Tag Archives: স্মৃতি কথা

Machhere

মাছেরে

(টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক মাতৃভাষায় লেখা স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

গ্রামে আমরা কেউ ঘাস কাটতে গেলে তারে কইতাম ঘাসেরে গেছে। আর কেউ মাছ ধরতে গেলে কইতাম মাছেরে গেছে। চেংরাকালে আমি মাছেরে গেতাম। আংগ বাড়ি সখিপুরের পাহার অঞ্চলে। উনা মাসে পাহারে পানি থাকত না। তাই মাছও পাও যাইত না। ভর অঞ্চলে হারা বোছরই পানি থাকত। মাছও মারন গেত হারা বোছর। উনা মাসে পাহাইরারা য়াটে তিগা মাছ কিন্যা আইন্যা খাইত। ১৫/২০ মাইল দূরে তনে মাঝিরা মাছ কান্দে কইরা নিয়া আইত পাহারে য়াটের দিন অইলে। এতদুর আনতে আনতে মাছ কুইয়া বকবকা অইয়া গোন্দ উইঠা যাইত। হেইন্যা ফালাই দিয়ন নাগত। তাই উনা মাসে জিওল মাছ, মাগুর মাছ, কই মাছ, ছাইতান মাছ, টেংরা, বাতাসি, গুইটা বাজাইল ছাড়া আর কিছু পাও গেত না। পাহাইরা মাইনষে জিওল মাছ, মাগুর মাছ, কই মাছ, ছাইতান মাছ বুরকা- পাইল্যায় পানি দিয়া জিয়াইয়া য়াকত। কয়দিন ভইরা য়াইন্দা খাইত। পঁচা মাছ গুলাইনের পাতা দিয়া য়াইন্দা খাইলে গোন্দ করতো না। ইন্যা খাইয়া পেট ভাটভুট করলে গোন্দবাদাইলের পাতা দিয়া হাক য়াইন্দা খাইত। বাইস্যা মাসে পাহারের ধাইরা দিয়া য়াট বইত। হেনু ভৌরারা নানান জাতের মাছ নিয়াইত বেচপার নিগা। বেশিরভাগই ছিল নোরাফেকা মাছ। পদ্মা নদীর ইলসা মাছও এই সব য়াটে নিয়াইত নাইয়ারা।

আমি যেবা কইরা মাছ মারতাম হেইন্যা হুইন্যা আন্নের মোনয়ব আমি বোধকরি বালা ছাত্র আছিলাম না। আমি খুব বালা ছাত্র আছিলাম। হেসুমকার দিনে বাটাজোর বি এম হাই স্কুল অত্র অঞ্চলের মদ্যে সব তিগা বালা স্কুল আছাল। হেই স্কুল তিগা এস এস সি পাস করছি য়েকর্ড ভাইঙ্গা, মানে আগে যারা পাস করছাল তাগ চাইতে বেশি নম্বর পাইছিলাম, জামাল স্যার কইছেন। এহন পর্যায়ের নিহি কেউ আমার নাগালা বালা এজাল্ট করপায় নাই।

আমি স্কুল তিগা আইয়া চাইরডা খাইয়া মাছেরে গেতাম। পুশ মাস তিগা জৈস্টি মাস পর্যন্ত পাহারে পানি থাকত না। তাই মাছেরে যামু কুনু? পাহারে পানি আইলে পানির নগে মাছ আইত। মাছ আইলে মাছেরে গেতাম। জৈস্টি মাসের হেষের দিকে যেদিন বেশি বিস্টি অইত হেদিন চালার বেবাক পানি ঘোনা ঘুনিতে নাইমা বাইদ ভইরা গেত। বাইদের পানিতে জোরা ভইরা গেত। জোরা অইল বাইদের মইদ দিয়া চিকন খালের নাগালা। জোরার পানি গিয়া নামত চাপরাবিলে। চাপরা বিল পানি দিয়া ভইরা গেত। চাপরা বিল উনা মাসেও হুকাইত না। হেনুকার মাছ বেশি পানি পাইয়া উজাইতে উজাইতে আংগ বাইদে আইয়া পড়ত আন্ডা পারনের নিগা। চলাচলা পুটি, হেলাম পুটি, টেংরা, গোলসা, নোন্দা, হৈল, বোয়াল, পাত্যা, ছাইতান, আগ্যা, ইচা, নোন্দা, বাইং, এবা নানান জাতের মাছ পেট ভর্তি আন্ডা নই আইত পাহাইরা হোতের মইদ্যে আন্ডা পারনের নিগা। আমরা বিস্টিত ভিজা, ছাতি মাথায় দিয়া, কলাপাতা পাথায় দিয়া, নয় মাতইল মাথায় দিয়া মাছেরে গেতাম। ক্ষেতের বাতর যেনু পানি যাওনের নিগা কাইটা দিত হেডা কইত জোর। আমরা জোরের হোতের পানিতে জালি পাইত্যা খারই থাকতাম। পানির নিচে জালির নগে ঠ্যাং ঠেহাই য়াকতাম। জালিতে মাছ ঢুইকা যেসুম ঠ্যাংগের মদ্যে গুতা মারত হেসুম জালি উচা করতাম। জালি তিগা মাছ ধইরা খালুইর মদে য়াকতাম। খালুই ভইরা যাইত মাছে। হেই মাছের পেট বোজাই আন্ডা থাকত। হেই জোরের মইদ্যে য়াইতে ঠুই পাইত্যা য়াকতাম। সক্কালে বেলা ওঠনের সোম গিয়া ঠুই চাইতাম। ঠুইয়ের আগায় হেই মাছগুনা বাইজা থাকত। ক্ষেতের বাতরে ঠুই উল্টাইয়া মাছ বাইর করতাম। খালুই ভইরা যাইত। মাছের নগে চেকমেকা, কাকরা, কুইচ্যা, টেপা, হামুক, ইন্যাও বাজত। ইন্যা বাইচ্যা পানিত ঢেইল মাইরা ফালাই দিতাম। জৈস্টি মাসে জাংলাভর্তি জিংগা, পোড়ল অইত। বাড়ির পালানে ডাংগা অইত নশনশা। মা হেইন্যা দিয়া মাছ য়ান্না করতেন। ঢলের মাছ নতুন তরিতরকারি দিয়া এবা মজাই যে নাগ ত গো, খাইয়া পেট ডিগ ডিগ করত।

আষাঢ়, শাওন, ভাদ্দর মাসে খালি বিস্টি অইত। বাইদ বোজাই পানি থাকত। পাহারের পাগার, পুস্কুনি, কুয়া, জোরা পানিতে ভইরা থাকত। এইসুম মাছগুনা বাইদে ছড়াই ছিটাই থাকত। আর মাছের পোনা গুনা বড় অইতে থাকত। হেসুম খালি ঠুই পাইত্যা মাছ ধরতাম। ভাদ্দর মাসের হেষের দিকে যখন বিস্টি কইমা যাইত হেসুম বাইদের জমিতে আমন ধানের গোছা নাগাইত। আর আগে এই জমিগুনাতে ছিল আউশ ধান। বেশি ভাগই ছিল ভাতুরি ধান। ভাতুরি ধান কাটার পর ক্ষেতে য়াল বাইয়া কেঁদা বানাইহালত। ধানের গোছা দেওনের আগে মই দিয়া ক্ষেত হোমান করন নাগত। কেঁদা ক্ষেতে মই দেওনের সূম চংগের পাছের পানি হইরা গিয়া মাছ বাইরইয়া দাফ্রাইতে থাকত। এইন্যা ধইরা ধইরা আমরা খালই বোজাই করতাম। কোমরের পিছনে খালই ঝুলাইয়া বাইন্ধা নিতাম। দুই য়াত দিয়া ধরতাম, আর খালই মইদ্যে য়াকতাম। কই মাছ গুনা কেঁদার উপর কাতাইতে থাকত। কি মজাই যে নাগত! আমি, মজি ভাই, জিন্না ভাই, সিদ্দি ভাই, এবা অনেকেই দল ধইরা হেইন্যা ধরতাম। মজি ভাই মইরা গেছে গাড়ি এক্সিডেন্ট কইরা। পাহাইরা বাইদের মাটি খুব সারিল মাটি। কয়দিনেই ধানের গোছা মোটা য়ই গেত। ক্ষেতে হেসুম টলটলা পানি থাকত। হেই পানি দিয়া নানান জাতের মাছ দৌড়াদৌড়ি করত। দেহা গেত। আমরা ক্ষেতের বাতর কাইটা জোর বানাইয়া হেনু বাইনাতি পাইত্যা য়াকতাম। বাইনাতি বাঁশের বেতি দিয়া বুনাইয়া বানান নাগত। বাইনাতির সামন দিয়া ভাটার মাছ ঢোকার পথ আছে, আবার পিছন দিক দিয়া উজাইন্যা মাছ ঢোকার পথ আছে। মাছ ঢোকপার পায়, বাইরবার পায় না। দিনাপত্তি সকালে বাইনাতি চাওয়া য়ইত। বাইনাতি পাতার সুম মুখ কাঠের, নইলে বাঁশের কচি দিয়া বন্ধ কইরা দেও য়ইত। হেইডা খুইলা মাছ খালইর মদ্যে ঢাইল্যা দেও য়ইত। বেশি ভাগ বাইনাতিত গুত্তুম আর দারকিনা মাছ বাজত। ইন্যা পিয়াজ কাঁচা, মইচ, হৌষার তেল দিয়া ভাজা ভাজা কইরা খাইলে কিবা মজাই যে নাগত গ! যেনুকার বাতর মোটা আছাল, হেনুকার বাতর ভাঙ্গাও বড় বড় আছাল। হেনু বাইনাতি না পাইত্যা বড় বড় দোয়ারি পাতন নাগত। দোয়ারি বাইনাতির নাগালা দুইমুরা চোক্কা না। দোয়ারি অইল বাসকর মোত। ইন্যাও বাঁশের হলা দিয়া বুনাইয়া বানায়।

আশ্বিন মাসে বেশি বিস্টি অইত না। ধানের গোছাগুনাও মোটা মোটা অইত। হেইন্যার ভিতর দিয়া মাছ কপ কপ করত। য়ইদের তাপে ক্ষেতের পানি ততা অই গেত। মাছগুনা যেম্মুরা গাছের ছেওয়া পড়ত হেম্মুরা আই পড়ত। আমরা স্কুল তিগা আইয়া বশ্যি নিয়া মাছেরে গেতাম। বশ্যির আধার গাত্তাম খই, কুত্তাডেউয়ার আন্ডা, নয় চেরা দিয়া। চেরাগুনারে জির কিরমিরমির নাগালা দেহা গেত। উন্যারে গাছতলের ভিজা মাটি তিগা কোদাল দিয়া কোবাইয়া বাইর কইরা ছেনি দিয়া টুকরা টুকরা কইরা কাইট্যা নিতাম। বড় বড় পিপড়াগুনারে আমরা ডেউয়া কইতাম। কুত্তার মোত অইলদা য়োংগের ডেউয়ারে কইতাম কুত্তাডেউয়া। গজারি গাছের আগায় পাতা পেঁচাইয়া কুত্তাডেউয়ায় বাহা বানাইয়া আন্ডা পারত। হেই আন্ডা দিয়া বশ্যি হালাইলে বেশি মাছ ধরত। তরুই বাঁশ দিয়া বশ্যির ছিপ বানাইতাম। না পাইলে বৌরাবাঁশের কুইঞ্চা দিয়া ছিপ বানাইতাম। খালই বুনাইতাম তল্যা বাসের বেতি দিয়া। গোছা ক্ষেতে বশ্যি ফালাইলে বড় বড় আগ্যা মাছ ধরত। পানির মদ্যে বশ্যি নাচাইলে আগ্যা মাছ ফালাই ফালাই আইয়া বশ্যির আইংটায় বাইজা পড়ত। খোট্টা দিয়া টানে তুইল্যা হালাইতাম। কোন কোনডা ছুইট্টা গিয়া আড়া জোংগলে গিয়া পইরা হাটি পারতে থাকত। পাতা খুচখুচানির শব্দ হুইন্যা আগ্যা মাছের ঘারে ধইরা খালইর মইধ্যে ভইরা ফালাইতাম। মাছ যাতে তাজাতুজা থাহে হেইজন্য জগের মইদ্যে নয় বদনার মইদ্যে পানি দিয়া জিয়াই য়াকতাম। আগ্যা মাছ জাইরা আছে৷ বদনায় য়াকলে আগ্যা মাছ হাটি মাইরা বাইরই গেত দেইখা হিসার জগে য়াকতাম। শিক্ষিত মাইন্সে আগ্যা মাছরে রাগা মাছ কইত ফ্যারাংগি দেহাইয়া। ভৌরা মাইনষে আগ্যা মাছ খাইত না। তারা গুত্তুম মাছও খাইত না। বংশি-মান্দাইরা চুইচ্চা খাইত। তারা কাছিমও খাইত। কাছিম জোংগলেও থাকত। ইন্যা খুব বড় বড় ছিল। ইন্যারে কইত দুরা।

বাইদের পানির টান পরলে মাছগুনা পাগার, জোরায় গিয়া জরা অইত। আমরা হেইন্যারে খুইয়া, জালি, জাহি জাল, নয় ছিপজাল দিয়া মাইরা খাইতাম। বিষগোটা ছেইচ্ছা পাগারে ছিটাই দিলে মাছ গাবাই উঠতো। গাবাইন্যা মাছ ধইরা আরাম পায়ন গেত। পাগারের মাছ, জোরার মাছ ইন্যা পালা মাছ আছাল না। তাই যে কেউ ইন্যা মারতে পারত। আমরা চন্দের জোরা, আলম ঠাকুরের জোরা, ওহা বেপারির জোরা, খাজাগ জোরা, নাটুগ পাগার, কলুমুদ্দি তাওইগ পাগার তিগা ভরা মাছ মারছি। ঘাট চওনার জোরায় তনে ভরা ইচা মাছ মারছি খুইয়া দিয়া দোয়াইয়া। এনুকার পানি কইমা গেলে কেঁদার নিচে বাইং মাছ বই থাকত। কেঁদা পারাইলে পায়ের নিচে পিচলা নাগত বাইং মাছ। পায়ের নিচ দিয়া য়াত দিয়া কেঁদা হুইদ্যা বাইং মাছ টানে মেইল্যা মারতাম। য়াত দিয়া ধরতে গেলে বাইং মাছ পিচিল্যা যায় গা। একবার করছিলাম কি, এবা কইরা এডা মাছ কেদাসুদ্যা মেইল্যা মারছি, হেডা গিয়া পড়ল এডা ঝোপের ভিত্তরে। আমি ঝোপের ভিতর ফুস্কি দিয়া দেহি মেলা মাইনষের কংকাল, এহেবারে ঠেংগি দিয়া য়াকছে। ডরের চোটে তাত্তারি মাছ মারন বাদ দিয়া বাইত আই পরছি। য়াইতে হুইয়া হুইয়া বাবার নগে হেই কতা কইছি। বাবা কইল যে বংশি – মান্দাইরা কলেরা-বসন্ত হইয়া বেশি মানুষ মইরা গেলে চিতায় না পুইরা এবা ঝোপের মইদ্যে পালা দিয়া য়াকত। হেইন্যা মোনয় হুকাইয়া কংকাল অইছে।

কাতিমাসে বেশি মাছ মারন গেত। বাইদের ছোট ছোট গাতায় ভরা মাছ থাকত। টিনের থালি দিয়া হেই পানি হিচ্চা মাছ ধরতাম। এলকা পানি হিস্তে কষ্ট অইত। হেইজন্যে হাজা ধইরা হিচা মাছেরে গেতাম। পানি হিচা যে যেডি ধরাহারি হেডি ধইরা নিয়াইতাম। শাজাহান ঠিকমোত চোহে দেকত না। কেঁদার মইদ্যে খালি আতাপাতা করত। এই জন্যে যদি কইতাম “শাজাহান, হিচা মাছেরে যাবি নিহি?” শাজাহান কইত “ভাগে নিলে যামু।” আমি যে বোছর সেভেনে পড়ি, হেই ১৯৭৩ সোনে, হে ট্রাক্টরের চাকার নিচে পইরা মইরা গেছে। অহনো তার নিগা আমার পরণ পোড়ে। কেঁদার মইদ্যে মাছ ধরতে গেলে শইলে কেদা নাগত। যতই বালা কইরা গোসল করতাম কানের নতির পাছে কেদা নাইগাই থাকত ধলা অইয়া। খাবার বইলে পড়ে মা হেই কেঁদা আচল দিয়া মুইছা দিত।

কাতিমাসে পাহারের পানি হুকাই গেলে সব মাছ গিয়া চাপরাবিলে জরা অইত। মাছে বিল কপকপ করত। হুনিবার মোংগলবারে চাপরাবিলে মাছ মারনের নিগা মানুষ পিল্টা পরত। হেইডারে কইত বাওয়ার মাছ। বেশি মানুষ একবারে পানিত নামলে মাছ গাবাই উঠতো। তাই ধরাও পড়ত বেশি বেশি। এই জন্য সবাই বিলে মাছেরে যাওনের নিগা ডাহাডাহি পারত। অনেকে পরভাইত তিগাই শিংগা ফুয়াইত। শিংগার ফু হুইন্যা পাহাইরা মানুষ গুনা যার কাছে যেডা আছে হেডা নিয়া ভাইংগা চুইরা আইত চাপরা বিলে। এক নগে জাহইর দিয়া বিলে নামত নানান ধরনের জিনিস নিয়া। হেন্যা অইল মোন করুন চাবি, পলো, টেপারি, ফস্কা, কোচ, খুইয়া, জালি, ছিপজাল, ঝাকিজাল, চাকজাল আরও কত কী! ইলশা মাছ ছাড়া আর যত ধরনের মাছ আছে সব পাও গেত এই বিলে। খালইর চাইরমুরা পাটখরির মোঠা বাইন্দা দিত যাতে খালই পানিত ভাইসা থাহে। বড় বড় খালই ভইরা মাছ আইন্যা উঠানে ঢাইল্যা দিত। মেওপোলা মাইনষে হেইন্যা দাও বটি দিয়া কুইটা পাট খরিতে গাইতা দড়ি দিয়া ঝুলাইয়া অইদে হুকাইয়া হুটকি কইরা য়াকত নাইন্দার মইদ্যে। খাইত কয় মাস ধইরা। চাপরা বিলের আশে পাশের পাহাইরা গ্রামের মানুষ তিগা নিয়া হেম্মুরা হেই আংগারগাড়া পর্যন্ত মানুষ চাপরা বিলের মাছ মারতে আইত। হেই গেরামের নামগুনা আমি কইতাছি হুনুন – গবরচাহা, বৈলারপুর, য়ামুদপুর, বাঘেরবাড়ি, বেড়িখোলা, আন্দি, হুরিরচালা, চেল ধারা, নাইন্দা ভাংগা, গড়বাড়ি, বুড়িচালা, ইন্দাজানি, কাজিরামপুর, আদানি, ভাতগড়া,, ভুয়াইদ, পোড়াবাহা, ছিরিপুর, খুইংগারচালা, চটানপাড়া, ছোট চওনা, বড় চওনা, ঢনডইনা, হারাইসা, বাহার চালা, কাইলা, কৌচা, আড়াই পাড়া, ধলি, জামাল আটখুরা, দাইমা, ডাকাইতা, আরও ভরা গেরাম যেগ্নার কতা অহন মোনাইতাছে না। আমি হুনছি ভৌরারা চাপরা বিলে মাছেরে আইত না। আব ক্যা, তাগ কি মাছের অভাব আছে?

আংগ খালাগ বাড়ি মাইজ বাড়ি, আর বুগ বাড়ি অইল আমজানি। দুইডাই গাংগের পারে। বংশি নদীডারে আমরা গাং কই। আপারে আমরা বু ডাকতাম। জৈস্টি মাসের হেষের দিকে গাং পানিতে ভইরা যাইত। আমি বুগ বাইত গেলে, খালাগ বাইত গেলে বশ্যি নইয়া গাংগে মাছেরে গেতাম। আমজানির এবাদত ভাই, য়শি ভাই, হায়দার ভাই, আর মাইজ বাড়ির ইয়াছিন, ইসমাইল ভাইর নগে বশ্যি বাইতাম। ইয়াসিন ক্যান্সার অইয়া মইরা গেছে। তার নিগাও পরণ পোড়ে। আমার খালাত ভাই। বড় বড় নাইয়া বাইং, গুজা মাছ, হেলাম পুটি, বাইলা মাছ ধরত বশ্যিতে। ধরার আগে মাছে আধার ঠোকরাইত। হেসুম পাতাকাটি পানিতে নাচন পারত। তা দেইখা মোনের মইদ্যেও নাচন আইত। পাতাকাটি তল অইলে খোট্টা দিয়া মাছ তুইল্যা ফালাইতাম। বশ্যির মইদ্যে আটকাইয়া মাছ দাফরাইতে থাকত। কান্তা তিগা বশ্যি খুইলা মাছ খালইর মইদ্যে য়াকতাম। বুগ পাট ক্ষেতে চলাচলা পুটি মাছ দৌড় পাড়ত। হেইন্যা য়াত দিয়াই ধইরা ফালাইতাম। খালুই ভইরা যাইত পুটি মাছে। একটা আগ্যা মাছ ধরছিলাম দেইক্যা য়শি ভাই কয় “শালার পাহাইরায় আগ্যা মাছ ধরছে। আগ্যা মাছ মাইনষে খায়?” অশি ভাই দুলাভাইর চাচত ভাই। হেও মইরা গেছেগা। আগন পুষ মাসে গাংগের পানি কুইমা যাইত। কয়জনে মিল্যা গাংগে ঝার ফালাইত। হেই ঝারে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইর মাছ, চিতল মাছ জরা অইত। ডল্যা জাল, নয় ঝাকি জাল, নয় চাক ঝাল দিয়া হেইন্যা ধরত। দুলাভাইরা কয়জনে ভাগে গাংগে ঝার ফালাইছাল। হেই ঝার তনে একটা মস্ত বড় পাংকাশ মাছ

ধরছাল। হেইডা কাইটা ভাগ কইরা নিছাল দুলাভাইরা। হেসুম বু আংগ বাইত্যে আছাল। দুলাভাই হেন তিগা এক ভাগা আংগ বাইত্যে নিয়াইছাল। আমি হেসুম দুল্যা আছিলাম। পাংকাশ মাছের নাম হেদিন হুনলাম। হায়রে মজা নাগছাল হেইডা!

আংগ নানিগ বাড়ি অইল ভরে, য়ৌয়া গেরামে। শিক্ষিত মাইনষে কয় রৌহা। হেনু গিয়াও মাছেরে গেছি। য়াইত কইরা আন্ধাইরের মইদ্যে বোরো ধান ক্ষেতের বাতর দিয়া আইটা যাওনের সোম হলক ধরাই যাইতাম। হলকের আলো দেইখা হৈল মাছ আইগাই আইত। কাছে আইয়া চাই থাকত। হেসুম ফস্কা দিয়া ঘাও মাইরা ধইরহালতাম। যাগ ফস্কা না থাকত তারা পাট কাটনের বাগি দিয়া কোপ মাইরা হৈলের ঘার কাইটাহালত। হৈল মাছ, সাইতান মাছ এক ঝাক পোনা নিয়া ঘুরাঘুরি করত। হেই পোনা খুইয়া দিয়া খেও দিয়া মারতাম। পোনামাছ ভাজি খুব বাসনা করত। এহন বুঝি উগ্না মারন ঠিক অয় নাই।

বাইস্যা মাসে আমি, ফজু ভাই, কাদে ভাই, নজু ডিংগি নাও নিয়া হুক্নি বিলের মইদ্যে গিয়া বশ্যি ফালাইতাম। বড় বড় ফইল্যা মাছ ধরত। নজু আমার তিগা এক বোছইরা ছোট আছাল। হে ছোট বালাই য়ক্ত আমাশা অইয়া মইরা গেছে। আশিন মাসে পানি নিটাল অইয়া গেত। চামারা ধান ক্ষেতের ভিতর হল্কা মাছ খাওয়া খাইত। হেসুম পানিত ছোট ছোট ঢেউ উঠত। আমি আর ভুলু ভাই ডিংগি নাও নিয়া যাইতাম মাছেরে। আমি পাছের গলুইয়ে বইয়া নগি দিয়া নাও খোজ দিতাম। ভুলু ভাই সামনের গলুইয়ে কোচ নইয়া টায় খারই থাকত। বিলাইর নাগালা ছপ্পন ধইরা। মাছে যেই য়া কইরা কান্তা নড়াইত অবাই ভুলু ভাই কোচ দিয়া ঘাও দিয়া ধইরা ফালাইত। আমি পৌকের নাগাল পাছের গলুইয়ে বই থাকতাম। ভিয়াইল আংগ ফুবুগ বাড়ি। হেনু গিয়াও এবা কইরা মাছ মারতাম গিয়াস ভাই, মতি ভাই, সূর্যভাই, সামসু ভাই, জিয়াবুল ভাই, চুন্নু ভাইগ নগে। চুন্নু ভাই, জিয়াবুল ভাই মইরা গেছে। ভিয়াইল আংগ কাক্কুগ বাড়িও। হায়দর ভাইর নগেও এবা কইরা মাছ ধরছি। ভৌরা মাইনষে আশিন মাসে পানির দারার মইদ্যে বড় বড় খরা পাইত্যা নোড়া ফেকা মাছ মারত। ফুবার নগে গিয়া ভরা নোড়া ফেকা মাছ কিন্যা আনছি নায় চইরা। কাতি মাসে তালতলাগ বোগল দিয়া যে বিলগুনা আছাল হেইগ্নার যত মাছ গোলাবাড়ির খাল দিয়া আমজানির গাংগে গিয়া নামত। আংগ গেরামের মাইনষে হেই খালে ছিপ জাল পাইত্যা হেই মাছ ধরত। খালের পাড়ে মাচাং বাইন্দা বইয়া বইয়া ছিপজাল বাইত। এহাকজোনে বাইক কান্দে নইয়া এক মোন দের মোন গোলাবাড়ি তিগা মারা পুটিমাছ আইন্যা উঠানে ঠেংগি দিয়া ঢালত। এত মাছ কিবা কইরা মারে ইডা দেকপার নিগা আমি আর জিন্না ভাই এক নগে গোলাবাড়ি গিয়া য়াইতে মাচাংগে হুইছিলাম। যাওনের সুম দেহি হাইল হিন্দুইরা খালে গুদারা নাই। অহন পাড় অমু কিবায়? ঘাটে কোন মানুষ জোনও আছাল না। জিন্না ভাই কইল “তুই অম্মুহি চা।” আমি চাইছি। ঘুইরা দেহি জিন্না ভাই এক য়াতে কাপর উচা কইরা ধইরা আরেক য়াত দিয়া হাতুর পাইরা খাল পাড় অইতাছে। দিস্ কুল না পাইয়া আমিও কাপড় খুইলা এক য়াতে উচা কইরা ধইরা হাতুর পাইরা পার অই গেলাম। য়াসুইন না জানি। হেসুম পোলাপান মানুষ আছিলাম। কেউ ত আর আংগ দেহে নাই। শরমের কি আছে? গোলাবাড়ি গিয়া দেহি হারা খাল ভর্তি খালি ছিপ জাল। ষাইট সত্তুরডা জাল পাতছে ছোট্ট এডা খালে, ঘোন ঘোন, লাইন দইরা। বেক্কেই য়াইত জাইগা জাল টানে। দিনে বেশি মাছ ওঠে না। য়াইতে নিটাল থাকে দেইখা মাছ খালে নামতে থাহে। দিনে বেক্কেই ঘুমায়। আমি আউস কইরা কয়ডা খেও দিছিলাম। অত বড় জাল আমি তুলবার পাই নাই। তাত্তারি মাচাংগে গুমাই পড়ি। হেষ আইতে ঘুম ভাইংগা যায় জারের চোটে। কাতি মাস অইলে কি অব, য়াইতে জার পড়ত। দেহি য়াত পাও টেল্কায় শান্নিক উইঠা গেছে গা। বিয়ান বেলা কোন মোতে কোকাইতে কোকাইতে বাইত আই পড়লাম। এন্তিগা এবা সর্দি নাগল গ, এক হপ্তা পর্যন্ত সর্দি জ্বর বাইছিল। জ্বর নিয়া কাতি মাসে বিয়ানবেলা য়ইদ তাপাইতে বালাই নাগত। এক নাক ডিবি ধইরা বন্ধ অই থাকত। নজ্জাবতি ফুলের বোটা ছিড়া নাকে হুরহুরি দিলে বাদা আইত। হাইচ্চ দিলে নাক বন্ধ খুইলা গেত। জোড়ে জোড়ে নাক ঝাইরা পরিস্কার করতাম। আমি গোলাবাড়ি একবারই গেছিলাম।

গোলাবাড়ির মাছ মারা নিয়া এডা মজার কতা কই। একবার এডা মেওপোলা য়োগী নিয়া আইল এক বেটা আংগ এলাকা তিগা। কাগজপাতি ঘাইটা দেকলাম সখিপুর আর টাঙ্গাইল তিগা ভরা টেহার পরীক্ষা করছে। খালি টেহাই গেছে। আমি কইলাম “ভরাইত পরীক্ষা করছুইন।” বেটাডায় য়াগ কইরা কই উঠলো “আন্নেরা সখিপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিং য়োগীগ কাছ তিগা টেহা নিয়নের নিগা গোলাবাড়ির খালের মতো জাল ফালাইছুন ক্লিনিক কইরা। গোলাবাড়ির খালে যেবা উজান ভাটি সব জালেই হোমানে মাছ বাজে, হেবা আন্নেগ বেবাক ক্লিনিকেও গেরামের মাইনষের টেহা বাজে। বেটা মাইনষে বিদেশে কষ্ট কইরা টেহা কামাই কইরা দেশে পাঠাইতাছে, আর হেই টেহা আন্নেরা জাল পাইত্যা ছাইব্বা তোলতাছুইন। য়োগী বালা অওনের নাম নাই। খালি টেহা নিতাছুইন। ” আমি কইলাম “য়োগী ডাকতরেরা বালা করবার পাবনা। বেটির জামাইরে দেশে নিয়াই পড়ুন। দেকবাইন এবাই বালা অই যাবো গা। “

জারের দিনে নানিগ বাড়ির চহের পানি হুকাই গেত। পাগারের পানি পানায় ঢাইকা গেত। আমি আর ফজু ভাই হেই পানিত তিগা খুইয়া দিয়া দোয়াইয়া মাছ মারতাম। ফজু ভাই পানার নিচ দিয়া খুইয়া ঠেইল্যা দিত। পানা হুইদ্যা খুইয়া উচা কইরা ধরত। আমি খাবলাইয়া পানা হরাইয়া দিতাম। হেই খুইয়ায় খইলসা মাছ, চাটা মাছ, কই, জিওল, মাগুর মাছ উঠত। চাটা মাছ খইলসা মাছের নাগালা দেখতে, তে একটু ছোট। আমি চাটারে খৈলসা কইছিলাম দেইকা ফজু ভাই কইল “এই শালার পাহাইরা, চাটা মাছ চিনে না!” তিন আংগুল দিয়া মাথা আর ঘার পেইচা ঠাসি মাইরা ধরন গাগত জিওল মাছেরে। কাতা দেয় দেইকা আমি ডরে জিওল মাছ ধরহাইতাম না। একদিন সায়স কইরা ধরবার নিছিলাম। অবাই একটা কাতা খাইলাম। হায়রে বিষান নইল! বিষের চোটে উজা নাফ পারন নইলাম। কানতে কানতে নানিগ বাইত গেলাম। মামানি কাতা দিওন্যা যাগায় চুনা নাগাই দিলে বিষ কিছুডা কমল। তারপর বিষ নামাইন্যা ঝারা দিল এবা কইরা

আউরা জাউরা বিষের নাম,

কোন কোন বিষের নাম।

অ বিষ ভাটি ছাইড়া যাও।

যুদি ভাটি ছাইরা উজান ধাও,

মা পদ্মার মাথা খাও।

অ বিষ ভাটি ছাইরা যাও।

ঝারা দেওনের ভরাক্ষোন পরে বিষ কোমলে ঘুমাই পড়ি। আমি আর কূন্দিন কাতা খাই নাই। কাতা খাইয়া এডা উপুকার অইছে। য়োগিরা যেসুম কয় “য়াত পাও এবা বিষায় জানি জিওল মাছে কাতা দিছে। ” হেসুম আমি বুঝি কিবা বিষায়।

শাওন ভাদ্দর মাসে আমজানি দুলাভাইগ পালানের পাট কাটার পরে কোমর তুরি পানি থাকত। হেই পানিত চেলা, মলা, ঢেলা, বাতাসি, তিতপুটি, এবা ভরা মাছ থাকত। দুলাভাইর নগে মুশুরি টাইনা হেইন্যা ধরতাম হিসার পাইল্যা বোজাই কইরা। হিসার পাইল্যা পানিত ভাইসা থাকত। মাছ ধইরা পাইল্যায় য়াকতাম।

চৈত বৈশাখ মাসে পানি হুকাই যাইত। নানিগ বোরো ক্ষেতে হিচা দিয়া পানি হিচপার নিগা গাড়া কইরা মান্দা বানাইত। হেই মান্দা হিচা মাছ ধরতাম। অইদের তাপিসে কাঠের নাও হুকাইয়া বেহা ধইরা গেত দেইখা ইন্যারে পুস্কুনির পানিতে ডুবাই য়াকত। নায়ের পাটাতনের নিচ দিয়া মাছ পলাই থাকত। আমরা দুই তিন জোনে মিল্যা ঝেংটা টান মাইরা নাও পারে উঠাই ফালাইয়া নাও তিগা মাছ ধরতাম। মামুরা পুস্কুনিতে ডল্যা জাল টাইনা বড় বড় বোয়াল মাছ ধরত। জালে মইদ্যে বাইজ্যা হেগ্নায় হাটিহুটি পারত। মামুগ কান্দের উপুর দিয়া নাফ দিয়া যাইত গা বড় বড় বোয়াল। পুস্কুনির পাড়ে খারইয়া আমরা তামসা দেখতাম।

মাছ মারনের এবা ভরা কতা লেহন যাবো। কিন্তু এত সোময় আমার নাই। আন্নেরা ত জানুইনই আমি একজোন ডাকতর মানুষ। ডাকতরে গ কি অত সোময় আছে? একটা হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান আমি। দিনাপত্তি বিয়ানবেলা সারে আটটা তিগা বিকাল আড়াইডা পর্যন্ত হেনু কাম করন নাগে। বৈকাল চাইরডা তিগা য়াইত নয়ডা পর্যন্ত নিজের প্রাইভেট ল্যাবরেটরিতে কাম করি। হেনু গেরামে তিগা মেলা লোক আহে। তাগ নগেও কতা কওন নাগে। শুক্কুরবারে বন্ধ থাহে। হেদিন য়াবিজাবি কাম করি। চাইরডা মেডিকেল জার্নাল সম্পাদনা করন নাগে আমার। বই লেহি। কম্পিউটারের সফটওয়্যার বানাই বিক্রি করি। ছাদবাগান করি। অনলাইনে ক্লাস নেই। জুমে মিটিং করি। ইউটিউব ভিডিও বানাই। মেয়াগ নগে, নাতি নাত্নিগ নগে, বন্ধুগ নগে, শালা সুমুন্দি গ নগে ভিডিও কলে কতা কইতে য়য়। এবা আরবিলের মইদ্যে থাকি। আন্নেগ নগে মাছ মারা নিয়া আর লেহনের সোময় নাই। অহন চেম্বারে যামু, থাইগ্যা। দোয়া করুইন জানি।

১৩/৭/২০২১ খ্রি.

ময়মনসিংহ

Ruhini

Ruhini Da

রুহিনী দা

রুহিনী দাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৩ সনে। নাম জানতাম না। পিজিতে এমফিল এডমিশন টেস্টের ভাইবা দিচ্ছিলাম একই দিনে। এখনকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আইপিজিএমআর নামে একটা পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল ইনস্টিটিউট ছিল। সংক্ষেপে বলা হতো পিজি। পিজিতে পড়া ও শিক্ষকতা করা খুবই সম্মানের ব্যাপার ছিলো। বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর বি আর খান স্যারের অফিস কক্ষে মৌখিক পরীক্ষা হচ্ছিল। একজন একজন করে ক্যান্ডিডেট প্রবেশ করছিলেন। আমরা সবাই ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। ১০/১৫ মিনিট পর ফিরে এসে একেকজন একেক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কী কী প্রশ্ন করলেন এটাই ছিলো অপেক্ষমান ক্যান্ডিডেটদের কমন প্রশ্ন। বর্ণনাকারীরা ভয়ংকরভাবে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। সবাই কোলাহল করে সেই সব প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমি সাধারণত নতুন কারো সাথে খোলামেলা আলাপ করতে পারি না। তাই, আমাকে অনেকেই বোকা ছেলেই মনে করে থাকেন। সেদিন আমি বোকার মতো এক দিকে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম। ছোট বেলা হুজুর ছমির মাওলানা আমাকে দোয়া শিখিয়েছিলেন পরীক্ষার আগে পড়ার জন্য। সেই দোয়াটা বার বার পড়ছিলাম আর দেখছিলাম অন্যরা কিভাবে কি ভঙ্গিতে কথা বলেন। কিভাবে শরীর নাড়াচাড়া করেন। কত স্মার্ট তারা। আমি মানুষের কথা বলার ভঙ্গি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। দোয়াটা আমার ছাত্রদেরকেও শেখাই পরীক্ষার আগে পড়ার জন্য। দোয়াটা এমন “রাব্বি, জেদনি, এলমা।” অর্থাৎ “হে আমার রব, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।” একজন ক্যান্ডিডেট ভাইভা দিয়ে ফিরে এসে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তার চেহাড়া দেখে বেশী স্মার্ট মনে হলো না। তিনি দু’হাতের দুই তর্জনী আঙ্গুল খারা করে কপালের দুপাশে ঠেকিয়ে বলছিলেন “সবই পারলাম। কিন্তু স্যার বলছিলেন ‘এরপর কি?’ আমি আর বলতে পারছিলাম না।” অন্য এক ক্যান্ডিডেট বলে দিলেন “এরপর হলো ফ্রি র‍্যাডিকেল সেল ইঞ্জুরি।” তিনি “ইয়েস, ইয়েস” বলে জিহব্বায় কামড় দিলেন। বললেন “আমার এবার হবে না।” অন্য এক ক্যান্ডিডেট বললেন “আপনার হবেই। আপনি গত দেড় বছর যাবত চিটাগং মেডিকেল কলেজে প্যাথলজির লেকচারার হিসাবে আছেন। আপনি অভিজ্ঞ।” দেখলাম সবাই সবাইকে চেনেন। আমি কাউকে চিনছি না। আমাকেও কেউ চিনছেন না। আমিও যে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের লেকচার তা কেউ জানেন না। এতক্ষণ যার কথা বললাম তিনিই রুহিনী দা। এই দাদা ১৯৯৯ সনে বিএসএমএমইউ-তে প্রথম এমডি কোর্স চালু হলে চাঞ্চ পেয়ে প্যাথলজিতে এমডি কোর্সে ভর্তি হন। আমি সে ১৯৯৩ সনের জুলাই সেসনেই এম ফিল চাঞ্চ পাই। ১৯৯৫ সনের জুলাই ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করে ১৯৯৬ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ফিরে আসি। ১৯৯৮ সনে সহকারী অধ্যাপক হই। আমাদের ডিপার্টমেন্টে আমার ব্যাচমেট ডাঃ এএফএম সালেহ (ইকবাল) তখন প্রভাষক ছিল। সে আমার সাথে পরামর্শ করে ১৯৯৯ সনে এমডি কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চাঞ্চ পেয়ে গেলো। সালেহ পিজি থেকে মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করে আমাকে দোষারোপ করতো। বলত “সাদেক, দোস্ত, তুমি আমারে কি এক সমুদ্রে ফেলে দিলা, আমি এর কূলকিনারা পাচ্ছি না।” আমি সাহস দিতাম এই বলে “দেখতে দেখতে ৫ বছর শেষ হয়ে যাবে। চিন্তা করবা না।” সালেহ রুহিনী দার খুব প্রশংসা করতো। বলত “সাদেক, আমি আমার এক রিডিং পার্টনার পেয়েছি, রুহিনী দা। দাদার মতো এত ভালো মানুষ হয় না।” সালেহ ২০০৩ সনে এমডি পাস করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আবার প্রভাষক হিসাবে ফিরে আসে। প্যাথলজি বিষয়ে প্রথম এমডি পাস করা হিসাবে সবার কাছে একটু বেশী প্রশংসা পেতে থাকে। আমি যেমন এমফিল পাস করে ময়মনসিংহ এসে ১৯৯৭ সনেই তালুকদার প্যাথলজি নামে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে প্রাক্টিস করতে থাকি সালেহও তেমনি নোভা প্যাথলজি নাম দিয়ে ময়মনসিংহে একটা প্যাথলজি ল্যাব দিয়ে প্র‍্যাক্টিস শুরু করে। সালেহ সারাক্ষণ রুহিনী দার প্রশংসা করতো। রুহিনী দা এমডি পাস করে চিটাগং মেডিকেল কলেজে ফিরে গিয়ে প্র‍্যাক্টিস শুরু করেন। এদিকে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে সালেহর বদলীর প্রস্তাব হয়। সালেহ এই বদলী ঠেকাতে না পেরে রুহিনী দাকেও রাজি করান দিনাজপুর নিয়ে যেতে। কর্তৃপক্ষকে রিকুয়েষ্ট করে সালেহ রুহিনীদাকে সহ একই অর্ডারে বদলীর অর্ডার করায়। অর্থাৎ দুজনই সহকারী অধ্যাপক হিসাবে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। সালেহ প্যাথলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নেন। মাইক্রবায়োলজির পোস্ট গ্রাজুয়েট করা টিচার না থাকাতে রুহিনী দা মাইক্রোবায়োলজির প্রধানে দায়িত্ব নেন। এভাবে চলে ৩ বছর। দাদা ও সালেহ একসাথে পার্টনারশিপে নোভা প্যাথলজি নামে দিনাজপুর শহরে একটা ল্যাবরেটরি দেন। দিনাজপুরে এর আগে কেউ হিস্টোপ্যাথলজি (বায়োপসি) পরীক্ষা করতো না। এই দু’জন মিলে প্রথম দিনাজপুরে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা শুরু করেন। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুর অঞ্চলের সব বায়োপসি ও সাইটোপ্যাথলজি পরীক্ষা এই দু’জন বিশেজ্ঞের দ্বারা করা হতো।

২০০৭ সনের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমার জীবনের ছন্দপতন হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। একই অর্ডারে আমাকে দিনাজপুর এবং সালেহকে ময়মনসিংহ বদলী করা হলো। আমরা যারযার কর্মস্থলে যোগদান করলাম। আমার তালুকদার প্যাথলজির রিপোর্ট করার দায়িত্ব নিলো সালেহ। আমি দিনাজপুর গিয়ে তেমন ভালো ল্যাবরেটরি পেলাম না। ততৎকালীন অধ্যক্ষের পরামর্শক্রমে আমি একটা কর্পোরেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হিস্টোপ্যাথলজি, সাইটোপ্যাথলজি ও ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি প্রাক্টিস শুরু করলাম। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে চাকরি করতে হলো আমাকে পূর্ণ ৮ বছর। এই ৮ বছর আমার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন সেই রুহিনী দা। যাকে নিয়ে আজ লিখবো।

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে যোগদান করার পর ভালো ভাবে বুঝতে পারলাম কেনো সালেহ রুহিনী দার এতো প্রশংসা করতো। আসলেই প্রশংসা পাওয়ার মতো বিরাট ব্যক্তিত্ব রুহিনী দা। তিনি আমাকে সাদেক ভাই বলে ডাকতেন। আট বছর একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছি। তিনি ছিলেন বিভাগের প্রধান। কিন্তু তিনি আমার সাথে বসের মতো আচরণ করেননি। শত শত গল্প করে শত শত ঘন্টা কেটেছে আমাদের। গল্প বলতে বলতে তিনি কমন একটা কথা বলতেন “হইছে কি সালেহ ভাই!” আমি ভুল শুধ্রে দিয়ে বলতাম “দাদা, আমি সালেহ না, আমি সাদেক।” সালেহ দাদার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিলো যে ৮ টা বছরেও দাদা আমাকে সালেহ ভাই বলেই ভুলে সম্ভোধন করে বসতেন। সালেহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও দু’জনের সভাবে বেশ পার্থক্য আছে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো দু’জনেই দাদাকে খুব বেশী ভালোবাসি।

আমি একদিন দাদার অফিস-রুমে বসে কিছু কাজ করছিলাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি ৩ জন জুব্বা পড়া টুপি মাথায় দেয়া হুজুর দাদার রুমে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। একজনের হাতে চাঁদা আদায়ের রশিদ। আমি জিজ্ঞেস করলাম

– আপনারা কিছু বলবেন?

– জি, আমরা এই স্যারের কাছে এসেছি।

– কি ব্যাপারে এসেছেন?

– আমরা একটা মাদ্রাসা ও মসজিদের সাহায্যের জন্য এসেছি।

– আসেন, আমার রুমে আসেন। পাশেই আমার রুম।

– স্যারের কাছ থেকে কিছু নিয়ে আসি। স্যার কি ব্যস্ত?

– মানে, স্যার তো মুসলিম না, পুঁজা করেন। স্যারের কাছ থেকে মসজিদের চাঁদা নিবেন?

– স্যার, হিন্দু?

– হ্যাঁ।

এরপর তারা ভালো করে দাদার নেইম প্লেটটা পড়লেন। ডাঃ রুহিনী কুমার দাস। বললেন “ও হো, ভুল হয়ে গেছে। আমরা ভাবছিলাম মোসলমান নাম “রুহানী।” আমরা সবাই মুস্কি হাসলাম। কোন কোন নামকরা ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তার নামের শেষে রুহানী টাইটেল থাকে। এই হুজুররা তেমন রুহানী মানুষ ভেবে মসজিদের চাঁদার জন্য এসেছিনেন। তবে দাদার রুহুটা আসলেই রুহানী।

দাদার সাথে আমি অনেক গল্প করে কাটিয়েছি। গল্পের ছলে আমাদের উভয়ের ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনী জানাজানি হয়ে গেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দাদা ক্লাস সিক্সে পড়তেন। আমি পড়তাম ক্লাস ফাইভে। দাদারা বাড়িঘর ফেলে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়নি। এই নয় মাস আমরা কে কি করেছি সে কথা নিয়েও আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে। আমরা দুজনই ব্যবসার কাজে সেসময় হেল্প করেছি। দেশ স্বাধীন হলে দাদারা ফিরে এসে দেখেন বাড়ি ভিটা পরিস্কার। কিচ্ছু নেই তাদের। গ্রামের এক মুসলিম প্রভাবশালী ধার্মিক লোক সব নিয়ে গেছে তাদের বাড়ির। দাদাদের সাথে দেখা করে সেলোক বলে যে “তোমরা চলে যাবার পর এসব জিনিস দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যেতো। তাই আমি তোমাদের সব কিছু নিয়ে আমার হেফাজতে রেখেছি। এখন তোমাদের জিনিসপত্র বুঝে নাও।” দাদারা সব কিছুই ফিরে পান। সেই কথা বারবার দাদা আমাকে বলতেন। মানুষ এতো ভালো হতে পারে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। দাদা মাঝে মাঝেই লোকটার জন্য দোয়া করতেন যেনো লোকটা জান্নাতবাসী হন।

দাদার ২০০৪ সন থেকেই হার্টের রোগ ধরা পরে। হার্টের রক্তনালী চিকন হয়ে গিয়েছিল। তাই হার্টে রক্ত সরবরাহ কম হতো। তাতে বুক ব্যথা করতো। বুকে হাত দিয়ে চিন্তিত থাকতেন। অল্প হাটলেই হাফিয়ে যেতেন। আমাদের ডিপার্টমেন্ট ছিল নিচ তলায়। আমরা চারতলার ডরমিটরিতে থাকতাম। দাদা চারতলায় উঠে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। দাদার খুব কষ্ট হতো। এইসময় দাদার গ্রামেরই এক টাউট লোক দাদা ও দাদার ভাইয়ের নামে জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে মামলা করে হয়রানি করেন। দাদা সারাক্ষণ মোবাইলে এনিয়ে উকিলের সাথে কথা বলেন। আমি খুব টেনশনে থাকতাম দাদাকে নিয়ে হার্ট এটাক করে বসেন কিনা। যাহোক, দাদারা সেই টাউট থেকে রেহাই পান। ২০০৯ সনে আমি, আমিনুল স্যার ও সালেহ দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে দাদাকেও যেতে বলি। তার কষ্ট হবে বলে তিনি রাজি হলেন না। যেই সালেহ রিকুয়েষ্ট করলো অমনি রাজি হয়ে গেলেন। তবে ইন্ডিয়া টোরে দাদার কষ্ট হয়েছিলো আমরা বুঝতে পারতাম। সালেহকে দাদা এমন ভালোবাসতো যে সালেহর কথায় দাদা না করতে পারেননি।

দাদার বিয়ের আলাপও আমার কাছে করেছেন। দাদা তার বড়ভাইকে খুব মেনে চলেন। বিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বড় ভাইকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দাদা চোখ বুঝে বড় ভাইয়ের কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছেন। দাদা বৌদিকে নিয়ে খুবই সুখী জীবন যাপন করেন। দাদার দু’মেয়ে। খুবই গুণবতী হয়েছে। দুজনই ডাক্তার হয়েছে। দাদা বলেছেন “বিয়ের কথাবার্তা যখন পাকাপাকি হয়ে গেছে তখন আমার শশুর মশাই আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে আমার হাত ধরে বললেন ‘আমার মেয়েকে তোমার কাছে সমর্পণ করলাম। তবে তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে সেটা হলো তুমি কখনো মোটর সাইকেলে উঠবে না’। ” আমাদের সময় অল্প বয়সে সাধারণত মারা যাওয়ার বেশী চাঞ্চ ছিল মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট। মেয়ে যেনো অল্প বয়সে বিধবা না হয় সে জন্যই হয়ত দাদার শশুর মশাই এমন ওয়াদা করিয়েছিলেন। এখন ইয়াং ডাক্তার মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে মারা যাওয়ার খবর তেমন শোনা যায়না। একটা চাঞ্চই বেশী সেটা হলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শহীদ হয়ে যাওয়া। দাদাকে আমি কারো মোটরসাইকেলে উঠতে দেখিনি। আমাকে কেউ ওয়াদা না করালেও আমি ভয়েই মোটরসাইকেলে চড়ি না।

দাদার কাছে একদিন একটা গল্প বলেছিলাম। গল্পটা দাদার খুব ভালো লেগেছিল। গুল্পগুজবের আসর বসলে দাদা সেই গল্পটা আমাকে শুনাতে বলতেন। গল্পটা আমি শুনেছিলাম শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ এখলাছুর রহমান স্যারের কাছে। গল্পটা ছিল এমন।

পাকিস্তান আমলে এক থানার এক দারোগা ছিল। তিনি ঘুষ খেতেন। মফস্বলে গিয়ে আসামী ধরে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দিতেন। রাতে বাসায় ফিরে ঘুষের টাকা বউয়ের হাতে দিতেন। বউ টাকা হাতে পেয়ে খুব খুশী হতেন। ট্রাংকের ভিতর টাকা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতেন। গহনা বানাতেন সেই টাকা দিয়ে। মাসের পহেলা বেশী টাকা দিতেন বউয়ের হাতে। বউ জিজ্ঞেস করতেন

– আইজ এতো বেশী টাকা পেয়েছেন?

– আজকের টাকা হলো বেতনের টাকা।

– অন্যদিনেরগুলা কিয়ের টাকা?

– অন্যদিনেরগুলো মফস্বলের টাকা।

বউ হিসাব করে দেখলেন যে মফস্বলের টাকা অল্প হলেও মাসের প্রতিদিন পাওয়া যায়। আর বেতনের টাকা মাসে মাত্র একদিন। তবে তুলনা করলে মফস্বলের টাকায় আয় বেশী।

একদিন খুব গরম পড়েছিল। সেদিন দারোগা চাকরি থেকে বরখাস্ত হয় ঘুষের খবর জানাজানি হয়ে। দারোগা বাসায় ফিরে খাটে বসে জামাখুলে খুব ঘামতেছিলেন। বউ বিচুন দিয়ে বাতাস করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন

– আপনের কী অইছে? এমন করতাছেন কেন?

– আমার চাকরিটা গেছে গা।

– কোন চাকরি গেছে? বেতনেরটা, না কি মফস্বলেরটা?

– বেতনেরটা গেছে?

– যাউগ গা। মফস্বলেরটা থাকলেই অইব।

– গিন্নি, বেতনের চাকরি না থাকলে মফস্বলেরটাও থাকে না।

– এ্যা?

আমি দাদাকে বলতাম “দাদা, এখনকার দারোগারা ভালো। মফস্বলে গিয়ে ঘুষ খান না। তবে এই গল্প থেকে আমার একটা শিক্ষা আছে। ডাক্তারদের বাড়তি আয়ের জন্য ঘুষ খেতে হয় না। তারা বৈধপথেই বিকেলে প্রাক্টিস করে মোটা অংকের টাকা আয় করতে পারেন। তবে যেসব ডাক্তার ভালো পজিশনে সরকারি চাকরি করেন তাদের বৈকালিক প্রাইভেট প্রাক্টিস আয়ও ভালো। চাকরি চলে গেলে তাদের প্রাইভেট আয়ও চলে যেতে থাকে।” দাদা হে হে করে হেসে বলতেন “ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাক্টিস আয় হলো মফস্বলের আয়ের মতো।”

আমি দু’এক মাস পরপর ছুটি নিয়ে ঢাকায় যেতাম। পরিবার ঢাকার উত্তরায় রেখেছিলাম। রাতের বাসে ফিরে সকালে অফিস করতাম। বিকেলে প্রাইভেট প্রাক্টিস করতাম। কোন কোন দিন ঢাকা থেকে ফিরতে দেরী হলে গাইবান্ধা পর্যন্ত এসে দাদাকে ফোন দিতাম “দাদা, আমি অফিস ধরার চেষ্টা করব। গাইবান্ধা পর্যন্ত এসেছি। অফিস ধরতে না পারলে মাইন্ড কইরেন না।” দাদা হেসে বলতেন “অসুবিধা নাই। মফস্বলেরটা ধরতে পারলেই হবে।” আসলেই মফস্বলের আয় বেতনের আয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশী।

আমাদের সাথে ডরমিটরিতে আরেক দাদা থাকতেন মেডিসিন বিভাগের। তিনি ডাঃ তিমির বরন বসাক। রুহনী দা ও তিমির দা দুজনই আমার থেকে এমবিবিএস-এ এক বছরের সিনিয়র। তারসাথেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। তাকে নিয়ে লেখলে সারাদিনেও পড়ে শেষ করা যাবে না। তার কথা আজ লেখব না। তিনি ছিলেন চিরকুমার। তিনি নিজ হাতে রান্না করে খেতেন। কারন, প্রায় সব মসলাতেই তার এলার্জি ছিলো। তিনি মেডিসিন বিভাগের প্রধান হয়েও নিজের কক্ষে বসতেন না। হাসতালে রাউন্ড দিয়ে ডরমিটরিতে এসে পড়তেন। একটা মাত্র সুতীর হাফ হাতা শার্ট পড়তে পারেন। কারন, অন্য কাপড়ে তার এলার্জি ছিলো। যত শীত হোক, ঐ হাফ শার্ট। তিনি একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। আত্বীয় স্বজনের সাথেও বেশী যোগাযোগ করতে দেখিনি। এক সন্ধায় চেম্বারে তার হার্ট এটাক হলো। তাকে দ্রুত স্থানীয় একটা প্রাইভেট হার্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ওখানকার পরিচর্যা ভালো ছিলো। সাথে এটেন্ডেন্স থাকার তেমন প্রয়োজন ছিল না। তিমির দার আপনজন কেউ আসেননি। দুদিন পর তার এক বড় ভাই এলেন। তিনিও চিরকুমার। তিনিও দু’একদিন থেকে চলে গেলেন। রুহিনী দা তিমির দার কাছে ঘন ঘন যেতেন। আমি কম কম যেতাম। একদিন দেখলাম একজন ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টিটিভ ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। ব্যাপারটা এমন- তিমির দার ব্যাংকে একাউন্ট আছে বহুদিন যাবত। তিনি বেতনের টাকা ও প্রাক্টিসের টাকা প্রায় সব ব্যাংকে জমা রাখেন। জামাকাপড় কিনতে হয় না তেমন। যা খান তার খরচও তেমন না। জমিজমাও কেনেননি। সব টাকা তার ব্যাংকে জমা। কিন্তু তিনি একাউন্ট করার পর চেক বই উঠাননি ব্যাংক থেকে। ব্যাংক থেকে একটা টাকাও উঠাননি কোনদিন। হার্টের এঞ্জিওগ্রাম করতে ঢাকায় যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার। তাই চেকবই উঠাতে হচ্ছে। এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তা নিজেই এসেছেন হাসপাতালে নমুনা স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে। যাহোক, টাকা সংগ্রহ করে তিমির দা বিমানে করে ঢাকায় গেলেন। সাথে আপন লোক কেউ গেলেন না। গেলেন শুধু আনাদের রুহিনী দা। কত বড় ভালো মানুষ আমাদের রুহিনী দা। তিমির দার বিপদের সময় এটেনডেন্ট হলেন আরেক হার্টের রোগী রুহিনী দা। রুহিনী দারও এঞ্জিওগ্রাম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল ৮ বছর আগে। তিনি মরে যাবেন এই ভয়ে কোন দিন এঞ্জিওগ্রাম করাতে সাহস পাননি। তিনি নিয়ে গেছেন তিমির দাকে এঞ্জিওগ্রাম করাতে প্রাইভেট দামী এক হাসপাতালে। তিমির দার এঞ্জিওগ্রাম করার সময় ডাক্তারগণ হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে দিলেন। তিমির দা সুস্থতা বোধ করলেন। এসব আমি পরে শুনেছি রুহিনী দার কাছে। আমি এগুলো জানতাম না। তিমির দার রিং পরানো দেখে রুহিনী দার সাহস বেড়ে যায়। তিনিও এঞ্জিওগ্রাম করান। কিন্তু ডাক্তার এঞ্জিওগ্রাম করে পরামর্শ দেন যে আজই অপেন হার্ট সার্জারী করে বাইপাস করে দিতে হবে হার্টের রক্তনালী। সংবাদটা রুহিনী দা আমাকে দ্রুত মোবাইলে জানান সকালে। প্রিন্সিপাল প্রফেসর হামিদুল হক খন্দকার সেদিন কলেজে আসেননি। তিনি সেদিন রংপুর বাসায় ছিলেন। আমি স্যারকে মোবাইলে জানালাম আজ রুহিনী দার ঢাকায় বাইপাস সার্জারি হবে। অবস্থা খুব খারাপ। স্যার শুধু বললেন “সেক্রেটারিকে বলে দাও মসজিদে মিলাদ দিতে।” আমি সেক্রেটারিকে বললাম প্রিন্সিপাল স্যার মসজিদে মিলাদ দিতে বলেছেন বাদ জোহর। আমি টিচারদের মধ্যে মোটামুটি রেগুলার ছিলাম মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে। ইমাম, মোয়াজ্জিন ও খাদেমদের সাথে সরলভাবে মিশতাম। মসজিদের মিলাদেও অংশগ্রহণ করতাম।

ছোটবেলা থেকেই আমি মিলাদে অংশগ্রহণ করতাম। ছোট বেলায় আমাদের এলাকায় বাড়ি বাড়ি মিলাদ হতো। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার আরোগ্য কামনা করে মিলাদ দেয়া হতো। কোন শুভ সংবাদ হলেও মিলাদ দেয়া হতো। নতুন ফসল ঘরে আনলেও মিলাদ দেয়া হতো। যিনি মিলাদ পড়িয়ে দিতেন তাকে বলা হতো মৌলভী। মৌলভীরা ইসলামি শিক্ষায় মোটামুটি শিক্ষিত ছিলেন। তারা মিলাদের সময় হালকা বয়ান করতেন। রাসুল মুহম্মদ (সঃ) এর জন্ম বৃত্তান্ত বলতেন, কোর আন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করতেন এবং উর্দু, ফার্সি ও বাংলায় কবিতাকারে ছন্দ মিলিয়ে সুর করে মহানবী (সঃ) এর গুণ গান করতেন। যেমন,

বালাগাল উলামে কামালি হী

কাসাফাত দোজা বি জামালি হী।

হাসুনাত জামিও খিসালি হী

সাল্লু আলাইহি ওয়ালি হী।।

ইয়া নাবী সালামু আলাইকা

ইয়া রাসুল সালামু আলাইকা।

ইয়া হাবিব সালামু আলাইকা

সালামু তুল্লাহ আলাইকা।।

নবী না হয়ে দুনিয়ায়

না হয়ে ফেরেস্তা খোদার।

হয়েছি উম্মত তোমার

তার তরে শোকর হাজার বার।।

এমন অনেক সিল্কি গাইতেন মৌলভীরা। মিলাদের পর সবাইর মাঝে খাজা, বাতাসা ও কদমা বিলি করা হতো। এগুলোর লোভে সব পোলাপান মিলাদের অংশ গ্রহণ করত। অল্প শিক্ষিত মিলাদ পড়ানে ওয়ালাকে মুন্সী বলা হতো। মৌলভী ও মুন্সীদের ভালো অংকের টাকা দেয়া হতো হাদিয়াসরূপ। একবার আমজানি বুবুদের বাড়ি গিয়ে পাশের বাড়িতে মিলাদে গিয়েছিলাম। একজন মুন্সী মিলাদ পড়াচ্ছিলেন। অনেক পোলাপান হয়েছিল সেই মিলাদে। মুন্সী সুর করে করে মিলাদের বাক্য বলছিলেন। পোলাপানের গ্যাঞ্জামে মিলাদ ভালো শুনা যাচ্ছিল না। মুন্সী মিলাদের সুরে সুরে গেয়ে গেলেন

“পোলাপান গোলমাল করিস না,

নইলে কইল খাজা পাবি না।”

আমরাও সুরে সুরে বললাম

“পোলাপান গোলমাল করিস না,

নইলে কইল খাজা পাবি না।”

শুনে পোলাপানের দল খিলখিল করে হেসে দিলো।

যাহোক, সেই মিলাদ নিয়ে এখন ইসলামি স্কলারদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কেউ কেউ এটাকে বিদআত বলছেন। তাই, অনেকেই মিলাদ বর্জন করছেন। প্রিন্সিপাল স্যারের কথামতো আমি কলেজের সেক্রেটারিকে মিলাদের ব্যবস্থা করতে বললাম। মিলাদ উপলক্ষে মসজিদে জিলাপি ও আনুসংগিক তোবারক আনা হলো সরকারি ধর্মীয় ফান্ড থেকে। তোবারক দেখে সেদিন পোলাপান মুসুল্লির সংখ্যা একটু বেশীই হলো। ইমাম সাবের পাশেই আমি বসেছিলাম মিলাদে। ইমাম সাবও মিলাদের পক্ষের লোক না। তিনি সরকারি ইমাম। তাই সরকারি অর্ডার তার পালন করতে হতো। তাই তিনি কবিতাগুলো বাদ দিয়ে কিছু কোরআন তেলাওয়াত করলেন, কিছু দরুদপাঠ করলেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলেন “স্যার, কি উপলক্ষে মিলাদ?” আমি বললাম “ডাঃ রুহিনী কুমার দাস স্যার খুব অসুস্থ। তার হার্টের ওপেন সার্জারী হচ্ছে আজ। তারজন্য দোয়া করা।” ইমাম সাব চমকে গেলেন কুমার দাস শুনে। তারপর সাভাবিক হয়ে মোনাজাত ধরলেন। মোনাজাতে এক পর্যায়ে বললেন “ইয়া আল্লাহ আমাদের ডাঃ রুহিনী কুমার দাস স্যারের প্রতি তুমি রহম করো। তাকে তুমি আরোগ্য দান করো।” সবাই বললেন “আমিন, আমিন, আল্লাহ হুম্মা আমিন।” সবাই তোবারক খেয়ে ফিরে গেলো।

যাহোক, রুহিনী দার সেদিন হার্টের অপারেশন হলো। আল্লাহ রুহিনী দাকে সুস্থ করে দিনাজপুর আনলেন। দাদাকে আমি অনেকদিন কাজ করতে দেইনি। আমিই ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম চালিয়ে নিয়েছি। অপারেশনের সময় তিনি অজ্ঞান ছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর তার যে তীব্র যন্ত্রণা হতো তার তিনি বিভতস ভাবে বর্ণনা করতেন। বাম বুকে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলতেন “সালেহ ভাই, কি যে কষ্ট হয়েছে আমার! অসয্য কষ্ট!” আমি বলতাম “দাদা, আমি সালেহ না, আমি সাদেক।” আমি ২০১৫ সনের শেষ পর্যন্ত দিনাজপুর ছিলাম। দাদার অপারেশন হয়েছে ২০১২ সনে। এই ৪ বছরই দাদাকে দেখতাম বাম বুকে হাতে দিয়ে থাকতে। মাঝে মাঝে আমি হাত নামিয়ে দিতাম। বুকে হাত দিয়ে থাকা দাদার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

আমার বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় ২০১২ সনে ঢাকায়। দাদার কষ্ট হওয়া সত্বেও সেই অনুষ্ঠানে দাদা উপস্থিত হয়েছিলেন। দাদা আমাকে না ছাড়তে চাইলেও আমি যে ৮ বছর ধরে দিনাজপুর কষ্ট করে থাকছি এটা দাদা অনুভব করতেন। তাই তিনিও চাইতেন যেনো আমি ময়মনসিংহে ফিরে আসতে পারি। আল্লাহর রহমতে কিংবদন্তি শিক্ষক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল স্যার আমাকে বদলি করে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসেন ২০১৫ সনের শেষে। অর্ডার নিয়ে দিনাজপুর গিয়ে দেখি দাদা আমার জন্য সুন্দর একটা নেইম প্লেট বানিয়েছেন। লাগানোর অপেক্ষায় আছেন। আমার বদলীর অর্ডার শুনে তিনি বিমর্ষ হয়ে বললেন “আমি আপনার জন্য সুন্দর একটা নেইম প্লেট বানালাম, আপনি চলে গেলেন! ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।” তিনি নেইম প্লেটটা প্যাকেট করে আমাকে দিয়ে দিলেন। সেইটা কিছুটা মোডিফাই করে আমি এখন ব্যবহার করছি। দাদার স্মৃতি ফেলে দেইনি। দাদা ডিপার্টমেন্ট ও ডর্মেটরির পক্ষ থেকে আমাকে গর্জিয়াস ভাবে বিদায় সংবর্ধনা দেন। উপহার দেন অনেক কিছু। আমি তার দেয়া উপহার সামগ্রী গর্ব ও মহব্বতের সাথে ব্যবহার করি।

২০১৯ সনের নভেম্বরে প্রফেসর ডাঃ সালেহ জামালপুর শেখ হাছিনা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে চলে যাওয়ায় ময়মনসিংহের প্যাথলজি বিভাগের প্রধানের পোস্টে আমার ফিরে আসার সুযোগ হয়। আমি জানতাম এই সংবাদে রুহিনী দাই বেশী খুশী হবেন। তাই আমি প্রথমেই রুহিনী দাকে জানাই। দাদা খুব খুশী হন। আমি এই বিভাগে ২০০২ সনেও কয়েকমাস ১৬ তম বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলাম। চাকরির শেষ জীবনে এসে আবার ২৫ তম বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে খুব ভালো কাটলো ২০২০ সনের এপ্রিলের ১৩ তারিখ পর্যন্ত আমার সরকারি চাকুরির শেষ সময়কাল। আমি বিদায় নিলাম সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে। দাদা দিনাজপুর থেকে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নিয়ে এখন কুমিল্লায় এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আছেন। প্রায়ই আমাদের মধ্যে কথা হয় মোবাইলে।

১৬/৬/২০২০ খ্রি.

ময়মনসিংহ

Cesarean section

Cesarean section

সিজার অপারেশন ছাড়াই বাচ্চা হয় কেমনে?

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

শিক্ষার্থীদেরকে কোন কিছু শিখাতে গেলে তার বয়সের দিকে একটু খেয়াল রাখতে হয়। আমি একদিন এই রকম একটা সমস্যায় পড়েছিলাম। ঈদের ছুটিতে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে ও মেয়ে একজায়গায় বসে গল্প করছিলো । আমি ভাবলাম এই সুযোগে তাদেরকে একটু ধর্মীয় জ্ঞান দেই। আমি মানব সৃষ্টির শুরুটা কেমন ছিল বুঝাতে গিয়ে আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) এর সৃষ্টির কাহিনী বললাম। বিবি হাওয়ার অনেক সন্তান হলো বললাম। এরপর বলতে চেয়েছিলাম “যেহেতু সেই সময় আদমের সন্তান ছাড়া আর কোন মানুষের সন্তান ছিলনা, তাই ভাই-বোনের মধ্যেই বিয়ে সম্পাদন হয়। তারপর বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম হয় এবং এভাবে মানব সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন এই অবস্থা হয়েছে।” এর আগেই এক শিশু আমার গল্পে বাধা দিয়ে বলল “তখন তো আদম ও হাওয়া ছাড়া আর কেউ ছিলনা। তাইলে সিজার অপারেশন করে দিলো কোন ডাক্তারে?

– সিজার ছাড়াই হইছে।

– সিজার ছাড়াই বাচ্চা হয়? আমরা এখানে সবাই সিজার অপারেশন হয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মেছি। আদমের সন্তানরা সিজার ছাড়াই জন্মিল কেমনে?

আমি ভেবাচেকা খেয়ে গল্প বাদ দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলাম

বইটি ঘরে বসে পেতে নিচের ছবির উপর ক্লিক করুন

শৈশবের একাত্তর

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

Haturi Peta

Haturi Peta

হাতুড়ি পেটা

(স্মৃতি কথা)

প্রথম পোস্টিং ছিল বরিশালের চরামদ্দি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে। ১৯৮৮ সনে এক বছর সেখানে ছিলাম। প্রচুর মারামারির রোগী আসতো। তাদেরকে চিকিৎসা করে ইনজুরির সার্টিফিকেটও দিতে হতো। একবার এক রোগী এলো হাতুড়ি পেটা খেয়ে। বিস্তারিত শুনলাম রোগীর কাছ থেকে। ঢাকা থেকে লঞ্চ যোগে তারা আসছিলো বরিশালে। লঞ্চগুলো সাধারণত রাতে যাতায়াত করতো। বরিশালের অনেক যাত্রী রাতের লঞ্চে ঢাকায় গিয়ে দিনের বেলা অফিসের কাজকর্ম বা মার্কেটিং করে আবার রাতের লঞ্চে ফিরে আসতো। প্রায়ই পথিমধ্যে ডাকাতের কবলে পড়তো। এমনি একটা অভিজ্ঞ ডাকাত পার্টি ছিলো হাতুড়ি পেটা করার। গভীর রাতে ফেরার সময় যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো তখন চার পাঁচ জনের অল্প বয়সি ডাকাত পার্টি অতর্কিতে হামলা চালাতো হাতুড়ি দিয়ে। রাইফেল ওয়ালা আনসারের মাথার পেছনে হাতুরি দিয়ে পিটুনি দিলে আনসার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতো। আনসারের রাইফেল কেড়ে নিয়ে লঞ্চের চালকের মাথার উপর তাক করে ধরে রাখতো ঠিকঠাক মতো চালিয়ে নিতে। অন্য ডাকাতরা সামনে যাকে পেতো তাকেই মাথার চান্দিতে হাতুড়ি পেটা করতো। দুই চার জনকে এভাবে মাথায় পিটুনি দিলে অন্য যাত্রীরা ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে মাথা নিচু করে লুকিয়ে উবুত করে বসে থাকতো। আশে পাশে কি হচ্ছে কেউ তা বুঝতে পারতো না। দুই চারজন যাত্রীর মাথায় পিটুনি দিয়ে শত শত যাত্রীকে অকেজো করে রাখতো কয়েকজন ডাকাতে। এ অবস্থায় যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও স্বর্নালংকার কেরে নিতো। কানের অলংকার খুলে না নিয়ে ঝেংটা টান মেরে ছিড়ে নিতো। লুট করা টাকা ও অলংকার পোটলায় ভরে সুবিধাজনক চর এলাকায় লঞ্চ ভিড়িয়ে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যেতো কাঁশবনের ভেতর। এদিকে যাত্রীরা অনেক্ষণ পর্যন্ত মাথা নিচু করেই বসে থাকতো। লঞ্চের চালক এসে তাদেরকে ইনফরমেশন দিতো এই বলে যে ডাকাতরা চলে গেছে আপনারা মাথা তুলুন।

রোগীর মুখে এমন বিভৎস কাহিনী শুনে আমিও আতংকগ্রস্ত ছিলাম। কারণ, আমাকেও মাসে একবার এমন লঞ্চে রাতে আসা-যাওয়া করতে হতো। সরকারি বেতন মাসিক ১৮৫০ টাকা ছিলো। প্রথম চাকরি। প্রথম মাসের টাকা ঠিকই পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় মাস থেকে আমাকে বেতন দেয়া হয় না। আমি ভাঙ্গা একটা ডোয়াপাকা টিনের ঘড়ে থাকতাম। অর্থ অফিসের দাবী ছিলো আমাকে নিয়ম অনুযায়ী ৩৫% বাড়ি ভাড়া কাটতে হবে। আমি ভাঙ্গা ঘরের ভাড়া কাটতে রাজি ছিলাম না। তাই, বেতন বন্ধ ছিলো। ২০ টাকা করে প্রাইভেট রোগী দেখে খাওয়া খরচ করে যা থাকতো তা থেকে বাবার জন্য কিছু টাকা মানি অর্ডার করে পাঠাতাম। আর যা থাকতো তা নিয়ে টাঙ্গাইল বাসায় আসতাম প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে। যাহোক, চার মাস পরে এক সাথে বাড়ি ভাড়া সহ বেতন পেয়েছিলাম। সেই টাকায় বাবার ইচ্ছানুযায়ী বাড়ির পাশের ১২.৫ শতাংশ জমি কিনেছিলাম। লঞ্চে উঠে আতংকে মাথা হাতাতাম কখন এসে ডাকাতরা আমার মাথায় হাতুড়ি পিটায়। তারা তো আর আমি ডাক্তার কি না তা জিজ্ঞেস করে না। তখন, ডাকাতরা ডাক্তার ও পুলিশকে সমিহ করতো।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ময়মনসিংহ

৩০ আগস্ট ২০২২ খ্রি.

#memoryofsadequel

#charamoddisadequel

এমন গল্প আরও পড়তে হ্যাস্ট্যাগ শব্দে ক্লিক করুন।

Khuingar Chala

খুইংগার চালা

গত দুই বছর আগে ইন্দ্রজানী হাট নিয়ে ফেসবুকে একটা গল্প লিখেছিলাম। সে গল্প পড়ে একজন পাঠক আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তাদের খুইংগার চালা নিয়ে একটা গল্প লিখতে। গল্পটা ছিল স্মৃতিচারণমূলক। স্মৃতিচারণমূলক গল্প কেউ লিখতে বললে আমি লিখতে পারি না। আমার মাথায় যখন স্মৃতিচারণ খেলতে থাকে তখন আমি স্মৃতিচারণমূলক গল্প লিখি। তাই খুইংগার চালা নিয়ে এখনো কোনো গল্প লেখা হয় নি আমার। গতকাল দুপুরে খাবার সময় মোবাইলে একটা কল আসে। আমি সাধারণত মোবাইলে খাবার সময় কল ধরি না। মোবাইল স্ক্রিনে ‘নূর-ই-আলম খুইংগার চালা’ নামটা দেখে মোবাইলটা আমি রিসিভ করলাম । কথা শেষে স্বপ্না জিজ্ঞেস করলো

– কে ফোন করেছিল? তুমিতো সাধারণত খাবার সময় ফোন ধর না।

– নূর-ই-আজম ফোন করেছিল। রোগী নিয়ে আসবে।

– নূর-ই-আজম কে?

– খুইংগার চালার।

– খুইংগার চালা? খুইংগার চালা আবার কেমন নাম? খুইংগার মানে কি?

আমি স্বপ্নাকে খুইংগা কথাটার মানে ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম। এরপর থেকে আমার ইচ্ছা হল খুইংগার চালা নিয়ে কিছু একটা লিখি। তাই আজ দুপুরে খাবার পর শুয়ে শুয়ে খুইংগার চালা নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম।

খুইংগার চালা নিয়ে আমার তেমন কোন স্মৃতি নেই। তবে আমি একবার খুইংগার চালায় গিয়েছিলাম । আমার চাচাতো ভাই ইখতিয়ার উদ্দিন (বাশার ভাই)পাকিস্তান আমলে এস এস সি পাশ করে খুইংগার চালা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নেন। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। যেহেতু এটা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে তাই আমাদের দেশের নাম ছিল পাকিস্তান। এই পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ছিল ১৪ ই আগস্ট। আমি স্বাধীনতা দিবস পালন করতে বাশার ভাইর সাথে খুইংগার চালা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে যাই। মাঠটা ছিল অনেক বড়। অনেক খেলাধুলা হয়েছিল সেদিন। ওই বিরাট মাঠে ঘোড়দৌড়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খুবই উপভোগ্য ছিল সেই ঘোড় দৌড়। যে ঘোড়াটি প্রথম স্থান অধিকার করেছিল সেই ঘোড়ার সওয়ার ছিল মাত্র ৭-৮ বছরের একটি ছেলে। ছেলেটির গা ছিল খালি। ভাঁজ করে লুঙ্গি পড়েছিল। আমরা পাহাড়িয়া পোলারা অনেকেউ ভাঁজ করে লুঙ্গি পড়তাম বাইটা বাছ্রার ভয়ে। লুঙ্গির নিচের অংশে মাঠের বাইটা বাছ্রা ছেঁকে ধরতো। তাই হাটু পর্যন্ত ভাঁজ করে লুঙ্গি পড়তে হতো। কিন্তু ওই ছেলেটি বাইটা বাছ্রার ভয়ে লুঙ্গি ভাঁজ করে পরে নি। সে পরেছিল ঘোড়া চালনার সুবিধার্তে। ঘোড়দৌড়ের সময় তাঁর ঘোড়াটি যেন উড়ে উড়ে চলছিল। সে ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছিল। ঘোড়ার পিঠের উপর সে ছুটে ছুটে পড়ছিল। এই সময় তার লুঙ্গি উপর দিকে একবার উড়ছিল আর নামছিল। দর্শকরা দুই কারণে আনন্দ পাচ্ছিল। এক নাম্বার আনন্দ ছিল ঘোড়ার দৌড় দেখার আনন্দ। তুই নাম্বার আনন্দের কারন ছিল বাচ্চাদের জন্য। এটা ছিল ছেলের লুঙ্গি উড়ার আনন্দ। লুঙ্গি উড়ার সময় ছেলেটি বেআব্রু হয়ে যাচ্ছিল। তাই বাচ্চারা আনন্দ পাচ্ছিল। আমিও কিন্তু তখন বাচ্চাই ছিলাম। তাই, আমি দুই কারনে আনন্দ পেয়েছিলাম। আরেকটি আনন্দের খেলা ছিল লাঠিবাড়ি খেলা। খুবই চমৎকার ছিল সেই লাঠিয়ালদের লাঠি বাড়ি খেলা। সারাদিন খেলাধুলার আনন্দ উপভোগ করে রাতে বাশার ভাইর সাথে বাড়িতে ফিরি। আমার সাথে মজিবর ভাইও সেদিন গিয়েছিলেন খুইংগার চালা। সাড়াসিয়া বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলটি যখন সরকারিকরণ করা হয় তখন বাশার ভাই সাড়াসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এটা খুব সম্ভব স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই।

Read more: Khuingar Chala

আপনাদের কিন্তু এখনো খুইংগার কথাটার মানে বোঝানো হয়নি। গাছের ভিতর যদি কোনো কারণে গর্ত থাকে সেটাকে বলা হয় খুং বা খোং। আপনারা বলেন গাছের কোটর। ছোট বেলায় আমরা পড়েছি “আদিম যুগের মানুষ গাছের কোটরে বাস করতো।” সে কোটরকেই আমরা বলতাম খোং। সাধারণত পুরাতন বা বৃদ্ধ গাছে খোং তৈরি হয়। খাঠখোকড়া পাখি ঠুকড়িয়ে গাছে খোং তৈরি করে খোংগের ভিতর বাসা বানায় । গাছের কোন অংশ পঁচে গিয়েও খোং তৈরি হতে পারে। খোং যে কারনেই তৈরি হোক না কেন অনেক প্রকার পাখি এসব খোংগে বাসা বানায়। কাঠঠোকড়া, টিয়া, দোয়েল, ভুতুম পেঁচা ইত্যাদি পাখি খোংগের ভিতর বাসা বানায়। আমি গাছে উঠে খোংগের ভিতর উঁকি দিয়ে পাখির বাসা দেখতাম। ডিম পাড়া থেকে শুরু করে বাচ্চা তোলানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্ব আমি পর্যবেক্ষণ করতাম। কোন পাখির ডিম কত দিনে ফোটে তা আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। গিরিকিটি বা কক্কে সাপও খোংগে থাকতো। আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে একটা অশথ্ব গাছ ছিল। আমরা বলতাম বটগাছ। সেই গাছে অসংখ্য খোং ছিল। সেই খোংগেও অনেক পাখি বাসা করতো। সন্ধায় বড় ভুতুম পাখি ডাকতো “ভুত ভুতুম, ভুতুম।” ছোট ভুতুম পেঁচা ডাকতো “কেচরমেচর” করে। পাখির কাছে গেলে কুতকুতি চেয়ে থেকে ভয় দেখাতো। বেলা ডোবার পর কক্কে সাপ ডেকে উঠতো “কক্কে কক্কে বলে। ” শুনেছি কক্কে সাপের যত বয়স ততবার কক্কে কথাটি উচ্চারণ করে ডাকার সময়। যেমন, যেটার বয়স তিন বছর সেটা ডাকতো তিন বার কক্কে কক্কে কক্কে বলে। একেক কক্কে একেক নির্দিষ্ট সময় দিনে-রাতে মাত্র একবার ডেকে উঠতো।

খোংগের ভিতর মৌমাছিও বাসা বানায়। আমরা বলতাম খুইংগা চাইক (চাক)। এই মৌমাছি আলাদা প্রজাতির মৌমাছি। এরা গাছের ডালে বসে না। এরা চাক বানায় গাছের খোংগে অথবা উলুর টিকরে। উইপোকাকে আমরা বলতাম উলু পোকা। পুরাতন গাছ মাটির উপর বরাবর কেটে ফেললে তার সাথে উইপোকা বাসা বেধেঁ মাটি তুলে ডিবির মতো করে ফেলে। তখন ছোটখাটো পাহারের মতো মনে হয়। এগুলোকে আমরা বলতাম উলুর টিকর। একসময় পাখা গজার পর সব উলু আকাশে উড়ে যেতো। চৈত্র মাসে সন্ধার সময় গজারির মরা পাতায় আগুন দিলে সেই আগুনের উপর উলু ঝাকে ঝাকে উড়ে এসে পড়ে পুড়ে যেতো। তাই বলা হয় “পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার কালে।” উলুও এক প্রকার পীপিলিকা। উলু বাসা ছেড়ে চলে গেলে সেই খোংগে খুইংগা চাক বসত। মনো ভাইদের বাড়ির পিছনের আড়ায় (জংলায়) একটা উলুর টিকর ছিলো। সেই টিকরে প্রতি বছর খুইংগা চাক বসতো। খুইংগা চাকের মৌমাছি সাধারণত কামড়ায় না। আমি খোংগে হাত দিয়ে আসতে করে মৌমাছি চাক থেতে সরিয়ে পাঠশোলা (স্ট্র) দিয়ে টেনে টেনে মধু খেতাম। আমার সাথে একদিন মুকুলও গিয়েছিল মধু খেতে। মৌমাছি কি মনে করে যেনো মুকুলের কঁচি কানের লতিতে হুল ফুটিয়ে বসে। মুকুল আমার চেয়েও তিন বছরের ছোট। মুকুল বিষে কান্না শুরু করে। আমি মুখ চেপে কান্না বন্ধ করে দেই। কারন, মনো ভাই টের পেলে খবর ছিল।

যেসব গাছে বেশি বেশি খোং থাকতো সেসব গাছকে খুইংগা গাছ বলা হতো। যেসব কাঠালের গায়ে গর্ত গর্ত থাকতো সেসব কাঠালকে খুইংগা কাঠাল বলা হতো। আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটা কাঠাল গাছ ছিল। সেই গাছের কাঠাল খুইংগা ছিল। তাই, সেই গাছকে খুইংগা গাছ বলা হতো। খুইংগা হলেও কাঠাল খুব স্বাদের ছিলো।

খুইংগার চালা গ্রামের নাম কেন খুইংগার চালা হয়েছে তা আমার জানা নেই। চালা হলো উচু ভুমি। খুইংগার চালা আমি দেখেছি একটু উচু ভুমি। খুব সম্ভব এই উচু ভুমিতে আগের দিনে অনেক খুইংগা গাছ ছিলো। তাই হয়ত খুইংগার চালা নাম হয়েছে। আপনার কি মনে হয়?

২৮/৩/২০২০ খ্রি.

Salah Uddin

Mawlana Salah Uddin

মাওলানা সালাউদ্দিন

Maolana Salah Uddin

মাওলানা সালাউদ্দিন ছিলেন আমার চাচাতো বোন হেলেনা আপার স্বামী। আরবী লাইনে লেখাপড়া করলেও তিনি বেশ বিজ্ঞান মনস্ক ও সাংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু পরিবারকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তিনি বিয়ের পর জমি জমা কিনে আমাদের গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি নিকাহ রেজিস্ট্রার করতেন। তিনি কাকরাজান ইউনিয়নের বিবাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। বিবাহ রেজিস্ট্রি করাকে ইসলামি পরিভাষায় কাবিননামা বলা হয়। আমরা সংক্ষেপে কাবিন বলতাম। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কাবিন করলে দুলাইভাই বেশী ফি নিতেন। তাই, অনেকেই দুলাভাইর বাড়িতে এসে কাবিন করাতেন। যিনি কাবিন রেজিস্ট্রি করতেন তাকে বলা হয় কাজী। তাই দুলাভাইকে কাজীও বলা হতো। দুলাভাই মারা যাবার পর তার মেজো ছেলে কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পায় এবং কাজীর কাজটাও পায়। এখন তার কাছে কাজীর কাজটা নেই। দুলাভাইর ছোট ছেলে রুহুল আমীনও ঘোনারচালা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। বড় ছেলে আব্দুল হালিম প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করে।

আমি ছোটবেলা থেকেই দেখতাম দুলাভাই কাবিন করেন। তিনি কচুয়া আব্দুল্লাহ স্যারদের বাড়ির জামে মসজিদের শুক্রবার জুম্মায় ইমামতিও করতেন। দুলাভাইর সাথে আমি দু-এক বাড়িতে কাবিন করতেও গিয়েছি। ভালো খাবারও খেয়েছি।

শীতের দিনে তিনি বাহিরবাড়ির ধানিখোলায় খর বিছিয়ে তার তার উপর পিঠের বেতের পাটি বিছিয়ে কাবিন করতে বসতেন। বর ও কনে উভয় পক্ষই আসতেন। তারাও পাটির উপর বসতেন। গ্রামের মানুষ তামাসা দেখতে ভালোবাসে। তাই, যেখানে কয়েকজন লোক একত্র বসত সেখানেই গিয়ে সবাই ভীর করতো। কোথাও দুইপক্ষ ঝগড়া বাঁধালেও সবাই তামসা দেখতে যেতো। একবার গোড়াই থেকে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে, বয়স খুব সম্ভব ১৬-১৭ হবে, হাত ধরে ঘুরাফিরা করছিল কচুয়া হাটের রাস্তায়। শুনলাম তারা একে অপরকে ভালোবেসে, বাবা-মার অমতে বিয়ে করার উদ্যেশে বের হয়ে পড়েছে। লোকে বলত বাইরইয়া পড়ছে। কাজেই তাদেরকে ভিন গ্রামের মানুষ ধরে বিয়ে পড়িয়ে দিত। এই জুটির পিছনে প্রায় ৫০-৬০ জন ছেলে মেয়ে তামসা দেখছিল। আমিও কিছুক্ষণ তামসা দেখলাম।

একবার পশ্চিম দিক থেকে কয়েকজন লোক এসেছিল দুলাভাইর কাছে কাবিন করতে। তাদের বেশভূষা দেখে গরীব মনে হলো। কনেটাকে আমার কাছে অসহায় মনে হলো। বর পক্ষের লোকগুলোকে তেমন সভ্য মনে হলো না। দুলাভাই কাবিন রেজিস্ট্রার খাতায় লিখার পর সরকারি ফি নিয়ে নিলেন। তারপর কনের উদ্দেশ্যে বললেন “অমুকের ছেলে তমুক এত টাকার দেন মোহর সাব্যস্ত করিয়া আপনাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়াছে। আপনি রাজি আছেন?” কনে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কিছুই বললো না। দুলাভাই দ্বিতীয় বার ওকথাগুলো বললেন। কনে অনেকক্ষণ চুপ করেই রইলো ঘোমটা দিয়ে। তৃতীয় বার দুলাভাই বিরক্তির সাথে কথাগুলো বলে ধমকের সুরে উচ্চকণ্ঠে বললেন “রাজি আছেন?” কনে বিস্ফোরিত কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলে উঠল “রাজি আছি।” আমি চমকে গিয়ে খেরের উপর ঢলে পড়লাম। কনে ফিকুরে ফিকুরে কান্না করতে লাগলো। আমি তখন ক্লাস সেভেন না এইটে পড়ি। আমার মনে হলো এটা ঠিক না। জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। দুলাভাই কিছুক্ষণ মেয়েটির কান্না শুনলেন। আমি দুলাভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুলাভাই চুপ করে রইলেন। দুলাভাই বললেন “এ বিয়ে হবে না।” বরপক্ষ বললেন “কনে রাজি আছে বলছে। বিয়ে হয়ে গেছে।” দুলাভাই বললেন “না, হবে না। সমস্যা আছে। কাবিন বাতিল।” মেয়েটি আরও পরিস্কার করে কান্না করতে লাগলো। অনেক কথাকাটাকাটির বরপক্ষ কাবিনের ফি ফেরত চাইল। দুলাভাই বললেন “কাবিনের পাতা খরচ হয়ে গেছে। আমি বই হিসাবে কিনে আনি। ফেরত পাবেন না। আপনাদের বিচার হবে। আপনারা জোর করে মেয়ে বিয়ে করতে নিয়ে এসেছেন। মেয়ে রাজি না। আমার ধমক শুনে রাজি বলেছে। মেম্বার ও পাড়ার মাদবর নিয়ে আসুন। তারপর কাগজ দেয়া হবে।” পরে কি হয়েছিল আমি জানি না।

কাবিননামা শেষ হলে বরের হাতের উপর কনের বাবার হাত রেখে দুলাভাই পাঠ করাতেন কনের বাবাকে “বলুন, আমার কন্যা, মুসাম্মত অমুক খাতুনকে এত টাকা দেন মোহরে আপনার কাছে বিবাহ দিলাম।” দুলাভাই বরকে বলতে বলতেন “আপনি বুলুন, কবুল, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করিলাম।” বর বলতেন “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করিলাম।” দুলাভাই বরের উদ্যেশ্যে বলতেন “আপনার বিবিকে ভরনপোষণ দিবেন, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী চলাফেরা করাবেন এবং পর্দা পুশিদায় রাখবেন। তিন মাসের অধিক কাল নিরুদ্দেশ থাকিলে, পাগল কিংবা কারাগারাবদ্ধ হইলে বিবি আপনাকে তালাক দিতে পারিবেন। খাতা বন্ধ করলে বরপক্ষ সবাইকে খাজা বাতাসা ও কদমা খাওয়াইত। আমার কাছে সাদা কদমা খুব মজা লাগতো।

আমাদের গ্রামে একজন গরীব লোক ছিল। নিজের জমি ছিলো না। খুব আলসে ছিল। বোকাও ছিল। তার নাম লিখলাম না। ছদ্মনাম দিলাম হামজা। হামজা ভাই মাঝে মাঝে বোকার মতো কথা বলতেন। কেউ বোকার মতো কথা বললে আমরা বলতাম ” তুই অবা হামজা ভাইর নাগাল কথা কস ক্যা?” চৈত্র মাসে অথবা যে মাসে কোন কাজ থাকত না সেই মাসে হামজা ভাই খাবেন কী। কামলা দিলে যা টাকা পাওয়া যেতো সেই টাকা দিয়ে হামজা ভাই চাউল ও আটা কিনে খেতেন। মানে, দিন এনে দিন খেতেন। একদিন কামলা না দিলে না খেয়ে থাকতে হতো তার স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ। হামজা ভাইর বউ পরের ধান ভেনে অল্প কিছু চাউল পেতেন। আঁচলে করে আনতেন। শরীর খুব দুর্বল ছিল অল্প খেয়ে খেয়ে। তাই, ঢেকিতেও তেমন বল করে পার দিতে পারতেন না। যেদিন কামলা দিতে না পারতেন সেদিন হামজা ধনি বাড়ি থেকে এক কামলার দাম নিতেন। সেই টাকায় কাজের সময় তিনি কামলা দিয়ে পরিশোধ করতেন। মৌসুমের সময় কামলার দাম দুইগুন তিনগুন হলেও তিনি তা নিতে পারতেন না। যেহেতু তিনি অগ্রিম টাকা নিয়ে নিয়েছেন। অগ্রিম টাকা নিয়ে মৌসুমের সময় কামলা দিলে তাকে বলা হয় ঠুকা কামলা। হামজা ভাই ছোটদের মতো সামনে ভাজ করে লুঙ্গি পরতেন। তাই, আরও বোধাই বোধাই দেখা যেতো। কম বয়সেই তিনজন সন্তান রেখে হামজা ভাইর স্ত্রী মারা যান।

গ্রামে গরীব পরিবার স্ত্রী ছাড়া চলতে পারে না। তাই, হামজা ভাই আরেকটি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বিয়ের কাবিনের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। হামজা ভাই কিস্তিটুপি পাতালি করে পরেছিলেন। তাতে আরও বোধাই বোধাই লাগছিলো। যথারীতি কাবিন সম্পাদন করে হামজা ভাইর হাত ধরলেন তার শশুর। কাজী বলতে বললেন “বলুন, আমার কন্যা।” হামজা ভাইর শশুরে বলার কথা। ভুলক্রমে হামজা ভাই বলে ফেললেন “আমার কন্যা।” দুলাভাই ধমক দিয়ে বললেন “এই বোধাই, কারে কী কয়।” আমি ও মজি ভাই হাসতে হাসতে খেরের উপর লুটিয়ে পড়লাম।

২২/৪/২০২২ খ্রি.
ময়মনসিংহ