কচুয়া স্কুলের পথে
প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ হেটে বাড়ী থেকে কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে যেতাম। আমাদের বাড়ীটা পড়েছে সখিপুর উপজেলার ঢনডনিয়া গ্রামের বড়বাইদ পাড়ার তালুকদার বাড়ী । স্কুলে যাওয়া আসার তিনটি পথ ছিল। একেক সিজনে একেক পথে যেতাম। বর্ষাকালে বাড়ী থেকে কালিয়া পর্যন্ত যেতাম সরু পায়ের পথে। কালিয়া থেকে কচুয়া স্কুল পর্যন্ত হালট ছিল গরুর গাড়ী যাতায়াতের জন্য। শুকনোর সিজনে বাড়ী থেকে চটানের বাইদের মাঝ বরাবর গরুর গাড়ীর পথে কালিয়ার ভন্ডেশ্বর পাড়ার ভিতর দিয়ে ঢুকে হালটে গিয়ে পৌছতাম। হাল্কা শুকনো সিজনে যেতাম সাড়াসিয়া হয়ে রামখার পাশ দিয়ে সোজা কচুয়ায়। কালিয়া-কচুয়ার হালটটি পাকা হয়েছে নব্বইর দশকে। আমি কচুয়া হাই স্কুলে পড়েছি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সনের মার্চ মাস পর্যন্ত।
সকাল ৯ টায় রওনা দিতাম স্কুলের উদ্যেশ্যে। পথের বাড়ী বাড়ী থেকে সংগীরা একাত্র হতো। হালটে পৌছার পর ২০/২৫ জনের দল তৈরি হয়ে যেতো। গল্পে গল্পে আনন্দে স্কুলে পৌঁছে যেতাম। পথে আমার সংগী হতো আমার ক্লাসমেট মুক্তার, আমীর আলী, ইদ্রিস, আবুবকর সিদ্দিক ও ঠান্ডু। মেয়েরা আলাদা দলে যেতো। মেয়েদের দলটা সামনে থাকতো। সকাল ১০ টায় ক্লাস শুরু হতো।
বাড়ী থেকে বের হয়ে বাব্বুর চালার জংগলের ভিতর দিয়ে, সালাম কাক্কুর ঝোড়ার পানি পাড় হয়ে চটানের বাতর দিয়ে হেটে গিয়ে ঢুকতাম হয়দর ভাইদের গহীন জংগলের চিপা রাস্তায়। জংগল থেকে বের হয়ে ওহা বেপারী চাচা, কুরপান চাচা, গাদু চাচা, মুজা চাচা,বান্দু চাচা ও নুরাক্কারী চাচার বাড়ী ঘেঁষে পৌছে যেতাম বিস্তির্ণ এক মাঠে। গাদু চাচার গাছের বরুই খুব মিষ্টি ছিল। আমাদের জন্য ফ্রি। ইচ্ছামত বরুই পেড়ে খেতাম। মুক্তার ও আমীর আলী খুব ফক্কর ছিল। সারাক্ষণ আমাদেরকে হাসিয়ে রাখতো। মুক্তার ১৯৭৭ সনে এসএসসি পাস করে মিডল ইস্ট চলে যায় জীবিকার সন্ধানে। বাড়ী গিয়ে তার খোজ নিতাম। ৫/৬ বছর পর পর দেশে আসতো ২/১ মাসের জন্য। একদিন সে আমাকে না জানিয়ে পরপারে চলে গেছে। ৭৭ সনের পর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয় নাই। আমার কাছে এটা একটা নিষ্ঠুরতা। গাদু চাচার ছেলে আমীর আলীও বিয়ে করার পর এলাকা ছেড়ে চলে গিয়ে ভন্ডেশ্বর বাড়ী করেছে। তাই তার সাথে ১৯৭৭ এর পর আর দেখা হয় নাই। তারে দেখতে মন চায়। কথা বলতে মন চায়। তাই তার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করেছি। ফোন দেই, ধরে তার স্ত্রী অথবা বিবাহিত মেয়ে। বলে ‘চরায় গেছে কাজ করতে।’ যদিও পাই, কথা বলে আগের মতো মজা পাই না। বলে তার বউয়ের কথা, তার মেয়ের কথা। কারো মাঞ্জায় ব্যথা, কারো পেটে ব্যথা ইত্যাদি। মুজা চাচার ছেলে ইদ্রিস রাস্তায় খুব নাড়াই করতো। তারপরও আমাদের খুব প্রিয় ছিল। সেও বিয়ে করার পর সখিপুর গিয়ে বাড়ী করেছে। ১৬/১৭ বছর পুর্বে তার সাথে বিদ্যুৎ অফিসে এক মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল। আবুবকর সিদ্দিকও মিডল ইস্টে চাকরী করছে। তার সাথেও আর দেখা হলো না। ঠান্ডু দেশেই থাকে। মাঝে মাঝে আমার চেম্বারে রুগী নিয়ে আসে। দেখে মনটা ভরে যায়।
সেই মাঠ পাড় হয়ে, জুলহাস ভাইদের বাড়ী ঘেষে, মোসলেম চাচাদের বাড়ীর দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলে যেতাম মেছু চাচার পুকুর পাড়ে। তারপর হালট। হালট দিয়ে কচুয়া। চৈত্র বৈশাখ মাসে বাইদে ফসল থাকতো না। বাইদ শুকিয়ে খা খা করতো। গাড়ীয়ালরা বাইদের মাঝ বরাবর গরুর গাড়ীর রাস্তা করে নিত। আমরা সেই রাস্তায় সহজেই কোনাকোনি পৌছে যেতাম কচুয়ার কাছাকাছি। ভন্ডেশ্বর পাড়ার গোলাম মোস্তফা ভাইদের বাড়ীর কাছ দিয়ে যেতাম। আগন-পৌষ মাসে যেতাম সাড়াসিয়া হয়ে। চটান পাড় হয়ে সিরা দাদার বাড়ী, জিন্নত মেম্বারের বাড়ী, মানিক তাঐদের বাড়ীর পাশ দিয়ে, খলিল কমান্ডার/চেয়ারম্যান চাচার বাড়ীর কাছের হালটে গিয়ে পৌছতাম। সেই পথে বেপারী পাড়া হয়ে সোজা পৌছে যেতাম কচুয়া। বেপারী পাড়ার পর হালটের পাশে একটা বাড়ী ছিল। সেই বাড়ীর মাটির দেয়ালে আমের করা দিয়ে বড় বড় অক্ষরে কাঁচা হাতে লিখা ছিল “এই বাড়ীর উম্মে কুলসুম ক্লাস থ্রিতে পড়ে।”
একদিন, খুব সম্ভব আমি নবম শ্রেণীতে পড়তাম, একাকী কচুয়া থেকে বাড়ী ফিরছিলাম। রাস্তায় কোন লোক দেখতে পেলাম না। হালট দিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ দেখি পিছে একটি রাস্তার কুকুর। গা শিউরে উঠলো। কুকুর দেখে খুব ভয় পেতাম। শুনতাম কুকুরে কামড়ালে পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়। একদিন এক ভিক্ষুকের কাছ থেকে তার নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনেছিলাম। তাকে নাকি কুকুরে কামড়িয়েছিল। তারপর সে অসুস্থ হয়ে পরে ভিক্ষা করে। তার প্রশ্রাবের সাথে নাকি ছোট ছোট ৮ টা কুকুরের বাচ্চা প্রসব হয়েছে। এই কথা শুনার পর আমি কুকুরকে খুব ভয় পেতাম। কুকুর কামড় দিয়ে আমার পায়ের গোছা পর্যন্ত খেয়ে ফেলুক, তাতে আমার আপত্তি ছিল না। প্রশ্রাবের সাথে কুকুরের বাচ্চা বের হবে এটাতে আমার আপত্তি ছিল। আমি রাস্তার এক পাশে সরে দাড়ালাম। কুকুরও সাথে এসে আমার পেছনে দাড়ালো। আমি চলতে লাগলাম। কুকুরও চলতে লাগলো। থামলাম। কুকুরও থামলো। ভয়ে ভয়ে হাল্কা ধমক দিলাম। বিনয়ের সাথে লেজ নাড়ালো। আবার চললাম। মেছু চাচার পুকুর পাড়ে আম গাছের নিচে ঘোড়া কাঠের উপর বসলাম যাতে সে চলে যায়। কিন্তু না, সে আমার দিকে চেয়ে সামনের পা খাড়া করে বসে রইল। যেনো তার সাথে আমার কত খাতির। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। অপুর্ব সুন্দর তার মুখ। টানা টানা টল মলে তার চোখ। মশৃন কালো তার নাক। লোমশ মুখমণ্ডল কত সুন্দর মোলায়েম। ছুতে ইচ্ছে করে। বয়সে কিশোর হবে।
আমি আবার চললাম। ও আমার পিছু পিছু এলো। আসুক। ভয় পেলাম না। এক বাড়ীর দক্ষিণ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই বাড়ী থেকে দুইটি বড় কুকুর আমার সাথী কুকুরটিকে উদ্যেশ্য করে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো। এইবার আমার পা কাপা শুরু করলো। বুকটা দুরুদুরু। মহা বিপদের আশংকা করছিলাম। রাস্তার কুকুরটি ভয়ে আমার পায়ের কাছে এলো। বাড়ীর কুকুর দুইটি রয়েল বেংগল টাইগারের মতো দৌড়িয়ে এসে আমার কুকুরটিকে আক্রমণ করলো। আমি চিতা বাঘের গতিতে পাশের বাড়ীর দিকে দৌড় দিলাম। আমার কুকুরটি হরিণের গতিতে আমার পিছনে দৌড়ালো। তার পিছনে বাড়ীর কুকুর দুইটি। বাড়ীর ভিতর ঢুকে পরলাম। একটি রন্নাঘরের বাশের তৈরি এক পাল্লা দড়জার অর্ধেক খোলা পেলাম। লাফ দিয়ে ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দিলাম। আমার কুকুরটিও সাথে সাথে ঢোকার চেষ্টা করলো। দড়জা চেপে ধরাতে তার মাথা ভিতরে আর শরীর বাইরে আটকা পড়লো। কুকুরটি কাউ কাউ করতে লাগলো। বাইরে থেকে বাড়ীর কুকুর তাকে কামড়াচ্ছিল। দড়জা বন্ধ করাতে ঘর অন্ধকার হয়েছিল। তাছাড়া আমি রৌদ্র থেকে এসে ঘরে ঢোকাতেও অন্ধকার দেখছিলাম। ঘরের ভিতর তিন চারজন মহিলা চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন “এই, বেটা মানুষ ছটি ঘরে ঢুকছে ক্যান?” একটা বিশেষ গন্ধ নাকে এলো। চোখে আইল্লার ধুয়া লাগলো। আমি বুঝলাম এটা ছটি ঘরের গন্ধ। যে ঘরে মায়েরা বাচ্চা প্রসব করে তাকে বলা হয় ছটি ঘর। তুষের আগুনে আইল্লা জ্বালিয়ে রাখা হতো মাটির ডুপিতে। প্রসুতি মা ৭ দিন ঘড় থেকে বের হতেন না। আওলা চাইলের ভাত কালিজিরা বাটা দিয়ে খেতেন পর্যাপ্ত বুকে দুধ আসার জন্য। বড় লজ্জায় পড়ে গেলাম। নবজাতক “ওহে অহে” করে কাঁদছিল। বাহিরের ছেলে মানুষের কোলাহল, কুকুরের ঘেউঘেউ, আমার কুকুরের কাউ কাউ, ভিতরের মহিলাদের চেঁচামেচি ও নবজাতকের কান্না সব মিলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। একিকে আমিও রাস্তার কুকুরটিকে চেপে ধরে আছি। আমার অপরাধ বোধ হচ্ছিল। বাহিরের লোকগুলি তাদের কুকুরকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে দড়জা ঢিলা দিতে বললেন। আমি একটু ঢিলা দিলাম। কুকুরটি পিছিয়ে গেলো। এবার আমাকে বের হতে আদেশ দিলেন। আমি বের হয়ে কুকুরটি দেখলাম না। দেখলাম ৫/৬ জন লোক আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি লজ্জায় তাদের দিকে তাকালাম না। মাথা নিচু করে চলে এলাম। শুধু পিছন থেকে আওয়াজ এলো “এটা তালুকদার বাড়ীর পোলা।”
বেশ কয়েকবছর আগে বাড়ী গিয়ে ইচ্ছা করলাম কচুয়া স্কুল থেকে একটু বেড়িয়ে আসি। তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ছিলাম। কালিয়া থেকে বড় বাইদ প্রশস্ত রাস্তা হওয়াতে সেই পায়ের পথে আর কেউ যায় না। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো সেই পথেই কচুয়া যাই। আমি একাই রওনা দিলাম। কেউ জানলো না। হয়দর ভাইদের জংগলে রাস্তা খুজে পেলাম না। বনের ভিতর দিয়েই কোনমতে চলে গেলাম। বান্দু সিকদারের বাড়ী পাড় হবার পর এক গহিন বনে ঢুকলাম। কোন পথ নেই। এক সময় দিক ভুলে এদিক সেদিক ঘুরাফিরা করলাম। চমকে গেলাম। এমন বন তো আমি আগে দেখি নি। এটা কোন বন। বনবাসী মানুষের মতো ঘুরাঘুরি করলাম। হঠাৎ একটি বাড়ীর দেখা মিললো। সেখানে একজনের সাথে কথা হলো। বুঝতে পারলাম এটা সেই বাড়ী যে বাড়ীর ছটি ঘরে ছোট বেলায় ঢুকে পড়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম “বান্দু সিকদার বাড়ীর পুর্বে যে বিড়াট বাছ্রাক্ষেত ছিল সেটা কোথায়?” তিনি বললেন “সেই বাছ্রাক্ষেতেই বনায়ন হয়েছে। এখন এটা অইরান জংগল। ”
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ থেকে একবার আমি ও রুহিনী দা রংপুর মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিলাম পরীক্ষা নিতে। বাস স্ট্যান্ডে চায়ের স্টলে বসে চা খাচ্ছিলাম। দেখলাম একটি তরুণ বয়সের কুকুর সামনে বসে আছে। সেই কুকুরের মতো দেখতে। আমি তিন টাকা দামের একটা গোল পাউরুটি দিলাম তাকে খেতে। খেয়ে লেজ নাড়িয়ে আমাকে শুকরিয়া জানালো। তারপর আমাদের মুখের দিকে চেয়ে রইল তৃপ্তি সহকারে। রুহিনী দা বললেন “সাদেক ভাই, দেখেন ভগবান কত সুন্দর করে কুকুরটাকে বানিয়েছেন! একটা রাস্তার কুকুর! কি তার সৌন্দর্য! দেখেন, মুখটা কত সুন্দর!” ভাবলাম আমার মনের মতো মিলের মানুষ আরো আছে। আমি চলে গেলাম আমার ফেলে আসা অতীতে। স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকলাম। মনে পড়লো কচুয়া স্কুলের পথ, মুক্তার আলী, আমীর আলী, ঠান্ডু, আবু বকর সিদ্দিক, ছটি ঘর আরো কত কি! এগুলি কারো কাছে বলিনা। কেউ আমার এই আলাপ পছন্দ করবে না। কেউ কেউ তো থাকতেও পারে রুহিনীদার মতো,আমার মতো মন। তাই, আজ ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ জার্নিতে সিটে বসে মোবাইলে টাইপ করে লিখে রাখলাম স্মৃতির পাতায় কিছু সাধারণ জীবনের গল্প।
২২/১১/২০১৮ ইং