আমাদের ফার্স্ট বয় দীপক
দীপক। দীপক কুমার ধর। ডা. দীপক কুমার ধর। ডক্টর দীপক কুমার ধর, পিএইচডি। আমাদের এমবিবিএস ক্লাসে সব পরীক্ষায় যে ফার্স্ট হতো তার কথা মনে পড়ছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফার্স্টবয় মানে হলো অত্যন্ত মেধাবী। আমাদের সময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের গুরত্ব ছিল ঢাকার পরেই । বড় বড় নাম করা চিকিৎসক এই কলেজ থেকেই বেরিয়েছে। আমরা ছিলাম ১৭ নাম্বার ব্যাচের। বলা হয় এম-১৭। আমাদের আগের এম-১৬ নাম্বার ব্যাচের ফার্স্টবয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল স্যার ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তী শিক্ষক। অনেকগুলি পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রী তিনি অর্জন করেছিলেন। খ্যাতির চুরান্ত সীমায় পৌছে অল্প বয়সেই ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। হিসাব করলে দেখা যাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অনেক মেধাবী ছাত্র পরবর্তীতে চিকিৎসক হয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। এই মেডিকেল কলেজে শুধু চিকিৎসা শিক্ষাই চর্চা হতো না, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপেও এখানকার ছাত্ররা বেশ পারদর্শী ছিল। এখানকার ছাত্ররা বাংলাদেশ রেডিও ও টেলিভিশনে অনেকেই ভালো পারফর্ম করে থাকে। অনেকেই ভালো কবি সাহিত্যিক। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বেশ উর্বর। সরকারি দলেরই হোক আর বিরোধী দলের পক্ষেরই হোক, এই কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক নেতারাই মুলত বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। শুধু দেশেই না, বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা ডাক্তার হয়ে রাজনীতি করে এম পি মিনিস্টার হয়ে গেছেন। ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ লোটে শেরিন এম-২৮ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দর্জিও এম-২৪ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে খোদ বাংলাদেশেরই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান এম পি এম-৩০ ব্যাচের আমার ছাত্র ছিলেন। আমি আরো স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি অচিরেই আরো অনেকে এম পি মন্ত্রী হবেন প্রাক্তন এমএমসিয়ানদের থেকে। এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একজন ফার্স্ট বয় ছিল আমাদের দীপক।
দীপককে আমি প্রথম চিনলাম তার এনাটমি কার্ডে বেশী বেশী মার্ক পাওয়ার জন্য। সব সময় সে সবার থেকে বেশী মার্ক পেতো কার্ড পরীক্ষায়। আরেকটা বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করলো। সেটা হলো তার সুন্দর ঝড়ঝড়ে হাতের লেখা। একবার সদর উদ্দিন এক বড় ভাইকে দেখিয়ে বলল “ইনি ফাইনাল ইয়ারের ফার্স্ট বয়। প্লেস করা ছাত্র। আমাদের ক্লাসের দীপকের বড় ভাই দীলিপ কুমার ধর ।” দুইজনই তুখুর ছাত্র। সেই দীলিপ দা এখন অবসর নিয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে। তিনি সেই মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছিলেন। বেশ কিছুকাল তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আমিও প্রায় ১৪ বছর এই মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করেছি। দীপকের ক্লাসমেট হিসাবে আমাকে বেশ স্নেহ করতেন তিনি। ক্লিনিক্যাল সেমিনারগুলিতে দীলিপ দা বেশ বিজ্ঞ ভুমিকায় অংশ গ্রহণ করতেন। তার উপস্থিতিতে সেমিনার সমৃদ্ধ হতো।
দীপক আর আমি বাঘমারার হোস্টেলের একই বিল্ডিং-এ ছিলাম প্রায় ৫ টি বছর। বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন সময় থাকলেও শেষের দিকে আমরা একই ফ্লোরে কাছাকাছি ছিলাম। দুই জনের কক্ষ দুই পাশে ছিলো। মাঝখানে ছিল ৩/৪ টি কক্ষ । তার রুমের সামনে একটা ফাকা যায়গা ছিলো। সেখানে একটি ভাংগা টেবিল ছিলো। শীতের দিনে সেখানে বসে আমরা গল্প করতাম। পড়া নিয়েও করতাম, পড়া ছাড়াও করতাম। তখন আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। দীপক কি যেন এক সিনেমা দেখেছিলো যেটা আমি দেখি নি। সেই সিনেমা দেখার পর সে আমাকে দেখেই বলতো “তালুকদার বানগিয়া।” আমি বললাম “কি সব বলছো, তালুকদার বানগিয়া।” সে বললো “আমরা একটা সিনেমা দেখেছি সেখানে নায়িকা শাবানা সুইপারের অভিনয় করে। ভিলেন খুবই পাঁজি একজন তালুকদার। শাবানার কমন একটা ডায়ালগ ছিলো তালুকদারকে উদ্যেশ্য করে “তালুকদার বানগিয়া।” তালুকদারটা পাঁজিও ছিলো। হায়রে পাঁজি! তোমাদের পুর্বপুরূষ তো তালুকদারি করেছে। তারাও কি এমন পাঁজি ছিলো?” এইভাবে কত গল্প করে সময় কাটিয়েছি দীপকের সাথে। দীপক হালকা গিটার বাজাতে পারতো। পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তো তখন সে সেই খালি জায়গায় বসে গিটারে সুর বাজাতো। গিটারের টুংটাং সুর শুনে আমিও আকৃষ্ট হয়ে তার কাছে এসে বসতাম। সে বলতো “সাদেইক্কা, নাক বাজাও।” আমি নাক দিয়ে মিউজিক বাজাতে পারতাম। কেউ না দেখলে সেই মিউজিককে গিটার অথবা সাঁনাইয়ের মিউজিক মনে করতো। এই নাক আমি স্কুল কলেজে অনুষ্ঠানে অনেকবার বাজিয়েছি। পুরস্কারও পেয়েছি। এখনো পুরনো বন্ধুরা অনেকদিন পর দেখা হলে বলে “আরে, নাকের বাঁশী, কেমন আছো?”
দীপক গিটার বাজাতো। গিটারের ফাকে ফাকে গিটারের সুরে আমি নাক বাজাতাম। জমতো ভালো। দীপককে শুধু একটি গানই বারবার গাইতে ও বাজাতে শুনেছি। রবীন্দ্রসংগীত। গানটির সম্পুর্ন কখনো গাইতে বা বাজাতে তাকে শুনি নি। হয়তো প্রথম লাইন একবার, দুইবার, তিনবার বা কয়েকবার গাইলো। পরে শেষের অংশ কয়েকবার অথবা মাঝের অংশ কয়েকবার গাইলো। গাইতো কিন্তু নিচু স্বরে। দূর থেকে শুধু গিটারই শুনা যেতো।
একবার গাইতো
“দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে
আমার বাটে বটের ছায়ায়
সারা বেলা গেলো খেলে
আ আ আ আ হা আ…..।।। ”
কিছুক্ষণ বাজিয়ে আবার হয়তো গাইলো
“গাইলো কি গান
সেই তা জানে
সূর বাজে তার আমার প্রাণে।
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে।।
আ আ আ আ হা আ।।”
কিছুক্ষণ আমি বাজানোর পর ও হয়তো গাইলো
“আমি যবে জিগাই তারে
কি তোমারে দেবো আনি?
সে শুধু কয় আর কিছু নয়
তোমার গলার মালা খানি।
দেই যদি তো, কি দাম দেবে?
যায় বেলা সেই ভাবনা ভেবে।
ফিরে এসে দেখি ধুলায়
বাঁশীটি তার গেছে ফেলে। ”
আমি শুনতে শুনতে কল্পনা করতাম “রবি ঠাকুর কাছারির বেলকনিতে বসে বসে গল্প-কবিতা লিখছেন। কাছারির পাশের বটের ছায়ায় বসে গ্রামের রাখাল বাঁশী বাজাচ্ছে রাখালিয়া সূরে, যেমনটি আমি কৈশোরে শুনতাম আমাদের গ্রামে বটের তলায় অথবা জয়না গাছের গোড়ায়। অথবা পলাশতলীর হিজল তমালের নিচে। আমার সেই রাখালির সূর প্রাণে বাজতো। রবি বাবু সেই সূরের কথা কিছু বুঝতে পারতেন না। কিন্তু সেই সূর তার কানে বাজতো। যেমন বাজে আমার প্রাণে। কল্পনায় রবি বাবু বাঁশীটি চেয়েছিলেন, বিনিময়ে সে তার গলার মালাটি চেয়েছিলো। ভাবতে ভাবতে বেলা শেষ। শেষে দেখা গেলো বাঁশীটা সে ধুলায় ফেলে গেছে।” এইসব ভাবতাম গান শুনে। একসময় রুমে গিয়ে আবার পড়া শুরু করতাম মেডিসিন, সার্জারি , গাইনি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে দোতলা থেকে স্বপন, নজরুলরাও এসে যোগ দিতো আমাদের সাথে। তখন গান বাদ দিয়ে নাটক, সিনেমা ও উপন্যাস নিয়ে আলাপ হতো। স্বপন ছিল প্রথম দিকে আমাদের মধ্যে থার্ডবয়। শেষের দিকে সে সেকেন্ড ছিলো। ডা. মিজানুর রহমান স্বপন। এমবিবিএস পাস করেই মেডিসিনে এফসিপিএস করেছিলো। পরে কার্ডিওলজিতে এম ডি করেছে। সে এখন খুলনায় আছে। স্বপনের বৈশিষ্ট্য ছিল সে সব সময় শুয়ে শুয়ে পড়তো, খুব বিনোদনমুলক ম্যাগাজিন পড়তো এবং কিছু আনন্দের সংবাদ শুনলেই বলতো “দোস্তো, চলো তাইলে প্রেস ক্লাবে বিরিয়ানি খাই।” স্বপন সব পরীক্ষায়ই ঢাকা ইউনিভারসিটিতে প্লেস করেছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হয়। আমাদের সময় ৪ টি প্রফেশনাল পরীক্ষা ছিলো এমবিবিএস কোর্সে। মেধা তালিকায় প্রথম ১০ জনকে প্লেস দেয়া হয় রেজাল্টে। স্বপন ও দীপক সবগুলিতেই প্লেস করেছিলো। কোন বিষয়ে ৮০% বা তার উপরে নম্বর পেলে অনার্স মার্ক বলা হয়। দীপক, জামিল, স্বপন ওরা অনেকবার অনার্স মার্ক পেয়েছে। শেষ পরীক্ষায় প্রয়াত নাজমা গাইনিতে অনার্স মার্ক পেয়েছিলো। প্লেস পেয়েছিলো কি না জানি না। আরো কেউ প্লেস বা অনার্স পেয়েছিলো কিনা এখন আমি মনে করতে পারছি না।
জামিল ছিলো প্রথম দিকে সেকেন্ড বয়। প্লেস করতো এবং অনার্স মার্ক পেতো। ডা. হোসাইন লিসান জামিল। ক্লাসে (মরহুম) প্রফেসর আব্দুল হক স্যার প্রায়ই পড়া ধরতেন “এই, লিসান জামিল কই, লিসান বলো।” যেমনটি আমি বলে থাকি “এই মোশারফ বলো।” অথবা বলে থাকতাম “এই বাশার বলো”, “এই সাব্বির বলো”, “এই জ্যোতি বলো”, “এই সালমান বলো”, “এই লাইজু বলো” ইত্যাদি। জামিল পাস করেই কানাডা প্রবাসী হয়। আর তার সাথে দেখা হয় নি আমার। তবে কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছি।
১৯৮৫ সনের নভেম্বরে এমবিবিএস পাস করে ১৯৮৬ সনের নভেম্বরে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে আমরা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ি। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না। তাই প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমরা। আমাদের আগ পর্যন্ত যারা পাস করেছে তাদেরকে সরকার সাথে সাথে চাকরি দিয়েছে। আমাদের সময় থেকে সরকার সাথে সাথে চাকরি দিতে অপারগ হলো। বিচ্ছিন্ন ভাবে আন্দোলন করে কিছুই করা গেল না প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত। শেষে সারা দেশে দুর্বার আন্দোলন করে সব বেকার ডাক্তার এডহক ভিত্তিতে মেডিকেল অফিসার হিসাবে সরকারী চাকরি পেলাম। এদিকে এই দেড় বছরে অনেকে হতাস হয়ে অথবা ভালো ক্যারিয়ারের অথবা সুখে থাকার জন্য অথবা নিরাপদে থাকার জন্য দেশ ত্যাগ করে ইউকে, ইউএসএ, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমাল। আমি ছিলাম ঘর কোণো মানুষ। আমি এসবের চিন্তাও করতে পাড়ি নি। ইনসার্ভিস ট্রেইনিং করার সময় একটা বেতন পেতাম। সেই বেতন থেকে বাবাকেও কিছু দিতাম। মহা সংকটে পড়ে গেলাম বেকার হয়ে। এখন তো বাবার কাছে টাকা চাওয়া যাবে না। কি করব ভাবছিলাম। ঘাটাইলের কদমতলীর কাছে ছিলো আমার শশুর বাড়ী। কদমতলী বাজারে ফার্মাসিস্ট নজরুল ভাইর একটা ফার্মেসী ছিলো। তিনি অনুরোধ করে আমাকে বসালেন প্রেক্টিস করতে। ভালোই জমছিলো। কিন্তু ইচ্ছে হলো শহরে কিছু করার। তাই, একদিন কাজের সন্ধানে বের হলাম। প্রথমে গেলাম টাঙ্গাইলে এনজিও পরিবার পরিকল্পনা সমিতি হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার ব্যাচের অন্য মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা এক মেডিকেল অফিসার। তিনি ছিলেন দিনাজপুরের বর্তমান বিএমএ লিডার ডা. আহাদ ভাই। আলাপ করে বুঝলাম এখানে চাকরি নেয়া সম্ভব না। পাশেই ছিল আকুর টাকুর পাড়ায় এক মাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল নাহার নার্সিং হোম। সেখান থেকে জানিয়ে দিলেন পোস্ট খালি নেই। বায়োডাটা জমা দিয়ে যেতে বলায় একটা বায়োডাটা জমা দিয়ে চলে গেলাম মীর্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে। দেখলাম ওখানে আমাদের এম -১৭ এর ডা. সেবাব্রত ও ডা. সফি চাকরি করছে। শুনলাম যে ডা. দীপকও আছে এখানে। ঐসময় দীপকের ডিউটি না থাকায় দেখা হলো না তার সাথে। জানতে পেলাম এখানে চাকরিতে প্রবেশ করা সম্ভব না। প্রথম দিকে যোগাযোগ করার প্রয়োজন ছিলো। আফসোস নিয়ে ফিরে এলাম। ধুমছে প্রেক্টিস করলাম কদমতলীতে। দুই আড়াই মাস পর নাহার নার্সিং হোমের পরিচালক খোকা ভাই এলেন আমার কদমতলীর চেম্বারে। রোগীর ভীর দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে নিয়ে মেডিকেল অফিসারের চাকরি দিলেন। থাকার জন্য বাসা দিলেন। চাকরির পাশাপাশি বটতলায় প্রাইভেট প্রেক্টিশও করতাম। কিছুদিন পর হাসপাতালের মালিক মোয়াজ্জম হোসেন ফারুখ ভাই কাজে মুগ্ধ হয়ে আমাকে মেডিকেল ডাইরেক্টর বানিয়ে দিলেন। ১৯৮৮ সনে জুলাই মাসে সরকারি চাকরি হবার আগ পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। এক বছর বরিশালে বাকেরগঞ্জের চরামদ্দি গ্রামের সাব সেন্টারে চাকরি করেছি, আড়াই বছর নকলা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে চাকরি করে দেড় বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি করে ঢাকার শাহবাগের তদানিন্তন আইপিজিএমআর-এ এম ফিল (প্যাথলজি) কোর্স করছিলাম। এত দিনে অনেক ক্লাসমেটদেরকে ভুলতে বসেছি। বেশীভাগের সাথে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং-এর পর আর দেখা হয় নি। ১৯৯৪ কি ৯৫ সন হবে। খুব দ্রুত বেগে পিজিতে ক্লাস করতে যাচ্ছি। হঠাৎ ক্যাম্পাসের বটতলায় দীপক সামনে পড়লো। বললো
– কি, সাদেইক্কা না?
– কি, দীপইক্কা না? কই থাকো? কই থেকে এলে? কেমন আছো? সেই ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে আলাদা হলাম, নয় দশ বছর হয়ে গেলো। কেউ কারো খবর নিলাম না। আমি ক্লাসে ঢুকব, বল তাড়াতাড়ি, কি খবর?
– আমি তো কুমুদিনী হাসপাতালে প্রথম ছিলাম। ওখান থেকে মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান যাই। ওখান থেকে এমডি ও পিএইসডি করে একটি হাসপাতালে চাকরি করছি। এখানে এসেছি একটা প্রজেক্ট-এর আন্ডারে লেপারোস্কোপির উপর একটা ট্রেইনিং দেওয়াতে। আমারও সময় নেই, দোস্তো। দেখা হবে।
দীপক মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে জাপান গিয়েছিলো। আমি কোন বসুই চিনতাম না। চিনলে হয়তো আমিও স্কলারশিপ নিয়ে জাপান যেতাম। না গিয়ে ভালো করেছি, না মন্দ করেছি, সে হিসাব এখন করছি।
তারপর অনেকদিন কেউ কারো খোজ নেই নি। এম ফিল পাস করে আমি ১৯৯৬ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ফিরে এলাম প্রভাষক পদে। ১৯৯৮ সনের মে মাসে সহকারী অধ্যাপকের পদ পেলাম। আমি এই ২১ বছর বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে এই সহকারী অধ্যাপক (প্যাথলজি) হিসাবেই আছি। ১৯৯৯ সন থেকে ইন্টার্নেট সংযোগ পাওয়ায় দীপকের সাথে আমার রেগুলার ইমেইলে যোগাযোগ হতে থাকে। ২০০২ সনের দিকে হঠাৎ দীপক ঢাকায় এসে মোবাইল করে। সে ময়মনসিংহ এসে সবার সাথে দেখা করবে বলে আমাকে যোগাযোগ করতে বলে। সে দীলিপদার বাসায় উঠে বউ বাচ্চা নিয়ে। সকালে আমার সাথে দেখা করে। সে আমার জন্য জাপান থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে আসে। বলে “আমি জানি, তুমি যেরকম ডিজিটাল হয়ে গেছো তোমার জন্য এখন ডিজিটাল ক্যামেরা দরকার।” আমি তাকে অশেষ ধন্যবাদ দিলাম। আমাদের মার্কেটগুলোতে তখন ডিজিটাল ক্যামেরার বেশ দাম ছিলো। মোবাইলে ক্যামেরা ছিলো না।
অফিস টাইমে দীপককে নিয়ে ঘুরলাম কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসে। ঘুরতে ঘুরতে জাপানের কালচার জানা হলো তার থেকে। জানা হলো জাপানে তাদের লাইফ স্টাইল। আরাম আছে প্রচুর। নিরাপত্তা আছে । নানান বিষয়ে যেগুলোতে আমার জানার আগ্রহ ছিল তা নিয়ে দীপকের সাথে হাটতে হাটতে জেনে নিলাম। সবার সাথে তো সব কথা নিয়ে আলাপ করা যায় না! বিএমএ অফিসে গিয়ে বসলাম। ওখানে দশ-বারোজন বসে গল্প করলাম। এম-১৭ ব্যাচের হাফিজ উদ্দিন রতন প্রবেশ করলো। দীপককে ইশারা দিলাম কিছু না বলতে। রতন বসে বসে অনেক্ষণ কথা বললো আর দীপকের দিকে আড়চোখে তাকালো। একসময় আমি বললাম “রতন, ওরকম আড়চোখে তাকাও কেন? মেহমানকে চিনেছো?” রতন বললো “আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেনো দেখেছি!” সবাই এক যোগে হেসে দিলো। আমি বললাম “আরে ব্যাটা, এটা দীপক।” রতন “আরে ব্যাটা, দীপক?” বলে জড়িয়ে ধরলো দীপককে। বললো “এরকম ফ্রেন্স কাটিং দাড়ি রাখছো বইলাই চিনতে পারি নি।” তারপর চললো আমাদের হৈ হল্লা। সিদ্ধান্ত হলো সন্ধায় আমরা দীপকের আগমন উপলক্ষে ইয়াংকিং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট-এ একটা পার্টি দেব এম-১৭ ব্যাচ ও তাদের ফ্যামিলি নিয়ে। আমি সবাইকে মোবাইলে ইনফর্ম করলাম, কারন আমার কাছে সবার নাম্বার ছিলো। সন্ধায় ২১ জন ব্যাচমেট সহ ৫৩ জনের একটা পার্টি হলো চাইনিজ রেস্তোরায়। দীপক বউ-বাচ্চা সাথে নিয়ে এসেছিলো। বেশ আনন্দ হলো আমাদের মধ্যে। দীপকের বাচ্চাদেরকে দেখলাম আঙ্গিনায় খেলছে। তারা নিজেদের মধ্যে জাপানী ভাষায় কথা বলছে খেলার সময়। পার্টি শেষে ফটোসেসন করে যার যার বাসায় ফিরলাম। একদিন পর গজনীতে ময়মনসিংহ বিএমএ-র পক্ষ থেকে পিকনিক ছিলো। আমি দীপককে অনুরোধ করে নিয়ে গেলাম। দীপকের ফ্যামিলি কোন কারনবশত যেতে পারলো না। আমার মেয়ের পরীক্ষা থাকার জন্য আমার ফ্যামিলিও নিতে পারলাম না পিকনিকে। ফলে আমি সারাদিন দীপককে সময় দিতে পারলাম। দীপকও আমাকে সারাদিন সময় দিতে পারলো। কত রকম আলাপ যে করলাম! দীপক জানালো যে পৃথিবীতে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় জাপানে। সেই অপারেশনে ৯ জন সার্জন অংশ গ্রহন করেন। তাদের মধ্যে দীপক একজন। তার বেশ কিছু ইন্টার্ন্যাশনাল পাবলিকেশন আছে। সে জানালো। আরো জানালো যে সে বড় বড় দামী জার্নালের অনলাইন রিভিউয়ার। বাংলাদেশে বসেও সে আর্টিকেল রিভিউয়ের কাজ করছে। আমি জানালাম যে আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ জার্নাল চেষ্টা করে প্রফেসর শাহ আব্দুল লতিফ স্যারের সহোযোগিতায় পাবমেডে ইন্ডেক্স করিয়েছি। এবং এটার ইন্টারনেট ভার্সন আমি সম্পাদনা করি। তখনি আমার প্রায় ৫০ টির মতো পাব্লিকেশন ছিলো। আমার পারফর্মেন্স শুনে সে মুগ্ধ হলো। সারাদিন আমাদের পিকনিকের হৈ হল্লা দেখে সে আবেগে আপ্লুত হলো। আমার হাত ধরে বললো
– সাদেক, তোমাদের এই আনন্দের পরিবেশ দেখে সত্যি ভালো লাগছে। আমার জাপানে থাকতে ভালো লাগছে না। যতোই সুখ থাকুক। ওটা আমার দেশ না। ঐ কালচারে বাচ্চারা থাকবে এটা আমি চাই না। আমাকে এখনই সরে আসতে হবে জাপান থেকে।
– তুমি কি আসলেই ফিরে আসতে চাচ্ছ?
– রিয়েলি বলছি। আমি যদি বাংলাদেশে নাও ফিরতে পারি তবে ইউকে অথবা ইউএসএ-তে চলে যাবো। জাপানে থাকবো না। সাদেক, তুমি আমাকে বিএসএমএমইউ-তে ঢোকার একটা ব্যাবস্থা করে দাও। যদি না পারো সিবিএমসি অথবা অন্য কোন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে এলেও ক্ষতি নাই।
– ঠিক আছে, যাকে ধরলে কাজ হবে তাকে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি চেষ্টা করলে ঢুকতে পারবে।
আমি তাকে বুঝিয়ে দিলাম কাকে ধরলে তার কাজটা হবে।
কয়েকবছর পর দীপক আবার ময়মনসিংহ এলো অল্প সময়ের জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে ফিরে আসা হলো না কেন। সে বললো “আমি অনেক চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে ঢোকার জন্য। তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে। ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট কাটতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে আমি সিএনজি অটোরিক্সায় করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার দুই পাশ থেকে দুইজন লোক উঠে চাকুর মাথা দেখিয়ে ভয় দেখিয়ে চোখে মরিচের গুড়া ঘষে দিলো। আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছিলো। কিছুই দেখতে পেলাম না। রিক্সা আমাকে নিয়ে ঘুরতে থাকলো আর ওরা আমার পকেটে যা ছিলো সব নিয়ে একসময় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে গেলো। আমি রাস্তায় পড়ে অন্ধ মানুষের মতো সাহায্য চাইলাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। রাস্তার মানুষ আমাকে রিক্সায় তুলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো। সেখানে আমার চিকিৎসা হয়। দেশের জন্য যে টুকু টান ছিলো চোখে মরিচ ডলা খেয়ে তাও চলে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ইউকেতে সেটল্ড হবো।”
তারপর ধীর্ঘদিন তার খবর নেই নি। একসময় জানলাম যে সে ইউকে-তে থাকা শুরু করেছে। তার টেলিফোন নাম্বার নেয়া হয় নি। যোগাযোগ করাও হয় নি। গত দুবছর আগে জানতে পারি দীপকের পরিবার ইউকেতে থাকে। কিন্তু দীপক চাকরি করে সৌদিআরব। শুনে আমার কাছে বেখাপ্পা মনে হলো। শুনলাম সৌদি থেকে দীপক তেমন যোগাযোগ রাখেনা বন্ধুদের সাথে। তার ফেইসবুকও নেই। গত বছর এম-১৭ ব্যাচের লিটনের নিকট থেকে জানতে পেলাম দীপক সৌদি থেকে ঢাকায় এসেছিলো অসুস্থ মাকে দেখতে। কিন্তু ঢাকায় এসে তার স্ট্রোক হয়ে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলে। বন্ধুদেরকে চিনতে পারেনা। অসংলগ্ন কথা বলে। লন্ডন থেকে তার স্ত্রী এসে দীপককে নিয়ে যায়, যেন তারা তাদের কাছে থেকে সেবা পায়। বাংলাদেশে রাখতে তারা নিরাপদ বোধ করছে না। শুনে মনটা আমার খারাপ হয়ে যায়। আর কি দীপকের সাথে কথা বলা যাবে না? ফোন করলে কি আমাকে কোনদিন চিনবে না? আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
গত ৭ই ফেব্রুয়ারি বৃ্হস্পতিবার সকাল থেকে দীপককে খুব মনে পড়ছিল। আমি এম-১৭ ব্যাচের ৭/৮ জন বন্ধুর কাছে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে দীপকের কন্টাক্ট চাইলাম। অনেকেই ‘জানে না’ লিখে জানিয়ে দিলো। স্বপন লিখলো দীপকের টেলিফোন নাম্বার। লিখলো যে দীপকের ফেইসবুক নেই। তারপর মোবাইল করে বললো
– সাদেক, তুমি লিটন ও রেজা-ইরির সাথে যোগাযোগ করতে পারো। তারা দীপকের খবর রাখে। রেজা মাঝে মাঝে লন্ডন যায়। সে দীপকের সাথে দেখা করে। শুনেছি, দীপকের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। আর তুমি ঐ নাম্বারে ফোন দিয়েও দেখতে পারো।”
আমি লিটনকে ফোন দিলাম। সে জানালো “এক বছর আগের খবর জানি। এখন কেমন আছে জানি না।” বিকেলে একঘন্টা পরপর তিনবার ফোন করলাম দীপকের নাম্বারে। ফোন রিসিভ হলো না। রাত ১২ টায় ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর ছয়টার আগে দীপকের নাম্বার থেকে কল আসায় ঘুম ভাংলো। দীপকের সাথে কথা হলো। কথা শুনে মনে হলো আমি ৭/৮ বছরের একজন বালকের সাথে কথা বলছি। শিশুসুলভ কন্ঠে ধীরগতিতে কথা বলছিল। আমার ফ্যামিলি টাঙ্গাইল বেড়াতে গিয়েছিল। কয়েকদিন আমি একা ছিলাম। একা থাকলে আমি মানষিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হই। রাজ্যের যতো স্মৃতি এসে ভির করে মাথায়। বন্ধুদের কথা মনে করে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে চায় এখনই যদি নাছিমকে ছুঁতে পারতাম! কিভাবে ছুঁব? সেতো থাকে আমেরিকা। এখনই যদি মনিরকে ছুতে পারতাম! কিভাবে ছুঁব? সেতো থাকে লন্ডনে। স্ত্রী স্বপ্না যখন কাছে থাকে তখন এসব মনে করার সময় পাই না। শুক্রবার ভোরেও একা ছিলাম। মোবাইল কানের কাছেই ছিল। মোবাইলের রিং শুনেই ঘুম ভাংগে। স্ক্রিনে দেখি Dipak M-17 calling.
– হ্যালো, আমি ময়মনসিংহ থেকে ডা. সাদেক বলছি। দীপক বলছো?
– কে?
– সাদেক, সাদেক তালুকদার, এম সেভেন্টিন ব্যাচের সাদেক। সাদেক, নজরুল, সদর ছিলাম টাঙ্গাইলের । মনে আছে?
– ও, সাদেইক্কা?
– হে, হে, সাদেক তালুকদার।
– তুমি কোথায়?
– আমার পোস্টিং কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক-এর কাছে বাড়ী করেছি। ময়মনসিংহ থেকে বলছি।
– আমাদের পুর্বের বাড়ী কিন্তু কিশোরগঞ্জ ছিলো। ওখানে যাওয়া হয় না। নজরুইল্লার কি খবর?
– নজরুল এফসিপিএস করেছে। টাংগাইল সদর হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের কনসাল্টেন্ট। বেশ নাম করেছে। টাঙ্গাইলে মেডিকেল কলেজ হয়েছে।
– বা বা!
– সদর টাঙ্গাইল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক।
– বা বা!
– ফারেজ ওখানে শিশু বিভাগের কনসাল্টেন্ট।
– বা বা! তোমরাতো ভালোই আছো!
– আমারে মনে আছে?
– আছে, আছে?
– বলতো, আমার দুই একটি ঘটনার কথা।
– তুমি নাক দিয়ে বাঁশী বাজাতে। মনে থাকবে না। অসুস্থ হওয়ার পর মনে করতে পারতাম না। এখন মোটামুটি মনে করতে পারি।
– তুমি জাপান থেকে আমার জন্য একটা গিফট এনেছিলে, মনে আছে?
– কি জেনো?
– ডিজিটাল ক্যামেরা।
– বা বা! সেটা তো অনেক দামী ছিলো!
– স্বপন খুলনা আছে। তার বড় ছেলে ডাক্তার হয়েছে। তোমার ছেলে মেয়েদের খবর কি?
– আমার মেয়েটা বড়। ও মেডিকেলে পড়ছে এখানে। আর একবছর পর ডাক্তার হবে। ছেলেটা (কি বললো ভালো বুঝা গেলো না)।
– আমি গতকাল ৩ বার কল করেছিলাম। রিসিভ কর নাই।
– এটাতো মোবাইল ফোন। কাছে ছিলো না। কল লিস্টে মিস কল দেখে কল ব্যাক করলাম।
– এটা মোবাইল?
– হা।
– তা হলে ম্যাসেজ দিলে যাবে?
– হে, আসবে।
– তোমার ফেইসবুক নাই?
– না, নাই।
– ফেইসবুক থাকলে সহজে যোগাযোগ করা যায়। আমরা সবাই ফেইসবুকে যোগাযোগ করি। তুমি ফেইসবুক করে ফেলো।
– ফেইসবুক একাউন্ট করতে হবে।
– ইমেইল আছে?
– আছে।
– আমি এসএমএস করে আমার ইমেইল এড্রেস দিব। ইমেইল কইরো।
– এখন কয়টা বাজে তোমাদের ওখানে।
– রাত ২টা।
– এত রাতে ঘুমাও না? বৌদি কোথায়?
– ও ঘুমাচ্ছে।
– তুমিও ঘুমিয়ে পড়। পরে কথা হবে। আল্লাহ্ হাফেজ।
কথা শেষ করে এসএমএস দিলাম আমার মোবাইল, ইমেইল, ফেইসবুক ও ওয়েবএড্রেস লিখে। মনটা কিছুটা প্রশান্তি পেলো দীপকের সাথে কথা বলতে পেরে। সারাদিন দীপক ও অন্যান্য পুরনো বুন্ধুদের কথা নতুন করে মনে পড়লো। সকাল ১০ টার দিকে স্বপনকে ফোন দিলাম। ধরলো না। জুম্মার নামাজ পড়ে এসে দেখি স্বপনের মিসকল উঠে আছে। কলব্যাক করলাম।
– সরি সাদেক, আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে সেমিনারে ছিলাম। তোমার কল শুনতে পাই নি।
– সমস্যা নেই। আমি নামাজে গিয়েছিলাম। তোমার কল ধরতে পারিনি। আমি গতকাল দীপকের নাম্বারে ৩ বার কল দিয়ে পাই নাই। আজ ভোর পৌনে ছয়টায় সে কল করেছিল। অনেক কথা হলো। চিনতে পারে। মনে আছে তার অনেক কিছু।
(বিস্তারিত বললাম)।
এরপর লিটনকে কল দিয়ে দীপকের কলের বিস্তারিত জানালাম।
রাত দশটার দিকে ফেইসবুক পোস্ট চেক করছিলাম । দেখলাম আমাদের ব্যাচের নাসিম তার প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেছে। আবারও তাকে ছুঁতে ইচ্ছে হলো। হায়! কিন্তু সে তো আমেরিকায়! ফেইসবুক পোস্ট দেখে জানতে পারলাম বড় ভাই ডা. এম এন আমিন অভিনিত টিভিতে একটা নাটক হচ্ছে । টিভি অন করে টিভি দেখা শুরু করলাম । নাটকের চেনেল খুজতে গিয়ে একেক চেনেলে একেক অনুষ্ঠানের কিছু কিছু অংশ দেখতে দেখতে নাটকের সময়ই শেষ হয়ে গেলো। সুইচ অফ করে স্বপ্নাকে মোবাইল করে শুতে গেলাম বিরক্তি নিয়ে। দোয়া পড়ে শুলাম। আল্লাহ্র শোকর করলাম। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, বিদ্যা অর্জন করিয়েছেন, চিকিৎসক বানিয়েছেন, প্যাথলজি বিষয়ে তখনকার উচ্চ ডিগ্রি এম ফিল অর্জন করিয়েছেন (১৯৯৫ সন), ২১ বছর আগে সহকারী অধ্যাপকের মর্যাদা দিয়েছেন, ২৭ বছর মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ দিয়েছেন, প্রায় ৪ হাজার ডাক্তারের শিক্ষক হবার মর্যাদা দিয়েছেন, ৮৪টি সাইন্টিফিক পাব্লিকেশন করার ক্ষমতা দিয়েছেন, অর্থ সম্পদ দিয়েছেন যথেষ্ট, পারিবারিক সুখ দিয়েছেন প্রচুর। মেধাবী গুণবতী ২ জন সন্তান দিয়েছেন। আরো কত কিছু দিয়েছে! আমি যদি ২০ বছর আগেই সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতাম! আমি যদি বিদেশ পাড়ি দিতাম! না, তা ঠিক হতো না। প্রবাসে থাকলে আমি ইচ্ছা করলেই আমার আপনজনদের পেতাম না। গত সপ্তাহেও বাড়ী গিয়ে গরীব দেখে দেখে তাদের হাতে কিছু দিয়ে এসেছি। তারা চায় নি। তারা শুধু আমার মুখের দিকে চেয়েছে। তাতেই আমি বুঝে নিয়েছি। বিদেশে থাকলে কি তা করতাম? এইসব নানাবিধ চিন্তা এসে ভির করল মাথায়। স্বপ্না পাশে থাকলে হয়তো এগুলো মাথায় আসতো না। মনে হলো গান বাজাই। চিন্তা দূর হয়ে যাক। দীপককে মনে পড়লো। তার বাজানো রবীন্দ্রসংগীত মনে পড়লো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইউটিউব-এ সার্চ দিতে লিখলাম “দূর দেশী সে”। সাজেশন আসলো “দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে”। ক্লিক করলে বেজে উঠলো “দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে, আমার বাটে বটের ছায়ায়, সারাবেলা গেলো খেলে…..। ” শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমাবার আগে শুনেছেলিম “ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশীটি তার গেছে ফেলে।”
৯/২/২০১৯ খ্রি.
পুনশ্চ:
আমার এই লেখাটা ফেইসবুকে প্রকাশ পাওয়ার পর অনেক বন্ধু ফোনে এবং মেসেঞ্জারে আমার সাথে কথা বলে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি দীপক তার অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মাকে দেখতে ঢাকার ভাইয়ের বাসায় আসে। এখানে এসে দীপকের কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে (হার্ট বন্ধ) ব্রেইন ডেমেজ হয় কিছুটা। বেচে উঠলেও সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। পুরাতন স্মৃতি মনে আছে তার কিন্তু নতুন স্মৃতি (রিসেন্ট মেমোরি) মনে থাকে না। ঢাকার বন্ধুদের সহায়তায় তার স্ত্রী এসে তাকে লন্ডনে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে একা চলতে পারে না। বাইরে রাস্তায় বেরুলে বাসায় ফিরতে পারবে না। কারন, তার বাসা কোন দিকে কত নাম্বার তার মনে থাকে না। কিন্তু পুরাতন কোন ঘটনা নিয়ে কথা বললে সে সব মনে করে কথা বলতে পারে। দিনে ঘুমায়। রাতে ঘুমায় না। এই জন্যই সে আমাকে রাতে কল করেছিল। আমার এই লেখার কথা দীপকের স্ত্রীকে আমার বন্ধু জামিল জানায়। বউদি লেখাটা পড়ে সেইভ করে পেন্ড্রাইভে করে নিয়ে গিয়ে বাইরের দোকান থেকে প্রিন্ট করে এনে দীপককে পড়তে দেয়। কারন দীপক ফেইসবুক চালাতে পারে না। দীপক লেখাটি পড়ে আবেগপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু আগের রাতে যে আমার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে এটা তার মনে নেই। কারন, তার ব্রেইনের রিসেন্ট মেমোরি সেন্টার লজ হয়েছে। যদি কোন দিন শুনতাম যে দীপকের রিসেন্ট মেমোরি সেন্টার ফিরে পেয়েছে!
৩/৯/২০১৯ খ্রী.