Tag Archives: memory

Amir Ali

আমীর আলীর শেষ বিদায়

(স্মৃতি কথা)

সাগরদিঘি পর্যন্ত এলেই আমীর আলীর ফোন এলো। কুশল বিনিময় হলো।

– কোথায় তুমি?

– আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসতেছি। ঢনঢনিয়া পর্যন্ত এসে গেছি।

– কোন সমস্যা হইছে?

– না, এমনিতেই তোমার সাথে দেখা করতে আসতেছি।

– তা, তুমি আসবে, আমাকে জানিয়ে আসবে না? ১৪/১৫ কিলোমিটার পথ হেটে এসে এখন ফোন করছো? আমি তো চলে যাচ্ছি ময়মনসিংহ। প্রাইভেট কারে যাচ্ছি। সাগরদিঘি পর্যন্ত এসে গেছি। ময়মনসিংহ গিয়ে অফিস ধরতে হবে। পরে একদিন দেখা করবো, ইনশাআল্লাহ। তুমি আমাদের বাড়ি যাও। আমি ভাতিজা মান্নান তালুকদারকে বলে দিচ্ছি তোমাকে আমার লেখা স্মৃতি কথার বইগুলো দিয়ে দিতে।

মান্নান আমীর আলীকে বই প্রদানের ছবি তুলে আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়।

এর বেশ কিছু দিন পর আমীর আলী ফোন করে। কিন্তু তার কথা ভালো করে বুঝা যাচ্ছিল না। তার ছেলে আমাকে বুঝিয়ে বললো যে, তার বাবার জিহবার এক কিনারায় বিড়াট একটা ঘা হয়েছে, জিহবা নাড়াতে পারেন না। খেতেও পারেন না, কথা বলতেও পারেন না। এরপর যতবার ফোন করেছে আমি আমির আলীর কথা তেমন বুঝতে পারিনি। আমি অনুরোধ করে আমীর আলীকে ময়মনসিংহ আনালাম। দীর্ঘ বছর পর আমার বাল্য বন্ধুর সাথে দেখা হলো। আমি তাকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। কেউ কথা বলছিলাম না। একে অপরের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। ছেড়ে দিয়ে আমীর আলীর জিহবার ঘা দেখলাম। আমার মনে হলো ক্যান্সার হয়েছে। আমি নিজেই তার এফএনএসি পরীক্ষা করলাম। ক্যান্সারই ধরা পরলো। চিঠি লিখে মুখ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ শমরেস কুন্ডু দাদার কাছে পঠালাম। দাদা বায়োপসি করে আমার কাছে সেম্পল পাঠালেন। আমীর আলী বাড়িতে চলে গেলো। তিন দিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট দিলাম, ক্যান্সার।

Continue reading

chharpoka

ছাড়পোকা

Chharpoka / Bed Bug

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ছাড়পোকার সাথে শেষ সাক্ষাৎ কবে, কোন সনে হয়েছিলো তা মনে করতে পারছি না। আপনার মনে আছে? ছাড়পোকাকে আমরা বলতাম উরুশ। উরুশ দেখতে তেলাপোকার বাচ্চার মতো লালচে, পাখা নেই। লম্বায় ২ থেকে ৭ মিলিমিটার। এরা চোরা কিসিমের পোকা। অন্ধকারে চিপা-চোপার ভিতর লুকিয়ে থাকতো।

গ্রামে আমরা বেশিরভাগই কাঠের চৌকিতে বেতের পাটি বিছিয়ে শুতাম। চৌকির তক্তার চিপায় ও পাটির বুননের চিপায় এই চোরারা লুকিয়ে থাকতো। লেপ-তোষক ও কাথা-বালিশের ভাজের ভিতরেও এরা লুকিয়ে থাকতো। কাঠের চেয়ার-টেবিলের চিপায়ও এরা লুকিয়ে থাকতো। রাতেরবেলা চোরের মতো এরা বেরিয়ে আসতো। ঘারের নিচে, পিঠের কিনারে এরা আসতে করে কামড়ে দিয়ে রক্ত পান করতো। মানুষের রক্তই ছিল এদের প্রধান খাদ্য। সারাদিন পরিশ্রম করে মানুষ রাতে আরাম করে ঘুমাবার চেষ্টা করতো। এই সময় এই চোরারা কামড়ানো শুরু করতো। কামড় খেয়ে মানুষ উ আ করে এপাশ ওপাশ করে ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তো। জ্যৈষ্ঠ মাসের ঘরমের দিনে একবার এক আত্মীয় বাড়ি গিয়ে রাতে বিপদে পড়েছিলাম। তোষকের নিচ থেকে ছাড়পোকারা এসে ঘারের নিচে কামড়াতে লাগলো। উঠে মশারির নিচে খাটের খারা তক্তার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলাম। ওমা, চোরারা পিঠে কামড়াতে লাগলো। লাফ দিয়ে গিয়ে খাটের মাঝখানে বসে রইলাম। একটু বাচা গেলো। কিন্তু ঘুমের চোটে আর বসে থাকা গেলো না। এদিকে গরম ধরলো প্রচুর। হাতপাখাটা হাতে নিয়ে বাহিরবাড়িতে গিয়ে ধানের আটির উপর বসলাম। এবার শুরু হলো মশার আক্রমণ। একবার ডান ঠ্যাংগে থাপ্পড় মারি, একবার বাম ঠ্যাংগে থাপ্পড় মারি, একবার ডান গালে মারি, একবার বাম গালে মারি, মাঝে মাঝে ডলা মারি রক্তচোষা মশার উপর। পরে কিভাবে রাত কাটিয়েছিলাম তা মনে করতে পারছি না। সব কথা মনে থাকে না।

টাংগাইল গিয়ে হলে বসে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা হলে রাত দিন ২৪ ঘন্টাই অন্ধকার থাকতো। তাই, সিনেমা হল ছিলো ছাড়পোকাদের অভয়ারণ্য। হলের কাঠের চেয়ারের ফাক ফোকও বেশি ছিলো। দর্শকরা মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতো। সেই সুযোগে চোরারা ইচ্ছামত কামড়াতো। সিনেমা শেষে পাছা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ি ফিরতো।

একবার এক ভদ্রমহিলাকে বসতে দিয়েছিলাম বেতের চেয়ারে। গল্প করার সময় মহিলা একবার ডানে কাত হন, একবার বামে কাত হন, একবার ডান চোখ ছোট করেন, একবার বাম চোখ ছোট করেন এবং একবার ঠোঁট শীশ দেয়ার মতো করে গোল করেন। আমি বুঝতে পারলাম ছাড়পোকার প্রতিটা কামড়ের সাথে তার এই অঙ্গভঙ্গি চলছে। করার কিছু নাই। বাসায় ফিরে তিনি এর চুলকানিটা বুঝবেন।

ছাড়পোকা মারার দৃশ্যগুলো ছিলো অপুর্ব। বাশের খরকি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র ও বিছানাপত্রের চিপা থেকে ছাড়পোকা বের করে পিঠের উপর চাপ দিয়ে ঠাস করে ফাটিয়ে ছাড়পোকা মারা হতো। একটা দুর্গন্ধ বের হতো উরুশের পেট থেকে। ওটার নামই ছিলো উরুশের গন্ধ। শীতকালে সকাল ১০/১১ টার সময় সব চৌকি উঠানে খারা করে রৌদ্রে দেয়া হতো । গরম পেয়ে সব উরুশ চিপা থেকে বের হয়ে আসতো। কুপি বাতির আগুন দিয়ে ছেকা দিলে ফটাশ করে ফুটে উরুশ মারা যেতো। এর ধুয়ার সাথেও উরুশের গন্ধ বের হতো। উঠোনে পাটি বিছিয়ে বালিশ লেপ কাথা রৌদ্রে দেয়া হতো। গরম পেয়ে উরুশ উঠোনের উপর দিয়ে হাটা ধরতো। পায়ের বুইড়া আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে দিয়ে ঠাসঠাসি উরুশ মারা হতো। বর্ষাকালে চৌকি পুকুরের পানিতে দুই তিন দিন ডুবিয়ে রাখলে উরুশ ফাফর হয়েই মারা যেতো।

গল্পটা লিখছিলাম প্রাইভেট কারে বসে লং জার্নিতে মোবাইল ফোনের নোটপ্যাডে। কিন্তু কবে থেকে দেশে ছাড়পোকা নেই সেটা মনে করতে পারছিলাম না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কি বলতে পারবেন কবে থেকে দেশে ছাড়পোকা নেই?” তিনি উত্তর দিলেন “খুব সম্ভব এরশাদ সাবের আমল থেকে।” আপনার কাছে কি মনে হয়?

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ময়মনসিংহ- কচুয়া জার্নিতে

#memoryofsadequel

বইটি ঘরে বসে পেতে নিচের ছবির উপর ক্লিক করুন

স্মৃতির পাতা থেকে

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

Cesarean section

Cesarean section

সিজার অপারেশন ছাড়াই বাচ্চা হয় কেমনে?

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

শিক্ষার্থীদেরকে কোন কিছু শিখাতে গেলে তার বয়সের দিকে একটু খেয়াল রাখতে হয়। আমি একদিন এই রকম একটা সমস্যায় পড়েছিলাম। ঈদের ছুটিতে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে ও মেয়ে একজায়গায় বসে গল্প করছিলো । আমি ভাবলাম এই সুযোগে তাদেরকে একটু ধর্মীয় জ্ঞান দেই। আমি মানব সৃষ্টির শুরুটা কেমন ছিল বুঝাতে গিয়ে আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) এর সৃষ্টির কাহিনী বললাম। বিবি হাওয়ার অনেক সন্তান হলো বললাম। এরপর বলতে চেয়েছিলাম “যেহেতু সেই সময় আদমের সন্তান ছাড়া আর কোন মানুষের সন্তান ছিলনা, তাই ভাই-বোনের মধ্যেই বিয়ে সম্পাদন হয়। তারপর বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম হয় এবং এভাবে মানব সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন এই অবস্থা হয়েছে।” এর আগেই এক শিশু আমার গল্পে বাধা দিয়ে বলল “তখন তো আদম ও হাওয়া ছাড়া আর কেউ ছিলনা। তাইলে সিজার অপারেশন করে দিলো কোন ডাক্তারে?

– সিজার ছাড়াই হইছে।

– সিজার ছাড়াই বাচ্চা হয়? আমরা এখানে সবাই সিজার অপারেশন হয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মেছি। আদমের সন্তানরা সিজার ছাড়াই জন্মিল কেমনে?

আমি ভেবাচেকা খেয়ে গল্প বাদ দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলাম

বইটি ঘরে বসে পেতে নিচের ছবির উপর ক্লিক করুন

শৈশবের একাত্তর

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

kanula

Kanula

কানুলা

(টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার)

ইডা ভরাদিন আগের কতা। হেই উনাশি শালের কতা মোনয়। হেসুম আমি ইন্টারে পড়ি, নায়য় পাস করছি। ঠিক করলাম, ছোট ফুবুগ বাইত্যে যামু। আংগ দুইজন ফুবু আছাল। বড় ফুবুগ বাড়ি অইল ভিয়াইল গায়। ছোট ফুবুগ বাড়ি অইল কাশতলার হাতাই পাড়ায়। হেনুকার হামিদ ডাক্তর আছাল আংগ ছোট ফুবা। মুকুল, মজি ভাই অইল আংগ বাবার চাচত ভাইয়ের পোলা। হেই ইসাবে তারা আমার চাচত ভাই। দুইওজন মইরা গেছে। অগ আছাল একটা ফুবু। হেই ফুবুরও বাড়ি আছাল ভিয়াইল। পরে হেই ফুবা চৌরা পাহারে জমিন কিন্যা বাড়ি বানাইছাল। হেই বাইত্যেও আমি গেছিলাম কেলাস এইটে থাকতে। আগের দিনে আমরা ইস্টিবাড়ি যাওনের সোম হাজা নিয়া যাইতাম। মজি ভাই আমারে হাজা নইয়া গেছাল তার ফুবুগ বাইত। মোনে আছে হেন্তিগা ডেইল্টার য়াটে গেছিলাম। বাড়ির বোগলেই, কাছরা পাহারে। আংগ বাড়িডা খাটি পাহারে, ঢনডইনা গায়ে। চিনুইন? বড়বাইদ পাড়ার তালুকদার বাড়িগ পোলা আমি। দলু তালুকদারের ছোট পোলা। যাইগ্যা হে কতা, যে কতা কইতে চাইছিলাম, হেই কতা কই।

আমি মুকুলেরে হাজা নইয়া ছোট ফুবুগ বাড়ি রওনা দিলাম। গিরিমিন্টি করতে করতে বিয়াল অই গেছাল। দেওপড়া গেলে পরেই বেইল ডুইব্যা গেলোগা। হেদিন মোনয় আমাবইস্যার য়াইত আছাল। পুসুন্ডা গেলে পরে ঘুটঘুইটা আন্দাইর পইরা গেল। য়াস্তাঘাট কিছুই দেহা যাইতাছাল না। আন্দাজি ডাইন মুহি ঘুইরা য়াটতে থাকলাম। একসুম দেহি বাড়িঘরের কোন চিহ্ন নাই। খালি চক ক্ষেত। ইটা ক্ষেতের উপুর দিয়া য়াটন নইলাম। মুকুল কইল আমি ডরাইতাছি। আমি কইলাম ডরাইস না। লা হাওলা অয়ালা কুয়াতা পড়তে থাক। আমার মোনইল বেশি ডাইনে গেছিগা। অহন বাম মুহি যাওনের চেষ্টা করি। কিন্তু যেনেই যাই হেনেই বিল বাজে। বিল আর হেশয় না। য়াটতে য়াটতে অরান অইগেলাম। পানি তুলাস নাইগ্যা গেলো। খিদায়ও পেট পোড়া শুরু করলো। অহন দিশ কুল না পাইয়া উলটা পালটা য়াটা শুরু করলাম। এবা কইরা কয়েক ঘন্টা য়াটার পর মাইন্সের শব্দ পাইলাম এক বেটা মোনয় বদনা নিয়া ইটা ক্ষেতে ঘাটুদ্ধারে বাইরইছাল। আন্দাইরে মইদ্যে আমাগো দিসা পাইয়া কয় যে, এই ক্যারা? আংগ যাতে চোর মোনে না করে হেইজন্য তারা তারি কইয়া উঠি, আমরা ফুবুগ বাইত্যে যাবার চাইছিলাম। পথ য়ারাই ফালাইছি গো। ইডা কোন গাও? বেটাডা কইল ইডা অইল নারাইংগেল গাও। মুকুল কইয়া ফালাইল, নইন নারাইংগেলের আনো বুগ বাইত্যে যাই। আনো বু অইল মুকুলের ফুবাত বোইন। দুলাভাইর নাম ওস্তম মাস্টর। আমি হইচ করলাম, কাশতলা কি কাছেই? কইল যে, না দূর আছে। বীরবাসুন্ডা অইল মাগ নানির বাড়ি। আমি হইছ করলাম, বীরবাসুন্ডা কি কাছে? কইল, না। মুকুল কইল, আমি আর য়াটপার পামু না। নইন দুলাভাইগ বাইত্তেই যাই। তাই করলাম। বেটায় দুলাইগ বাড়ি দেহাই দিল। বাড়ির উঠানে গিয়া, ভাইগ্না নুর ইসলামরে ডাক দিলাম, নুর ইসলাম ঘুমাই পরছ? দুলাভাই কইয়া উঠলো, ক্যারা? আমরা পরিচয় দিলাম। আনো বু দোয়াত আতে নইয়া আংগ মুহের মুহি চাইয়া কইল, তরা কোন তিগা আইলি। বাড়িত তিগা পলাই আইছস না ত? বাব্বুর কাছে কই য়াইছস? মুকুলের দাদিরে নাতিরা বাব্বু কইত। এবা ভরা কতা। আমি কইলাম, ভরা কতা আছে। আগে তাততারি চাইরডা খাবার দেইন। খিদায় মইরা যাইতাছি। বু কইল, এবা দুপুর য়াইতে কী খাবার দিমু। বিয়ানা খাওনের নিগা আলু হিদ্দ আছে। আগে এইগনাই খাইয়া নি। আমি ধাতুবাত কইরা চাইরডা ভাত চরাই দেই। আমি কইলাম, বু আংগ অহন ভাত খাওন নাগব না। আলু খাইয়াই হুইয়া পড়মু।

নারাইংগেলে খুব আলু অয়। বাইল্যা মাটি ত। চিনামুরার মানুষ নিহি খালি আলু খাইয়া থাকছে। আংগ এক কাক্কু কইছে। ইডা মিছা কতাও অইতে পারে। কতার কতা। মস্কারি কইরা কইত, চিনামুরার ভদ্রলোক। বাইত্যে আলু খায়, বাইরে ফ্যারাঙ্গি করে। যাইজ্ঞ্যা, আমাগ কতা সব হুইন্যা দুলাভাই কইলেন “তোমগ কানুলায় ধরছাল। কানুলায় ধরলে পথ ভুলাই দিয়া অন্য পথ দিয়া ঘুরায়।”

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

১৪/৬/২০২১

Jummaghor

Jummaghor

আমাদের গ্রামের জুম্মাঘর

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমি বুঝমান হয়েই দেখেছি আমাদের বড়বাইদপাড়া গ্রামের আজিম উদ্দিন সিকদার বাড়ির কেন্দ্রীয় মসজিদটি। আমরা বলতাম জুম্মাঘর। এটার চালের ছাউনি ছিলো ঢেউ টিনের। বেড়া ছিল চেপটা টিনের। মেঝে ছিল কাঁচা। চট বিছিয়ে নামাজ পড়তাম। ঐ বাড়ির মানুষ জুম্মা ঘরে পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করতেন আজান দিয়ে। গ্রামের মুছুল্লিরা শুধু শুক্রবার জুম্মার নামাজ জামাতে আদায় করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার কাক্কী (জয়নাল ভাইর মা) জুম্মাঘরের মাইঝাল (মেঝে) ও পিড়া (ডোয়া) হাইল মাটি (বাইদের মাটি) দিয়ে লেপে দিতেন।

আজিম উদ্দিন সিকদার দাদা বহরমপুর থেকে এসে এখানে বাড়ি করে একটা পুকুর খনন করেন সেই ব্রিটিশ আমলে। পুকুরের পশ্চিম পাশে তিনি এই জুম্মাঘর নির্মাণ করেন গ্রামের মানুষের নামাজ আদায় করার জন্য। উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া, পূর্বপাড়া, তালুকদার বাড়ি, নওপাড়া ও চনপাড়ার সব মুছুল্লিরা এই মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মিলন মেল হতো। মসজিদ প্রাঙ্গণে বড় আম গাছ ছিলো। সেই আমগাছের নিচে একটা বাঁশের মাচাং ও দুইটা ঘোড়া কাঠ ছিলো। নামাজ শুরুর আগে ও পরে এখানে বসে যুকক ও কিশোর বয়সের মুছুল্লিরা খোস গল্প করতো। গ্রামের মানুষের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে বড়রাও আলাপ আলোচনা করতেন। গ্রামের মাতবর ছিলেন কোরবান আলী সিকদার কাক্কু ও কাশেম তালুকদার কাক্কু (মিয়াকাক্কু)। মাতবরের মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারতো না।

এই মসজিদের ইমাম ছিলেন শিরিরচালার হাছেন ক্কারীসাব। তিনি শুক্রবারের জুম্মার নামাজে ইমামতি করতেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে মিলাদ পড়ে দোয়া করে বখসিয়ে দিতেন। আমাদের শমে কাক্কুও মিলাদ পড়াতেন। আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন তালেবে ইলিম হিসাবে।

আমগাছ তলায় মাঝে মাঝে মাসআলা নিয়ে অল্প বয়সের যুবকদের মধ্যে তর্ক লেগে যেতো। মিয়া কাক্কু এগিয়ে এসে থামিয়ে দিয়ে সঠিক মাসআলা কি হবে বলে দিতেন। মিয়া কাক্কুর উপরে কেউ কোন মাসআলা বলতে সাহস পেতো না। মাসআলা বলার পরে এটা পাকাপোক্ত করার জন্য ইমাম সাবকে জিজ্ঞেস করতেন “তাই না হুজুর?” হুজুর ইতস্তত করে গোল টুপিটা ডান হাত দিয়ে হালকা ঘুরান মেরে বলতেন “ঐত্য।” তারপর টুপিটা মাথা থেকে খুলে ফু দিয়ে গোল করে আবার মাথায় পরে দ্রুত চলে যেতেন জুম্মা ঘরের ভিতর। ‘ঐত্য’ কথাটি একটি হালকা সম্মতিসরূপ একটি শব্দ। আমার মেয়ে দুটি যখন ছোট ছিলো তখন দুজনে মাঝে মাঝে তর্কে করে কার কথা ঠিক এটির সমাধান নিতে আমার কাছে এলে আমিও বলে দিতাম “ঐত্য। তোমাদের জন্য আজ কি যেনো আনত হবে?”

ইমাম সাব ছিলেন ক্কারী। অল্প কিছু মাস আলা জানতেন। অল্প কিছু বয়ান করতেন খুতবার আগে অথবা নামাজের পর দোয়ার আগে। দোয়াকে মুছুল্লিরা খুব প্রয়োজন মনে করতেন। শেষ দোয়া না করে কেউ বের হতে চেতেন না। জুম্মার নামাজ শেষ হতে প্রায় দুটো বেজে যেতো। মুছুল্লিদের ক্ষুধা পেতো। হুজুর দোয়া করার আগে কিছুক্ষণ বয়ান করতেন। মুছুল্লিরা কেউ কেউ বলে উঠতেন “হুজুর, দোয়া কইরা দেইন।” হুজুর বলতেন “মুক্তাছার করতাছি। আর এটু বহুন।” মুক্তাছার মানে কি আমি জানি না। তবে বুঝে নিয়েছি ‘সংক্ষিপ্ত’। হুজুর হাছেন ক্কারী সাব ছিলেন মুক্তার আলী মাস্টার স্যারের বড় ভাই। উভয়ই খুব ভালো মানুষ।

আয়েন উদ্দিন সিকদার দাদার ছেলে হাছেন সিকদার কাক্কু খুব নিয়মিত মুছুল্লি ছিলেন। তিনি সবার আগে এসে প্রথম কাতারে ইমাম সাবের পিছনেই বসতেন। সবার শেষে তারাহুরো করে উপস্থিত হতেন ওহাদালী কাক্কু (ওয়াহেদ আলী)। ওহাদালী কাক্কু অল্প লেখাপড়া জানলেও সুর করে ভালো পুথি পড়তে পারতেন। আমি মাঝে মাঝে কাক্কুদের বাড়ি গিয়ে পুথি পড়তে বলতাম। কাক্কু বারান্দায় জলচৌকিতে বসে আমাকে পুথি পড়ে শুনাতেন। আমরা পুথিকে বলতাম কিতাব। এটা ছিলো জংগে কারবালার কিচ্ছা। কাক্কু চৌকিতে কিতাব খুলে রেখে সোজা হয়ে বসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিনয় করে কিতাব পাঠ করতেন। “ঘোরায় চড়িয়া মর্দ চলিতে লাগিলো ” বলার সময় মনে হতো যেনো কাক্কুই চড়ে তলোয়ার হাতে ছুটে চলেছেন। “শত শত মারা গেলো মর্দ কাতারে কাতার” শুনে মনে হতো কাক্কুর সামনেই শত শত সৈন্য শহীদ হয়ে পড়ে আছে। কিতাবের করুণ পংতিগুলো কাক্কু এক গালে হাত রেখে করুণ শুরে বিলাপ করে পড়তেন “ও সিমার সিমাররে……। “

জুম্মার নামাজের কোন টাইম টেবিল ছিলো না। সব মুছুল্লিরা চলে এলেই নামাজ শুরু হতো। সব মুছুল্লিরা চলে এলেও অনেক সময় মাদবর কাক্কুরা আসা পর্যন্ত হুজুর অপেক্ষা করতেন। ওহাদলী কাক্কু সবার শষে তারাহুরো করে এসে অজু করে টুপিটা মাথায় ঢুকাতে ঢুকাতে জুম্মাঘরে প্রবেশ করতেন। হাছেন সিকদার কাক্কু বলতেন ” হুজুর, নামাজ শুরু করুন। ওহাদালী আইপড়ছে।” হাছেন কাক্কু খুব ফক্কর ছিলেন। তিনি খালি হাসাতেন। একবার জুম্মায় আগে আসার গুরুত্ব নিয়ে মুক্তাছার বয়ান করছিলেন “জুম্মার নামাজে আগে আইলে বেশী লাভ। যেমন ধরুন, যে অজ প্রথম আইলো, হে পাইল একটা উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব, যে তারপর আইল, হে পাবো একটা গরু কোরবানি করার সমান ছোয়াব, তারপর যে আইলো হে পাবো একটা ছাগল কোরবানি করার সমান ছোয়াব, এভাবে কমতে কমতে সবার শেষে যে আইলো হে পাইলো একটা মুরগি কোরবানি করার সমান ছোয়াব।” হাছেন কাক্কু হেসে বলেন “হুজুর, মুরগি কোরবানি করার ছোয়াবটা তাইলে ওহাদালী পাবো।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কথা কইন না জানি কেউ।” আমি মনে করলাম “উট কোরবানি করার সমান ছোয়াবটা হাছেন কাক্কুই পেলেন।” অথচ ওয়াদালী কাক্কুর বাড়ি কিন্তু জুম্মাগরের কাছেই ছিলো। তারপরও উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করতে পারেননি।

আরেকদিন আল্লাহর নিয়ামত ও কুদরত নিয়ে হুজুর জুম্মাঘরে বয়ান দিতেছিলেন “আল্লাহ কত নিয়ামত আমাদেরকে দিয়েছেন! কত সুস্বাদু ফল দিয়েছেন আমাদের জন্য! কাঠাল, আম, জাম, কলা, লিচু, আনারস, এমন অনেক কিছু।” হাছেন কাক্কু খুশি হয়ে বলে উঠলেন “হুজুর, আর তেঁতুল। ঐডাই ত মজা বেশি। মনে অইয়াই জিলবায় পানি আই পড়ছে।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কতা কইন না জানি।”

আমাদের বাড়ি জুম্মা ঘর থেকে বেশ দূরে ছিলো। প্রায় আধা কিলোমিটার হবে। পাঞ্জেগানা নামাজ জামাতে আদায় করা সম্ভব হতো না। বাড়িতেই পড়ে নিতাম। উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করার ইচ্ছা থাকলেও আগে যেতে পারতামনা। তালুকদার বাড়ির বড় ছোট সব মুছুল্লিরা একত্র হতে সময় লাগতো। দল বেধে মুরুব্বিদের পিছনে হেটে যেতে হতো জুম্মায়। তাই একটু দেড়িতে পৌছতে হতো জুম্মায়। রমজান মাসে তারাবি নামাজে যেতে হতো রাতের অন্ধকারে সরু পথ দিয়ে। বুইদ্যা চালা ও জুয়াদালী কাক্কুদের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। সাপ ও জংলী শুকুরের ভয় ছিলো রাস্তায়। তাই দলবেধে হারিকেন, চুঙ্গাবাতি (মশাল), দোয়াত (কুপি বাতি), বদনাবাতি, বা পাটখড়ির (সোলা) আগুন জ্বালিয়ে এই দুর্গম পথে যেতে হতো তারাবি নামাযে। এই পথে ৪ টা ঘোনাও পারি দিতে হতো। ঘোনার পিচলা বাতর (আইল) থেকে অনেকেই কাদা ক্ষেতে অন্ধকারে পড়ে যেতাম। এমন কষ্ট করে যেতে হতো আমাদের জুম্মায়।

আমাদের মক্তবে যারা প্রথম কোরআন পড়ার উপযুক্ত হতেন তারা জুম্মার দিন জুম্মায় গিয়ে সবার সামনে কোরআন হাতে নিতেন। সবাই দোয়া করতেন। মিষ্টি বিতরন করা হতো এ উপলক্ষে। আমি ও এছাক ভাই একসাথে এই জুম্মায় এসে সবার সামনে কোর আন হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষক ছিলেন নোয়াখালী নিবাসী আব্দুল কদ্দুস ক্কারী সাব। তিনি পরে পাইন্নাবাইদ গ্রামে স্থায়ী হন। খুব ছোট ছিলাম। এত ছোট কাউকে কেউ কোরআন হাতে নিতে দেখেননি। তাই, সবাই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিলেন।

জুম্মায় আনন্দও ছিলো। একবার সবে ক্কদরের রাত জেগে ইবাদত করতে আমরা জুম্মাঘরে একত্র হয়েছিলাম। মাওলানা সালাউদ্দিন দুলাভাই এটার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। একটা খাসি জবাই করা হয়েছিলো। জুম্মাঘরের উত্তর পাশে মাটি কেটে চুলা করা হয়েছিলো। কয়েকজনে মিলে রান্না করছিলেন। বাকীরা জুম্মাঘরে বসে ইবাদতে মসগুল ছিলেন। আমার ভাগে পড়েছিলো দুই পাড়া কোরআন পড়া। একেক জনে একেক রকম ইবাদত করছিলেন। কোরআন পড়া শেষ করে আমি রান্না দেখতে গেলাম। এক জনে বললেন যে যারা রান্না করছে তারাও ইবাদতের ছয়াব পাবেন। ফিরে গিয়ে দেখি মাওলানা দুলাভাই বয়ান করছেন। আমি প্রবেশ করা মাত্রই দুলাভাই বললেন “এই যে, সাদেকই বলতে পারবে। সাদেক, বলতো চাঁদে কে কে পৌছেছিলো?” আমি একটু স্টাইল করে কথা বলে উত্তর দিলাম “নীল আর্মস্ট্রং, এড উইন ই অল্ড্রিন এন্ড মাইকেল কলিন্স।” তিনি বললেন “হে, সাদেক ঠিক বলছে। ও বিজ্ঞান জানে। কাজেই আমরা যে রকম দেখি চাঁদ সে রকম না। আল্লাহ চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সব সৃষ্টি করেছেন……….। “

আমাকে ১৯৭৫ সন থেকে পড়শুনা ও চাকরি করার জন্য গ্রামের বাইরে থাকতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে গ্রামে আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। সেহেতু ঐ কেন্দ্রীয় মসজিদে আমার আর যাওয়া হয় না। নওপাড়া ও চনপাড়ার মুছুল্লিদের সুবিধার্থে দুইপাড়ার সংযোগ স্থলে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তালুকদার বাড়ির মুসুল্লিদের সুবিধার্থে তালুকদার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানের পশ্চিম পাশে শিরিরচালা – সারাসিয়া রাস্তার ধারে আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আমি বাড়ি গিয়ে তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদে জুমআর নামাজ পড়ি। ইচ্ছা থাকলেও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও চনপাড়া জামে মসজিদে যেতে পারিনা। যদি যাই, তবে নিন্দুকেরা বলবে “ডাক্তরে নিজের বাড়ির মসজিদে না গিয়ে অন্য পাড়ার মসজিদে গেছে।” বস্তুত তিনটি মসজিদই আমাদের। তিনটি মসজিদেই গ্রামের মানুষের আর্থিক সহযোগিতা আছে। নামাজে মুছুল্লিদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। শুধু মসজিদ না, গ্রামের সবার সহযোগিতায় মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। একটা জিনিসের অভাব আছে, সেটা হলো পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা করার এখতিয়ার গ্রামের মানুষের নেই। এটা সরকারি অর্থায়নের কাজ। সরকার দেশের মেঘা মেঘা রাস্তার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। একদিন হয়তো পাকা রাস্তা হবে। সেদিন হয়তো আমরা থাকবোনা। ঘুমিয়ে থাকবো চির নিদ্রায় রাস্তার ধারের তালুকদার বাড়ি পারিবারিক গোরস্থানে বাবা-মার পাশে আসাদুজ্জামান তালুকদার মুকুলের মতো। পথচারীরা সালাম দিয়ে যাবে। মসজিদের মুছুল্লিরা জুমআর নামাজ শেষে দোয়া করবে “ইয়া, আল্লাহ, মেহেরবানী করে করববাসীদেরকে মাফ করে দিন।”

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

বড়বাইদপাড়া, সখিপুর, টাঙ্গাইল।

১৮ নভেম্বর ২০২২ খ্রি.

ময়মনসিংহ

এমন স্মৃতি কথা আরও পড়তে নিচের হ্যাস ট্যাগ শব্দের উপর ক্লিক করুন

#memoryofsadequel

ads banner:

Bag Niye Nadite Jhap

Bag Niye Nadite Jhap

ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে নদীতে ঝাপ দিলো

(স্মৃতি কথা)

ঢাকা থেকে বরিশাল ফিরছিলাম লঞ্চে কর্মস্থল চরামদ্দি ইউনিয়ন হেলথ সাব-সেন্টারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রতিমাসেই একবার এভাবে লঞ্চে রাতে যাতায়াত করতে হতো বরিশাল-ঢাকা-বরিশাল ১৯৮৮-৮৯ সনে। সরকারি বেতন মাসে ছিলো ১৮৫০ টাকা। লঞ্চের কেবিন ভাড়া ছিলো ৬০০ টাকা। তাই, সবসময় কেবিনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বেশি সময় লঞ্চের ডেকে শুয়ে যাতায়াত করতাম। ব্রীফকেসে একটা লুঙ্গি ও একটা তোয়ালে রাখতাম। বিকাল ৬ টা বা ৭টায় লঞ্চ ছাড়তো এদিকে ঢাকার সদরঘাট থেকে, ওদিকে বরিশাল সদরঘাট থেকে। সবাই একটা করে সিংগেল বিছানার চাদর সাথে রাখতো। এই চাদরে যতটুকু জায়গা দখল করা যায় ততটুকু জায়গা যাত্রীর অধীন ছিলো। ভাড়া ছিলো ৩০ টাকা। আমি ৩০ টাকার টিকিট কিনতাম। বরিশালের মানুষ আমাকে চিনত না। তাই, অতি সাধারণ ভাবে চলাফেরা করতে আমার লজ্জাবোধ হতো না। লঞ্চের হোটেলে ইলিশের ডিম দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে রাত আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম লুঙ্গি পরে, বিছার চাদর বিছিয়ে ব্রিফকেসের উপর মাথা রেখে। ব্রিফকেসের উপর তাওয়েল বিছাতাম। লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দে ভালো ঘুম হতো। ছেলে বা মেয়ে আগে উঠলে আগে যে যেখানে জায়গা পেতো সেখানেই চাদর বিছিয়ে জায়গা দখল করতো। পরিচয় যাতে কেউ জানতে না পারে সেজন্য সহযাত্রীদের সাথে তেমন আলাপ করতাম না। ব্রিফকেসের উপরের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লেখা নেইম কার্ডটি উল্টিয়ে রাখতাম। যখন বাসে যাতায়াত করতাম তখন নেইম কার্ডটি সোজা করে রাখতাম। কারন, ডাক্তার পরিচয় পেলে সহযাত্রীরা সম্মান করে ৩/৪ ইঞ্চি জায়গা ফাঁক করে দিতো। নিজের পরিচয় প্রকাশ করার জন্য আমি নিজেই সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করতাম “ভাই, কি করেন?” সহযাত্রী উত্তর দিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করতেন “ভাই, আপনি কি করেন?” আমি ডাক্তার পরিচয় দিলে একটু নড়ে চড়ে বসে ৩/৪ ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দিতো। আমি কাছে এসে বসুন বললে আরও বেশি করে জায়গা ছেড়ে দিতো।

যাহোক, লঞ্চের কথায় আসি। মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত একটা নির্দিষ্ট এলাকা নিয়ে বিছানা পারতো। ঐ এলাকাটার চারিদিকে চাদর ঝুলিয়ে পর্দা করে দিতো। তারা ঘুমাতো কিনা জানি না। যতক্ষণ আমি চেতন থাকতাম তাদেরকে গল্পসল্প, হৈহল্লা করে কাটাতে শুনতাম। এদের সংখ্যা সাধারণত ১২/১৪ জন হতো। এমনি এক লঞ্চ জার্নির সময় আমার শিতানের দিকে শুয়েছিলেন এক ভদ্রমহিলা ও তার পাশের জায়গায় শুয়েছিলো এক যুবক ছেলে। গভীর রাতে হঠাৎ সেই যুবক ভদ্রমহিলার ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে মাঝ নদীতে ঝাপ দিলো। যাত্রীদের কোলাহল শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। লঞ্চ থামতে থামতে ছেলেটি অনেক দূরে পড়ে গেলো। লঞ্চ ছেলেটিকে ধরার জন্য পেছাতে লাগলো। ততক্ষণে ছেলেটি নদীর কিনারে কাঁশবনে উঠে পড়লো। ওখানে আগে থেকেই তার সহকর্মীরা তাকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তারা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে কাঁশবনে হারিয়ে গেলো। আমার ব্রিফকেস কেউ ছিন্তাই করতে পারেনি। কারন, ওটা থাকতো আমার মাথার নিচে। নিলেও সমস্যা ছিলো না। টাকা রাখতাম আন্ডারওয়্যারের নিচের পকেটে।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ময়মনসিংহ

১ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি.

#memoryofsadequel #charamoddisadequel

এমন গল্প আরও পড়তে হ্যাস্ট্যাগ শব্দে ক্লিক করুন।