Tag Archives: গল্প

Falani

Falani

ফালানি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি

ফালানির একটাও কুরকা

ফালানির একটাও কুরকা আছাল না। তার বাহের তিগা পয়সা নিয়া নিয়া খুটির বিতর জরা করতো। এবা কইরা হে ১০০ টেহা জরা করছাল। হেই টেহা দিয়া তার বাহে আটে তিগা একটা ডেহি মুরগি কিন্না দিছাল। কয়দিন পরই হেই মুরগি করকরাইয়া ডোলের বিতর আন্ডা পারন ধরে। বালাই আন্ডা পারছাল। বাইসটা আন্ডা পারছাল। চাইরডা আন্ডা হিদ্দ কইরা রাইন্দা খাইছাল। চাইরডা আন্ডা আন্ডার পাইকারের কাছে বেইচ্যা নইটানা কিন্যা খাইছাল। দুইডা আন্ডা পচা বাইরইছাল। আর যেডি আছাল ঝাইঞ্জরে মইধ্যে খের বিছাইয়া মুরগিরে কুইচা বহাইছাল। মুরগি মইদ্যে মইদ্যে কক কক কইরা বাইরে গিয়া আদার খাইয়া আইত। হেসের দিকে হারাদিন কুইচা বইয়া থাকত। কুইচা মুরগির ঠোলার খের ভর্তি হুরহুরি পোকা অইছাল। হেই হুরহুরি পোকা বারির বেবাককের গতরেই হুরহুরাইত। বাইসদিন পর মুরগি বাচ্চা তোলায়। উঠানে খুদ ছিটাইয় দেয় বাচ্চাগুনারে খাওনের নিগা। বাচ্চাগুনায় চিয় চিয় কইরা ডাহে আর ঠুকরাইয়া খুদ খায়। একটা বাচ্চা ছাইয়ের ঠেংগিত পরছাল। ছাইয়ের বিতর গনগনা আগুন আছাল। হেই আগুনে পুইরা একটা বাচ্চা মইরা যায়। আরেকটা বাচ্চা আইশালের আগুনে পুইরা মইরা যায়। একটা বাচ্চা চিলে নিয়ে যায়। আরেকটা নেয় বেজিয়ে। আরেকটা গরুর পারা খাইয়া চেটকা অইয়া মইরা যায়। উঠানে ধান খেদানোর সোম ফালানির দাদির কোটার বারি খাইয়া মইরা যায় একটা । যেডি বাইচ্চা থাহে হেডির মইদ্যে অর্ধেক অয় ডেহি, আর অর্ধেক অয় মোরগ।

ফালানির বিয়া অইছে

(টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক গ্রাম্য ভাষায় লেখা গল্প)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

হেদিন যে ফালানির কতা কইছিলাম হে ফালানির বিয়া অইয়া গেছে। অইজে, কইছিলাম না যে, ফালানির ডেহি মুরগি বাইশটা আন্ডা পারছাল। হেন তিগা চাইরডা আন্ডা হিদ্দ কইরা আইন্দা খাইছাল। চাইরডা আন্ডা পাইকারের কাছে বেচচাল, দুইডা আন্ডা পচা বাইরইছাল। আর যেডি আছাল হেডি দিয়া মুরগিরে কুইচা বহাইছাল। হেন তিগা মুরগি যে কয়ডা বাচ্চা তোলাইছাল তার তিগা একটা আইশালের আগুনে পইরা পুইরা মরে, একটা ছাইয়ের ঠেংগিত পইরা পুইরা মরে, একটা গরুর পারা নাইগ্যা মইরা যায়, আর একটা ধান খেদাইন্যা কোটার বারি নাইগ্যা মইরা যায়, একটা নিয়া যায় চিলে আর একটা নিয়া যায় বেজিয়ে। যে ছয়ডা বাইচ্চা আছাল হেইগনা বড় অইয়া তিন্ডা অয় ডেহি আর তিন্ডা অয় মোরগ। হেন তিগা দুইডা মোরগ পলাই আটার য়াটে নিয়া বেইচ্চা একটা য়াসা আর একটা য়াসি কিন্না আনে। তাইলে অহন ফালানির অইল গিয়া পাচডা কুরকা আর দুইডা য়াস। য়াসগুলা ফালানিগ পাগারে হাতুর পারে। য়াসিডায় হারাদিন ঘাগ ঘাগ কইরা ডাহে, আর য়াসাডায় গলা হেস হেসাইয়া পাকপাক কইরা ডাহে। বিল পাড়ের ক্ষেত তিগা হামুক কুরাইয়া আইন্যা পাচন দিয়া ভাইংগা দেয় য়াসের হুমকে। য়াস হেগনা ক্যাত ক্যাতি গিলে আর গলা মোচড় পারে। ছোট ছোট হামুক আমানই গিল্লা হালায়। ফালানির বিয়ার পর য়াস মুরগি পালনের খুবই কষ্ট অইতাছে ফালানির মায়। ফালানিরে দুল্লা য়াইখাই ফালানির বাপে মইরা গেছে। ফালানিরে ডাংগর করতে অনেক কষ্ট করতে অইছে। বিয়া দিবার পর কষ্ট আবার বাইরা গেলো। কী আর করবো, মেও পোলা অইয়া জন্মাইলে হশুর বাড়ি ত যায়নই নাগব। মেয়াডারে বিয়া দিবার পর তিগা থাইকা থাইকা ফালানির মায় কান্দে আর আঁচল দিয়া চোখের পানি মুছে।

বালা ধনি বাইত্যেই ফালানির বিয়া অইছে। ফালানির চেহারাও বালা খপছুরতের। পরতম সরাদার দেইহা যায় তারে পাগার পাড়এ যেসুম হে কলস বোজাই কইরা মাঞ্জায় কইরা নিয়া য়াইটা যায়। ফালানির বিয়ার কতা তোলে আহাদুল্লা হিকদারের নাতি দিয়া, অর নাম অইল শাব্দুল। শাব্দুল মেট্রিক পর্যন্ত পড়ছে। হে অহন বিদেশ করব। গেরামের পোলারা মোছ একটু কালা অন ধরলেই আদম বেপারির দালাল ধইরা বিদেশ চইলা যায় জমিন জিরাত, বাড়ি ঘর, নোটা বাটি বেইচ্চা দিয়া। যাগ কিছু নাই তারাও গরীবের বন্ধু সমিতি তিগা সুদী কইরা টেহা নিয়া বিদেশ চইলা যায়। হেই ইন হোদাইতেই চাইর পাচ বোছর নাইগ্যা যায়। শাব্দুলের পাসপোর্ট ভিসা অইয়া গেছে। টেহাও যোগার অইছে। অর্ধেক যোগাইছে শাব্দুলের বাহে আর অর্ধেক যোদাইছে ফালানির চাচায়। দুই এক হপ্তার মধ্যেই শাব্দুলের ফেলাইট। পরতম গিয়া পাঁচ বোছর পর দুই মাসের ছুটি নিয়া দেশে আইব। যাওনের আগে যুদি ফালানির পেটে সোন্তান ধরে হেই সোন্তান তহন চাইর বোছইরা অইয়া যাবো। এই চাইরডা বোছর গেন্দাডায় বাপের আদর পাবো না। মইদ্যে মইদ্যে মোবাইলে দেকপার পাবো বাপের মুখ। তয় ছুইয়া দেকপার পাবো না। পেটের উপর গড়াগড়ি করার ভাইগ্যে থাকপ না। কান্দে নিয়া নাচনের ভাইগ্য থাকপ না। তুলতুলা গালের মইদ্যে নাক দিয়া ঘষা দিয়া উলু উলু করার সুযোগ পাব না। কতা হেস কইরা খালি কবো আব্বু টা টা। উম্মা উম্মা। আর যুদি এই কয়দিনে ফালানির পেটে বাচ্চা না ধরে তয়লে পাঁচ বোছর পর্যন্ত দেরি করন নাগব সোন্তান ধরনের নিগা। ভাগ্যে যুদি না থাহে হেই দুইমাসে সোন্তান না ধরে তাইলে আবার ছুটি নিয়া আহন পর্যন্ত দেরি করন নাগব। ফালানিরে বিয়া করার পর তিগা শাব্দুলের বিদেশ যাইতে ইচ্ছা করতাছে না। কিন্তু করার কিছু নাই। দালালেরে টেহা পয়সা দেয়া হেস। পাসপোর্ট ভিসাও কম্পিলিট। অহন না করন ঠিক অব না।

অ, ফালানির কিবা কইরা বিয়া অইল হেইডা কবার নইছিলাম। সোমবার দিন য়াটে যাওনের সুম হরাদারে ফালানিরে পাগার পাড়ে দেখছাল। মোঙ্গল বারে শাব্দুলের বাপের কাছে বিয়ার কতাডা তোলে। বুইধবারে ফালানির চাচার কাছে কতা নিয়া যায়। বিসুদবারে কয়জন নোক নিয়া ফালানিরে দেকবার যায়। পাঁচশ টেহা য়াতে দিয়া ফালানিরে দেইহা আহে। তাগো পছন্দ অয়। শুক্কুরবারে ফালানির চাচা কয়জন নোক নিয়া শাব্দুলেগ বাইত্যে ঘর দেহুনি আহে। তাগো ঘর বর পছন্দ অয়। হুনিবার যায়, অববার যায়। এবা কইরা বাজার হদায় হেস কইরা বিসুদবারে বিয়া পড়াইয়া ফালানিরে নিয়া যায় হশুরবাড়ি। ইনু তার সবই আছে। দাদা হশুর, দাদি হউরি, হশুর, হউরি, ভাশুর, জাও, নোনাশ, নোনদ, দেওর, চাচাহশুর, চাচিহউরি, ফুবুহউরি, খালাহউরি, ভাশুরের ঘরে ভাইস্তা, ভাস্তি ইন্না বেকই আছে। ই বাড়ির বেক্কেই বালা মানুষ। খালি জাওডা একটু জাইরা গোছের। বেশী জাউরামি করলে জামাইয়ে ঢেহির ওচা দিয়া বাইরাইয়া য়ান্দন ঘরে ফালাই য়াখে। চাইর ভিটায় চাইরডা টিনের ঘর। বাইরবাড়ি আছে কাছাড়ি ঘর। হেনু ইস্টি এগানা আইলে থাকপার দেয়। একটা জাগীরও থাহে হে ঘরে। কামলা জামলা নুইলেও এই কাছাড়ি ঘরে বহে, খায় থাহে। য়ান্দন ঘর আগে ছোনের ছাউনি আছাল। অহন টিন নাগাই দিছে। অর দাদাহশুর অনেক বুড়া। মুতুল্লায় এহান দাঁতও নাই। হক্ত খাবার খাপ্পায় না। তার নিগা আটার নুটানি য়াইন্দা দিওন নাগে। হউরির য়াতের য়ান্দন বেক্কের কাছেই বালা নাগে। তার য়াতের সালুন পাসের বাড়ির মাইন্সেও চাইয়া নেয়, এবা মজা কইরা সালুন য়ান্দে। ভাহুরের ডাইবিটিস আছে। তার নিগা উটি বানান নাগে। হশুরেরও ডাইবিটিস য়োগ আছে। উনি আবার য়োটি খাপ্পায় না। খাইলে গলা জ্বলে। য়াইতে দুধ দিয়া কলা দিয়া ভাত চেইতকা খান। কবিরাজে য়োগের জইন্যে জানি তারে মুধু খাইতে কইছে। য়াতের তালুতে মধু নিয়া চাইটা খান।

ছাগল, গরু, মইশ, ভেরা, য়াস, কুরকা ইন্না বেকই আছে। পালে একটা বড় পাঠা আছে, দুইডা বড় খাসি আছে, পাঠি আছে দুইডা, ভরুইন্যা দুইডা ছাগল আছে। বিয়াইন্য ছাগলো আছে একটা। হেডার আবার তিন বাচ্চা। দুইডা মাইগ্যা বাচ্চা আর একটা মর্দা বাচ্চা। ছাগলের ওলানে বোটা মাত্র একটা। দুই বোটা তিগা যেসুম দুই বাচ্চায় দুধ খায় আরেকটায় ফাল পারতে থাহে। এই জন্যেই কেউ বঞ্চিত অইলে কয় “আমি অইলাম গিয়া ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা।” পাঠি দুইডা ভরুইন্যা সময় অইছে। বাইস্যা মাসে ভরবার পারে। বিয়াইন্যা গাই আছে দুইডা। একটার কাচিল্যা বাছুর। কাচিল্যা গাইয়ের দুধ খাওন যায় না। বাছুরের বয়েস এক মাস অইলেই কাচুইল্যা ছাইড়া যাব। হেসুম তিগা ফালানিরা ইডার দুধ পানাবার পাব। আর যে গাই কাচুইল্যা ছাইড়া গেছে হেডার দুধ পানায় ফালানির হউরি। পরতম বাছুরেরে গাইয়ের ওলান চাটতে দেয়। ওলান চাটতে চাটতে গাই চোনাইয়া দেয়। এরপরই ওলানভর্তি দুধ আহে। যেসুম বাছুরে দুধের বোটায় চোশন দেয় হেসুম হউরি বাছুরের মুখ ঝেংটা মাইরা হরাই হালায়। বাছুরের গলায় পাগা নাগাইয়া ফালানি বাছুরেরে টাইন্যা ধইরা হরাই য়াখে। ফালানি বাছুরের গতর য়াতাইয়া দেয়। বাছুরে ফালানির আচল চাবায়। উম্মুর দিয়া য়াটুর উপর দোনা য়াইখা হউরি চই চই কইরা গাই পানায়। দোনা ভইরা দুধ অয়। অব না ক্যা, গাইয়েরে ধানের কুড়া, গোমের ভুষি, পান্তা ভাত, আর কত কি খাওয়ায়। দুধ ত অবই। হেই দুধ খাইয়া হাইরাও য়াট বাজারে নিয়া বেইচা টেহা পায়। পালে একটা বড় হাড় গরু আছে। ইডারে কুরপানির নাম কইরা য়াইখা দিছে। কুরপানি দিলে মেলা গোস্ত অব। ই বাইত্যে দুইডা বল্ দও আছে। হেগ্না দিয়া আলানে পালানে চিপা চুপা দিয়ে য়াল বায়। কারন, বড় বড় ক্ষেতগুনায় য়াল বাওয়া য়য় পাওর ট্রিলার দিয়া। বহন বাছুর আছে দুইডা। বুইড়া একটা গাই আছে। হেডা বিয়ায়ও না, য়ালেও জোড়ন যায় না। ইডা কামে নাগে মলন দেওনের সুম। মলন জোরার সুম ইডা মেউয়া ইসাবে কাম করে। মলনের মইদ্যে জোড়ে বল্দগুনারে। কিনারায় জোরে বহন বাছুরগুনারের। পানাইন্যা গাই মলনে জোড়ে না।

সোংসারের কাম করনের বাবাকই আছে শাব্দুলেগ। নাঙ্গল, জোয়াল, চংগ, নাঙ্গুইলা, কোদাল, খোন্তা, ছেনি, পাচন, কাঁচি, দাও, বটি, বাগি, ইন্যা বেকই আছে। মেওপোলা মাইনষের কাম করনের সব জিনিসই আছে এগ বাইত্যে। ঢেহি আছে ধান ভানার, হাফট আছে ধান হুকাবার, কোটা আছে গাছ তিগা আম কাঠল পারবার, হলা হাছুন আছে ঘর বাড়ি হোরনের নিগা, উচি আছে ময়লা ফালাবার। ডাহি আছে ধান নেওয়ার, ঝাঞ্জইর ছাপ্নি আছে খই ভাজনের। জাতা আছে ছাতু ভাঙ্গনের নিগা। বুরকা, পাইল্যা, চাপ্নি, খোরা, হানকি, বাটি, ঘটি, নাইন্দা, কোলা, জালা, ডোল, বেড়, চালা, ডালা, ঝান্না ইন্না বেকই আছে। তাগ টিনের থালিও আছে, আবার করইর থালিও আছে। জামাই জোড়া, ইস্টি এগানাই আইলে করইর থালিতে খাবার দেয়। ট্রাংগ সুটেসও আছে। ধরতে গেলে ফালানির বালা বাড়িতেই বিয়া অইছে।

পালানের ক্ষতের ধাইরায় নাউ, কুমরা, হশা, ঝিংগা, পোড়ল, শিমইর, শীবচরণ এইন্যা আরজিছে ফালানির হউরি। ইন্যার জইন্যে বাশ দিয়া জাঙলা বানাই দিছে। হেইন্যা মইদ্যে ঝলমি ঝলমি তরিতরকারি ধরে। বাপের বাড়ির নিগা ফালানির পরাণ পোড়ে। তাই জাংলা তলে খারইয়া পুম্মুহি চাইয়া থাহে। বুক ভাইঙা কান্দন আহে তার।

ফালানির জামাইর ফেলাইট ছাড়নের তারিখ ঠিক অইছে। বিমান বন্দর পর্যন্ত তার নগে ক্যারা ক্যারা যাবো হেডা ঠিক অইল। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করলো। মাও বাপেরে হেলাম কইরা শাব্দুল গাড়িতে উঠলো। গাড়িতে শাব্দুলের নগে উঠলেন এলাহি মেম্বর সাব, ফালানির ভাহুর, আর ফালানি। বিমান বন্দরে যাওনের পর পেঁচ মাইরা দালালে আরও ১০ য়াজার টেহা চাইয়া বইল। কয় যে কুনু কুনু জানি দেওন নাগব। অহন টেহা পাব কুনু? বিমান ছাইড়া দেওনের সোময়ও অইয়া গেল গা। হারাহারি কইরা মোবাইল কইরা বিকাশ কইরা দশ য়াজার টেহা আইন্যা দালালের য়াতে দেয়। শাব্দুল বিমানের সীটে গিয়া বহে। একসুম বিমান ছাইড়া দিল। শো শো শব্দ কইরা আসমানের দিকে উঠতে নইল। ফালানি বিমানের দিকে ফ্যাল ফ্যাল কইরা চাইয়া রইল। একসুম পচিম দিকের আসমানের দেওয়ার হাজের বিতর বিমানডা য়ারাইয়া গেল গা।

১০/৫/২০২১ খ্রি.

লেখকের কথাঃ

মাতৃভাষায় কথা বলতে ও শুনতে সবাই ভালো বাসে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের অনেকেই মায়ের ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। অনেকেরই নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা আছে। তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আমার বাড়ি টাঙ্গাইল। আমার এলাকায়ও নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা আছে। সেই ভাষাটাকে আপনাদের মাঝে তুলে ধরার জন্য ফালানির গল্পের ছলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের গ্রাম বাংলার জিনিসপত্রের আঞ্চলিক নামের সাথে পরিচয় করার প্রয়াস করেছি এই গল্পে। গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফালানি ও শাব্দুল নামের দুটি কাল্পনিক চরিত্রে তাদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাটা সামান্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কাউকে দোষারোপ করার উদ্দেশ্য আমার ছিল না।

ফালানির নোনাশের জামাই

ফালানির নোনাশের জামাই একটু ভেবলা কিছিমের। কয় বছর ধইরা বিয়া করছে এহনো কোন পোলাহান ছোলাপান অয় নাই। বাপ মাও মইরা গেছে গা। দুইডা গরু আছে য়াল বাওনের। হেন্নারে পালতে অয় অর নোনাশেরই। খের কাইটা কুরার নগে মিশাইয়া চারিত দিয়া খাওয়ায়। নগে এক মোট নুনও মিশাই দেয়। অর নোনাশের জামাইই গরুগুনারে বাছ্রা ক্ষেতে নিয়া হাচার দেয়। গরুগুনা বালাই আছে, গামচাইয়া ঘাস খায়। টাইক ধইরা পানি খায়। নোনাশের জামাইরে হশুর বাড়িত নিতার দাওত দিলে নোনাশেরে নিয়া ত আহেই, নগে গরু দুইডারেও নিয়াহে। হেন্নারে ফালানিগ গরুর নগেই বাইন্দা থয়। অগ গরুয়ে হেগ গরুরে দেকবার পায় না। হিং দিয়া খালি গুতায়। ইন্না এহেবারে যাইরা গরু। নিতা খাবার আইয়া এক হপ্তা ভইরা তাহে। নোনাশে বাপের বাড়ি আইয়া একটা কামেও য়াত দেয় না। বইয়া বইয়া খালি ফালানির ছক্কল ধরে। আর ইডা ওডা কয়। ফালানি য়াও করে না। ফালানি মনে মনে কয় “নোনাশডা পাজি অইলেও বাপের বাড়ি আইয়া থাকপার চায় থাকুক। তার জামাইডারে নিয়া এত দিন থাহে ক্যা? জামাই খাওনের সুম একবার ইডা চায়, একবার ওডা চায়। একবার কয় কাচা মইচ দেও। একবার কয় পিয়াইচ কাইটা দেও। থাহুক মরারডা। ওডার গরুগুনা কিয়েরে নিয়ায়?”

২৭/৫/২০২১

ফালানির ঘাউড়া চাচা হশুর

ফালানির চাচা হশুরের একজোন বছরকারী কামলা আছে। কামে কাইজে বালাই। হেদিন য়াল বাওনের সুম নাংলের ফালাডা ভাইংগা ফালায়। দেহা অইলে তারে হইচ করে

– তুই নাংগল ভাংলি কিবায় রে?

– চাচা, উত্তর মুরার ক্ষেতে য়াল জুরছিলাম। দুই ঘুরানি দেওনের পরে একটা গাছের হিকরে বাইজা নাংগলডা ভাইংগা গেল গা।

– হে ডা ত বুজলাম। তুই নাংগল বাংলি কিবা কইরা হেইডা বালা কইরা ক?

– হেইডাই ত কইলাম। য়াল জোরার পাজুন দিয়া দুই বলদরে দুইডা বারি মারলাম। দুই ঘুরানির পরই মাটির নিচের একটা হক্ত হিকরের নগে বাইজা নাংগলডা ভাইংগা গেল গা।

– আরে বাইরা বেটা, নাংগল ভাংলি কিবা কইরা হেইডা ভাইংগা ক?

– য়াল জুইরা কুটি হক্ত কইরা ধইরা আছিলাম। ক্ষেতের মইদ্যে দুই ঘুরানি দেওনের সুম হিকরের নগে বাইজা টাস কইরা নাংগল্ডা বাইংগা গেল গা। মটকা কাঠের নাংগল মোনয়।

– আরে গাবর, নাংগল কিবা কইরা ভাংলি হেইডা ক।

এবা কইরা যতই বুঝায় ফালানির চাচাহশুর খালি হইচ করে লাংগল ভাংল কিবায়। কামলায় দেখল ইডা ত বালা ঠেটা মানু রে! ইডারে বালা একটা শিক্ষা দিওন নাগব।

কামলাডায় কয়দিন পারে দুপুরে খওনের সুম একটা ডাংগর মেয়ায় তারে খাওন বাইরা দিছাল। খাইয়া হাইরা বাইর বাড়ি গিয়া ফালানির চাচা হশুরের নগে দেহা য়য়। কামলায় হইচ করে

– চাচা, আইচকা দুপুর সুম আমারে যে মাইয়াডায় বাইরা দিছাল হেডা ক্যারা?

– আরে ছেরা, তুই অরে চিনস নাই। ওডা আংগ ছোট গেদি জয়গন।

– তাত চিনলাম। অইজে যে ছেরিডায় আমারে ভাত বাইরা দিল হেডারে ত চিনলাম না?

– আরে বাইরা বেটা, ওইডাই ত আংগ জয়গন। বেহের ছোট। আইজকা শাড়ী পিনছে। হেই জিন্তেই তুই চিনবার পারস নাই।

– আরে চাচা, আমি ত হেইডাই জানবার চাইতাছি ঐ মাইয়াডা ক্যারা?

এমুন্সুম জয়গন আইয়া কইল “এই যে আন্নেরা যে এনু মিটাই মিটাই কতা কইতাছুইন, উম্মুরা দিয়া গরু ছুইটা পাহা ধানের হিঞ্জা গুনা আমচাইয়া খাইহালাইতাছে। হেইডা দেহুইন গা।

১/৭/২০২১

ফালানির চাচি হউরিডা এহেবারে কিরপিন। মাছ পইচ্যা যুদি বগবগা কুইয়া অইয়া গোন্দ উইঠাও যায় তাইলেও ফালব না। আন্দন ঘরের পাছ তনে গুলাইলের পাতা তুইলা হেগনার নগে নাড়াচারি কইরা খায়। পেট পরিস্কার য়াখনের নিগা গোন্দ বাদাইলের পাতা ভাইজা খায়।

Salah Uddin

Mawlana Salah Uddin

মাওলানা সালাউদ্দিন

Maolana Salah Uddin

মাওলানা সালাউদ্দিন ছিলেন আমার চাচাতো বোন হেলেনা আপার স্বামী। আরবী লাইনে লেখাপড়া করলেও তিনি বেশ বিজ্ঞান মনস্ক ও সাংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু পরিবারকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তিনি বিয়ের পর জমি জমা কিনে আমাদের গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি নিকাহ রেজিস্ট্রার করতেন। তিনি কাকরাজান ইউনিয়নের বিবাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। বিবাহ রেজিস্ট্রি করাকে ইসলামি পরিভাষায় কাবিননামা বলা হয়। আমরা সংক্ষেপে কাবিন বলতাম। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কাবিন করলে দুলাইভাই বেশী ফি নিতেন। তাই, অনেকেই দুলাভাইর বাড়িতে এসে কাবিন করাতেন। যিনি কাবিন রেজিস্ট্রি করতেন তাকে বলা হয় কাজী। তাই দুলাভাইকে কাজীও বলা হতো। দুলাভাই মারা যাবার পর তার মেজো ছেলে কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পায় এবং কাজীর কাজটাও পায়। এখন তার কাছে কাজীর কাজটা নেই। দুলাভাইর ছোট ছেলে রুহুল আমীনও ঘোনারচালা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। বড় ছেলে আব্দুল হালিম প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করে।

আমি ছোটবেলা থেকেই দেখতাম দুলাভাই কাবিন করেন। তিনি কচুয়া আব্দুল্লাহ স্যারদের বাড়ির জামে মসজিদের শুক্রবার জুম্মায় ইমামতিও করতেন। দুলাভাইর সাথে আমি দু-এক বাড়িতে কাবিন করতেও গিয়েছি। ভালো খাবারও খেয়েছি।

শীতের দিনে তিনি বাহিরবাড়ির ধানিখোলায় খর বিছিয়ে তার তার উপর পিঠের বেতের পাটি বিছিয়ে কাবিন করতে বসতেন। বর ও কনে উভয় পক্ষই আসতেন। তারাও পাটির উপর বসতেন। গ্রামের মানুষ তামাসা দেখতে ভালোবাসে। তাই, যেখানে কয়েকজন লোক একত্র বসত সেখানেই গিয়ে সবাই ভীর করতো। কোথাও দুইপক্ষ ঝগড়া বাঁধালেও সবাই তামসা দেখতে যেতো। একবার গোড়াই থেকে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে, বয়স খুব সম্ভব ১৬-১৭ হবে, হাত ধরে ঘুরাফিরা করছিল কচুয়া হাটের রাস্তায়। শুনলাম তারা একে অপরকে ভালোবেসে, বাবা-মার অমতে বিয়ে করার উদ্যেশে বের হয়ে পড়েছে। লোকে বলত বাইরইয়া পড়ছে। কাজেই তাদেরকে ভিন গ্রামের মানুষ ধরে বিয়ে পড়িয়ে দিত। এই জুটির পিছনে প্রায় ৫০-৬০ জন ছেলে মেয়ে তামসা দেখছিল। আমিও কিছুক্ষণ তামসা দেখলাম।

একবার পশ্চিম দিক থেকে কয়েকজন লোক এসেছিল দুলাভাইর কাছে কাবিন করতে। তাদের বেশভূষা দেখে গরীব মনে হলো। কনেটাকে আমার কাছে অসহায় মনে হলো। বর পক্ষের লোকগুলোকে তেমন সভ্য মনে হলো না। দুলাভাই কাবিন রেজিস্ট্রার খাতায় লিখার পর সরকারি ফি নিয়ে নিলেন। তারপর কনের উদ্দেশ্যে বললেন “অমুকের ছেলে তমুক এত টাকার দেন মোহর সাব্যস্ত করিয়া আপনাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়াছে। আপনি রাজি আছেন?” কনে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কিছুই বললো না। দুলাভাই দ্বিতীয় বার ওকথাগুলো বললেন। কনে অনেকক্ষণ চুপ করেই রইলো ঘোমটা দিয়ে। তৃতীয় বার দুলাভাই বিরক্তির সাথে কথাগুলো বলে ধমকের সুরে উচ্চকণ্ঠে বললেন “রাজি আছেন?” কনে বিস্ফোরিত কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলে উঠল “রাজি আছি।” আমি চমকে গিয়ে খেরের উপর ঢলে পড়লাম। কনে ফিকুরে ফিকুরে কান্না করতে লাগলো। আমি তখন ক্লাস সেভেন না এইটে পড়ি। আমার মনে হলো এটা ঠিক না। জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। দুলাভাই কিছুক্ষণ মেয়েটির কান্না শুনলেন। আমি দুলাভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুলাভাই চুপ করে রইলেন। দুলাভাই বললেন “এ বিয়ে হবে না।” বরপক্ষ বললেন “কনে রাজি আছে বলছে। বিয়ে হয়ে গেছে।” দুলাভাই বললেন “না, হবে না। সমস্যা আছে। কাবিন বাতিল।” মেয়েটি আরও পরিস্কার করে কান্না করতে লাগলো। অনেক কথাকাটাকাটির বরপক্ষ কাবিনের ফি ফেরত চাইল। দুলাভাই বললেন “কাবিনের পাতা খরচ হয়ে গেছে। আমি বই হিসাবে কিনে আনি। ফেরত পাবেন না। আপনাদের বিচার হবে। আপনারা জোর করে মেয়ে বিয়ে করতে নিয়ে এসেছেন। মেয়ে রাজি না। আমার ধমক শুনে রাজি বলেছে। মেম্বার ও পাড়ার মাদবর নিয়ে আসুন। তারপর কাগজ দেয়া হবে।” পরে কি হয়েছিল আমি জানি না।

কাবিননামা শেষ হলে বরের হাতের উপর কনের বাবার হাত রেখে দুলাভাই পাঠ করাতেন কনের বাবাকে “বলুন, আমার কন্যা, মুসাম্মত অমুক খাতুনকে এত টাকা দেন মোহরে আপনার কাছে বিবাহ দিলাম।” দুলাভাই বরকে বলতে বলতেন “আপনি বুলুন, কবুল, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করিলাম।” বর বলতেন “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করিলাম।” দুলাভাই বরের উদ্যেশ্যে বলতেন “আপনার বিবিকে ভরনপোষণ দিবেন, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী চলাফেরা করাবেন এবং পর্দা পুশিদায় রাখবেন। তিন মাসের অধিক কাল নিরুদ্দেশ থাকিলে, পাগল কিংবা কারাগারাবদ্ধ হইলে বিবি আপনাকে তালাক দিতে পারিবেন। খাতা বন্ধ করলে বরপক্ষ সবাইকে খাজা বাতাসা ও কদমা খাওয়াইত। আমার কাছে সাদা কদমা খুব মজা লাগতো।

আমাদের গ্রামে একজন গরীব লোক ছিল। নিজের জমি ছিলো না। খুব আলসে ছিল। বোকাও ছিল। তার নাম লিখলাম না। ছদ্মনাম দিলাম হামজা। হামজা ভাই মাঝে মাঝে বোকার মতো কথা বলতেন। কেউ বোকার মতো কথা বললে আমরা বলতাম ” তুই অবা হামজা ভাইর নাগাল কথা কস ক্যা?” চৈত্র মাসে অথবা যে মাসে কোন কাজ থাকত না সেই মাসে হামজা ভাই খাবেন কী। কামলা দিলে যা টাকা পাওয়া যেতো সেই টাকা দিয়ে হামজা ভাই চাউল ও আটা কিনে খেতেন। মানে, দিন এনে দিন খেতেন। একদিন কামলা না দিলে না খেয়ে থাকতে হতো তার স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ। হামজা ভাইর বউ পরের ধান ভেনে অল্প কিছু চাউল পেতেন। আঁচলে করে আনতেন। শরীর খুব দুর্বল ছিল অল্প খেয়ে খেয়ে। তাই, ঢেকিতেও তেমন বল করে পার দিতে পারতেন না। যেদিন কামলা দিতে না পারতেন সেদিন হামজা ধনি বাড়ি থেকে এক কামলার দাম নিতেন। সেই টাকায় কাজের সময় তিনি কামলা দিয়ে পরিশোধ করতেন। মৌসুমের সময় কামলার দাম দুইগুন তিনগুন হলেও তিনি তা নিতে পারতেন না। যেহেতু তিনি অগ্রিম টাকা নিয়ে নিয়েছেন। অগ্রিম টাকা নিয়ে মৌসুমের সময় কামলা দিলে তাকে বলা হয় ঠুকা কামলা। হামজা ভাই ছোটদের মতো সামনে ভাজ করে লুঙ্গি পরতেন। তাই, আরও বোধাই বোধাই দেখা যেতো। কম বয়সেই তিনজন সন্তান রেখে হামজা ভাইর স্ত্রী মারা যান।

গ্রামে গরীব পরিবার স্ত্রী ছাড়া চলতে পারে না। তাই, হামজা ভাই আরেকটি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বিয়ের কাবিনের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। হামজা ভাই কিস্তিটুপি পাতালি করে পরেছিলেন। তাতে আরও বোধাই বোধাই লাগছিলো। যথারীতি কাবিন সম্পাদন করে হামজা ভাইর হাত ধরলেন তার শশুর। কাজী বলতে বললেন “বলুন, আমার কন্যা।” হামজা ভাইর শশুরে বলার কথা। ভুলক্রমে হামজা ভাই বলে ফেললেন “আমার কন্যা।” দুলাভাই ধমক দিয়ে বললেন “এই বোধাই, কারে কী কয়।” আমি ও মজি ভাই হাসতে হাসতে খেরের উপর লুটিয়ে পড়লাম।

২২/৪/২০২২ খ্রি.
ময়মনসিংহ