হায়াত সিকদারের ওয়াসিয়ত
হায়াত সিকদারের ওয়াসিয়ত
সাদেকুল তালুকদার
ঝগড়াটা শুরু হয়েছিল হায়াত সিকদারের মৃত্যুর ৪০ দিন পর। অর্থাৎ চল্লিশা খাওয়ার পরদিন থেকে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হায়াত সিকদার একটা ওয়াসিয়ত করে যান। বড় ছেলের শশুরের কাছ থেকে তিনি ৫ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। সেই টাকা আর ফেরত দেননি। কেউ কেউ মনে করে নিয়েছেন এই টাকা যৌতুক হিসেবে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভেবে নিয়েছেন যে এটা ধার হিসেবে নিয়েছেন। যে হিসেবেই নিয়ে থাকুন এই টাকা ফেরত দেয়ার চিন্তাও করেননি হায়াত সিকদার। মৃত্যুর আগে হুজুরের একটা বয়ান স্মরণ হয়। হুজুর বলেছিলেন আল্লাহ তার যেকোনো হক আদায় না করলে নিজ গুণে বান্দাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন তওবা করলে। কিন্তু বান্দার হক বান্দাকেই ক্ষমা করতে হবে। বান্দায় ক্ষমা না করলে আল্লাহয় ক্ষমা করবেন না। তাই, তিনি মৃত্যুর আগ মুহুর্তে তওবা পড়ে তার স্ত্রী ও দুই ছেলে-বৌয়ের উপস্থিতিতে ওয়াসিয়ত করেন “আমি মরে গেলে আমার ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা তুলে বড় বৌয়ের বাবাকে দিয়ে দিও। আর আমাকে মাফ করে দিতে বলো। ” এরপরে কালিমা বলতে বলতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
দাফনের ৪০ দিন পর যথারীতি খরচ করে চল্লিশা খাওয়ানো হলো। পেট ভরে খেয়ে সবাই হায়াত সিকদারের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করে গেলেন। নিকটাত্মীয়রা সেদিন বাড়িতেই থেকে গেলেন। অনেক খাবার বেশী হয়েছিলো। সেগুলো দিয়েই রাতের খাবার খেয়ে নিলেন সবাই। বাকী বাসী ভাতে পানি দিয়ে পান্তা করার জন্য রেখে দেয়া হলো। গরমের দিনে পান্তা ভাত চুকা মানে টক হয়ে গিয়েছিলো। সেই পান্তাভাত দিয়ে চুকা খিচুড়ি রান্না করে সবাই সকালের নাস্তা খেলেন। সবাই হায়াত সিকদারের প্রসংশা করে স্মৃতিচারণ করলেন। কিন্তু বড় ছেলের বৌ মজলিসে বলে বসলেন “আব্বা মারা যাবার সময় ওয়াসিয়ত করে গেছেন তার ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ৫ লাখ টাকা আমাকে দিয়ে দিতে।” ছোট বৌ বলে উঠলেন “মিথ্যা কথা। এই কথার কি কোন স্বাক্ষী আছে?”
বড় বৌ – কেন, আম্মার সামনেই তো বলেছেন। তুমিও শুনছো। এখন এমন কথা বলছো কেন? আম্মা, আপনেও শুনেছেন। এখন সবার সামনে বলুন।
শাশুড়ি – তাই তো বলেছেন। আমিও শুনেছি।
ছোট বৌ – আপনিও মিথ্যা কথা বলছেন, আম্মা। আপনি ভাবীর পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন। মিথ্যা কথা আমি মানি না।
এভাবে বেশ কিছুদিন ঝগড়া বিবাদ চলতে লাগলো। বড় বৌয়ের ছোট ভাই একটু চালাক চতুর আছে। ফেইসবুক, ইউটিউব ও গুগল দেখে দেখে অনেক কিছুর উপর জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে এই ২০ বছর বয়েসেই। ইন্টারনেট থেকে পড়ে জানতে পেরেছে যে, সাউন্ড রিট্রাইভাল নামে একটা এপ আছে যেটা দিয়ে অতীতের কথা, যা কোন কিছু দিয়ে রেকর্ড করে রাখা হয়নি সেগুলো বের শোনা যায়। সে বুদ্ধিকরে মামুন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে মানুনকে জিজ্ঞেস করলো
– আপনার কাছে কি এমন এপ আছে যা অতীতে যে কথা রেকর্ড করে রাখা হয়নি সেই কথা বের করে শোনা যায়?
– আছে তো। এই মোবাইলেই ইনস্টল করা আছে।
– আমার তালই ৪০ দিন আগে একটা ওয়াসিয়ত করে গেছেন। কিন্ত সেটা এখন অস্বীকার করছে কেউ কেউ। আপনি সেই কথা এখন শোনাতে পারবেন?
– অবশ্যই। এটাও তো আমার ব্যবসা। এজন্য আমি ফি নিয়ে থাকি। এই এপ নামানোর জন্য আমাকে ফি দিতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় ডাটা এন্ট্রি দিলে সেই কথা শোনা যাবে।
– চলুন ভাই, আমার বোনের বাড়ি। ওখানে একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
সমস্যাটা বুঝিয়ে বলে মনির মামুনকে নিয়ে এলো হায়াত সিকদারের বাড়ি। সাথে মসজিদের ইমাম সাব, ওয়ার্ড কাউন্সিলার ও কয়েকজন গণ্যমান্য লোক নিয়ে এলেন। মনির সমস্যাটা মামুনের কাছে তুলে ধরলো। মামুনের কাছে জানতে চাইল
– মামুন ভাই, আগে ব্যাখ্যা করে বলুন, এটায় কিভাবে অতীতের সাউন্ড রেট্রাইভ করে আনে।
মামুন – এখানে কয়েকটা সিস্টেম এক সাথে কাজ করে। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস দিয়ে হারানো সাউন্ড উতপত্তির স্থান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। গ্লোবাল টাইমিং সিস্টেম দিয়ে কোন একটা নির্দিষ্ট সময় ইনপুট দিতে হয়। এন্টার দিলেই সাউন্ড তথা নির্দিষ্ট লোকেশনের অতীতের কথা শোনা যায়।
কাউন্সিলর – আমাদের মুখের কথা বলার সাথেই রেকর্ড করা না হলে সেটা বাতাসে মিলিয়ে যায়। সেই কথা এই মেশিনে উতপত্তি করে কিভাবে?
মামুন – আমরা যখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে মোবাইল ফোনে কথা বলি সেটা একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ফিজিটাল সিগনালে রুপান্তরিত করে ইথার মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় । যাকে বলা হয় মডুলেশন। যিনি ফোন রিসিভ করবেন তার ফোনের ডিভাইস সেই সিগনালটিকে রুপান্তরিত করে সেই কথা বা সাউন্ড তৈরি করে আমাদের শোনায় ডিমডুলেশন করিয়ে। এজন্য এটাকে মোডেম নামে ডাকা হয়। মডুলেশন-ডিমডুলেশন সংক্ষিপ্ত হয়ে মোডেম হয়েছে। আর সাউন্ড রিট্রাইভাল সিস্টেম হচ্ছে অতীতের সাউন্ড বের করে শুনায়। সব সাউন্ড ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সিগনালে রুপান্তরিত হয়ে আমাদের অদেখা ন্যাচারাল মিডিয়াতে সংরক্ষিত থাকে। সাউন্ড রিট্রাইভাল সিস্টেম দিয়ে সেই সিগনাল থেকে আবার সাউন্ড তৈরি করা যায়।
ইমাম – আমরা জীবনে যেসব আমল করছি সেগুলো অনবরত কেরামান কাতেবীন ফেরেস্তা আল্লাহর নির্দেশে লিপিবদ্ধ করছে। মৃত্যুর পর বিচারের দিন সেই আমলনামা যার যার হাতে দিবেন। সেই মিডিয়াতে বান্দার সব কর্মকাণ্ড দেখা যাবে। আপনাদের আবিস্কার দেখছি কেরামান কাতেবীনের রেকর্ডের সাথে মিল আছে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর সৃষ্টি জীব হচ্ছে মানব। এই মানব জাতিই এমন জিনিস বানাতে পারলো। সেই মানবের যিনি সৃষ্টিকর্তা তার না জানি কত ক্ষমতা। সোবহান আল্লাহ!
কাউন্সিলর – মামুন, এখন কাজটা শুরু করুন। অনেক সময় লাগবে? আমার আরেকটা দরবার আছে। চুরির কেইস।
মামুন – কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। চুরির কেইস ধরারও এপ আছে। হায়াত সিকদার যে স্থানে কথাগুলো বলেছিলেন সেই স্থানের কো-অর্ডিনেট ইনপুট দিতে হবে অর্থাৎ লেটিচুড, লংগিচুড এবং এল্টিচুড নাম্বার দিতে হবে।
কাউন্সিলর – এটা কি আবার?
মামুন – পৃথিবীর যেকোন স্থানের একটি পজিশন নাম্বার আছে। এটা বের করা সহজ। আপনি গুগুল ম্যাপের যে কোন পয়েন্টে ক্লিক করলে দেখবেন এর পজিশন লেখা উঠে। আপনার মোবাইল ফোন দিয়েও দেখতে পারেন। আমি যে স্থানে হায়াত সিকদার কথা বলছিলেন সেখানে মোবাইল নিয়ে গিয়ে পজিশন বের করলাম। এটা ইনপুট দিলাম। এখন তারিখ ও সময়টা বলুন, ইনপুট দেই।
বড় বৌ – এত তারিখের বিকাল চারটা সারে চারটার দিকে।
মামুন লেটিচুড, লংগিচুড, এল্টিচুড এবং তারিখ ও সময় এন্ট্রি দিয়ে রেজাল্ট বাটন ক্লিক করতেই মোবাইলে বেজে উঠল একটা শিশুর কান্না। অনেকেই বলে উঠলো “এইটা আবার কে কাঁদে?” বড় বৌ বললেন “এটা মর্জিনার বাচ্চা কান্না করছে। মারা যাওয়ার কয়েক মিনিট আগে মর্জিনা এসেছিল আব্বাকে দেখতে। সেই বাচ্চার কান্না শোনা যাচ্ছে। আপনি এর কয়েক মিনিট পর টাইম সেট করুন।” এবার শোনা গেলো পাশের মসজিদের মুয়াজ্জিন হেলালের আজান। শাশুড়ি বললেন “এই আজানের পর কথাগুলো বলছিলেন। টাইম আরেকটু বাড়িয়ে দিন।”
এবার বেজে উঠল “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মরে গেলে আমার ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা তুলে বড় বৌয়ের বাবাকে দিয়ে দিও। আর আমাকে মাফ করে দিতে বলো। মরে যাচ্ছি। বৌমার বাবাকে দিয়ে যা থাকে তা ইসলামী বিধান অনুসারে তোমরা ভাগ করে নিবে। আসতাগফিরুল্লাহ, রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বেও ওয়াতুবু ইলাইহি। লা হাওলা ওয়া লা কুয়াতা ইল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। ” কান্নার রোল শোনা গেলো। সবাই সত্যটা ধরে ফেললেন। ছোট বৌ বলে উঠলেন “এই মোবাইলে যত সত্য-মিথ্যা কথা শোনা যায়। মোবাইলে ইউটিউব ভিডিওতে দেখেছি একজন আরেকজনের কন্ঠ হুবহু নকল করে বলে যাচ্ছে। ভাবী তার ছোট ভাইকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে এসব আয়োজন করছে আব্বার ৫ লাখ টাকা মেরে খাওয়ার জন্য। যান গা এলা।” শুনে সবাই থ মেরে বসে রইলেন।
২১ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি.
ময়মনসিংহ
(বিজ্ঞান ভিত্তিক কল্পকাহিনি)
কপিরাইট প্রটেক্টেড।
কপি পেস্ট না করে শেয়ার বাটনে ক্লিক করে শেয়ার করুন।