Tag Archives: Bed Bug

chharpoka

ছাড়পোকা

Chharpoka / Bed Bug

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ছাড়পোকার সাথে শেষ সাক্ষাৎ কবে, কোন সনে হয়েছিলো তা মনে করতে পারছি না। আপনার মনে আছে? ছাড়পোকাকে আমরা বলতাম উরুশ। উরুশ দেখতে তেলাপোকার বাচ্চার মতো লালচে, পাখা নেই। লম্বায় ২ থেকে ৭ মিলিমিটার। এরা চোরা কিসিমের পোকা। অন্ধকারে চিপা-চোপার ভিতর লুকিয়ে থাকতো।

গ্রামে আমরা বেশিরভাগই কাঠের চৌকিতে বেতের পাটি বিছিয়ে শুতাম। চৌকির তক্তার চিপায় ও পাটির বুননের চিপায় এই চোরারা লুকিয়ে থাকতো। লেপ-তোষক ও কাথা-বালিশের ভাজের ভিতরেও এরা লুকিয়ে থাকতো। কাঠের চেয়ার-টেবিলের চিপায়ও এরা লুকিয়ে থাকতো। রাতেরবেলা চোরের মতো এরা বেরিয়ে আসতো। ঘারের নিচে, পিঠের কিনারে এরা আসতে করে কামড়ে দিয়ে রক্ত পান করতো। মানুষের রক্তই ছিল এদের প্রধান খাদ্য। সারাদিন পরিশ্রম করে মানুষ রাতে আরাম করে ঘুমাবার চেষ্টা করতো। এই সময় এই চোরারা কামড়ানো শুরু করতো। কামড় খেয়ে মানুষ উ আ করে এপাশ ওপাশ করে ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তো। জ্যৈষ্ঠ মাসের ঘরমের দিনে একবার এক আত্মীয় বাড়ি গিয়ে রাতে বিপদে পড়েছিলাম। তোষকের নিচ থেকে ছাড়পোকারা এসে ঘারের নিচে কামড়াতে লাগলো। উঠে মশারির নিচে খাটের খারা তক্তার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলাম। ওমা, চোরারা পিঠে কামড়াতে লাগলো। লাফ দিয়ে গিয়ে খাটের মাঝখানে বসে রইলাম। একটু বাচা গেলো। কিন্তু ঘুমের চোটে আর বসে থাকা গেলো না। এদিকে গরম ধরলো প্রচুর। হাতপাখাটা হাতে নিয়ে বাহিরবাড়িতে গিয়ে ধানের আটির উপর বসলাম। এবার শুরু হলো মশার আক্রমণ। একবার ডান ঠ্যাংগে থাপ্পড় মারি, একবার বাম ঠ্যাংগে থাপ্পড় মারি, একবার ডান গালে মারি, একবার বাম গালে মারি, মাঝে মাঝে ডলা মারি রক্তচোষা মশার উপর। পরে কিভাবে রাত কাটিয়েছিলাম তা মনে করতে পারছি না। সব কথা মনে থাকে না।

টাংগাইল গিয়ে হলে বসে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা হলে রাত দিন ২৪ ঘন্টাই অন্ধকার থাকতো। তাই, সিনেমা হল ছিলো ছাড়পোকাদের অভয়ারণ্য। হলের কাঠের চেয়ারের ফাক ফোকও বেশি ছিলো। দর্শকরা মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতো। সেই সুযোগে চোরারা ইচ্ছামত কামড়াতো। সিনেমা শেষে পাছা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ি ফিরতো।

একবার এক ভদ্রমহিলাকে বসতে দিয়েছিলাম বেতের চেয়ারে। গল্প করার সময় মহিলা একবার ডানে কাত হন, একবার বামে কাত হন, একবার ডান চোখ ছোট করেন, একবার বাম চোখ ছোট করেন এবং একবার ঠোঁট শীশ দেয়ার মতো করে গোল করেন। আমি বুঝতে পারলাম ছাড়পোকার প্রতিটা কামড়ের সাথে তার এই অঙ্গভঙ্গি চলছে। করার কিছু নাই। বাসায় ফিরে তিনি এর চুলকানিটা বুঝবেন।

ছাড়পোকা মারার দৃশ্যগুলো ছিলো অপুর্ব। বাশের খরকি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র ও বিছানাপত্রের চিপা থেকে ছাড়পোকা বের করে পিঠের উপর চাপ দিয়ে ঠাস করে ফাটিয়ে ছাড়পোকা মারা হতো। একটা দুর্গন্ধ বের হতো উরুশের পেট থেকে। ওটার নামই ছিলো উরুশের গন্ধ। শীতকালে সকাল ১০/১১ টার সময় সব চৌকি উঠানে খারা করে রৌদ্রে দেয়া হতো । গরম পেয়ে সব উরুশ চিপা থেকে বের হয়ে আসতো। কুপি বাতির আগুন দিয়ে ছেকা দিলে ফটাশ করে ফুটে উরুশ মারা যেতো। এর ধুয়ার সাথেও উরুশের গন্ধ বের হতো। উঠোনে পাটি বিছিয়ে বালিশ লেপ কাথা রৌদ্রে দেয়া হতো। গরম পেয়ে উরুশ উঠোনের উপর দিয়ে হাটা ধরতো। পায়ের বুইড়া আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে দিয়ে ঠাসঠাসি উরুশ মারা হতো। বর্ষাকালে চৌকি পুকুরের পানিতে দুই তিন দিন ডুবিয়ে রাখলে উরুশ ফাফর হয়েই মারা যেতো।

গল্পটা লিখছিলাম প্রাইভেট কারে বসে লং জার্নিতে মোবাইল ফোনের নোটপ্যাডে। কিন্তু কবে থেকে দেশে ছাড়পোকা নেই সেটা মনে করতে পারছিলাম না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কি বলতে পারবেন কবে থেকে দেশে ছাড়পোকা নেই?” তিনি উত্তর দিলেন “খুব সম্ভব এরশাদ সাবের আমল থেকে।” আপনার কাছে কি মনে হয়?

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ময়মনসিংহ- কচুয়া জার্নিতে

#memoryofsadequel

বইটি ঘরে বসে পেতে নিচের ছবির উপর ক্লিক করুন

স্মৃতির পাতা থেকে

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার