়তে হবে। এই যে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি জীবাণু যে স্টোমাকে থাকে কজনে জানেন? আপনি স্টোমাক থেকে জীবাণু আইসোলেট করেছেন এবং তার সাথে যে ক্যান্সারের এসোসিয়েশন আছে তার প্রমাণও করেছেন।
স্যার ছোট বড় সবাইকে আপনি করে বলতেন। আমি স্যারের ছাত্র হলেও তিনি আমাকে আপনি করে বলতেন। অনেক্ক্ষণ তিনি অনেক স্মৃতিচারণ করে কথা বললেন। বিশেষকরে তিনি যখন ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সে ছিলেন সেই সময়ের স্মৃতি কথা বলছিলেন। আমার ক্লাস আছে বলে উঠতে চাইলে স্যার বললেন “সাদেক, একটু বসেন। চা দিচ্ছি” বলে দ্রুত ভিতরের রুমে গিয়ে নিজেই চা বানিয়ে আমার জন্য নিয়ে এলেন।” আমি বিনয়ের সাথে বললাম “স্যার, আপনি কষ্ট করে চা বানালেন!” স্যার, হালকা হেসে বলেলেন “এই সামান্য এক কাপ চা, আর কি, খান। এভাবেই কেটে যাচ্ছে। “
৯ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি
ময়মনসিংহ
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
ম-১৭ ব্যাচ
সাবেক বিভাগীয় প্রধান
প্যাথলজি বিভাগ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ