Nouka Vronon

নৌকা ভ্রমণ

পনের বিশ বছর আগের কথা। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল। বর্ষাকালের শেষে অথবা শরৎ কালে মামার বাড়ি যেতে ইচ্ছে হল। অনেক বছর যাওয়া হয়নি। নদী নালা খাল বিল ভরে গিয়ে মাঠ ঘাট প্লাবিত হয়ে বাড়ির পালান ভর্তি পানি হয়েছে খবর পেলাম। সেই সময় বৃষ্টি থাকে না। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। ছোট ছোট ঢেউ এসে বাড়ির ভিটায় আঘাত করে। দেখতে মন চায়। পুর্ণিমার রাত দেখে একটা তারিখ  ঠিক করলাম মামা বাড়ি যাবো। ডিঙি নৌকা নিয়ে বিলের মাঝখানে লগি গেড়ে নৌকা বেঁধে পাটাতনের উপর খালি গায়ে চিত হয়ে শুয়ে পুর্ণিমার চাঁদ দেখবো। সমবয়সী মামাতো ভাই ফজলু ভাই ও কাদের ভাইর সাথে শৈশবকালের স্মৃতিচারণ করব। ডাহুক, কোড়া ও কুড়া পাখির ডাক শুনব। দূর থেকে বাউলের গান ভেসে আসবে। বিলের মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাবে।

একদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে ময়মনসিংহ থেকে রওনা দিলাম। বাসে করে কালিহাতি এসে নামলাম। কালিহাতি থেকে একটা লগি দিয়ে খোজ দেয়া ছইওয়ালা নৌকায় উঠলাম। নৌকার দুইজন মাঝি ছিল। খাল দিয়ে নৌকা চালাচ্ছিল। একজন লগি দিয়ে খালের দুইপাড়ে খোজ দিচ্ছিল। আরেকজন পিছনে দাঁড় ধরে বসেছিল। নৌকায় সাত-আট জন যাত্রী ছিল। সবাইকে এলাকার যাত্রী মনে হচ্ছিল। আমাকে তাদের থেকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। প্যান্ট শার্ট পরা । হাতে ব্রিফকেইস। সবাই ছইয়ের বাইরে পাটাতনে বসেছিল। আমিও নৌকার গুড়ায় বসলাম একটু খোলা মেলা হাওয়া খাওয়ার জন্য। মাঝি অনুরোধ করল “স্যার, ছইয়ের ভিতরে গিয়ে বহুন । আপনের গতরে নগির পানির ছিটা নাগতে পারে। আপনে বসা থাকলে আমিও ভাল ভাবে নগি দিয়া খোজ দিতে পারি না। তাছাড়া রৈদে বসলে আপনের জ্বর আইতে পারে।”

আমি ছইয়ের ভিতরে গিয়ে বসলাম। আমার জন্য পাতলা কাথা বিছানো ছিল। আমি মোজা খুলে আসন বিড়ায়ে বসলাম। ভিতরে আরেকজন লোক পেলাম শার্ট ও লুঙ্গী পড়া। ঠেংগের উপর ঠেং তুলে চিত হয়ে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। বেয়াদব বেয়াদব মনে হল। আমি কিছুটা অসস্থি বোধ করছিলাম। কিছুক্ষণ পর রৌদ্রের প্রখরতায় সবাই ছইয়ের ভিতরে এসে বসল । তারা গ্রাম্য সমস্যা নিয়ে কথা বলছিল। আমি ও বেয়াদব লোকটা শুধু শুনছিলাম। একসময় লক্ষ্য করলাম বেয়াদব লোকটার দুই হাতে দুইটি এবং দুই পায়ে দুইটি গোল্ডেন ব্রেসলেট পরা ।

একজন জিজ্ঞেস করলেন

-লোকে ব্রেসলেট পরে  হাতে একটা। আপনি চার হাতপায়ে চারটি পড়েছেন কেন?
-আমি কি এমনি এমনি পরেছি? আমার সমস্যার জন্য এগুলো পরেছি। বাতের জন্য এগুলো সাংঘাতিক উপকার দেয়। আমার ভাতিজা সৌদি আরব থাকে। সে জানতো আমার সারা শরীরে বাতের ব্যাথা। প্রথমে লোক মার্ফৎ আমার জন্য একটা ব্রেস্টলেট পাঠায়। এরপর উপকার পাওয়ার কথা শুনে পরপর আরো তিনটা পাঠায়। তাই চারটি ব্রেস্টলেট চার জায়গায় পরেছি। আমি এখন বাতমুক্ত।”

এরপর বাত রোগ নিয়ে সবাই যার যার মত প্রকাশ করতে লাগলো। নানান রকমের তেলেসমাতি চিকিৎসা পদ্ধতির কথাও শুনলাম নিরবে। একসময় প্রথম প্রশ্নকারী বললেন

-আপনার ভাতিজা তো সৌদি থাকেন। আমার জন্য একটা  ব্রেসলেট আনিয়ে দেবেন? আমি টাকা দিয়ে দেব। আমার শরীরে খুব বাতের ব্যথা।
-আপনার প্রয়োজন থাকলে এটা নিন। আমি ভাতিজাকে ফোন করে আনিয়ে নেব নি।
-দাম কত দিব?
-পাঁচশ টাকা দিন। এগুলোর দাম অনেক। খুব উপকারী ধাতু তো!
-তা হলে আমাকে একটা দিন।
-এই নিন। আপনার হাতে খুব মানিয়েছে। এর উপকার আগামীকাল থেকেই পেয়ে যাবেন।

আমরা সবাই দেখলাম। একটু পর আরেকজন বললেন

-ভাই, আপনাকে তো আনাতেই হবে। আমাকেও একটা দিন না। আপনার ভাতিজাকে দিয়ে আনিয়ে নিবেন।
-এই নিন আপনি।

এইভাবে লোকটি চারজনের কাছে চারটি ব্রেসলেট আমাদের চোখের সামনে দুইহাজার টাকায় বেচে দিলাম। সামনের ঘাটে নৌকা ভিরালে বেয়াদব লোকটি ও প্রথম গ্রাহক নেমে পড়ল। এতক্ষণে আমরা রহস্য বুঝে ফেললাম। সবাই হাসাহাসি করলাম টাউটের টাউটামি বুঝে। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। মাঝি বলল “প্রথম গ্রাহকটা ঐ টাউটেরই লোক। ওকে দিয়ে বিক্রি শুরু করে। এরপর তারা আরেক নৌকায় উঠে এই কাজই করবে।”

আউলিয়াবাদ ঘাটে এসে এই নৌকা জার্নি শেষ হল । নেমে আরেকটি প্রাইভেট ডিঙি নৌকায় উঠলাম রৌহা মামাবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রৌহা কালিহাতি উপজেলায়। পুর্বদিকে বংশী নদীর কাছাকাছি ভর অঞ্চল বা ভাটি অঞ্চল। ছাতা ফুটিয়ে নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসলাম। দূর থেকে দেখা গেল দক্ষিণের পালান পারে মেঝ মামী দল বল নিয়ে আমাকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। নৌকা ঘাটে এসে ভিড়ল। ঘাটে নামলাম। মামী এগিয়ে এসে গায়ে আদর করে বললেন “সাদক আইছ, কত দিন পরে আইলা, বাজান।”

মামাতো ভাই কদ্দুছের বউ এক গ্লাস সরবত এনে দক্ষিণ ভিটার গাছের নিচে চেয়ার দিল বসতে। আমি সরবত খেয়ে শার্টের উপরের বোতাম খুলে দক্ষিণ মুখ করে বসলাম। সবার সাথে কুশল বিনিময় হল। দক্ষিণের বিস্তির্ণ জলরাশি থেকে মৃদুমন্দ বাতাস এসে বুকে লাগছিল। ছোট ছোট ঢেউ পায়ের কাছে এসে ভেংগে যাচ্ছিল। মৃদু মৃদু কুলু কুলু শব্দ হচ্ছিল। দূরে বিলের মাঝ খানে তিন কিশোর ডিঙি নৌকা নিয়ে খেলা করছিল। মুহুর্তে আমি হারিয়ে গেলাম আমার শৈশব কৈশোরে। মনে হলো যেনো আমি, ফজু ভাই ও কাদের ভাই ডিঙি নৌকা নিয়ে খেলা করছি ।
১০/৩/২০১৮ খ্রি.

vegetable-garden-june-24

ছাদের উপর সবজি বাগান | Vegetable Garden on the rooftop

Dr. sadequel Islam Talukder

আমরা ছাদে একটি সমৃদ্ধ সবজি বাগান তৈরি করেছি এবং রক্ষণাবেক্ষণ করি ৷ সঠিক পাত্র এবং মাটি নির্বাচন থেকে শুরু করে উৎকৃষ্ট শাকসবজি বাছাই পর্যন্ত, এই টিউটোরিয়ালটি শহুরে বাগানে আগ্রহী সকলের জন্য মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ছাদের সবজি বাগানের সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতা দেখাতে আমাদের নিচের ভিডিও লিংকে ক্লিক করুন ।
 we explore the process of creating and maintaining a thriving vegetable garden on a rooftop. From selecting the right containers and soil to choosing the best vegetables to grow, below is a link of video in which we  provides valuable insights for anyone interested in urban gardening. Join us as we showcase the beauty and functionality of rooftop vegetable gardens. keywords:  Vegetable, garden, rooftop, gardening, সবজি, সৌন্দর্য, বাগান

Machhere

মাছেরে

(টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক মাতৃভাষায় লেখা স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

গ্রামে আমরা কেউ ঘাস কাটতে গেলে তারে কইতাম ঘাসেরে গেছে। আর কেউ মাছ ধরতে গেলে কইতাম মাছেরে গেছে। চেংরাকালে আমি মাছেরে গেতাম। আংগ বাড়ি সখিপুরের পাহার অঞ্চলে। উনা মাসে পাহারে পানি থাকত না। তাই মাছও পাও যাইত না। ভর অঞ্চলে হারা বোছরই পানি থাকত। মাছও মারন গেত হারা বোছর। উনা মাসে পাহাইরারা য়াটে তিগা মাছ কিন্যা আইন্যা খাইত। ১৫/২০ মাইল দূরে তনে মাঝিরা মাছ কান্দে কইরা নিয়া আইত পাহারে য়াটের দিন অইলে। এতদুর আনতে আনতে মাছ কুইয়া বকবকা অইয়া গোন্দ উইঠা যাইত। হেইন্যা ফালাই দিয়ন নাগত। তাই উনা মাসে জিওল মাছ, মাগুর মাছ, কই মাছ, ছাইতান মাছ, টেংরা, বাতাসি, গুইটা বাজাইল ছাড়া আর কিছু পাও গেত না। পাহাইরা মাইনষে জিওল মাছ, মাগুর মাছ, কই মাছ, ছাইতান মাছ বুরকা- পাইল্যায় পানি দিয়া জিয়াইয়া য়াকত। কয়দিন ভইরা য়াইন্দা খাইত। পঁচা মাছ গুলাইনের পাতা দিয়া য়াইন্দা খাইলে গোন্দ করতো না। ইন্যা খাইয়া পেট ভাটভুট করলে গোন্দবাদাইলের পাতা দিয়া হাক য়াইন্দা খাইত। বাইস্যা মাসে পাহারের ধাইরা দিয়া য়াট বইত। হেনু ভৌরারা নানান জাতের মাছ নিয়াইত বেচপার নিগা। বেশিরভাগই ছিল নোরাফেকা মাছ। পদ্মা নদীর ইলসা মাছও এই সব য়াটে নিয়াইত নাইয়ারা।

আমি যেবা কইরা মাছ মারতাম হেইন্যা হুইন্যা আন্নের মোনয়ব আমি বোধকরি বালা ছাত্র আছিলাম না। আমি খুব বালা ছাত্র আছিলাম। হেসুমকার দিনে বাটাজোর বি এম হাই স্কুল অত্র অঞ্চলের মদ্যে সব তিগা বালা স্কুল আছাল। হেই স্কুল তিগা এস এস সি পাস করছি য়েকর্ড ভাইঙ্গা, মানে আগে যারা পাস করছাল তাগ চাইতে বেশি নম্বর পাইছিলাম, জামাল স্যার কইছেন। এহন পর্যায়ের নিহি কেউ আমার নাগালা বালা এজাল্ট করপায় নাই।

আমি স্কুল তিগা আইয়া চাইরডা খাইয়া মাছেরে গেতাম। পুশ মাস তিগা জৈস্টি মাস পর্যন্ত পাহারে পানি থাকত না। তাই মাছেরে যামু কুনু? পাহারে পানি আইলে পানির নগে মাছ আইত। মাছ আইলে মাছেরে গেতাম। জৈস্টি মাসের হেষের দিকে যেদিন বেশি বিস্টি অইত হেদিন চালার বেবাক পানি ঘোনা ঘুনিতে নাইমা বাইদ ভইরা গেত। বাইদের পানিতে জোরা ভইরা গেত। জোরা অইল বাইদের মইদ দিয়া চিকন খালের নাগালা। জোরার পানি গিয়া নামত চাপরাবিলে। চাপরা বিল পানি দিয়া ভইরা গেত। চাপরা বিল উনা মাসেও হুকাইত না। হেনুকার মাছ বেশি পানি পাইয়া উজাইতে উজাইতে আংগ বাইদে আইয়া পড়ত আন্ডা পারনের নিগা। চলাচলা পুটি, হেলাম পুটি, টেংরা, গোলসা, নোন্দা, হৈল, বোয়াল, পাত্যা, ছাইতান, আগ্যা, ইচা, নোন্দা, বাইং, এবা নানান জাতের মাছ পেট ভর্তি আন্ডা নই আইত পাহাইরা হোতের মইদ্যে আন্ডা পারনের নিগা। আমরা বিস্টিত ভিজা, ছাতি মাথায় দিয়া, কলাপাতা পাথায় দিয়া, নয় মাতইল মাথায় দিয়া মাছেরে গেতাম। ক্ষেতের বাতর যেনু পানি যাওনের নিগা কাইটা দিত হেডা কইত জোর। আমরা জোরের হোতের পানিতে জালি পাইত্যা খারই থাকতাম। পানির নিচে জালির নগে ঠ্যাং ঠেহাই য়াকতাম। জালিতে মাছ ঢুইকা যেসুম ঠ্যাংগের মদ্যে গুতা মারত হেসুম জালি উচা করতাম। জালি তিগা মাছ ধইরা খালুইর মদে য়াকতাম। খালুই ভইরা যাইত মাছে। হেই মাছের পেট বোজাই আন্ডা থাকত। হেই জোরের মইদ্যে য়াইতে ঠুই পাইত্যা য়াকতাম। সক্কালে বেলা ওঠনের সোম গিয়া ঠুই চাইতাম। ঠুইয়ের আগায় হেই মাছগুনা বাইজা থাকত। ক্ষেতের বাতরে ঠুই উল্টাইয়া মাছ বাইর করতাম। খালুই ভইরা যাইত। মাছের নগে চেকমেকা, কাকরা, কুইচ্যা, টেপা, হামুক, ইন্যাও বাজত। ইন্যা বাইচ্যা পানিত ঢেইল মাইরা ফালাই দিতাম। জৈস্টি মাসে জাংলাভর্তি জিংগা, পোড়ল অইত। বাড়ির পালানে ডাংগা অইত নশনশা। মা হেইন্যা দিয়া মাছ য়ান্না করতেন। ঢলের মাছ নতুন তরিতরকারি দিয়া এবা মজাই যে নাগ ত গো, খাইয়া পেট ডিগ ডিগ করত।

আষাঢ়, শাওন, ভাদ্দর মাসে খালি বিস্টি অইত। বাইদ বোজাই পানি থাকত। পাহারের পাগার, পুস্কুনি, কুয়া, জোরা পানিতে ভইরা থাকত। এইসুম মাছগুনা বাইদে ছড়াই ছিটাই থাকত। আর মাছের পোনা গুনা বড় অইতে থাকত। হেসুম খালি ঠুই পাইত্যা মাছ ধরতাম। ভাদ্দর মাসের হেষের দিকে যখন বিস্টি কইমা যাইত হেসুম বাইদের জমিতে আমন ধানের গোছা নাগাইত। আর আগে এই জমিগুনাতে ছিল আউশ ধান। বেশি ভাগই ছিল ভাতুরি ধান। ভাতুরি ধান কাটার পর ক্ষেতে য়াল বাইয়া কেঁদা বানাইহালত। ধানের গোছা দেওনের আগে মই দিয়া ক্ষেত হোমান করন নাগত। কেঁদা ক্ষেতে মই দেওনের সূম চংগের পাছের পানি হইরা গিয়া মাছ বাইরইয়া দাফ্রাইতে থাকত। এইন্যা ধইরা ধইরা আমরা খালই বোজাই করতাম। কোমরের পিছনে খালই ঝুলাইয়া বাইন্ধা নিতাম। দুই য়াত দিয়া ধরতাম, আর খালই মইদ্যে য়াকতাম। কই মাছ গুনা কেঁদার উপর কাতাইতে থাকত। কি মজাই যে নাগত! আমি, মজি ভাই, জিন্না ভাই, সিদ্দি ভাই, এবা অনেকেই দল ধইরা হেইন্যা ধরতাম। মজি ভাই মইরা গেছে গাড়ি এক্সিডেন্ট কইরা। পাহাইরা বাইদের মাটি খুব সারিল মাটি। কয়দিনেই ধানের গোছা মোটা য়ই গেত। ক্ষেতে হেসুম টলটলা পানি থাকত। হেই পানি দিয়া নানান জাতের মাছ দৌড়াদৌড়ি করত। দেহা গেত। আমরা ক্ষেতের বাতর কাইটা জোর বানাইয়া হেনু বাইনাতি পাইত্যা য়াকতাম। বাইনাতি বাঁশের বেতি দিয়া বুনাইয়া বানান নাগত। বাইনাতির সামন দিয়া ভাটার মাছ ঢোকার পথ আছে, আবার পিছন দিক দিয়া উজাইন্যা মাছ ঢোকার পথ আছে। মাছ ঢোকপার পায়, বাইরবার পায় না। দিনাপত্তি সকালে বাইনাতি চাওয়া য়ইত। বাইনাতি পাতার সুম মুখ কাঠের, নইলে বাঁশের কচি দিয়া বন্ধ কইরা দেও য়ইত। হেইডা খুইলা মাছ খালইর মদ্যে ঢাইল্যা দেও য়ইত। বেশি ভাগ বাইনাতিত গুত্তুম আর দারকিনা মাছ বাজত। ইন্যা পিয়াজ কাঁচা, মইচ, হৌষার তেল দিয়া ভাজা ভাজা কইরা খাইলে কিবা মজাই যে নাগত গ! যেনুকার বাতর মোটা আছাল, হেনুকার বাতর ভাঙ্গাও বড় বড় আছাল। হেনু বাইনাতি না পাইত্যা বড় বড় দোয়ারি পাতন নাগত। দোয়ারি বাইনাতির নাগালা দুইমুরা চোক্কা না। দোয়ারি অইল বাসকর মোত। ইন্যাও বাঁশের হলা দিয়া বুনাইয়া বানায়।

আশ্বিন মাসে বেশি বিস্টি অইত না। ধানের গোছাগুনাও মোটা মোটা অইত। হেইন্যার ভিতর দিয়া মাছ কপ কপ করত। য়ইদের তাপে ক্ষেতের পানি ততা অই গেত। মাছগুনা যেম্মুরা গাছের ছেওয়া পড়ত হেম্মুরা আই পড়ত। আমরা স্কুল তিগা আইয়া বশ্যি নিয়া মাছেরে গেতাম। বশ্যির আধার গাত্তাম খই, কুত্তাডেউয়ার আন্ডা, নয় চেরা দিয়া। চেরাগুনারে জির কিরমিরমির নাগালা দেহা গেত। উন্যারে গাছতলের ভিজা মাটি তিগা কোদাল দিয়া কোবাইয়া বাইর কইরা ছেনি দিয়া টুকরা টুকরা কইরা কাইট্যা নিতাম। বড় বড় পিপড়াগুনারে আমরা ডেউয়া কইতাম। কুত্তার মোত অইলদা য়োংগের ডেউয়ারে কইতাম কুত্তাডেউয়া। গজারি গাছের আগায় পাতা পেঁচাইয়া কুত্তাডেউয়ায় বাহা বানাইয়া আন্ডা পারত। হেই আন্ডা দিয়া বশ্যি হালাইলে বেশি মাছ ধরত। তরুই বাঁশ দিয়া বশ্যির ছিপ বানাইতাম। না পাইলে বৌরাবাঁশের কুইঞ্চা দিয়া ছিপ বানাইতাম। খালই বুনাইতাম তল্যা বাসের বেতি দিয়া। গোছা ক্ষেতে বশ্যি ফালাইলে বড় বড় আগ্যা মাছ ধরত। পানির মদ্যে বশ্যি নাচাইলে আগ্যা মাছ ফালাই ফালাই আইয়া বশ্যির আইংটায় বাইজা পড়ত। খোট্টা দিয়া টানে তুইল্যা হালাইতাম। কোন কোনডা ছুইট্টা গিয়া আড়া জোংগলে গিয়া পইরা হাটি পারতে থাকত। পাতা খুচখুচানির শব্দ হুইন্যা আগ্যা মাছের ঘারে ধইরা খালইর মইধ্যে ভইরা ফালাইতাম। মাছ যাতে তাজাতুজা থাহে হেইজন্য জগের মইদ্যে নয় বদনার মইদ্যে পানি দিয়া জিয়াই য়াকতাম। আগ্যা মাছ জাইরা আছে৷ বদনায় য়াকলে আগ্যা মাছ হাটি মাইরা বাইরই গেত দেইখা হিসার জগে য়াকতাম। শিক্ষিত মাইন্সে আগ্যা মাছরে রাগা মাছ কইত ফ্যারাংগি দেহাইয়া। ভৌরা মাইনষে আগ্যা মাছ খাইত না। তারা গুত্তুম মাছও খাইত না। বংশি-মান্দাইরা চুইচ্চা খাইত। তারা কাছিমও খাইত। কাছিম জোংগলেও থাকত। ইন্যা খুব বড় বড় ছিল। ইন্যারে কইত দুরা।

বাইদের পানির টান পরলে মাছগুনা পাগার, জোরায় গিয়া জরা অইত। আমরা হেইন্যারে খুইয়া, জালি, জাহি জাল, নয় ছিপজাল দিয়া মাইরা খাইতাম। বিষগোটা ছেইচ্ছা পাগারে ছিটাই দিলে মাছ গাবাই উঠতো। গাবাইন্যা মাছ ধইরা আরাম পায়ন গেত। পাগারের মাছ, জোরার মাছ ইন্যা পালা মাছ আছাল না। তাই যে কেউ ইন্যা মারতে পারত। আমরা চন্দের জোরা, আলম ঠাকুরের জোরা, ওহা বেপারির জোরা, খাজাগ জোরা, নাটুগ পাগার, কলুমুদ্দি তাওইগ পাগার তিগা ভরা মাছ মারছি। ঘাট চওনার জোরায় তনে ভরা ইচা মাছ মারছি খুইয়া দিয়া দোয়াইয়া। এনুকার পানি কইমা গেলে কেঁদার নিচে বাইং মাছ বই থাকত। কেঁদা পারাইলে পায়ের নিচে পিচলা নাগত বাইং মাছ। পায়ের নিচ দিয়া য়াত দিয়া কেঁদা হুইদ্যা বাইং মাছ টানে মেইল্যা মারতাম। য়াত দিয়া ধরতে গেলে বাইং মাছ পিচিল্যা যায় গা। একবার করছিলাম কি, এবা কইরা এডা মাছ কেদাসুদ্যা মেইল্যা মারছি, হেডা গিয়া পড়ল এডা ঝোপের ভিত্তরে। আমি ঝোপের ভিতর ফুস্কি দিয়া দেহি মেলা মাইনষের কংকাল, এহেবারে ঠেংগি দিয়া য়াকছে। ডরের চোটে তাত্তারি মাছ মারন বাদ দিয়া বাইত আই পরছি। য়াইতে হুইয়া হুইয়া বাবার নগে হেই কতা কইছি। বাবা কইল যে বংশি – মান্দাইরা কলেরা-বসন্ত হইয়া বেশি মানুষ মইরা গেলে চিতায় না পুইরা এবা ঝোপের মইদ্যে পালা দিয়া য়াকত। হেইন্যা মোনয় হুকাইয়া কংকাল অইছে।

কাতিমাসে বেশি মাছ মারন গেত। বাইদের ছোট ছোট গাতায় ভরা মাছ থাকত। টিনের থালি দিয়া হেই পানি হিচ্চা মাছ ধরতাম। এলকা পানি হিস্তে কষ্ট অইত। হেইজন্যে হাজা ধইরা হিচা মাছেরে গেতাম। পানি হিচা যে যেডি ধরাহারি হেডি ধইরা নিয়াইতাম। শাজাহান ঠিকমোত চোহে দেকত না। কেঁদার মইদ্যে খালি আতাপাতা করত। এই জন্যে যদি কইতাম “শাজাহান, হিচা মাছেরে যাবি নিহি?” শাজাহান কইত “ভাগে নিলে যামু।” আমি যে বোছর সেভেনে পড়ি, হেই ১৯৭৩ সোনে, হে ট্রাক্টরের চাকার নিচে পইরা মইরা গেছে। অহনো তার নিগা আমার পরণ পোড়ে। কেঁদার মইদ্যে মাছ ধরতে গেলে শইলে কেদা নাগত। যতই বালা কইরা গোসল করতাম কানের নতির পাছে কেদা নাইগাই থাকত ধলা অইয়া। খাবার বইলে পড়ে মা হেই কেঁদা আচল দিয়া মুইছা দিত।

কাতিমাসে পাহারের পানি হুকাই গেলে সব মাছ গিয়া চাপরাবিলে জরা অইত। মাছে বিল কপকপ করত। হুনিবার মোংগলবারে চাপরাবিলে মাছ মারনের নিগা মানুষ পিল্টা পরত। হেইডারে কইত বাওয়ার মাছ। বেশি মানুষ একবারে পানিত নামলে মাছ গাবাই উঠতো। তাই ধরাও পড়ত বেশি বেশি। এই জন্য সবাই বিলে মাছেরে যাওনের নিগা ডাহাডাহি পারত। অনেকে পরভাইত তিগাই শিংগা ফুয়াইত। শিংগার ফু হুইন্যা পাহাইরা মানুষ গুনা যার কাছে যেডা আছে হেডা নিয়া ভাইংগা চুইরা আইত চাপরা বিলে। এক নগে জাহইর দিয়া বিলে নামত নানান ধরনের জিনিস নিয়া। হেন্যা অইল মোন করুন চাবি, পলো, টেপারি, ফস্কা, কোচ, খুইয়া, জালি, ছিপজাল, ঝাকিজাল, চাকজাল আরও কত কী! ইলশা মাছ ছাড়া আর যত ধরনের মাছ আছে সব পাও গেত এই বিলে। খালইর চাইরমুরা পাটখরির মোঠা বাইন্দা দিত যাতে খালই পানিত ভাইসা থাহে। বড় বড় খালই ভইরা মাছ আইন্যা উঠানে ঢাইল্যা দিত। মেওপোলা মাইনষে হেইন্যা দাও বটি দিয়া কুইটা পাট খরিতে গাইতা দড়ি দিয়া ঝুলাইয়া অইদে হুকাইয়া হুটকি কইরা য়াকত নাইন্দার মইদ্যে। খাইত কয় মাস ধইরা। চাপরা বিলের আশে পাশের পাহাইরা গ্রামের মানুষ তিগা নিয়া হেম্মুরা হেই আংগারগাড়া পর্যন্ত মানুষ চাপরা বিলের মাছ মারতে আইত। হেই গেরামের নামগুনা আমি কইতাছি হুনুন – গবরচাহা, বৈলারপুর, য়ামুদপুর, বাঘেরবাড়ি, বেড়িখোলা, আন্দি, হুরিরচালা, চেল ধারা, নাইন্দা ভাংগা, গড়বাড়ি, বুড়িচালা, ইন্দাজানি, কাজিরামপুর, আদানি, ভাতগড়া,, ভুয়াইদ, পোড়াবাহা, ছিরিপুর, খুইংগারচালা, চটানপাড়া, ছোট চওনা, বড় চওনা, ঢনডইনা, হারাইসা, বাহার চালা, কাইলা, কৌচা, আড়াই পাড়া, ধলি, জামাল আটখুরা, দাইমা, ডাকাইতা, আরও ভরা গেরাম যেগ্নার কতা অহন মোনাইতাছে না। আমি হুনছি ভৌরারা চাপরা বিলে মাছেরে আইত না। আব ক্যা, তাগ কি মাছের অভাব আছে?

আংগ খালাগ বাড়ি মাইজ বাড়ি, আর বুগ বাড়ি অইল আমজানি। দুইডাই গাংগের পারে। বংশি নদীডারে আমরা গাং কই। আপারে আমরা বু ডাকতাম। জৈস্টি মাসের হেষের দিকে গাং পানিতে ভইরা যাইত। আমি বুগ বাইত গেলে, খালাগ বাইত গেলে বশ্যি নইয়া গাংগে মাছেরে গেতাম। আমজানির এবাদত ভাই, য়শি ভাই, হায়দার ভাই, আর মাইজ বাড়ির ইয়াছিন, ইসমাইল ভাইর নগে বশ্যি বাইতাম। ইয়াসিন ক্যান্সার অইয়া মইরা গেছে। তার নিগাও পরণ পোড়ে। আমার খালাত ভাই। বড় বড় নাইয়া বাইং, গুজা মাছ, হেলাম পুটি, বাইলা মাছ ধরত বশ্যিতে। ধরার আগে মাছে আধার ঠোকরাইত। হেসুম পাতাকাটি পানিতে নাচন পারত। তা দেইখা মোনের মইদ্যেও নাচন আইত। পাতাকাটি তল অইলে খোট্টা দিয়া মাছ তুইল্যা ফালাইতাম। বশ্যির মইদ্যে আটকাইয়া মাছ দাফরাইতে থাকত। কান্তা তিগা বশ্যি খুইলা মাছ খালইর মইদ্যে য়াকতাম। বুগ পাট ক্ষেতে চলাচলা পুটি মাছ দৌড় পাড়ত। হেইন্যা য়াত দিয়াই ধইরা ফালাইতাম। খালুই ভইরা যাইত পুটি মাছে। একটা আগ্যা মাছ ধরছিলাম দেইক্যা য়শি ভাই কয় “শালার পাহাইরায় আগ্যা মাছ ধরছে। আগ্যা মাছ মাইনষে খায়?” অশি ভাই দুলাভাইর চাচত ভাই। হেও মইরা গেছেগা। আগন পুষ মাসে গাংগের পানি কুইমা যাইত। কয়জনে মিল্যা গাংগে ঝার ফালাইত। হেই ঝারে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইর মাছ, চিতল মাছ জরা অইত। ডল্যা জাল, নয় ঝাকি জাল, নয় চাক ঝাল দিয়া হেইন্যা ধরত। দুলাভাইরা কয়জনে ভাগে গাংগে ঝার ফালাইছাল। হেই ঝার তনে একটা মস্ত বড় পাংকাশ মাছ

ধরছাল। হেইডা কাইটা ভাগ কইরা নিছাল দুলাভাইরা। হেসুম বু আংগ বাইত্যে আছাল। দুলাভাই হেন তিগা এক ভাগা আংগ বাইত্যে নিয়াইছাল। আমি হেসুম দুল্যা আছিলাম। পাংকাশ মাছের নাম হেদিন হুনলাম। হায়রে মজা নাগছাল হেইডা!

আংগ নানিগ বাড়ি অইল ভরে, য়ৌয়া গেরামে। শিক্ষিত মাইনষে কয় রৌহা। হেনু গিয়াও মাছেরে গেছি। য়াইত কইরা আন্ধাইরের মইদ্যে বোরো ধান ক্ষেতের বাতর দিয়া আইটা যাওনের সোম হলক ধরাই যাইতাম। হলকের আলো দেইখা হৈল মাছ আইগাই আইত। কাছে আইয়া চাই থাকত। হেসুম ফস্কা দিয়া ঘাও মাইরা ধইরহালতাম। যাগ ফস্কা না থাকত তারা পাট কাটনের বাগি দিয়া কোপ মাইরা হৈলের ঘার কাইটাহালত। হৈল মাছ, সাইতান মাছ এক ঝাক পোনা নিয়া ঘুরাঘুরি করত। হেই পোনা খুইয়া দিয়া খেও দিয়া মারতাম। পোনামাছ ভাজি খুব বাসনা করত। এহন বুঝি উগ্না মারন ঠিক অয় নাই।

বাইস্যা মাসে আমি, ফজু ভাই, কাদে ভাই, নজু ডিংগি নাও নিয়া হুক্নি বিলের মইদ্যে গিয়া বশ্যি ফালাইতাম। বড় বড় ফইল্যা মাছ ধরত। নজু আমার তিগা এক বোছইরা ছোট আছাল। হে ছোট বালাই য়ক্ত আমাশা অইয়া মইরা গেছে। আশিন মাসে পানি নিটাল অইয়া গেত। চামারা ধান ক্ষেতের ভিতর হল্কা মাছ খাওয়া খাইত। হেসুম পানিত ছোট ছোট ঢেউ উঠত। আমি আর ভুলু ভাই ডিংগি নাও নিয়া যাইতাম মাছেরে। আমি পাছের গলুইয়ে বইয়া নগি দিয়া নাও খোজ দিতাম। ভুলু ভাই সামনের গলুইয়ে কোচ নইয়া টায় খারই থাকত। বিলাইর নাগালা ছপ্পন ধইরা। মাছে যেই য়া কইরা কান্তা নড়াইত অবাই ভুলু ভাই কোচ দিয়া ঘাও দিয়া ধইরা ফালাইত। আমি পৌকের নাগাল পাছের গলুইয়ে বই থাকতাম। ভিয়াইল আংগ ফুবুগ বাড়ি। হেনু গিয়াও এবা কইরা মাছ মারতাম গিয়াস ভাই, মতি ভাই, সূর্যভাই, সামসু ভাই, জিয়াবুল ভাই, চুন্নু ভাইগ নগে। চুন্নু ভাই, জিয়াবুল ভাই মইরা গেছে। ভিয়াইল আংগ কাক্কুগ বাড়িও। হায়দর ভাইর নগেও এবা কইরা মাছ ধরছি। ভৌরা মাইনষে আশিন মাসে পানির দারার মইদ্যে বড় বড় খরা পাইত্যা নোড়া ফেকা মাছ মারত। ফুবার নগে গিয়া ভরা নোড়া ফেকা মাছ কিন্যা আনছি নায় চইরা। কাতি মাসে তালতলাগ বোগল দিয়া যে বিলগুনা আছাল হেইগ্নার যত মাছ গোলাবাড়ির খাল দিয়া আমজানির গাংগে গিয়া নামত। আংগ গেরামের মাইনষে হেই খালে ছিপ জাল পাইত্যা হেই মাছ ধরত। খালের পাড়ে মাচাং বাইন্দা বইয়া বইয়া ছিপজাল বাইত। এহাকজোনে বাইক কান্দে নইয়া এক মোন দের মোন গোলাবাড়ি তিগা মারা পুটিমাছ আইন্যা উঠানে ঠেংগি দিয়া ঢালত। এত মাছ কিবা কইরা মারে ইডা দেকপার নিগা আমি আর জিন্না ভাই এক নগে গোলাবাড়ি গিয়া য়াইতে মাচাংগে হুইছিলাম। যাওনের সুম দেহি হাইল হিন্দুইরা খালে গুদারা নাই। অহন পাড় অমু কিবায়? ঘাটে কোন মানুষ জোনও আছাল না। জিন্না ভাই কইল “তুই অম্মুহি চা।” আমি চাইছি। ঘুইরা দেহি জিন্না ভাই এক য়াতে কাপর উচা কইরা ধইরা আরেক য়াত দিয়া হাতুর পাইরা খাল পাড় অইতাছে। দিস্ কুল না পাইয়া আমিও কাপড় খুইলা এক য়াতে উচা কইরা ধইরা হাতুর পাইরা পার অই গেলাম। য়াসুইন না জানি। হেসুম পোলাপান মানুষ আছিলাম। কেউ ত আর আংগ দেহে নাই। শরমের কি আছে? গোলাবাড়ি গিয়া দেহি হারা খাল ভর্তি খালি ছিপ জাল। ষাইট সত্তুরডা জাল পাতছে ছোট্ট এডা খালে, ঘোন ঘোন, লাইন দইরা। বেক্কেই য়াইত জাইগা জাল টানে। দিনে বেশি মাছ ওঠে না। য়াইতে নিটাল থাকে দেইখা মাছ খালে নামতে থাহে। দিনে বেক্কেই ঘুমায়। আমি আউস কইরা কয়ডা খেও দিছিলাম। অত বড় জাল আমি তুলবার পাই নাই। তাত্তারি মাচাংগে গুমাই পড়ি। হেষ আইতে ঘুম ভাইংগা যায় জারের চোটে। কাতি মাস অইলে কি অব, য়াইতে জার পড়ত। দেহি য়াত পাও টেল্কায় শান্নিক উইঠা গেছে গা। বিয়ান বেলা কোন মোতে কোকাইতে কোকাইতে বাইত আই পড়লাম। এন্তিগা এবা সর্দি নাগল গ, এক হপ্তা পর্যন্ত সর্দি জ্বর বাইছিল। জ্বর নিয়া কাতি মাসে বিয়ানবেলা য়ইদ তাপাইতে বালাই নাগত। এক নাক ডিবি ধইরা বন্ধ অই থাকত। নজ্জাবতি ফুলের বোটা ছিড়া নাকে হুরহুরি দিলে বাদা আইত। হাইচ্চ দিলে নাক বন্ধ খুইলা গেত। জোড়ে জোড়ে নাক ঝাইরা পরিস্কার করতাম। আমি গোলাবাড়ি একবারই গেছিলাম।

গোলাবাড়ির মাছ মারা নিয়া এডা মজার কতা কই। একবার এডা মেওপোলা য়োগী নিয়া আইল এক বেটা আংগ এলাকা তিগা। কাগজপাতি ঘাইটা দেকলাম সখিপুর আর টাঙ্গাইল তিগা ভরা টেহার পরীক্ষা করছে। খালি টেহাই গেছে। আমি কইলাম “ভরাইত পরীক্ষা করছুইন।” বেটাডায় য়াগ কইরা কই উঠলো “আন্নেরা সখিপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিং য়োগীগ কাছ তিগা টেহা নিয়নের নিগা গোলাবাড়ির খালের মতো জাল ফালাইছুন ক্লিনিক কইরা। গোলাবাড়ির খালে যেবা উজান ভাটি সব জালেই হোমানে মাছ বাজে, হেবা আন্নেগ বেবাক ক্লিনিকেও গেরামের মাইনষের টেহা বাজে। বেটা মাইনষে বিদেশে কষ্ট কইরা টেহা কামাই কইরা দেশে পাঠাইতাছে, আর হেই টেহা আন্নেরা জাল পাইত্যা ছাইব্বা তোলতাছুইন। য়োগী বালা অওনের নাম নাই। খালি টেহা নিতাছুইন। ” আমি কইলাম “য়োগী ডাকতরেরা বালা করবার পাবনা। বেটির জামাইরে দেশে নিয়াই পড়ুন। দেকবাইন এবাই বালা অই যাবো গা। “

জারের দিনে নানিগ বাড়ির চহের পানি হুকাই গেত। পাগারের পানি পানায় ঢাইকা গেত। আমি আর ফজু ভাই হেই পানিত তিগা খুইয়া দিয়া দোয়াইয়া মাছ মারতাম। ফজু ভাই পানার নিচ দিয়া খুইয়া ঠেইল্যা দিত। পানা হুইদ্যা খুইয়া উচা কইরা ধরত। আমি খাবলাইয়া পানা হরাইয়া দিতাম। হেই খুইয়ায় খইলসা মাছ, চাটা মাছ, কই, জিওল, মাগুর মাছ উঠত। চাটা মাছ খইলসা মাছের নাগালা দেখতে, তে একটু ছোট। আমি চাটারে খৈলসা কইছিলাম দেইকা ফজু ভাই কইল “এই শালার পাহাইরা, চাটা মাছ চিনে না!” তিন আংগুল দিয়া মাথা আর ঘার পেইচা ঠাসি মাইরা ধরন গাগত জিওল মাছেরে। কাতা দেয় দেইকা আমি ডরে জিওল মাছ ধরহাইতাম না। একদিন সায়স কইরা ধরবার নিছিলাম। অবাই একটা কাতা খাইলাম। হায়রে বিষান নইল! বিষের চোটে উজা নাফ পারন নইলাম। কানতে কানতে নানিগ বাইত গেলাম। মামানি কাতা দিওন্যা যাগায় চুনা নাগাই দিলে বিষ কিছুডা কমল। তারপর বিষ নামাইন্যা ঝারা দিল এবা কইরা

আউরা জাউরা বিষের নাম,

কোন কোন বিষের নাম।

অ বিষ ভাটি ছাইড়া যাও।

যুদি ভাটি ছাইরা উজান ধাও,

মা পদ্মার মাথা খাও।

অ বিষ ভাটি ছাইরা যাও।

ঝারা দেওনের ভরাক্ষোন পরে বিষ কোমলে ঘুমাই পড়ি। আমি আর কূন্দিন কাতা খাই নাই। কাতা খাইয়া এডা উপুকার অইছে। য়োগিরা যেসুম কয় “য়াত পাও এবা বিষায় জানি জিওল মাছে কাতা দিছে। ” হেসুম আমি বুঝি কিবা বিষায়।

শাওন ভাদ্দর মাসে আমজানি দুলাভাইগ পালানের পাট কাটার পরে কোমর তুরি পানি থাকত। হেই পানিত চেলা, মলা, ঢেলা, বাতাসি, তিতপুটি, এবা ভরা মাছ থাকত। দুলাভাইর নগে মুশুরি টাইনা হেইন্যা ধরতাম হিসার পাইল্যা বোজাই কইরা। হিসার পাইল্যা পানিত ভাইসা থাকত। মাছ ধইরা পাইল্যায় য়াকতাম।

চৈত বৈশাখ মাসে পানি হুকাই যাইত। নানিগ বোরো ক্ষেতে হিচা দিয়া পানি হিচপার নিগা গাড়া কইরা মান্দা বানাইত। হেই মান্দা হিচা মাছ ধরতাম। অইদের তাপিসে কাঠের নাও হুকাইয়া বেহা ধইরা গেত দেইখা ইন্যারে পুস্কুনির পানিতে ডুবাই য়াকত। নায়ের পাটাতনের নিচ দিয়া মাছ পলাই থাকত। আমরা দুই তিন জোনে মিল্যা ঝেংটা টান মাইরা নাও পারে উঠাই ফালাইয়া নাও তিগা মাছ ধরতাম। মামুরা পুস্কুনিতে ডল্যা জাল টাইনা বড় বড় বোয়াল মাছ ধরত। জালে মইদ্যে বাইজ্যা হেগ্নায় হাটিহুটি পারত। মামুগ কান্দের উপুর দিয়া নাফ দিয়া যাইত গা বড় বড় বোয়াল। পুস্কুনির পাড়ে খারইয়া আমরা তামসা দেখতাম।

মাছ মারনের এবা ভরা কতা লেহন যাবো। কিন্তু এত সোময় আমার নাই। আন্নেরা ত জানুইনই আমি একজোন ডাকতর মানুষ। ডাকতরে গ কি অত সোময় আছে? একটা হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান আমি। দিনাপত্তি বিয়ানবেলা সারে আটটা তিগা বিকাল আড়াইডা পর্যন্ত হেনু কাম করন নাগে। বৈকাল চাইরডা তিগা য়াইত নয়ডা পর্যন্ত নিজের প্রাইভেট ল্যাবরেটরিতে কাম করি। হেনু গেরামে তিগা মেলা লোক আহে। তাগ নগেও কতা কওন নাগে। শুক্কুরবারে বন্ধ থাহে। হেদিন য়াবিজাবি কাম করি। চাইরডা মেডিকেল জার্নাল সম্পাদনা করন নাগে আমার। বই লেহি। কম্পিউটারের সফটওয়্যার বানাই বিক্রি করি। ছাদবাগান করি। অনলাইনে ক্লাস নেই। জুমে মিটিং করি। ইউটিউব ভিডিও বানাই। মেয়াগ নগে, নাতি নাত্নিগ নগে, বন্ধুগ নগে, শালা সুমুন্দি গ নগে ভিডিও কলে কতা কইতে য়য়। এবা আরবিলের মইদ্যে থাকি। আন্নেগ নগে মাছ মারা নিয়া আর লেহনের সোময় নাই। অহন চেম্বারে যামু, থাইগ্যা। দোয়া করুইন জানি।

১৩/৭/২০২১ খ্রি.

ময়মনসিংহ

Dipok

আমাদের ফার্স্ট বয় দীপক


দীপক। দীপক কুমার ধর। ডা. দীপক কুমার ধর। ডক্টর দীপক কুমার ধর, পিএইচডি। আমাদের এমবিবিএস ক্লাসে সব পরীক্ষায় যে ফার্স্ট হতো তার কথা মনে পড়ছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফার্স্টবয় মানে হলো অত্যন্ত মেধাবী। আমাদের সময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের গুরত্ব ছিল ঢাকার পরেই  । বড় বড় নাম করা চিকিৎসক এই কলেজ থেকেই বেরিয়েছে। আমরা ছিলাম ১৭ নাম্বার ব্যাচের। বলা হয় এম-১৭। আমাদের আগের এম-১৬ নাম্বার ব্যাচের ফার্স্টবয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল স্যার ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তী শিক্ষক। অনেকগুলি পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রী তিনি অর্জন করেছিলেন। খ্যাতির চুরান্ত সীমায় পৌছে অল্প বয়সেই ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। হিসাব করলে দেখা যাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অনেক মেধাবী ছাত্র পরবর্তীতে চিকিৎসক হয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। এই মেডিকেল কলেজে শুধু চিকিৎসা শিক্ষাই চর্চা হতো না, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপেও এখানকার ছাত্ররা বেশ পারদর্শী ছিল। এখানকার ছাত্ররা বাংলাদেশ রেডিও ও টেলিভিশনে অনেকেই ভালো পারফর্ম করে থাকে। অনেকেই ভালো কবি সাহিত্যিক। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বেশ উর্বর। সরকারি দলেরই হোক আর বিরোধী দলের পক্ষেরই হোক, এই কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক নেতারাই মুলত বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। শুধু দেশেই না, বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা ডাক্তার হয়ে রাজনীতি করে এম পি মিনিস্টার হয়ে গেছেন। ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ লোটে শেরিন এম-২৮ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দর্জিও এম-২৪ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে খোদ বাংলাদেশেরই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান এম পি এম-৩০ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। আমি আরো স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি অচিরেই আরো অনেকে এম পি মন্ত্রী হবেন প্রাক্তন এমএমসিয়ানদের থেকে। এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একজন ফার্স্ট বয় ছিল আমাদের দীপক।

দীপককে আমি প্রথম চিনলাম তার এনাটমি কার্ডে বেশী বেশী মার্ক পাওয়ার জন্য। সব সময় সে সবার থেকে বেশী মার্ক পেতো কার্ড পরীক্ষায়। আরেকটা বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করলো। সেটা হলো তার সুন্দর ঝড়ঝড়ে হাতের লেখা। একবার সদর উদ্দিন  এক বড় ভাইকে দেখিয়ে বলল “ইনি ফাইনাল ইয়ারের ফার্স্ট বয়। প্লেস করা ছাত্র। আমাদের ক্লাসের দীপকের বড় ভাই দীলিপ কুমার ধর ।” দুইজনই তুখুর ছাত্র। সেই দীলিপ দা এখন অবসর নিয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে। তিনি সেই মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছিলেন। বেশ কিছুকাল তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আমিও প্রায় ১৪ বছর এই মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছি। দীপকের ক্লাসমেট হিসাবে আমাকে বেশ স্নেহ করতেন তিনি। ক্লিনিক্যাল সেমিনারগুলিতে দীলিপ দা বেশ বিজ্ঞ ভুমিকায় অংশ গ্রহণ করতেন। তার উপস্থিতিতে সেমিনার সমৃদ্ধ হতো।
দীপক আর আমি বাঘমারার হোস্টেলের একই বিল্ডিং-এ ছিলাম প্রায় ৫ টি বছর। বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন সময় থাকলেও শেষের দিকে আমরা একই ফ্লোরে কাছাকাছি ছিলাম। দুই জনের কক্ষ দুই পাশে ছিলো। মাঝখানে ছিল ৩/৪ টি কক্ষ । তার রুমের সামনে একটা ফাকা যায়গা ছিলো। সেখানে একটি ভাংগা টেবিল ছিলো। শীতের দিনে সেখানে বসে আমরা গল্প করতাম। পড়া নিয়েও করতাম, পড়া ছাড়াও করতাম। তখন আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। দীপক কি যেন এক সিনেমা দেখেছিলো যেটা আমি দেখি নি। সেই সিনেমা দেখার পর সে আমাকে দেখেই বলতো “তালুকদার বানগিয়া।” আমি বললাম “কি সব বলছো, তালুকদার বানগিয়া।” সে বললো “আমরা একটা সিনেমা দেখেছি সেখানে নায়িকা শাবানা সুইপারের অভিনয় করে। ভিলেন খুবই পাঁজি একজন তালুকদার। শাবানার কমন একটা ডায়ালগ ছিলো তালুকদারকে উদ্যেশ্য করে “তালুকদার বানগিয়া।” তালুকদারটা পাঁজিও ছিলো। হায়রে পাঁজি! তোমাদের পুর্বপুরূষ তো তালুকদারি করেছে। তারাও কি এমন পাঁজি ছিলো?” এইভাবে কত গল্প করে সময় কাটিয়েছি দীপকের সাথে। দীপক হালকা গিটার বাজাতে পারতো। পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তো তখন সে সেই খালি জায়গায় বসে গিটারে সুর বাজাতো। গিটারের টুংটাং সুর শুনে আমিও আকৃষ্ট হয়ে তার কাছে এসে বসতাম। সে বলতো “সাদেইক্কা, নাক বাজাও।” আমি নাক দিয়ে মিউজিক বাজাতে পারতাম। কেউ না দেখলে সেই মিউজিককে গিটার অথবা সাঁনাইয়ের মিউজিক মনে করতো। এই নাক আমি স্কুল কলেজে অনুষ্ঠানে অনেকবার বাজিয়েছি। পুরস্কারও পেয়েছি। এখনো পুরনো বন্ধুরা অনেকদিন পর দেখা হলে বলে “আরে, নাকের বাঁশী, কেমন আছো?”

দীপক গিটার বাজাতো। গিটারের ফাকে ফাকে গিটারের সুরে আমি নাক বাজাতাম। জমতো ভালো। দীপককে শুধু একটি গানই বারবার গাইতে ও বাজাতে শুনেছি। রবীন্দ্রসংগীত। গানটির সম্পুর্ন কখনো গাইতে বা বাজাতে তাকে শুনি নি। হয়তো প্রথম লাইন একবার, দুইবার, তিনবার বা কয়েকবার গাইলো। পরে শেষের অংশ কয়েকবার অথবা মাঝের অংশ কয়েকবার গাইলো। গাইতো কিন্তু নিচু স্বরে। দূর থেকে শুধু গিটারই শুনা যেতো।
একবার গাইতো
“দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে
আমার বাটে বটের ছায়ায়
সারা বেলা গেলো খেলে
আ আ আ আ হা আ…..।।। ”
কিছুক্ষণ বাজিয়ে আবার হয়তো গাইলো
“গাইলো কি গান
সেই তা জানে
সূর বাজে তার আমার প্রাণে।
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে।।
আ আ আ আ হা আ।।”
কিছুক্ষণ আমি বাজানোর পর ও হয়তো গাইলো
“আমি যবে জিগাই তারে
কি তোমারে দেবো আনি?
সে শুধু কয় আর কিছু নয়
তোমার গলার মালা খানি।
দেই যদি তো, কি দাম দেবে?
যায় বেলা সেই ভাবনা ভেবে।
ফিরে এসে দেখি ধুলায়
বাঁশীটি তার গেছে ফেলে। ”

আমি শুনতে শুনতে কল্পনা করতাম “রবি ঠাকুর কাছারির বেলকনিতে বসে বসে গল্প-কবিতা লিখছেন। কাছারির পাশের বটের ছায়ায় বসে গ্রামের রাখাল বাঁশী বাজাচ্ছে রাখালিয়া সূরে, যেমনটি আমি কৈশোরে শুনতাম আমাদের গ্রামে বটের তলায় অথবা জয়না গাছের গোড়ায়। অথবা পলাশতলীর হিজল তমালের নিচে। আমার সেই রাখালির সূর প্রাণে বাজতো। রবি বাবু সেই সূরের কথা কিছু বুঝতে পারতেন না। কিন্তু সেই সূর তার কানে বাজতো। যেমন বাজে আমার প্রাণে। কল্পনায় রবি বাবু বাঁশীটি চেয়েছিলেন, বিনিময়ে সে তার গলার মালাটি চেয়েছিলো। ভাবতে ভাবতে বেলা শেষ। শেষে দেখা গেলো বাঁশীটা সে ধুলায় ফেলে গেছে।” এইসব ভাবতাম গান শুনে। একসময় রুমে গিয়ে আবার পড়া শুরু করতাম মেডিসিন, সার্জারি , গাইনি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে দোতলা থেকে স্বপন, নজরুলরাও এসে যোগ দিতো আমাদের সাথে। তখন গান বাদ দিয়ে নাটক, সিনেমা ও উপন্যাস নিয়ে আলাপ হতো। স্বপন ছিল প্রথম দিকে আমাদের মধ্যে থার্ডবয়। শেষের দিকে সে সেকেন্ড ছিলো। ডা. মিজানুর রহমান স্বপন। এমবিবিএস পাস করেই মেডিসিনে এফসিপিএস করেছিলো। পরে কার্ডিওলজিতে এম ডি করেছে। সে এখন খুলনায় আছে। স্বপনের বৈশিষ্ট্য ছিল সে সব সময় শুয়ে শুয়ে পড়তো, খুব বিনোদনমুলক ম্যাগাজিন পড়তো এবং কিছু আনন্দের সংবাদ শুনলেই বলতো “দোস্তো, চলো তাইলে প্রেস ক্লাবে বিরিয়ানি খাই।” স্বপন সব পরীক্ষায়ই ঢাকা ইউনিভারসিটিতে প্লেস করেছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হয়। আমাদের সময় ৪ টি প্রফেশনাল পরীক্ষা ছিলো এমবিবিএস কোর্সে। মেধা তালিকায় প্রথম ১০ জনকে প্লেস দেয়া হয় রেজাল্টে। স্বপন ও দীপক সবগুলিতেই প্লেস করেছিলো। কোন বিষয়ে ৮০% বা তার উপরে নম্বর পেলে অনার্স মার্ক বলা হয়। দীপক, জামিল, স্বপন ওরা অনেকবার অনার্স মার্ক পেয়েছে। শেষ পরীক্ষায় প্রয়াত নাজমা গাইনিতে অনার্স মার্ক পেয়েছিলো। প্লেস পেয়েছিলো কি না জানি না। আরো কেউ প্লেস বা অনার্স পেয়েছিলো কিনা এখন আমি মনে করতে পারছি না।
জামিল ছিলো প্রথম দিকে সেকেন্ড বয়। প্লেস করতো এবং অনার্স মার্ক পেতো। ডা. হোসাইন লিসান জামিল। ক্লাসে (মরহুম) প্রফেসর আব্দুল হক স্যার প্রায়ই পড়া ধরতেন “এই, লিসান জামিল কই, লিসান বলো।” যেমনটি আমি বলে থাকি “এই মোশারফ বলো।” অথবা বলে থাকতাম “এই বাশার বলো”, “এই সাব্বির বলো”, “এই জ্যোতি বলো”, “এই সালমান বলো”, “এই লাইজু বলো” ইত্যাদি। জামিল পাস করেই কানাডা প্রবাসী হয়। আর তার সাথে দেখা হয় নি আমার। তবে কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছি।
১৯৮৫ সনের নভেম্বরে এমবিবিএস পাস করে ১৯৮৬ সনের নভেম্বরে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে আমরা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ি। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না। তাই প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমরা। আমাদের আগ পর্যন্ত যারা পাস করেছে তাদেরকে সরকার সাথে সাথে চাকরি দিয়েছে। আমাদের সময় থেকে সরকার সাথে সাথে চাকরি দিতে অপারগ হলো। বিচ্ছিন্ন ভাবে আন্দোলন করে কিছুই করা গেল না প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত। শেষে সারা দেশে দুর্বার আন্দোলন করে সব বেকার ডাক্তার এডহক ভিত্তিতে মেডিকেল অফিসার হিসাবে সরকারী চাকরি পেলাম। এদিকে এই দেড় বছরে অনেকে হতাস হয়ে অথবা ভালো ক্যারিয়ারের অথবা সুখে থাকার জন্য অথবা নিরাপদে থাকার জন্য দেশ ত্যাগ করে ইউকে, ইউএসএ, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমাল। আমি ছিলাম ঘর কোণো মানুষ। আমি এসবের চিন্তাও করতে পাড়ি নি। ইনসার্ভিস ট্রেইনিং করার সময় একটা বেতন পেতাম। সেই বেতন থেকে বাবাকেও কিছু দিতাম। মহা সংকটে পড়ে গেলাম বেকার হয়ে। এখন তো বাবার কাছে টাকা চাওয়া যাবে না। কি করব ভাবছিলাম। ঘাটাইলের কদমতলীর কাছে ছিলো আমার শশুর বাড়ী। কদমতলী বাজারে ফার্মাসিস্ট নজরুল ভাইর একটা ফার্মেসী ছিলো। তিনি অনুরোধ করে আমাকে বসালেন প্রেক্টিস করতে। ভালোই জমছিলো। কিন্তু ইচ্ছে হলো শহরে কিছু করার। তাই, একদিন কাজের সন্ধানে বের হলাম। প্রথমে গেলাম টাঙ্গাইলে এনজিও পরিবার পরিকল্পনা সমিতি হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার ব্যাচের অন্য মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা এক মেডিকেল অফিসার। তিনি ছিলেন দিনাজপুরের বর্তমান বিএমএ লিডার ডা. আহাদ ভাই। আলাপ করে বুঝলাম এখানে চাকরি নেয়া সম্ভব না। পাশেই ছিল আকুর টাকুর পাড়ায় এক মাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল নাহার নার্সিং হোম। সেখান থেকে জানিয়ে দিলেন পোস্ট খালি নেই। বায়োডাটা জমা দিয়ে যেতে বলায় একটা বায়োডাটা জমা দিয়ে চলে গেলাম মীর্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে। দেখলাম ওখানে আমাদের এম -১৭ এর ডা. সেবাব্রত ও ডা. সফি চাকরি করছে। শুনলাম যে ডা. দীপকও আছে এখানে। ঐসময় দীপকের ডিউটি না থাকায় দেখা হলো না তার সাথে। জানতে পেলাম এখানে চাকরিতে প্রবেশ করা সম্ভব না। প্রথম দিকে যোগাযোগ করার প্রয়োজন ছিলো। আফসোস নিয়ে ফিরে এলাম। ধুমছে প্রেক্টিস করলাম কদমতলীতে। দুই আড়াই মাস পর নাহার নার্সিং হোমের পরিচালক খোকা ভাই এলেন আমার কদমতলীর চেম্বারে। রোগীর ভীর দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে নিয়ে মেডিকেল অফিসারের চাকরি দিলেন। থাকার জন্য বাসা দিলেন। চাকরির পাশাপাশি বটতলায় প্রাইভেট প্রেক্টিশও করতাম। কিছুদিন পর হাসপাতালের মালিক মোয়াজ্জম হোসেন ফারুখ ভাই কাজে মুগ্ধ হয়ে আমাকে মেডিকেল ডাইরেক্টর বানিয়ে দিলেন। ১৯৮৮ সনে জুলাই মাসে সরকারি চাকরি হবার আগ পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। এক বছর বরিশালে বাকেরগঞ্জের চরামদ্দি গ্রামের সাব সেন্টারে চাকরি করেছি, আড়াই বছর নকলা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে চাকরি করে দেড় বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি করে ঢাকার শাহবাগের তদানিন্তন আইপিজিএমআর-এ এম ফিল (প্যাথলজি) কোর্স করছিলাম। এত দিনে অনেক ক্লাসমেটদেরকে ভুলতে বসেছি। বেশীভাগের সাথে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং-এর পর আর দেখা হয় নি। ১৯৯৪ কি ৯৫ সন হবে। খুব দ্রুত বেগে পিজিতে ক্লাস করতে যাচ্ছি। হঠাৎ ক্যাম্পাসের বটতলায় দীপক সামনে পড়লো। বললো
– কি, সাদেইক্কা না?
– কি, দীপইক্কা না? কই থাকো? কই থেকে এলে? কেমন আছো? সেই ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে আলাদা হলাম, নয় দশ বছর হয়ে গেলো। কেউ কারো খবর নিলাম না। আমি ক্লাসে ঢুকব, বল তাড়াতাড়ি, কি খবর?
– আমি তো কুমুদিনী হাসপাতালে প্রথম ছিলাম। ওখান থেকে মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান যাই। ওখান থেকে এমডি ও পিএইসডি করে একটি হাসপাতালে চাকরি করছি। এখানে এসেছি একটা প্রজেক্ট-এর আন্ডারে লেপারোস্কোপির উপর একটা ট্রেইনিং দেওয়াতে। আমারও সময় নেই, দোস্তো। দেখা হবে।

দীপক মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান গিয়েছিলো। আমি কোন বসুই চিনতাম না। চিনলে হয়তো আমিও  স্কলারশিপ নিয়ে জাপান যেতাম। না গিয়ে ভালো করেছি, না মন্দ করেছি, সে হিসাব এখন করছি।

তারপর অনেকদিন কেউ কারো খোজ নেই নি। এম ফিল পাস করে আমি ১৯৯৬ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ফিরে এলাম প্রভাষক পদে। ১৯৯৮ সনের মে মাসে সহকারী অধ্যাপকের পদ পেলাম। আমি এই ২১ বছর বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে এই সহকারী অধ্যাপক (প্যাথলজি) হিসাবেই আছি। ১৯৯৯ সন থেকে ইন্টার্নেট সংযোগ পাওয়ায় দীপকের সাথে আমার রেগুলার ইমেইলে যোগাযোগ হতে থাকে। ২০০২ সনের দিকে হঠাৎ দীপক ঢাকায় এসে মোবাইল করে। সে ময়মনসিংহ এসে সবার সাথে দেখা করবে বলে আমাকে যোগাযোগ করতে বলে। সে দীলিপদার বাসায় উঠে বউ বাচ্চা নিয়ে। সকালে আমার সাথে দেখা করে। সে আমার জন্য জাপান থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে আসে। বলে “আমি জানি, তুমি যেরকম ডিজিটাল হয়ে গেছো তোমার জন্য এখন ডিজিটাল ক্যামেরা দরকার।” আমি তাকে অশেষ ধন্যবাদ দিলাম। আমাদের মার্কেটগুলোতে তখন ডিজিটাল ক্যামেরার বেশ দাম ছিলো। মোবাইলে ক্যামেরা ছিলো না।

অফিস টাইমে দীপককে নিয়ে ঘুরলাম কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসে। ঘুরতে ঘুরতে জাপানের কালচার জানা হলো তার থেকে। জানা হলো জাপানে তাদের লাইফ স্টাইল। আরাম আছে প্রচুর। নিরাপত্তা আছে । নানান বিষয়ে যেগুলোতে আমার জানার আগ্রহ ছিল তা নিয়ে দীপকের সাথে হাটতে হাটতে জেনে নিলাম। সবার সাথে তো সব কথা নিয়ে আলাপ করা যায় না! বিএমএ অফিসে গিয়ে বসলাম। ওখানে দশ-বারোজন বসে গল্প করলাম। এম-১৭ ব্যাচের হাফিজ উদ্দিন রতন প্রবেশ করলো। দীপককে ইশারা দিলাম কিছু না বলতে। রতন বসে বসে অনেক্ষণ কথা বললো আর দীপকের দিকে আড়চোখে তাকালো। একসময় আমি বললাম “রতন, ওরকম আড়চোখে তাকাও কেন? মেহমানকে চিনেছো?” রতন বললো “আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেনো দেখেছি!” সবাই এক যোগে হেসে দিলো। আমি বললাম “আরে ব্যাটা, এটা দীপক।” রতন “আরে ব্যাটা, দীপক?” বলে জড়িয়ে ধরলো দীপককে। বললো “এরকম ফ্রেন্স কাটিং দাড়ি রাখছো বইলাই চিনতে পারি নি।” তারপর চললো আমাদের হৈ হল্লা। সিদ্ধান্ত হলো সন্ধায় আমরা দীপকের আগমন উপলক্ষে ইয়াংকিং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট-এ একটা পার্টি দেব এম-১৭ ব্যাচ ও তাদের ফ্যামিলি নিয়ে। আমি সবাইকে মোবাইলে ইনফর্ম করলাম, কারন আমার কাছে সবার নাম্বার ছিলো। সন্ধায় ২১ জন ব্যাচমেট সহ ৫৩ জনের একটা পার্টি হলো চাইনিজ রেস্তোরায়। দীপক বউ-বাচ্চা সাথে নিয়ে এসেছিলো। বেশ আনন্দ হলো আমাদের মধ্যে। দীপকের বাচ্চাদেরকে দেখলাম আঙ্গিনায় খেলছে। তারা নিজেদের মধ্যে জাপানী ভাষায় কথা বলছে খেলার সময়। পার্টি শেষে ফটোসেসন করে যার যার বাসায় ফিরলাম। একদিন পর গজনীতে ময়মনসিংহ বিএমএ-র পক্ষ থেকে পিকনিক ছিলো। আমি দীপককে অনুরোধ করে নিয়ে গেলাম। দীপকের ফ্যামিলি কোন কারনবশত যেতে পারলো না। আমার মেয়ের পরীক্ষা থাকার জন্য আমার ফ্যামিলিও নিতে পারলাম না পিকনিকে। ফলে আমি সারাদিন দীপককে সময় দিতে পারলাম। দীপকও আমাকে সারাদিন সময় দিতে পারলো। কত রকম আলাপ যে করলাম! দীপক জানালো যে পৃথিবীতে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় জাপানে। সেই অপারেশনে ৯ জন সার্জন অংশ গ্রহন করেন। তাদের মধ্যে দীপক একজন। তার বেশ কিছু ইন্টার্ন্যাশনাল পাবলিকেশন আছে। সে জানালো। আরো জানালো যে সে বড় বড় দামী জার্নালের অনলাইন রিভিউয়ার। বাংলাদেশে বসেও সে আর্টিকেল রিভিউয়ের কাজ করছে। আমি জানালাম যে আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ জার্নাল চেষ্টা করে প্রফেসর শাহ আব্দুল লতিফ স্যারের সহোযোগিতায় পাবমেডে ইন্ডেক্স করিয়েছি। এবং এটার ইন্টারনেট ভার্সন আমি সম্পাদনা করি। তখনি আমার প্রায় ৫০ টির মতো পাব্লিকেশন ছিলো। আমার পারফর্মেন্স শুনে সে মুগ্ধ হলো। সারাদিন আমাদের পিকনিকের হৈ হল্লা দেখে সে আবেগে আপ্লুত হলো। আমার হাত ধরে বললো
– সাদেক, তোমাদের এই আনন্দের পরিবেশ দেখে সত্যি ভালো লাগছে। আমার জাপানে থাকতে ভালো লাগছে না। যতোই সুখ থাকুক। ওটা আমার দেশ না। ঐ কালচারে বাচ্চারা থাকবে এটা আমি চাই না। আমাকে এখনই সরে আসতে হবে জাপান থেকে।
– তুমি কি আসলেই ফিরে আসতে চাচ্ছ?
– রিয়েলি বলছি। আমি যদি বাংলাদেশে নাও ফিরতে পারি তবে ইউকে অথবা ইউএসএ-তে চলে যাবো। জাপানে থাকবো না। সাদেক, তুমি আমাকে বিএসএমএমইউ-তে ঢোকার একটা ব্যাবস্থা করে দাও। যদি না পারো সিবিএমসি অথবা অন্য কোন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে এলেও ক্ষতি নাই।
– ঠিক আছে, যাকে ধরলে কাজ হবে তাকে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি চেষ্টা করলে ঢুকতে পারবে।
আমি তাকে বুঝিয়ে দিলাম কাকে ধরলে তার কাজটা হবে।

কয়েকবছর পর দীপক আবার ময়মনসিংহ এলো অল্প সময়ের জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে ফিরে আসা হলো না কেন। সে বললো “আমি অনেক চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে ঢোকার জন্য। তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে। ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট কাটতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে আমি সিএনজি অটোরিক্সায় করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার দুই পাশ থেকে দুইজন লোক উঠে চাকুর মাথা দেখিয়ে ভয় দেখিয়ে চোখে মরিচের গুড়া ঘষে দিলো। আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছিলো। কিছুই দেখতে পেলাম না। রিক্সা আমাকে নিয়ে ঘুরতে থাকলো আর ওরা আমার পকেটে যা ছিলো সব নিয়ে একসময় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে গেলো। আমি রাস্তায় পড়ে অন্ধ মানুষের মতো সাহায্য চাইলাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। রাস্তার মানুষ আমাকে রিক্সায় তুলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো। সেখানে আমার চিকিৎসা হয়। দেশের জন্য যে টুকু টান ছিলো চোখে মরিচ ডলা খেয়ে তাও চলে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ইউকেতে সেটল্ড হবো।”

তারপর ধীর্ঘদিন তার খবর নেই নি। একসময় জানলাম যে সে ইউকে-তে থাকা শুরু করেছে। তার টেলিফোন নাম্বার নেয়া হয় নি। যোগাযোগ করাও হয় নি। গত দুবছর আগে জানতে পারি দীপকের পরিবার ইউকেতে থাকে। কিন্তু দীপক চাকরি করে সৌদিআরব। শুনে আমার কাছে বেখাপ্পা মনে হলো। শুনলাম সৌদি থেকে দীপক তেমন যোগাযোগ রাখেনা বন্ধুদের সাথে। তার ফেইসবুকও নেই। গত বছর এম-১৭ ব্যাচের লিটনের নিকট থেকে জানতে পেলাম দীপক সৌদি থেকে ঢাকায় এসেছিলো অসুস্থ মাকে দেখতে। কিন্তু ঢাকায় এসে তার স্ট্রোক হয়ে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলে। বন্ধুদেরকে চিনতে পারেনা। অসংলগ্ন কথা বলে। লন্ডন থেকে তার স্ত্রী এসে দীপককে নিয়ে যায়, যেন তারা তাদের কাছে থেকে সেবা পায়। বাংলাদেশে রাখতে তারা নিরাপদ বোধ করছে না। শুনে মনটা আমার খারাপ হয়ে যায়। আর কি দীপকের সাথে কথা বলা যাবে না? ফোন করলে কি আমাকে কোনদিন চিনবে না? আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

গত ৭ই ফেব্রুয়ারি বৃ্হস্পতিবার সকাল থেকে দীপককে খুব মনে পড়ছিল। আমি এম-১৭ ব্যাচের ৭/৮ জন বন্ধুর কাছে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে দীপকের কন্টাক্ট চাইলাম। অনেকেই ‘জানে না’ লিখে জানিয়ে দিলো। স্বপন লিখলো দীপকের টেলিফোন নাম্বার। লিখলো যে দীপকের ফেইসবুক নেই। তারপর মোবাইল করে বললো
– সাদেক, তুমি লিটন ও রেজা-ইরির সাথে যোগাযোগ করতে পারো। তারা দীপকের খবর রাখে। রেজা মাঝে মাঝে লন্ডন যায়। সে দীপকের সাথে দেখা করে। শুনেছি, দীপকের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। আর তুমি ঐ নাম্বারে ফোন দিয়েও দেখতে পারো।”
আমি লিটনকে ফোন দিলাম। সে জানালো “এক বছর আগের খবর জানি। এখন কেমন আছে জানি না।” বিকেলে একঘন্টা পরপর তিনবার ফোন করলাম দীপকের নাম্বারে। ফোন রিসিভ হলো না। রাত ১২ টায় ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর ছয়টার আগে দীপকের নাম্বার থেকে কল আসায় ঘুম ভাংলো। দীপকের সাথে কথা হলো। কথা শুনে মনে হলো আমি ৭/৮ বছরের একজন বালকের সাথে কথা বলছি। শিশুসুলভ কন্ঠে ধীরগতিতে কথা বলছিল। আমার ফ্যামিলি টাঙ্গাইল বেড়াতে গিয়েছিল। কয়েকদিন আমি একা ছিলাম। একা থাকলে আমি মানষিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হই। রাজ্যের যতো স্মৃতি এসে ভির করে মাথায়। বন্ধুদের কথা মনে করে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে চায় এখনই যদি নাছিমকে ছুঁতে পারতাম! কিভাবে ছুঁব? সেতো থাকে আমেরিকা। এখনই যদি মনিরকে ছুতে পারতাম! কিভাবে ছুঁব? সেতো থাকে লন্ডনে। স্ত্রী স্বপ্না যখন কাছে থাকে তখন এসব মনে করার সময় পাই না। শুক্রবার ভোরেও একা ছিলাম। মোবাইল কানের কাছেই ছিল। মোবাইলের রিং শুনেই ঘুম ভাংগে। স্ক্রিনে দেখি Dipak M-17 calling.
– হ্যালো, আমি ময়মনসিংহ থেকে ডা. সাদেক বলছি। দীপক বলছো?
– কে?
– সাদেক, সাদেক তালুকদার, এম সেভেন্টিন ব্যাচের সাদেক। সাদেক, নজরুল, সদর ছিলাম টাঙ্গাইলের । মনে আছে?
– ও, সাদেইক্কা?
– হে, হে, সাদেক তালুকদার।
– তুমি কোথায়?
– আমার পোস্টিং কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক-এর কাছে বাড়ী করেছি। ময়মনসিংহ থেকে বলছি।
– আমাদের পুর্বের বাড়ী কিন্তু কিশোরগঞ্জ ছিলো। ওখানে যাওয়া হয় না। নজরুইল্লার কি খবর?
– নজরুল এফসিপিএস করেছে। টাংগাইল সদর হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের কনসাল্টেন্ট। বেশ নাম করেছে। টাঙ্গাইলে মেডিকেল কলেজ হয়েছে।
– বা বা!
– সদর টাঙ্গাইল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক।
– বা বা!
– ফারেজ ওখানে শিশু বিভাগের কনসাল্টেন্ট।
– বা বা! তোমরাতো ভালোই আছো!
– আমারে মনে আছে?
– আছে, আছে?
– বলতো, আমার দুই একটি ঘটনার কথা।
– তুমি নাক দিয়ে বাঁশী বাজাতে। মনে থাকবে না। অসুস্থ হওয়ার পর মনে করতে পারতাম না। এখন মোটামুটি মনে করতে পারি।
– তুমি জাপান থেকে আমার জন্য একটা গিফট এনেছিলে, মনে আছে?
– কি জেনো?
– ডিজিটাল ক্যামেরা।
– বা বা! সেটা তো অনেক দামী ছিলো!
– স্বপন খুলনা আছে। তার বড় ছেলে ডাক্তার হয়েছে। তোমার ছেলে মেয়েদের খবর কি?
– আমার মেয়েটা বড়। ও মেডিকেলে পড়ছে এখানে। আর একবছর পর ডাক্তার হবে। ছেলেটা (কি বললো ভালো বুঝা গেলো না)।
– আমি গতকাল ৩ বার কল করেছিলাম। রিসিভ কর নাই।
– এটাতো মোবাইল ফোন। কাছে ছিলো না।  কল লিস্টে মিস কল দেখে কল ব্যাক করলাম।
– এটা মোবাইল?
– হা।
– তা হলে ম্যাসেজ দিলে যাবে?
– হে, আসবে।
– তোমার ফেইসবুক নাই?
– না, নাই।
– ফেইসবুক থাকলে সহজে যোগাযোগ করা যায়। আমরা সবাই ফেইসবুকে যোগাযোগ করি। তুমি ফেইসবুক করে ফেলো।
– ফেইসবুক একাউন্ট করতে হবে।
– ইমেইল আছে?
– আছে।
– আমি এসএমএস করে আমার ইমেইল এড্রেস দিব। ইমেইল কইরো।
– এখন কয়টা বাজে তোমাদের ওখানে।
– রাত ২টা।
– এত রাতে ঘুমাও না? বৌদি কোথায়?
– ও ঘুমাচ্ছে।
– তুমিও ঘুমিয়ে পড়। পরে কথা হবে। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

কথা শেষ করে এসএমএস দিলাম আমার মোবাইল, ইমেইল, ফেইসবুক ও ওয়েবএড্রেস লিখে। মনটা কিছুটা প্রশান্তি পেলো দীপকের সাথে কথা বলতে পেরে। সারাদিন দীপক ও অন্যান্য পুরনো বুন্ধুদের কথা নতুন করে মনে পড়লো। সকাল ১০ টার দিকে স্বপনকে ফোন দিলাম। ধরলো না। জুম্মার নামাজ পড়ে এসে দেখি স্বপনের মিসকল উঠে আছে। কলব্যাক করলাম।
– সরি সাদেক, আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে সেমিনারে ছিলাম। তোমার কল শুনতে পাই নি।
– সমস্যা নেই। আমি নামাজে গিয়েছিলাম। তোমার কল ধরতে পারিনি। আমি গতকাল দীপকের নাম্বারে ৩ বার কল দিয়ে পাই নাই। আজ ভোর পৌনে ছয়টায় সে কল করেছিল। অনেক কথা হলো। চিনতে পারে। মনে আছে তার অনেক কিছু।
(বিস্তারিত বললাম)।
এরপর লিটনকে কল দিয়ে দীপকের কলের বিস্তারিত জানালাম।
রাত দশটার দিকে ফেইসবুক পোস্ট চেক করছিলাম । দেখলাম আমাদের ব্যাচের নাসিম তার প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেছে। আবারও তাকে ছুঁতে ইচ্ছে হলো। হায়! কিন্তু সে তো আমেরিকায়! ফেইসবুক পোস্ট দেখে জানতে পারলাম বড় ভাই ডা. এম এন আমিন অভিনিত টিভিতে একটা নাটক হচ্ছে । টিভি অন করে টিভি দেখা শুরু করলাম । নাটকের চেনেল খুজতে গিয়ে একেক চেনেলে একেক অনুষ্ঠানের কিছু কিছু অংশ দেখতে দেখতে নাটকের সময়ই শেষ হয়ে গেলো। সুইচ অফ করে স্বপ্নাকে মোবাইল করে শুতে গেলাম বিরক্তি নিয়ে। দোয়া পড়ে শুলাম। আল্লাহ্‌র শোকর করলাম। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, বিদ্যা অর্জন করিয়েছেন, চিকিৎসক বানিয়েছেন, প্যাথলজি বিষয়ে তখনকার উচ্চ ডিগ্রি এম ফিল অর্জন করিয়েছেন (১৯৯৫ সন), ২১ বছর আগে সহকারী অধ্যাপকের মর্যাদা দিয়েছেন, ২৭ বছর মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছেন, প্রায় ৪ হাজার ডাক্তারের শিক্ষক হবার মর্যাদা দিয়েছেন, ৮৪টি সাইন্টিফিক পাব্লিকেশন করার ক্ষমতা দিয়েছেন, অর্থ সম্পদ দিয়েছেন যথেষ্ট, পারিবারিক সুখ দিয়েছেন প্রচুর। মেধাবী গুণবতী ২ জন সন্তান দিয়েছেন। আরো কত কিছু দিয়েছে! আমি যদি ২০ বছর আগেই সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতাম! আমি যদি বিদেশ পাড়ি দিতাম! না, তা ঠিক হতো না। প্রবাসে থাকলে আমি ইচ্ছা করলেই আমার আপনজনদের পেতাম না। গত সপ্তাহেও বাড়ী গিয়ে গরীব দেখে দেখে তাদের হাতে কিছু দিয়ে এসেছি। তারা চায় নি। তারা শুধু আমার মুখের দিকে চেয়েছে। তাতেই আমি বুঝে নিয়েছি। বিদেশে থাকলে কি তা করতাম? এইসব নানাবিধ চিন্তা এসে ভির করল মাথায়। স্বপ্না পাশে থাকলে হয়তো এগুলো মাথায় আসতো না। মনে হলো গান বাজাই। চিন্তা দূর হয়ে যাক। দীপককে মনে পড়লো। তার বাজানো রবীন্দ্রসংগীত মনে পড়লো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইউটিউব-এ সার্চ দিতে লিখলাম “দূর দেশী সে”। সাজেশন আসলো “দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে”। ক্লিক করলে বেজে উঠলো “দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে, আমার বাটে বটের ছায়ায়, সারাবেলা গেলো খেলে…..। ” শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমাবার আগে শুনেছেলিম “ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশীটি তার গেছে ফেলে।”
 ৯/২/২০১৯ খ্রি.

পুনশ্চ:
আমার এই লেখাটা ফেইসবুকে প্রকাশ পাওয়ার পর অনেক বন্ধু ফোনে এবং মেসেঞ্জারে আমার সাথে কথা বলে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি দীপক তার অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মাকে দেখতে ঢাকার ভাইয়ের বাসায় আসে। এখানে এসে দীপকের কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে (হার্ট বন্ধ) ব্রেইন ডেমেজ হয় কিছুটা। বেচে উঠলেও সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। পুরাতন স্মৃতি মনে আছে তার কিন্তু নতুন স্মৃতি (রিসেন্ট মেমোরি) মনে থাকে না। ঢাকার বন্ধুদের সহায়তায় তার স্ত্রী এসে তাকে লন্ডনে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে একা চলতে পারে না। বাইরে রাস্তায় বেরুলে বাসায় ফিরতে পারবে না। কারন, তার বাসা কোন দিকে কত নাম্বার তার মনে থাকে না। কিন্তু পুরাতন কোন ঘটনা নিয়ে কথা বললে সে সব মনে করে কথা বলতে পারে। দিনে ঘুমায়। রাতে ঘুমায় না। এই জন্যই সে আমাকে রাতে কল করেছিল। আমার এই লেখার কথা দীপকের স্ত্রীকে আমার বন্ধু জামিল জানায়। বউদি লেখাটা পড়ে সেইভ করে পেন্ড্রাইভে করে নিয়ে গিয়ে বাইরের দোকান থেকে প্রিন্ট করে এনে দীপককে পড়তে দেয়। কারন দীপক ফেইসবুক চালাতে পারে না। দীপক লেখাটি পড়ে আবেগপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু আগের রাতে যে আমার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে এটা তার মনে নেই। কারন, তার ব্রেইনের রিসেন্ট মেমোরি সেন্টার লজ হয়েছে। যদি কোন দিন শুনতাম যে দীপকের রিসেন্ট মেমোরি সেন্টার ফিরে পেয়েছে!
৩/৯/২০১৯ খ্রী.

Gouranga

২০২৩ সনে Shadow of Village ইউটিউবার গৌরাংদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম আমি, স্ত্রী স্বপ্না এবং ভাতিজী আফরোজা । তারা আমাদেরকে খুব ভালোভাবে আপ্যায়ন করে । সেই ভিডিওটা দেখুন নিচের ছবির উপর ক্লিক করে ।

গৌরাঙ্গ আমাদেরকে নিয়ে একটা ভিডিও আপলোড করে। সেই ভিডিও দেখুন নিচের ছবির উপর ক্লিক করে ।

prepaidmeter

Prepaid Electricity Meter

Dr. Sadequel Islam Talukder

প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার, টোকেন নাম্বার, ভেন্ডিং এমাউন্ট, টোকেন এমাউন্ট, মিটার রিচার্জিং, ব্যাল্যান্স চেক ইত্যাদি জেনে নিন সহজ কথায়
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
Know prepaid electricity meter, token number, vending amount, token amount, meter recharging, balance check etc. in simple words
Dr. Sadequel Islam Talukder

প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার বিল মাসের প্রথম বিকাশে এত টাকা বেশী কাটে কেন এবং কেমনে?
সহজে হিসাব জেনে নিন

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

Why and how much money is spent on the prepaid electricity meter bill in the first development of the month?
Know the account easily

প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটারের ডিসপ্লে পড়ে পড়ে বিদ্যুৎ বিলের বিভিন্ন বিষয় সহজে বুঝে নিন
ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার
Read the display of the prepaid electricity meter and understand the various aspects of the electricity bill easily
Dr. Sadequel Islam Talukder

Ruhini

Ruhini Da

রুহিনী দা

রুহিনী দাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৩ সনে। নাম জানতাম না। পিজিতে এমফিল এডমিশন টেস্টের ভাইবা দিচ্ছিলাম একই দিনে। এখনকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আইপিজিএমআর নামে একটা পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল ইনস্টিটিউট ছিল। সংক্ষেপে বলা হতো পিজি। পিজিতে পড়া ও শিক্ষকতা করা খুবই সম্মানের ব্যাপার ছিলো। বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর বি আর খান স্যারের অফিস কক্ষে মৌখিক পরীক্ষা হচ্ছিল। একজন একজন করে ক্যান্ডিডেট প্রবেশ করছিলেন। আমরা সবাই ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। ১০/১৫ মিনিট পর ফিরে এসে একেকজন একেক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কী কী প্রশ্ন করলেন এটাই ছিলো অপেক্ষমান ক্যান্ডিডেটদের কমন প্রশ্ন। বর্ণনাকারীরা ভয়ংকরভাবে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। সবাই কোলাহল করে সেই সব প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমি সাধারণত নতুন কারো সাথে খোলামেলা আলাপ করতে পারি না। তাই, আমাকে অনেকেই বোকা ছেলেই মনে করে থাকেন। সেদিন আমি বোকার মতো এক দিকে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম। ছোট বেলা হুজুর ছমির মাওলানা আমাকে দোয়া শিখিয়েছিলেন পরীক্ষার আগে পড়ার জন্য। সেই দোয়াটা বার বার পড়ছিলাম আর দেখছিলাম অন্যরা কিভাবে কি ভঙ্গিতে কথা বলেন। কিভাবে শরীর নাড়াচাড়া করেন। কত স্মার্ট তারা। আমি মানুষের কথা বলার ভঙ্গি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। দোয়াটা আমার ছাত্রদেরকেও শেখাই পরীক্ষার আগে পড়ার জন্য। দোয়াটা এমন “রাব্বি, জেদনি, এলমা।” অর্থাৎ “হে আমার রব, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।” একজন ক্যান্ডিডেট ভাইভা দিয়ে ফিরে এসে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তার চেহাড়া দেখে বেশী স্মার্ট মনে হলো না। তিনি দু’হাতের দুই তর্জনী আঙ্গুল খারা করে কপালের দুপাশে ঠেকিয়ে বলছিলেন “সবই পারলাম। কিন্তু স্যার বলছিলেন ‘এরপর কি?’ আমি আর বলতে পারছিলাম না।” অন্য এক ক্যান্ডিডেট বলে দিলেন “এরপর হলো ফ্রি র‍্যাডিকেল সেল ইঞ্জুরি।” তিনি “ইয়েস, ইয়েস” বলে জিহব্বায় কামড় দিলেন। বললেন “আমার এবার হবে না।” অন্য এক ক্যান্ডিডেট বললেন “আপনার হবেই। আপনি গত দেড় বছর যাবত চিটাগং মেডিকেল কলেজে প্যাথলজির লেকচারার হিসাবে আছেন। আপনি অভিজ্ঞ।” দেখলাম সবাই সবাইকে চেনেন। আমি কাউকে চিনছি না। আমাকেও কেউ চিনছেন না। আমিও যে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের লেকচার তা কেউ জানেন না। এতক্ষণ যার কথা বললাম তিনিই রুহিনী দা। এই দাদা ১৯৯৯ সনে বিএসএমএমইউ-তে প্রথম এমডি কোর্স চালু হলে চাঞ্চ পেয়ে প্যাথলজিতে এমডি কোর্সে ভর্তি হন। আমি সে ১৯৯৩ সনের জুলাই সেসনেই এম ফিল চাঞ্চ পাই। ১৯৯৫ সনের জুলাই ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করে ১৯৯৬ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ফিরে আসি। ১৯৯৮ সনে সহকারী অধ্যাপক হই। আমাদের ডিপার্টমেন্টে আমার ব্যাচমেট ডাঃ এএফএম সালেহ (ইকবাল) তখন প্রভাষক ছিল। সে আমার সাথে পরামর্শ করে ১৯৯৯ সনে এমডি কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চাঞ্চ পেয়ে গেলো। সালেহ পিজি থেকে মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করে আমাকে দোষারোপ করতো। বলত “সাদেক, দোস্ত, তুমি আমারে কি এক সমুদ্রে ফেলে দিলা, আমি এর কূলকিনারা পাচ্ছি না।” আমি সাহস দিতাম এই বলে “দেখতে দেখতে ৫ বছর শেষ হয়ে যাবে। চিন্তা করবা না।” সালেহ রুহিনী দার খুব প্রশংসা করতো। বলত “সাদেক, আমি আমার এক রিডিং পার্টনার পেয়েছি, রুহিনী দা। দাদার মতো এত ভালো মানুষ হয় না।” সালেহ ২০০৩ সনে এমডি পাস করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আবার প্রভাষক হিসাবে ফিরে আসে। প্যাথলজি বিষয়ে প্রথম এমডি পাস করা হিসাবে সবার কাছে একটু বেশী প্রশংসা পেতে থাকে। আমি যেমন এমফিল পাস করে ময়মনসিংহ এসে ১৯৯৭ সনেই তালুকদার প্যাথলজি নামে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে প্রাক্টিস করতে থাকি সালেহও তেমনি নোভা প্যাথলজি নাম দিয়ে ময়মনসিংহে একটা প্যাথলজি ল্যাব দিয়ে প্র‍্যাক্টিস শুরু করে। সালেহ সারাক্ষণ রুহিনী দার প্রশংসা করতো। রুহিনী দা এমডি পাস করে চিটাগং মেডিকেল কলেজে ফিরে গিয়ে প্র‍্যাক্টিস শুরু করেন। এদিকে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে সালেহর বদলীর প্রস্তাব হয়। সালেহ এই বদলী ঠেকাতে না পেরে রুহিনী দাকেও রাজি করান দিনাজপুর নিয়ে যেতে। কর্তৃপক্ষকে রিকুয়েষ্ট করে সালেহ রুহিনীদাকে সহ একই অর্ডারে বদলীর অর্ডার করায়। অর্থাৎ দুজনই সহকারী অধ্যাপক হিসাবে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। সালেহ প্যাথলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নেন। মাইক্রবায়োলজির পোস্ট গ্রাজুয়েট করা টিচার না থাকাতে রুহিনী দা মাইক্রোবায়োলজির প্রধানে দায়িত্ব নেন। এভাবে চলে ৩ বছর। দাদা ও সালেহ একসাথে পার্টনারশিপে নোভা প্যাথলজি নামে দিনাজপুর শহরে একটা ল্যাবরেটরি দেন। দিনাজপুরে এর আগে কেউ হিস্টোপ্যাথলজি (বায়োপসি) পরীক্ষা করতো না। এই দু’জন মিলে প্রথম দিনাজপুরে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা শুরু করেন। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুর অঞ্চলের সব বায়োপসি ও সাইটোপ্যাথলজি পরীক্ষা এই দু’জন বিশেজ্ঞের দ্বারা করা হতো।

২০০৭ সনের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমার জীবনের ছন্দপতন হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। একই অর্ডারে আমাকে দিনাজপুর এবং সালেহকে ময়মনসিংহ বদলী করা হলো। আমরা যারযার কর্মস্থলে যোগদান করলাম। আমার তালুকদার প্যাথলজির রিপোর্ট করার দায়িত্ব নিলো সালেহ। আমি দিনাজপুর গিয়ে তেমন ভালো ল্যাবরেটরি পেলাম না। ততৎকালীন অধ্যক্ষের পরামর্শক্রমে আমি একটা কর্পোরেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হিস্টোপ্যাথলজি, সাইটোপ্যাথলজি ও ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি প্রাক্টিস শুরু করলাম। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে চাকরি করতে হলো আমাকে পূর্ণ ৮ বছর। এই ৮ বছর আমার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন সেই রুহিনী দা। যাকে নিয়ে আজ লিখবো।

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে যোগদান করার পর ভালো ভাবে বুঝতে পারলাম কেনো সালেহ রুহিনী দার এতো প্রশংসা করতো। আসলেই প্রশংসা পাওয়ার মতো বিরাট ব্যক্তিত্ব রুহিনী দা। তিনি আমাকে সাদেক ভাই বলে ডাকতেন। আট বছর একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছি। তিনি ছিলেন বিভাগের প্রধান। কিন্তু তিনি আমার সাথে বসের মতো আচরণ করেননি। শত শত গল্প করে শত শত ঘন্টা কেটেছে আমাদের। গল্প বলতে বলতে তিনি কমন একটা কথা বলতেন “হইছে কি সালেহ ভাই!” আমি ভুল শুধ্রে দিয়ে বলতাম “দাদা, আমি সালেহ না, আমি সাদেক।” সালেহ দাদার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিলো যে ৮ টা বছরেও দাদা আমাকে সালেহ ভাই বলেই ভুলে সম্ভোধন করে বসতেন। সালেহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও দু’জনের সভাবে বেশ পার্থক্য আছে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো দু’জনেই দাদাকে খুব বেশী ভালোবাসি।

আমি একদিন দাদার অফিস-রুমে বসে কিছু কাজ করছিলাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি ৩ জন জুব্বা পড়া টুপি মাথায় দেয়া হুজুর দাদার রুমে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। একজনের হাতে চাঁদা আদায়ের রশিদ। আমি জিজ্ঞেস করলাম

– আপনারা কিছু বলবেন?

– জি, আমরা এই স্যারের কাছে এসেছি।

– কি ব্যাপারে এসেছেন?

– আমরা একটা মাদ্রাসা ও মসজিদের সাহায্যের জন্য এসেছি।

– আসেন, আমার রুমে আসেন। পাশেই আমার রুম।

– স্যারের কাছ থেকে কিছু নিয়ে আসি। স্যার কি ব্যস্ত?

– মানে, স্যার তো মুসলিম না, পুঁজা করেন। স্যারের কাছ থেকে মসজিদের চাঁদা নিবেন?

– স্যার, হিন্দু?

– হ্যাঁ।

এরপর তারা ভালো করে দাদার নেইম প্লেটটা পড়লেন। ডাঃ রুহিনী কুমার দাস। বললেন “ও হো, ভুল হয়ে গেছে। আমরা ভাবছিলাম মোসলমান নাম “রুহানী।” আমরা সবাই মুস্কি হাসলাম। কোন কোন নামকরা ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তার নামের শেষে রুহানী টাইটেল থাকে। এই হুজুররা তেমন রুহানী মানুষ ভেবে মসজিদের চাঁদার জন্য এসেছিনেন। তবে দাদার রুহুটা আসলেই রুহানী।

দাদার সাথে আমি অনেক গল্প করে কাটিয়েছি। গল্পের ছলে আমাদের উভয়ের ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী জানাজানি হয়ে গেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দাদা ক্লাস সিক্সে পড়তেন। আমি পড়তাম ক্লাস ফাইভে। দাদারা বাড়িঘর ফেলে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়নি। এই নয় মাস আমরা কে কি করেছি সে কথা নিয়েও আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে। আমরা দুজনই ব্যবসার কাজে সেসময় হেল্প করেছি। দেশ স্বাধীন হলে দাদারা ফিরে এসে দেখেন বাড়ি ভিটা পরিস্কার। কিচ্ছু নেই তাদের। গ্রামের এক মুসলিম প্রভাবশালী ধার্মিক লোক সব নিয়ে গেছে তাদের বাড়ির। দাদাদের সাথে দেখা করে সেলোক বলে যে “তোমরা চলে যাবার পর এসব জিনিস দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যেতো। তাই আমি তোমাদের সব কিছু নিয়ে আমার হেফাজতে রেখেছি। এখন তোমাদের জিনিসপত্র বুঝে নাও।” দাদারা সব কিছুই ফিরে পান। সেই কথা বারবার দাদা আমাকে বলতেন। মানুষ এতো ভালো হতে পারে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। দাদা মাঝে মাঝেই লোকটার জন্য দোয়া করতেন যেনো লোকটা জান্নাতবাসী হন।

দাদার ২০০৪ সন থেকেই হার্টের রোগ ধরা পরে। হার্টের রক্তনালী চিকন হয়ে গিয়েছিল। তাই হার্টে রক্ত সরবরাহ কম হতো। তাতে বুক ব্যথা করতো। বুকে হাত দিয়ে চিন্তিত থাকতেন। অল্প হাটলেই হাফিয়ে যেতেন। আমাদের ডিপার্টমেন্ট ছিল নিচ তলায়। আমরা চারতলার ডরমিটরিতে থাকতাম। দাদা চারতলায় উঠে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। দাদার খুব কষ্ট হতো। এইসময় দাদার গ্রামেরই এক টাউট লোক দাদা ও দাদার ভাইয়ের নামে জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে মামলা করে হয়রানি করেন। দাদা সারাক্ষণ মোবাইলে এনিয়ে উকিলের সাথে কথা বলেন। আমি খুব টেনশনে থাকতাম দাদাকে নিয়ে হার্ট এটাক করে বসেন কিনা। যাহোক, দাদারা সেই টাউট থেকে রেহাই পান। ২০০৯ সনে আমি, আমিনুল স্যার ও সালেহ দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে দাদাকেও যেতে বলি। তার কষ্ট হবে বলে তিনি রাজি হলেন না। যেই সালেহ রিকুয়েষ্ট করলো অমনি রাজি হয়ে গেলেন। তবে ইন্ডিয়া টোরে দাদার কষ্ট হয়েছিলো আমরা বুঝতে পারতাম। সালেহকে দাদা এমন ভালোবাসতো যে সালেহর কথায় দাদা না করতে পারেননি।

দাদার বিয়ের আলাপও আমার কাছে করেছেন। দাদা তার বড়ভাইকে খুব মেনে চলেন। বিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বড় ভাইকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দাদা চোখ বুঝে বড় ভাইয়ের কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছেন। দাদা বৌদিকে নিয়ে খুবই সুখী জীবন যাপন করেন। দাদার দু’মেয়ে। খুবই গুণবতী হয়েছে। দুজনই ডাক্তার হয়েছে। দাদা বলেছেন “বিয়ের কথাবার্তা যখন পাকাপাকি হয়ে গেছে তখন আমার শশুর মশাই আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে আমার হাত ধরে বললেন ‘আমার মেয়েকে তোমার কাছে সমর্পণ করলাম। তবে তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে সেটা হলো তুমি কখনো মোটর সাইকেলে উঠবে না’। ” আমাদের সময় অল্প বয়সে সাধারণত মারা যাওয়ার বেশী চাঞ্চ ছিল মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট। মেয়ে যেনো অল্প বয়সে বিধবা না হয় সে জন্যই হয়ত দাদার শশুর মশাই এমন ওয়াদা করিয়েছিলেন। এখন ইয়াং ডাক্তার মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে মারা যাওয়ার খবর তেমন শোনা যায়না। একটা চাঞ্চই বেশী সেটা হলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শহীদ হয়ে যাওয়া। দাদাকে আমি কারো মোটরসাইকেলে উঠতে দেখিনি। আমাকে কেউ ওয়াদা না করালেও আমি ভয়েই মোটরসাইকেলে চড়ি না।

দাদার কাছে একদিন একটা গল্প বলেছিলাম। গল্পটা দাদার খুব ভালো লেগেছিল। গুল্পগুজবের আসর বসলে দাদা সেই গল্পটা আমাকে শুনাতে বলতেন। গল্পটা আমি শুনেছিলাম শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ এখলাছুর রহমান স্যারের কাছে। গল্পটা ছিল এমন।

পাকিস্তান আমলে এক থানার এক দারোগা ছিল। তিনি ঘুষ খেতেন। মফস্বলে গিয়ে আসামী ধরে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দিতেন। রাতে বাসায় ফিরে ঘুষের টাকা বউয়ের হাতে দিতেন। বউ টাকা হাতে পেয়ে খুব খুশী হতেন। ট্রাংকের ভিতর টাকা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতেন। গহনা বানাতেন সেই টাকা দিয়ে। মাসের পহেলা বেশী টাকা দিতেন বউয়ের হাতে। বউ জিজ্ঞেস করতেন

– আইজ এতো বেশী টাকা পেয়েছেন?

– আজকের টাকা হলো বেতনের টাকা।

– অন্যদিনেরগুলা কিয়ের টাকা?

– অন্যদিনেরগুলো মফস্বলের টাকা।

বউ হিসাব করে দেখলেন যে মফস্বলের টাকা অল্প হলেও মাসের প্রতিদিন পাওয়া যায়। আর বেতনের টাকা মাসে মাত্র একদিন। তবে তুলনা করলে মফস্বলের টাকায় আয় বেশী।

একদিন খুব গরম পড়েছিল। সেদিন দারোগা চাকরি থেকে বরখাস্ত হয় ঘুষের খবর জানাজানি হয়ে। দারোগা বাসায় ফিরে খাটে বসে জামাখুলে খুব ঘামতেছিলেন। বউ বিচুন দিয়ে বাতাস করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন

– আপনের কী অইছে? এমন করতাছেন কেন?

– আমার চাকরিটা গেছে গা।

– কোন চাকরি গেছে? বেতনেরটা, না কি মফস্বলেরটা?

– বেতনেরটা গেছে?

– যাউগ গা। মফস্বলেরটা থাকলেই অইব।

– গিন্নি, বেতনের চাকরি না থাকলে মফস্বলেরটাও থাকে না।

– এ্যা?

আমি দাদাকে বলতাম “দাদা, এখনকার দারোগারা ভালো। মফস্বলে গিয়ে ঘুষ খান না। তবে এই গল্প থেকে আমার একটা শিক্ষা আছে। ডাক্তারদের বাড়তি আয়ের জন্য ঘুষ খেতে হয় না। তারা বৈধপথেই বিকেলে প্রাক্টিস করে মোটা অংকের টাকা আয় করতে পারেন। তবে যেসব ডাক্তার ভালো পজিশনে সরকারি চাকরি করেন তাদের বৈকালিক প্রাইভেট প্রাক্টিস আয়ও ভালো। চাকরি চলে গেলে তাদের প্রাইভেট আয়ও চলে যেতে থাকে।” দাদা হে হে করে হেসে বলতেন “ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাক্টিস আয় হলো মফস্বলের আয়ের মতো।”

আমি দু’এক মাস পরপর ছুটি নিয়ে ঢাকায় যেতাম। পরিবার ঢাকার উত্তরায় রেখেছিলাম। রাতের বাসে ফিরে সকালে অফিস করতাম। বিকেলে প্রাইভেট প্রাক্টিস করতাম। কোন কোন দিন ঢাকা থেকে ফিরতে দেরী হলে গাইবান্ধা পর্যন্ত এসে দাদাকে ফোন দিতাম “দাদা, আমি অফিস ধরার চেষ্টা করব। গাইবান্ধা পর্যন্ত এসেছি। অফিস ধরতে না পারলে মাইন্ড কইরেন না।” দাদা হেসে বলতেন “অসুবিধা নাই। মফস্বলেরটা ধরতে পারলেই হবে।” আসলেই মফস্বলের আয় বেতনের আয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশী।

আমাদের সাথে ডরমিটরিতে আরেক দাদা থাকতেন মেডিসিন বিভাগের। তিনি ডাঃ তিমির বরন বসাক। রুহনী দা ও তিমির দা দুজনই আমার থেকে এমবিবিএস-এ এক বছরের সিনিয়র। তারসাথেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। তাকে নিয়ে লেখলে সারাদিনেও পড়ে শেষ করা যাবে না। তার কথা আজ লেখব না। তিনি ছিলেন চিরকুমার। তিনি নিজ হাতে রান্না করে খেতেন। কারন, প্রায় সব মসলাতেই তার এলার্জি ছিলো। তিনি মেডিসিন বিভাগের প্রধান হয়েও নিজের কক্ষে বসতেন না। হাসতালে রাউন্ড দিয়ে ডরমিটরিতে এসে পড়তেন। একটা মাত্র সুতীর হাফ হাতা শার্ট পড়তে পারেন। কারন, অন্য কাপড়ে তার এলার্জি ছিলো। যত শীত হোক, ঐ হাফ শার্ট। তিনি একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। আত্বীয় স্বজনের সাথেও বেশী যোগাযোগ করতে দেখিনি। এক সন্ধায় চেম্বারে তার হার্ট এটাক হলো। তাকে দ্রুত স্থানীয় একটা প্রাইভেট হার্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ওখানকার পরিচর্যা ভালো ছিলো। সাথে এটেন্ডেন্স থাকার তেমন প্রয়োজন ছিল না। তিমির দার আপনজন কেউ আসেননি। দুদিন পর তার এক বড় ভাই এলেন। তিনিও চিরকুমার। তিনিও দু’একদিন থেকে চলে গেলেন। রুহিনী দা তিমির দার কাছে ঘন ঘন যেতেন। আমি কম কম যেতাম। একদিন দেখলাম একজন ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিটিভ ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। ব্যাপারটা এমন- তিমির দার ব্যাংকে একাউন্ট আছে বহুদিন যাবত। তিনি বেতনের টাকা ও প্রাক্টিসের টাকা প্রায় সব ব্যাংকে জমা রাখেন। জামাকাপড় কিনতে হয় না তেমন। যা খান তার খরচও তেমন না। জমিজমাও কেনেননি। সব টাকা তার ব্যাংকে জমা। কিন্তু তিনি একাউন্ট করার পর চেক বই উঠাননি ব্যাংক থেকে। ব্যাংক থেকে একটা টাকাও উঠাননি কোনদিন। হার্টের এঞ্জিওগ্রাম করতে ঢাকায় যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার। তাই চেকবই উঠাতে হচ্ছে। এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তা নিজেই এসেছেন হাসপাতালে নমুনা স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে। যাহোক, টাকা সংগ্রহ করে তিমির দা বিমানে করে ঢাকায় গেলেন। সাথে আপন লোক কেউ গেলেন না। গেলেন শুধু আনাদের রুহিনী দা। কত বড় ভালো মানুষ আমাদের রুহিনী দা। তিমির দার বিপদের সময় এটেনডেন্ট হলেন আরেক হার্টের রোগী রুহিনী দা। রুহিনী দারও এঞ্জিওগ্রাম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল ৮ বছর আগে। তিনি মরে যাবেন এই ভয়ে কোন দিন এঞ্জিওগ্রাম করাতে সাহস পাননি। তিনি নিয়ে গেছেন তিমির দাকে এঞ্জিওগ্রাম করাতে প্রাইভেট দামী এক হাসপাতালে। তিমির দার এঞ্জিওগ্রাম করার সময় ডাক্তারগণ হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে দিলেন। তিমির দা সুস্থতা বোধ করলেন। এসব আমি পরে শুনেছি রুহিনী দার কাছে। আমি এগুলো জানতাম না। তিমির দার রিং পরানো দেখে রুহিনী দার সাহস বেড়ে যায়। তিনিও এঞ্জিওগ্রাম করান। কিন্তু ডাক্তার এঞ্জিওগ্রাম করে পরামর্শ দেন যে আজই অপেন হার্ট সার্জারী করে বাইপাস করে দিতে হবে হার্টের রক্তনালী। সংবাদটা রুহিনী দা আমাকে দ্রুত মোবাইলে জানান সকালে। প্রিন্সিপাল প্রফেসর হামিদুল হক খন্দকার সেদিন কলেজে আসেননি। তিনি সেদিন রংপুর বাসায় ছিলেন। আমি স্যারকে মোবাইলে জানালাম আজ রুহিনী দার ঢাকায় বাইপাস সার্জারি হবে। অবস্থা খুব খারাপ। স্যার শুধু বললেন “সেক্রেটারিকে বলে দাও মসজিদে মিলাদ দিতে।” আমি সেক্রেটারিকে বললাম প্রিন্সিপাল স্যার মসজিদে মিলাদ দিতে বলেছেন বাদ জোহর। আমি টিচারদের মধ্যে মোটামুটি রেগুলার ছিলাম মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে। ইমাম, মোয়াজ্জিন ও খাদেমদের সাথে সরলভাবে মিশতাম। মসজিদের মিলাদেও অংশগ্রহণ করতাম।

ছোটবেলা থেকেই আমি মিলাদে অংশগ্রহণ করতাম। ছোট বেলায় আমাদের এলাকায় বাড়ি বাড়ি মিলাদ হতো। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার আরোগ্য কামনা করে মিলাদ দেয়া হতো। কোন শুভ সংবাদ হলেও মিলাদ দেয়া হতো। নতুন ফসল ঘরে আনলেও মিলাদ দেয়া হতো। যিনি মিলাদ পড়িয়ে দিতেন তাকে বলা হতো মৌলভী। মৌলভীরা ইসলামি শিক্ষায় মোটামুটি শিক্ষিত ছিলেন। তারা মিলাদের সময় হালকা বয়ান করতেন। রাসুল মুহম্মদ (সঃ) এর জন্ম বৃত্তান্ত বলতেন, কোর আন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করতেন এবং উর্দু, ফার্সি ও বাংলায় কবিতাকারে ছন্দ মিলিয়ে সুর করে মহানবী (সঃ) এর গুণ গান করতেন। যেমন,

বালাগাল উলামে কামালি হী

কাসাফাত দোজা বি জামালি হী।

হাসুনাত জামিও খিসালি হী

সাল্লু আলাইহি ওয়ালি হী।।

ইয়া নাবী সালামু আলাইকা

ইয়া রাসুল সালামু আলাইকা।

ইয়া হাবিব সালামু আলাইকা

সালামু তুল্লাহ আলাইকা।।

নবী না হয়ে দুনিয়ায়

না হয়ে ফেরেস্তা খোদার।

হয়েছি উম্মত তোমার

তার তরে শোকর হাজার বার।।

এমন অনেক সিল্কি গাইতেন মৌলভীরা। মিলাদের পর সবাইর মাঝে খাজা, বাতাসা ও কদমা বিলি করা হতো। এগুলোর লোভে সব পোলাপান মিলাদের অংশ গ্রহণ করত। অল্প শিক্ষিত মিলাদ পড়ানে ওয়ালাকে মুন্সী বলা হতো। মৌলভী ও মুন্সীদের ভালো অংকের টাকা দেয়া হতো হাদিয়াসরূপ। একবার আমজানি বুবুদের বাড়ি গিয়ে পাশের বাড়িতে মিলাদে গিয়েছিলাম। একজন মুন্সী মিলাদ পড়াচ্ছিলেন। অনেক পোলাপান হয়েছিল সেই মিলাদে। মুন্সী সুর করে করে মিলাদের বাক্য বলছিলেন। পোলাপানের গ্যাঞ্জামে মিলাদ ভালো শুনা যাচ্ছিল না। মুন্সী মিলাদের সুরে সুরে গেয়ে গেলেন

“পোলাপান গোলমাল করিস না,

নইলে কইল খাজা পাবি না।”

আমরাও সুরে সুরে বললাম

“পোলাপান গোলমাল করিস না,

নইলে কইল খাজা পাবি না।”

শুনে পোলাপানের দল খিলখিল করে হেসে দিলো।

যাহোক, সেই মিলাদ নিয়ে এখন ইসলামি স্কলারদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কেউ কেউ এটাকে বিদআত বলছেন। তাই, অনেকেই মিলাদ বর্জন করছেন। প্রিন্সিপাল স্যারের কথামতো আমি কলেজের সেক্রেটারিকে মিলাদের ব্যবস্থা করতে বললাম। মিলাদ উপলক্ষে মসজিদে জিলাপি ও আনুসংগিক তোবারক আনা হলো সরকারি ধর্মীয় ফান্ড থেকে। তোবারক দেখে সেদিন পোলাপান মুসুল্লির সংখ্যা একটু বেশীই হলো। ইমাম সাবের পাশেই আমি বসেছিলাম মিলাদে। ইমাম সাবও মিলাদের পক্ষের লোক না। তিনি সরকারি ইমাম। তাই সরকারি অর্ডার তার পালন করতে হতো। তাই তিনি কবিতাগুলো বাদ দিয়ে কিছু কোরআন তেলাওয়াত করলেন, কিছু দরুদপাঠ করলেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলেন “স্যার, কি উপলক্ষে মিলাদ?” আমি বললাম “ডাঃ রুহিনী কুমার দাস স্যার খুব অসুস্থ। তার হার্টের ওপেন সার্জারী হচ্ছে আজ। তারজন্য দোয়া করা।” ইমাম সাব চমকে গেলেন কুমার দাস শুনে। তারপর সাভাবিক হয়ে মোনাজাত ধরলেন। মোনাজাতে এক পর্যায়ে বললেন “ইয়া আল্লাহ আমাদের ডাঃ রুহিনী কুমার দাস স্যারের প্রতি তুমি রহম করো। তাকে তুমি আরোগ্য দান করো।” সবাই বললেন “আমিন, আমিন, আল্লাহ হুম্মা আমিন।” সবাই তোবারক খেয়ে ফিরে গেলো।

যাহোক, রুহিনী দার সেদিন হার্টের অপারেশন হলো। আল্লাহ রুহিনী দাকে সুস্থ করে দিনাজপুর আনলেন। দাদাকে আমি অনেকদিন কাজ করতে দেইনি। আমিই ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম চালিয়ে নিয়েছি। অপারেশনের সময় তিনি অজ্ঞান ছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর তার যে তীব্র যন্ত্রণা হতো তার তিনি বিভতস ভাবে বর্ণনা করতেন। বাম বুকে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলতেন “সালেহ ভাই, কি যে কষ্ট হয়েছে আমার! অসয্য কষ্ট!” আমি বলতাম “দাদা, আমি সালেহ না, আমি সাদেক।” আমি ২০১৫ সনের শেষ পর্যন্ত দিনাজপুর ছিলাম। দাদার অপারেশন হয়েছে ২০১২ সনে। এই ৪ বছরই দাদাকে দেখতাম বাম বুকে হাতে দিয়ে থাকতে। মাঝে মাঝে আমি হাত নামিয়ে দিতাম। বুকে হাত দিয়ে থাকা দাদার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

আমার বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় ২০১২ সনে ঢাকায়। দাদার কষ্ট হওয়া সত্বেও সেই অনুষ্ঠানে দাদা উপস্থিত হয়েছিলেন। দাদা আমাকে না ছাড়তে চাইলেও আমি যে ৮ বছর ধরে দিনাজপুর কষ্ট করে থাকছি এটা দাদা অনুভব করতেন। তাই তিনিও চাইতেন যেনো আমি ময়মনসিংহে ফিরে আসতে পারি। আল্লাহর রহমতে কিংবদন্তি শিক্ষক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল স্যার আমাকে বদলি করে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসেন ২০১৫ সনের শেষে। অর্ডার নিয়ে দিনাজপুর গিয়ে দেখি দাদা আমার জন্য সুন্দর একটা নেইম প্লেট বানিয়েছেন। লাগানোর অপেক্ষায় আছেন। আমার বদলীর অর্ডার শুনে তিনি বিমর্ষ হয়ে বললেন “আমি আপনার জন্য সুন্দর একটা নেইম প্লেট বানালাম, আপনি চলে গেলেন! ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।” তিনি নেইম প্লেটটা প্যাকেট করে আমাকে দিয়ে দিলেন। সেইটা কিছুটা মোডিফাই করে আমি এখন ব্যবহার করছি। দাদার স্মৃতি ফেলে দেইনি। দাদা ডিপার্টমেন্ট ও ডর্মেটরির পক্ষ থেকে আমাকে গর্জিয়াস ভাবে বিদায় সংবর্ধনা দেন। উপহার দেন অনেক কিছু। আমি তার দেয়া উপহার সামগ্রী গর্ব ও মহব্বতের সাথে ব্যবহার করি।

২০১৯ সনের নভেম্বরে প্রফেসর ডাঃ সালেহ জামালপুর শেখ হাছিনা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে চলে যাওয়ায় ময়মনসিংহের প্যাথলজি বিভাগের প্রধানের পোস্টে আমার ফিরে আসার সুযোগ হয়। আমি জানতাম এই সংবাদে রুহিনী দাই বেশী খুশী হবেন। তাই আমি প্রথমেই রুহিনী দাকে জানাই। দাদা খুব খুশী হন। আমি এই বিভাগে ২০০২ সনেও কয়েকমাস ১৬ তম বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলাম। চাকরির শেষ জীবনে এসে আবার ২৫ তম বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে খুব ভালো কাটলো ২০২০ সনের এপ্রিলের ১৩ তারিখ পর্যন্ত আমার সরকারি চাকুরির শেষ সময়কাল। আমি বিদায় নিলাম সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে। দাদা দিনাজপুর থেকে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নিয়ে এখন কুমিল্লায় এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আছেন। প্রায়ই আমাদের মধ্যে কথা হয় মোবাইলে।

১৬/৬/২০২০ খ্রি.

ময়মনসিংহ

Winter Flowers

ছাদবাগানের শীতের ফুল ও সবজি

Borishaler Kohinur

বরিশালের কোহিনূর

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

স্মৃতি কথা

বরিশালের এই কোহিনূরকে আপনারা চিনবেন না। এই কোহিনূর একজন গরীবের মেয়ে। দেখতে ছিল রবি ঠাকুরের গানের কৃষ্ণকলির মতো। তার বাবার কাছে ছিল বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত মোগল সম্রাজ্ঞীর ব্যবহার করা পৃথিবীর সবচেয়ে দামী হীরা কোহিনূরের মতো। ত্রিশ বছরেরও বেশী আগে আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার হিসাবে। চিকিৎসা পেশার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা থাকায় দুঃসাহসিক ইচ্ছা নিয়ে আমি সেই গ্রামের জরাজীর্ণ টিনসেড হাসপাতালে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা দিতে থাকি। পাশে একটা পরিত্যক্ত সরকারি বাসস্থান ছিল মেডিকেল অফিসারের জন্য। ইতিপূর্বে কোন এমবিবিএস ডাক্তার সেখানে পোস্টিং হয় নি। আমিই প্রথম। ১০০ টাকা দামের চৌকি কিনে সেই বাসাতেই আমি থাকা শুরু করলাম। সাথে একটা রান্নাঘর ছিল। ওটার ভিতর কোহিনূরের বাবা ধানের ক্ষর রেখেছিলেন। আরেকটা বৈঠককখানা ছিল। ওটার ভিতর কোহিনূরের বাবা ধানের আটি রেখেছিলেন স্তুপ করে। বাড়ীর চারিদিকে পরিত্যক্ত সিমেন্টের খুটি ছিল টিনের বেড়ার। কিন্তু টিন ছিল না। একটা কামলা নিয়ে বাঁশ কিনে সেই খুটিতে বাঁশ বেঁধে বাঁশের উপর দিয়ে কলাপাতা ভাজ করে ঝুলিয়ে বেড়া তৈরি করালাম। বাড়ির পশ্চিমপাশ সংলগ্ন একটা বিরাট জমিদারি পুকুর ছিল। খুব স্বচ্ছ ছিল তার পানি। সেই পানিতে জ্যোৎস্নার আলো ঝলমল করতো। রান্নাঘর ও থাকার ঘরের গলি বরাবর পুকুরপাড়ে একটা শানবাঁধানো ঘাট ছিল। এইগুলি চরামদ্দির জমিদারদের ছিল। তারাই প্রজাদের জন্য বৃটিশ আমলে ডিসপেনসারি করেছিল। সেইটাই এখন হয়েছে সরকারি উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই বাড়ি বাংলাদেশের এক সময়ের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আহসানুল্লাহ সাহেবের শশুরবাড়ি ছিল। সেখানে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে। পুকুরের টলটলে পানিতে শানবাঁধানো ঘাটে আমি খালি গায়ে লুঙ্গী পরে গোসল করতাম। বয়স ছিল আমার ২৭ কি ২৮। দেখতে খুব সুদর্শন ছিলাম। খালি গা দেখে পুকুরের অপর দিকের মানুষ আমার দিকে চেয়ে থাকতো। তাই, শানবাঁধানো ঘাটে বাঁশ গেড়ে কলাপাতা ভাঁজ করে বেড়া দেওয়ালাম। ফার্মাসিস্ট এর সাথে পরামর্শ করে বৈঠকখানা খালি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোহিনূরের বাবাকে ডেকে বললাম “আমি সরকারি মেডিকেল অফিসার। এখানে অবস্থান করে আমি চাকরি করব। বিকেলে একটু প্রাইভেট প্রেক্টিশ করব। আপনি ধানের আটি গুলি সরিয়ে ফেলুন। এখানে চেম্বার বানাবো। রান্নাঘর থেকে ক্ষর সরিয়ে ফেলুন। এখানে রান্না করার ব্যবস্থা করব।” শুনে কোহিনূরের বাবা আমার দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইলেন। তার গায়ে জামা ছিল না। বুকের হার সবগুলি বের করা ছিল। পেট চিমটা লাগা ছিল। নাভীর নিচে লুঙ্গী পরা ছিল। লুঙ্গীর দুই পাশ খাটো করার জন্য দুই পাশে গুজে দেয়া ছিল। উপরের পাটির দাত উঁচু ছিল। দাঁত বের করার জন্য হাসতে হয় নি। অসহায় ভাবে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে। যেন এক জমিদারের সামনে প্রজা দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কোহিনূরের বাবা বললেন
– সায়েব, আমি খুব গরীব মানুষ। জমি জমা কিচ্ছু নাই। অন্যের জমি চাষ করে কয়েকটা ধানের আটি পাইছি। এইগুলি রাখার জাওয়গাও নাই আমার। সংসারে বুড়া মা, বউ, আর দুগগা মাইয়া। আমি বাজার থাইক্কা ধান কিন্না আনি। সিদ্ধ কইরা শুকাইয়া ঢেকিতে পাড় দিয়া চাইল বানায় কোহিনূরের মায়। বেইচা যা অয় তাই দিয়া কোন মতে চালাইয়া নেই। আপ্নে যা কইছেন বুইজ্জি।
– ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি কইরেন।

আমি দেখেছি কোহিনূরের মা ও বাপকে সব সময় এক সাথে কাজ করতে। তারা সবসময় হাসিখুসি থাকতেন। হাসপাতালের সামনের খালি জায়গায় ধান শুকাতেন। বৃষ্টি এলে হাসপাতালের বারান্দায় ধান উঠাতেন। বারান্দায় রেলিং-এ বসে কতো যে সুখের আলাপ তারা করতো! এতো সুখি দম্পতি খুব কমই দেখেছি। এত ভালো মানুষ আমি কমই দেখেছি।

পরেরদিন একজন পরিপাটি লোক এলেন। পরিচয় দিলেন ঢাকায় ডিসি অফিসে চাকরি করেন। খুবই ভদ্র। তিনি বললেন
– পুকুরের দক্ষিণ পারের বাড়িটাই আমাদের। কোহিনূরের মা আমার ছোট বোন। গরীব ঘরে বিয়ে হওয়াতে বড় সমস্যায় আছি। আপনি যা করতে বলেছেন তা ঠিকই আছে। আমি ওদের বলেছি খুব শীগ্রি ঘর খালি করে দিতে। দেরী হলে ক্ষমা করে দিয়েন।
– ঠিক আছে। আমি দেখব।

কোহিনূরের বাবা আমার ঘর খালি করে দিলেন। আমি পরিষ্কার করে চেয়ার টেবিল বসিয়ে চেম্বার বানিয়ে নিলাম। কোহিনূরের দাদী কোহিনূর ও তার ছোট বোনকে নিয়ে আমার থাকার ঘরে ঢুকে পড়লেন “দাদু, দাদু” করে ডাকতে ডাকতে। দেখলাম একটা দেড় দুই বছরের বাচ্চাকে পাতালি কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন বুড়ি। ব্লাউজ ছিল না তার গায়। গ্রামের এমন বুড়িরা ব্লাউজ প্রেটিকোট পরতেন না। শুধু ১৩ হাত সুতীর কাপড় এক পেচ দিয়ে পরতেন। তিনি বাচ্চাটাকে দুধ মুখে দিয়ে রেখেছিলেন প্রকাশ্যে। এজন্য আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম
– একি ঘরের ভিতরে এলেন কেন? বাইরে থাকুন।
– দাদু, আমি কোহিনূরের দাদী। খালের ঐ পাড়েই থাকি। এইটা আমার নাত্নী কোহিনূর। কোলেরটা কোহিনূরের ছোট।
– নাত্নীকে কি কেউ দুধ খাওয়ায়।
– ও আল্লাহ, দাদু, কি বুলায়। আমি বুড়া মানুষ। দুধ শুকাইয়া গেছে। অর মায় সারাক্ষণ কাম করে। আমার কোলে দিয়া রাখে। খালি কান্দে। তাই দুধের বোটা মুখে দিয়া রাখি। দুধ নাই। খালি বোটা চাটে।
– আমারে দাদু বলছেন কেনো। আমি সরকারি অফিসার।
– হেই ছোট কাল থাইকাই সায়েব দেইখা আইতাছি। এইহানেই বাড়ি। সবাই আমারে আপনা মানুষই ভাবছে। আপনের আগের সায়েব বুড়া মানুষ ছিল। এইখানে অনেকদিন ছিল। এইখান থাইকাই তার চাকরি শেষ অইছে। তারে আমি দাদু ডাকতাম। আপনেও আমার দাদু।
– ঠিক আছে, এখন যান।
– দাদু, এই মাইয়াউগগার একছের পাতলা পায়খানা অয়।
– হাসপাতাল টাইমে আইসেন।
– আমি যামু হাসপাতালে? আমি হাসপাতালে যাই না। দাদু আমাকে বাসায় থাইকাই ঔষধ দিয়া দিতেন।
– খাবার সেলাইন লাগবে। আমার কাছে নাই। এখন যান।
– আগের দাদুর সময় টিনের বেড়া গুলি অমুকে নিয়ে তার বাড়িতে লাগাইছে। চার দিক দিয়া বেড়া ছিল।

আমি ফার্মাসিস্ট-এর কাছ থেকে জেনে নিলাম কে এই টিনের বেড়া নিয়ে গেছে। তার সাথে পরামর্শ করে ডেকে এনে টিনগুলি উদ্ধার করে কলারপাতা ফেলে দিয়ে টিনের বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করলাম।

এরপর থেকে আমি বাসায় খাবার সেলাইন রাখতাম। কেউ পাতলা পায়খানার কথা বললে আমি সেলাইন দিয়ে দিতাম। কিন্তু কোহিনূরের কোন দিন পাতলা পায়খানা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানতাম যে তার দাদী পাতলা পায়খানার কথা বলে সেলাইন নেয়। কোহিনূরের বয়স তখন ৬ বছরের মতো ছিল। দাদীর সাথে আসতো। তার দিকে তাকালে চোখ নিচু করে মিষ্টি করে হাসতো। আমি জানতাম দাদী খাবার সেলাইন নিতেন নিজে খাওয়ার জন্য। খেয়ে তিনি শক্তি পেতেন। কোহিনূরের নাম ভাংগিয়ে নিতেন সেলাইন।

একা এক বাড়িতে থাকতাম। মাঝে মাঝে শুয়ে বিশ্রাম নিতাম। প্রকৃতি খুব শান্ত ছিল। মাঝে মাঝে কোহিনূরের বাবার কন্ঠের ডাক ভেসে আসতো “কনুরে…।” তার বাবা মা তাকে কোহিনূর না ডেকে কনুর ডাকতেন। এক বছর আমি চরামদ্দি চাকরি করেছি। শেষের চার পাচ মাস আমার ফ্যামিলি নিয়ে ছিলাম। কোহিনূরকে আমার স্ত্রী আদর করতো। কোহিনূরের মা আমার স্ত্রীর খোঁজ খবর নিতেন। আমার স্ত্রী তাকেও ভালবাসতো। এখনো আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে চরামদ্দির স্মৃতিচারণ করার সময় কোহিনূর, কোহিনূরের মা ও বাবার কথা বলে। বলে “তারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের জন্য মায়া হয়। তাদের বাড়ি যেতে খাল পার হতে হতো। খালের উপর দিয়ে একটা তালগাছ না কি গাছ যেনো ফেলে সাঁকো বানানো হয়েছিল।” ওটা আসলে ছিল তাল গাছ। জোয়ারের সময় খাল পানিতে ভরে যেতো। ভাটার সময় তলা দেখা যেতো।

সেই ১৯৮৯ সনে চরামদ্দি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিলাম। রেখে এসেছিলাম ভালো একটি প্রতিবেশী পরিবার। এর ঠিক ১০ বছর পর ১৯৯৯ সনে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে এক্সটারনাল হিসাবে পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে কির্তনখোলা নদী পার হয়ে কাউয়ার চর হয়ে রিক্সায় চরামদ্দি বেড়াতে গিয়েছিলাম, আমার স্মৃতি বিজড়িত কোহিনূরদের গ্রামে। সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম বরিশালে এই মেডিকেল কলেজে ৫ম বর্ষের ছাত্র আমার ভাতিজা শহিদুল্লাহ হুমায়ুন কবীরকে (এখন এনাস্থেসিওলজিস্ট)। ঘুরে ঘুরে আগের দিনের অনেক কিছুই দেখি। সেই টিনসেড হাসপাতাল নেই। বিল্ডিং হয়েছে। সেই পরিত্যক্ত বাড়ি নেই। কোয়ার্টার হয়েছে বহুতল। পুকুরের ঘাট সংস্কার করা হয়েছে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী মকবুল দফাদারের ছেলে মাসুদকে নিয়ে সব দেখলাম। তুলনা করলাম দশ বছর আগেকার চরামদ্দির সাথে। কত উন্নত হয়েছে আজ! কোহিনূরের বাবাকে পেলাম সামনে। সেই আগের হাসি। সেই আগের মতোই লুঙ্গী পরা খালি গায়। আমি বললাম “আপনার বাচ্চা দুইটিকে দেখতে চাই। কোহিনূরের মা কই?” তিনি খাল পেড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কোহিনূরের মা, একজন শাড়ী পরা কিশোরী ও একজন পাজামা পরা মেয়েকে নিয়ে এলেন। কোহিনূরের দাদী এলেন কি না আমার মনে নেই। ৩০ বছর আগের কথা তো! সব মনে করতে পারি না। আমি বললাম
– কোহিনূর কই?
– এইটাই তো কোহিনূর।

সেই শাড়ী পরা কিশোরীটিই কোহিনূর। আমি চমকে গেলাম। আমার দেখা সেই হাফ প্যান্ট পরা কোহিনূর কই? সেই কোহিনূর, যার গায়ে জামা থাকতো না। গলায় থাকতো ৪ আনা দামের সীসার রুপালী চেইন। যার চোখের দিকে তাকালে চোখ নত করে মিষ্টি হাসি দিতো। সেই কোহিনূর আমাকে দেখে একটু ঘোমটা টেনে পাশ ফিরে তাকালো। কারন, এখন সে ৬ বছরের শিশু নয়, এখন ১৬ বছরের এক গ্রাম্য কিশোরী, কোহিনূর।
৪/৮/২০১৯ খ্রি.

Surzo-banur-chheleti

সূর্যবানুর ছেলেটি


সূর্যবানু ছিল নাহার নার্সিং হোমের আয়া। তখন টাংগাইল শহরে তথা টাংগাইল জেলায় মাত্র একটি প্রাইভেট ক্লিনিক ছিল এই নার্সিং হোম। এটা ছিল আকুরটাকুর পাড়ায় একটা বড় পুকুরের পাড়ে। আশেপাশে বড় বড় আমগাছ ও নারিকেল গাছ ছিল। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে হলেও এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল সুন্দর, মনোরম । ক্লিনিকের মালিক ছিলেন টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত কাইয়ামারার নিঃসন্তান মোয়াজ্জেম হোসেন ফারুক ভাই। তিনি তার স্ত্রী নাহারের নামে এই ক্লিনিক করেন পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া জমির উপর তিন তলা বিল্ডিং-এ। পাশেই আগে থেকেই পুরাতন আধাপাঁকা একটা ঘর ছিল তাদের । সেই বাড়িটা চিকিৎসকের থাকার কাজে ব্যবহার হতো । আমি ফ্যামিলি নিয়ে সেই বাসায় থাকতাম। বাসা ভাড়া দিতে হতো না। সর্ব সাকুল্যে মাসিক বেতন ছিল আমার ১,৮৫০ টাকা। ১৯৮৮ সনের জুলাই মাসে সরকারি চাকুরি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি এক বছর এই ক্লিনিকে চাকরি করেছিলাম। আমার কর্তব্যনিষ্ঠা ও দক্ষতায় মুদ্ধ হয়ে ফারুক ভাই ছয় মাসের মাথায়ই আমাকে ক্লিনিকের মেডিকেল ডাইরেক্টর বানিয়ে দেন। তিনি ছিলেন জীবন বীমা কোম্পানির ম্যানেজার। অফিস ছিল ঢাকায়। থাকতেন ঢাকায়। প্রতিদিন তিনি আমাকে ফোন করে ক্লিনিকের খোঁজ খবর নিতেন। প্রথম দিকে ক্লিনিকে লোকশান হতো। আমি লোকশান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখিয়েছিলাম। লাভের টাকা তার হাতে তুলে দিলে তিনি টাকা ফেরৎ দিয়ে বললেন “আমার ক্লিনিক থেকে লাভ নেয়ার দরকার নেই। লাভের টাকা দিয়ে ক্লিনিকের উন্নয়ন করতে পারলেই হবে।” আমি সেই টাকা দিয়ে ক্লিনিকের রিপেয়ারিং-এর কাজ করিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশী ছিলেন আমার প্রতি। আমার সরকারি চাকরি হলে তিনি আমাকে দ্বিগুণ বেতন অফার করেছিলেন রেখে দেয়ার জন্য। আমি সেই অফার গ্রহণ করিনি।

ফারুখ ভাইর  ছোট ভাই খোকা ভাই ও তার শ্যালক দীপু ভাই ছিলেন প্রথম দিকে ক্লিনিক পরিচালনার দায়িত্বে। কর্মচারীদের বেশীরভাগই ছিল ফারুক ভাইর  প্রতিবেশী ও আত্বীয়। সামসু ও ফজলু ছিল ওয়ার্ডবয় কাম পাহারাদার। এলেঙ্গার মোতালেবকে আমি নিয়োগ দিয়েছিলাম পরে। আমীর হামজা ছিলেন রিসেপসনিষ্ট। এলেঙ্গার মজিদকে ম্যানেজার পদে আমি রিক্রুট করেছিলাম। সূর্যবানু, হ্যাপির মা (নূরজাহান) ও সাহিদা ছিল আয়া। এই তিনজনই ছিলো স্বামী-হারা অসহায় মহিলা। তাই তারা ফারুক ভাইর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। হ্যাপির মার হ্যাপিকে অল্প বয়সেই বিয়ে দেয়া হয়। তাকে আমি দেখিনি। হ্যাপির পরই এক ভাই ছিলো। তাকে নিয়ে হ্যাপির মার খুব অশান্তি ছিলো। হ্যাপির আরেকটা ভাই ছিলো ছোট ছয়-সাত বছর বয়সের। হ্যাপির মা সন্তান নিয়ে ক্লিনিকে আসতোনা। সাহিদার কোন সন্তান ছিল না। সূর্যবানুর স্বামী মারা গিয়েছিল। একমাত্র সন্তান ছিল তার ছেলে আল-আমীন। সবাই ডাকতো আলামিন। সূর্যবানু ছেলে আলামিনের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাকী জীবন বিয়ে করবে না। সূর্যবানু কাজে কর্মে ও রোগীদের প্রতি দরদী ছিলো। আমাদের বাসায় যেতো। আমার স্ত্রী তাকে পছন্দ করতো। আমার স্ত্রীর কাছে সে ছিলো ভালো মানুষ। আমার স্ত্রী ভালো মানুষ চিনতে সাধারণত ভুল করে না। সময় সময় আমার স্ত্রীকে সূর্যবানুর সাথে গল্প করতে দেখেছি।

আলামিনের বয়স ছয় কি সাত বছর ছিলো। চেহারায় মায়া মায়া ভাব ছিলো। আদর করতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু প্রকাশ্যে আদর করতাম না। কারন, আমি জানি, শিশুরা আদর করলে মাথায় উঠে। হয়তো দেখা যাবে স্টেথোস্কোপটা আমার গলায় থেকে খুলে নিয়ে তার কানে ঢুকাবে। অথবা আমার অনুপস্থিতিতে আমার চেয়ারে বসে দোল খাবে। অথবা মুল্যবান যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলা করবে। অথবা মিষ্টি ঔষধ নিজের মনে করে খেয়ে ফেলবে।  ফারুক ভাইর সামনে আলামিন পড়লে সূর্যবানুকে ধমক দিয়ে বলতেন “এই সূর্যবানু, আমি কতবার বলেছি না, যে বাচ্চা নিয়ে ডিউটিটে আসবি না।” সূর্যবানু মাথা নিচু করে থাকতো। ফারুক ভাই আমার দিকে চেয়ে বলতেন “ডাক্তার সাব, আপনি মানা করেন নাই সূর্যবানুকে বাচ্চা না নিয়ে আসতে?” আমি সূর্যবানুর দিকে চেয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে বলতাম “এই সূর্যবানু, আমি কতবার বলেছি তুমি আলামিনকে নিয়ে ডিউটিতে আসবা না। তুমি আমার কথাই শুনছো না।” সূর্যবানু মনে মনে বলতো “আপনি অমন নিষ্ঠুর হতেই পারেন না। বলবেন কি করে?” আসলে বাবা-হারা মাসুম আলামিন কি মাকে ছেড়ে একা বাড়িতে থাকতে পারে? তাই, আমি কোন দিন সূর্যবানুকে মানা করিনি। আলামিন সব সময় মায়ের কাছাকাছি থাকতো। কোন জিনিসে হাত দিত না। কোন জিনিস নষ্ট করতো না। কেউ কেউ তাকে দিয়ে ফুট ফরমায়েস করাতো। আমি করাতাম না। কারন, চাকরি করতো তার মা, সে তো না।

আলামিনের একটা মাত্র শার্ট ছিলো। হাল্কা আকাশী রঙের হাফ হাতা হাওই শার্ট। সে বেশী সময়ই ঠিক ঘরে বোতাম লাগাতে পারতো না। এক ঘরের বোতাম আরেক ঘর পর লাগাতো। তাতে শার্টের নিচের দিকে একপার্ট নিচু আরেক পার্ট উচু থাকতো। আমি বলতাম “আলামিনের শার্ট নিচের দিকে সমান না। ক্যাঁচি দিয়ে কেটে সমান করে নিও।” আলামিন বুঝতে পেড়ে সুন্দর দাঁত বের করে মুচকি হাসতো।

আলামিনকে দিয়ে বেশী ফরমাইস করাতো আজিজ ভাই। আজিজ ভাই ছিলেন প্যাথলজি ল্যাবের টেকনোলজিস্ট। ক্লিনিকের নিচ তলায় ল্যাবরেটরি ছিলো। আলামিন এই ল্যাবে যাতায়াত করতো। একদিন দেখা গেলো ল্যাবের মূল্যবান একটি কাঁচের যন্ত্র ভেঙ্গে মেঝেতে পড়ে আছে। আজিজ ভাই জোড়ে সোড়ে বলছিলেন “আমার দামী নিউবার কাউন্টিং চেম্বারটা ভাংলো কে?” সারা ক্লিনিক জুড়ে তোলপাড় করতে লাগলেন। প্রফেশনাল ঝাড়ুদারের প্রতিই সবার সন্দেহ। কিন্তু সে ভগবানের নামে কসম খেয়ে বলছিলো যে সে ভাংগেনি। একদিন পর্যন্ত সন্দেহের দৃষ্টি ঝাড়ুদারের উপরই ছিল। ঝাড়ুদার বলছিলো “বাবু, হামি গারীব হোতে পারি, হামি মিছা কথা কইতে পারিনেক।” আমি আজিজ ভাইকে মানা করে দিলাম ঝাড়ুদারে প্রতি সন্দেহ না করতে। এবার আজিজ ভাইর সন্দেহ পড়লো আলামিনের প্রতি “আলামিনই ভাংছে। এই জন্যই বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে ডিউটিতে আসা ঠিক না।” আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এবার ফারুক ভাই শুনলে আলামিনকেসহ সূর্যবানুকে তাড়াবে। আজিজ ভাই ল্যাবে এসেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করতে থাকেন “নিউবার কাউন্টিং চেম্বার ছাড়া আমি রক্ত পরীক্ষা করব কিভাবে? আমি যেনো কালকে থেকে আলামিনকে না দেখি।” আলামিনকে নানা ভাবে জিজ্ঞেস করে বের করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু না সে ভাংগেনি। সেও খুব চিন্তিত ছিল যে এবার থেকে সে তার মায়ের সাথে আসতে পারবে না। সূর্যবানুও চিন্তিত ছিলো। আমি লাঞ্চ করতে বাসায় এসেছিলাম। বাসা আর ক্লিনিক পাশাপাশি ছিল। আজিজ ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন “কেউ স্বীকার করছে না যে সে ভেংগেছে। তাইলে ভাংলো কে? তাইলে কি ভূমিকম্প হয়েছিলো?” আমি জানালা দিয়ে চিৎকার করে উত্তর দিলাম “হ্যা, হ্যা, দুই দিন আগে রাতে ভূমিকম্প হয়েছিলো। সারাদেশ কেঁপে উঠেছিলো। চিটাগাং দুইটা ভবন ধ্বসে গেছে ভূমিকম্পে। আপনার টেবিলে ঝাকুনি খেয়ে কাউন্টিং চেম্বার পড়ে গিয়ে ভেংগে গেছে।” সবাই শুনে দৌড়িয়ে এলো আজিজ ভাইর কাছে। বলাবলি হাসা হাসি হচ্ছিলো। ঝাড়ুদার ও আলামিন অভিযোগ থেকে রক্ষা পেলো। খুশীতে আমি একটু বেশীই খেলাম।

একবার কোন একটা কারনে আমি এবং ফারুক ভাই মিলে একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু সূর্যবানু বুঝতে না পেড়ে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তাতে ক্লিনিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে থাকে। আমি সূর্যবানুর উপর ক্ষেপে গিয়ে উচ্চস্বরে ধমকাতে থাকি। সূর্যবানু নিরবে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে। আলামিন সাথেই ছিলো। সে তার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে ফোঁফাতে থাকে। হটাৎ আমার দিকে আঙুল নির্দেশ করে সিনেমার নায়কের স্টাইলে বলতে থাকে “এই আমার মায়েরে কিছু কবিনা।” শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। বুঝতে পারি সন্তানের সামনে মাকে অপমান করা ঠিক হয়নি। শুধু বললাম “যাও।” আলামিন মাকে টেনে নিতে নিতে বললো “নও, মা, এনে চাকরি করবা না।” সূর্যবানুর বিদ্রোহের কথা ফারুক ভাইর কানে গেলে ফারুক ভাই নির্দেশ দিলেন সূর্যবানুকে বরখাস্ত করতে। সবাই সূর্যবানুকে পরামর্শ দিলো তোমার চাকরি থাকতে পারে যদি আমি তাকে ক্ষমা করে দেই। আমারও ইচ্ছা ছিলো তাকে রাখবো। আমি বাসায় ছিলাম বিশ্রামে। সুর্যবানু বাসায় এসে অনেকক্ষণ অনুনয় করে ক্ষমা চাইলেন। আমি কোন কথা বললাম না। আমার স্ত্রী সূর্যবানুকে বললো “যাও, কাজ করোগে। তোমার স্যার তোমাকে মাফ করে দিয়েছে।” সূর্যবানু বুঝতে পারলো যে আপার কথাই স্যারের কথা। পরদিন সব কিছু সাভাবিক নিয়মে চললো। আলামিনকে আশ্বস্ত করার জন্য তার মাথায় হাত বুলালাম। বললাম “তোমার শার্টের উচু নিচু অংশটা ক্যাঁচি দিয়ে কেটে সমান করে নাও।” আলামিন মুচকি হাসলো।

এবার রোজা হবে গ্রীষ্মককালে। ৩০ বছর আগে সেবারও রোজা হয়েছিল গ্রীষ্মকালে। প্রচুর আম ধরেছিলো ক্লিনিকের দক্ষিণ-পূর্ব কোণার আম গাছে। কঁচি কঁচি আম। ঝোকা ঝোকা ঝুলছিলো। ছাদে উঠলে হাতের কাছেই ছিলো। পেড়ে খেতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু গাছটা ক্লিনিকের বাইরের সীমানায় ছিলো। তাই, এই আম আমাদের ছিড়তে মানা। আমি ইফতার করার জন্য বাসায় গিয়েছিলাম। সবাই যার যার মতো করে ইফতার করছিলো। সূর্যবানুও দক্ষিণ পাসের দোতলা এক রুমে ইফতার করছিলো। আলামিন ছোট মানুষ। তাই রোজা রাখেনি। আলামিন মায়ের সাথে ছিলোনা। আমি মাত্র আজান দেয়ার সাথে ইফতার মুখে দিয়েছিলাম। ধরাম করে একটা শব্দ হলো ক্লিনিকের দিক থেকে। ‘আলামিন’ বলে সূর্যবানু চিৎকার করে থেমে গেলো। আমি ইফতার রেখে দৌড়িয়ে গেলাম ক্লিনিকের পূর্ব পাশে। দেখি আলামিন উপুর হয়ে পড়ে আছে চার হাত পা ছড়িয়ে কংক্রিটের রাস্তার উপর নিস্তেজ হয়ে। মুষ্ঠিতে আমের ডাল সহ আম। বুঝতে দেরী হলো না যে সবাই যখন ইফতারে ব্যস্ত আলামিন সেই সুযোগে ছাদে গিয়েছিলো আম চুরি করে ছিড়তে। আমের ঝোকা ধরে টান দিলে আমের ডালেও তাকে  বিপরীত দিকে টান দিয়েছিলো। আমের ডাল ছিড়ে আলামিনও পড়ে গিয়েছিল তিন তলা বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে। অর্থাৎ চার তলা থেকে। চার তলা থেকে সিমেন্ট-এর পাকা রাস্তায় পড়ে কেউ কি বাঁচার কথা? আলামিনের পালস ও রেস্পাইরেশন পেলাম না। দু’হাত দিয়ে কোলে করে নিয়ে গেলাম দোতলার অপারেশন থিয়েটারে। ওটি টেবিলে শুইয়ে কৃত্তিম শ্বাস প্রশ্বাস দিলাম।  বুকে হার্টের উপর মাসাজ দিলাম। পালস ফিরে এলো। শ্বাস ফিরে এলো আলামিনের। অক্সিজেন চালু করে দিলাম আলামিনের নাকে। আসার সময় দেখেছিলাম সূর্যবানু বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। শব্দ শুনে জানালা দিয়ে আলামিনকে পড়ে থাকতে দেখে সূর্যবানু এক চিৎকারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে দোতলার বারান্দায়। তাকেও ওটিতে এনে চিকিৎসা দেয়া হলো। অনেক্ষণ পর মা-ছেলের জ্ঞান ফিরে এলো। সারারাত পর্যবেক্ষণে রাখলাম। পরীক্ষা করলাম। বুকের এক্স-রে করা হলো। আল্লাহ্‌র রহমতে কোথাও কোন হাড় ভাংগা পাওয়া গেলো না। উভয়েই সুস্থ হয়ে উঠলো। মহল্লাবাসী ও সাংবাদিকরা যেন না জানতে পারে সে জন্য সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হলো। সাংবাদিকরা যদি জানতে পাড়তো তাহলে হয়তো খবর বের হতো “৪ তলা থেকে পড়ে গিয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে আলামিন নামে এক ছেলে।” শোকজ খেত ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ।

কিছুদিন পর থেকে দেখলাম আলামিন তার মায়ের সাথে আসছে না। আলামিনের কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সূর্যবানু জানালো যে তাকে খোকা ভাইর ভাইয়ের ফাস্ট ফুডের দোকানে নিয়ে গেছে।
– ওখানে কি তাকে চাকরি করতে দিলে?
– না। এতো ছোট ছেলে, চাকরি করবে কেন? তাকে নাকি খোকা ভাইর ভাইয়ের মতো মনে হয় তাই তারা নিয়ে নিয়েছে। কাজ শিখুক। বড় হয়ে তো কাজ করেই খেতে হবে।

যে ছেলে সব সময় মায়ের সাথে থাকতো সে ছেলে এখন ফাস্টফুডের দোকানে ফুট ফরমায়েশ করবে। শুনে আমার কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো।

একদিন পুরান বাস স্ট্যান্ড-এ একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলাম কিছু কিনতে। দেখি একটা টুলে আনমনে বসে আছে আলামিন। শরীরটা শুকিয়ে গেছে। সেই জামাটি গায়। কিন্তু সোজা করে বোতাম লাগানো আছে। সেলসম্যান ধমক দিয়ে আলামিনকে বললো “এই ছেরা, ঝিম ধরে বসে আছস ক্যান, পানি দে।” আলামিন বিনম্র ভাবে উঠে গিয়ে কাস্টমারকে পানি দিলো। ঘুরে আমাকে দেখে একটা কাষ্ঠ হাসি দিলো। আমার অন্তরে কোথায় যেনো ব্যাথা অনুভূত হলো।

তারও কিছুদিন পর দেখি ভিক্টোরিয়া রোডে হ্যাপির মার ছোট ছেলে ও আলামিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ফেরী করে চা বিক্রি করছে। একটা বড় ফ্লাস্কে রেডিমেড চা নিয়ে কাপে ভরে বিক্রি করছে। হ্যাপির মার ছেলের হাতে ফ্লাস্ক আর আলামিনের হাতে জগ, কাপ, গ্লাস ও টোস্ট বিস্কুট। আমাকে দেখে ইশারা দিয়ে সালাম দিয়ে দুইজনই মিটি মিটি হাসছিলো। আমিও মিটিমিটি হাসছিলাম।
– তোমরা কি করছো?
– আমরা ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করি। মায় টাকা দিছে দোকান করতে। ভালোই লাভ হয়। আমরা দুইজনে ভাগে দোকান করি।
(বুঝলাম তারা স্বাধীন ব্যবসা উপভোগ করছে)
– তোমরা পড়তে যাওনা?
– না। পইড়া কি হইব? স্যার, চা খাইন।
– না। চা খাব না।
– খাইন স্যার, একটা।
তারা দুইজনই আমাকে খুব করে ধরলো চা খেতে। আমি এক কাপ চা খেয়ে বললাম
– খুব ভালো হয়েছে।
– আরেক কাপ দেই, স্যার?
– আরে, না।
তারা দুইজনই খুব খুশী আমাকে চা খাওয়াতে পেরে। আমি পকেটে হাত দিতেই সমস্বরে দুইজন বলে উঠলো “দাম লাগবে না, স্যার। এমনি দিয়েছি।”

আমি কিছুতেই দাম দিতে পারছিলাম না। পরে বললাম যে এটা চায়ের দাম না এটা এমনি দিলাম তোমাদেরকে কিছু খাওয়ার জন্য। কত দিয়েছিলাম তা মনে নেই। তবে তখন আমার পকেটে বেশী টাকা থাকতো না। সারামাসের বেতন ছিলো মাত্র ১,৮৫০ টাকা।
তবে এটাই মনে হয় আলামিনের সাথে আমার শেষ দেখা। সেদিন তার গায়ে সেই শার্ট ছিল অসমানে লাগানো বোতাম। হাফ হাতা হাল্কা আকাশী হাওই শার্ট।

সূর্যবানু আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বেড়াতো। কোন সময় ধাওয়া কান্না শুরু করলে সূর্যবানু এসে কোলে নিতো। তার কোলে সে চুপ হয়ে যেতো। ছোট্ট মেয়েটাকে সে বুড়ি বলে ডাকতো। বেজার হয়ে থাকলে নানান ভঙ্গী করে হাসাতে চেষ্টা করতো। সরকারি চাকরি নিয়ে চলে আসার পর আমার স্ত্রী সুর্যবানুকে নিয়ে কথা বলতো। “আবার টাঙ্গাইল গেলে সূর্যবানুকে দেখে আসব” বলে মন্তব্যও করেছে অনেকবার। মাঝে মাঝে আমরা নাহার নার্সিং হোমে বেড়াতে গিয়ে সূর্যবানুকে দেখে আসতাম। সব সময়ই সুর্যবানু আমার মেয়েরা কেমন আছে কি করছে খোঁজ নিতো। আমি কখনো আলামিনের খোঁজ নেইনি। বহু বছর হয়ে গেছে সূর্যবানুর খোঁজ নেনি। বেঁচে আছে কিনা তাও জানিণনা। বেঁচে থাকলেও বয়সের ভারে তার শরীর ভেংগে যাওয়ার কথা। আলামিনের বয়স তো এখন ৩৬ সের উপরে হবে। সেকি তার মাকে কামাই করে খাওয়াচ্ছে? যে ছেলের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে। যদি কোনদিন আলামিনের সাথে দেখা হয় তবে নিশ্চয়ই আমি আগের আলামিনকে পাবো না। পাবো কি সেই মাসুম শিশু, হাল্কা আকাশী রংগের হাফ হাতা হাওই শার্ট গায়ে অসমান বোতাম লাগানো, যেমনটি দেখেছিলাম শেষবারে ভিক্টোরিয়া রোডে আলামিনকে, সূর্যবানুর ছেলেটিকে!

২৪/২/২০১৯ খ্রি.
ময়মনসিংহ- কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ জার্নি