Tag Archives: Salah Uddin

Salah Uddin

Mawlana Salah Uddin

মাওলানা সালাউদ্দিন

Maolana Salah Uddin

মাওলানা সালাউদ্দিন ছিলেন আমার চাচাতো বোন হেলেনা আপার স্বামী। আরবী লাইনে লেখাপড়া করলেও তিনি বেশ বিজ্ঞান মনস্ক ও সাংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু পরিবারকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তিনি বিয়ের পর জমি জমা কিনে আমাদের গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি নিকাহ রেজিস্ট্রার করতেন। তিনি কাকরাজান ইউনিয়নের বিবাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। বিবাহ রেজিস্ট্রি করাকে ইসলামি পরিভাষায় কাবিননামা বলা হয়। আমরা সংক্ষেপে কাবিন বলতাম। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কাবিন করলে দুলাইভাই বেশী ফি নিতেন। তাই, অনেকেই দুলাভাইর বাড়িতে এসে কাবিন করাতেন। যিনি কাবিন রেজিস্ট্রি করতেন তাকে বলা হয় কাজী। তাই দুলাভাইকে কাজীও বলা হতো। দুলাভাই মারা যাবার পর তার মেজো ছেলে কচুয়া পাবলিক হাই স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পায় এবং কাজীর কাজটাও পায়। এখন তার কাছে কাজীর কাজটা নেই। দুলাভাইর ছোট ছেলে রুহুল আমীনও ঘোনারচালা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। বড় ছেলে আব্দুল হালিম প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করে।

আমি ছোটবেলা থেকেই দেখতাম দুলাভাই কাবিন করেন। তিনি কচুয়া আব্দুল্লাহ স্যারদের বাড়ির জামে মসজিদের শুক্রবার জুম্মায় ইমামতিও করতেন। দুলাভাইর সাথে আমি দু-এক বাড়িতে কাবিন করতেও গিয়েছি। ভালো খাবারও খেয়েছি।

শীতের দিনে তিনি বাহিরবাড়ির ধানিখোলায় খর বিছিয়ে তার তার উপর পিঠের বেতের পাটি বিছিয়ে কাবিন করতে বসতেন। বর ও কনে উভয় পক্ষই আসতেন। তারাও পাটির উপর বসতেন। গ্রামের মানুষ তামাসা দেখতে ভালোবাসে। তাই, যেখানে কয়েকজন লোক একত্র বসত সেখানেই গিয়ে সবাই ভীর করতো। কোথাও দুইপক্ষ ঝগড়া বাঁধালেও সবাই তামসা দেখতে যেতো। একবার গোড়াই থেকে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে, বয়স খুব সম্ভব ১৬-১৭ হবে, হাত ধরে ঘুরাফিরা করছিল কচুয়া হাটের রাস্তায়। শুনলাম তারা একে অপরকে ভালোবেসে, বাবা-মার অমতে বিয়ে করার উদ্যেশে বের হয়ে পড়েছে। লোকে বলত বাইরইয়া পড়ছে। কাজেই তাদেরকে ভিন গ্রামের মানুষ ধরে বিয়ে পড়িয়ে দিত। এই জুটির পিছনে প্রায় ৫০-৬০ জন ছেলে মেয়ে তামসা দেখছিল। আমিও কিছুক্ষণ তামসা দেখলাম।

একবার পশ্চিম দিক থেকে কয়েকজন লোক এসেছিল দুলাভাইর কাছে কাবিন করতে। তাদের বেশভূষা দেখে গরীব মনে হলো। কনেটাকে আমার কাছে অসহায় মনে হলো। বর পক্ষের লোকগুলোকে তেমন সভ্য মনে হলো না। দুলাভাই কাবিন রেজিস্ট্রার খাতায় লিখার পর সরকারি ফি নিয়ে নিলেন। তারপর কনের উদ্দেশ্যে বললেন “অমুকের ছেলে তমুক এত টাকার দেন মোহর সাব্যস্ত করিয়া আপনাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়াছে। আপনি রাজি আছেন?” কনে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কিছুই বললো না। দুলাভাই দ্বিতীয় বার ওকথাগুলো বললেন। কনে অনেকক্ষণ চুপ করেই রইলো ঘোমটা দিয়ে। তৃতীয় বার দুলাভাই বিরক্তির সাথে কথাগুলো বলে ধমকের সুরে উচ্চকণ্ঠে বললেন “রাজি আছেন?” কনে বিস্ফোরিত কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলে উঠল “রাজি আছি।” আমি চমকে গিয়ে খেরের উপর ঢলে পড়লাম। কনে ফিকুরে ফিকুরে কান্না করতে লাগলো। আমি তখন ক্লাস সেভেন না এইটে পড়ি। আমার মনে হলো এটা ঠিক না। জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। দুলাভাই কিছুক্ষণ মেয়েটির কান্না শুনলেন। আমি দুলাভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুলাভাই চুপ করে রইলেন। দুলাভাই বললেন “এ বিয়ে হবে না।” বরপক্ষ বললেন “কনে রাজি আছে বলছে। বিয়ে হয়ে গেছে।” দুলাভাই বললেন “না, হবে না। সমস্যা আছে। কাবিন বাতিল।” মেয়েটি আরও পরিস্কার করে কান্না করতে লাগলো। অনেক কথাকাটাকাটির বরপক্ষ কাবিনের ফি ফেরত চাইল। দুলাভাই বললেন “কাবিনের পাতা খরচ হয়ে গেছে। আমি বই হিসাবে কিনে আনি। ফেরত পাবেন না। আপনাদের বিচার হবে। আপনারা জোর করে মেয়ে বিয়ে করতে নিয়ে এসেছেন। মেয়ে রাজি না। আমার ধমক শুনে রাজি বলেছে। মেম্বার ও পাড়ার মাদবর নিয়ে আসুন। তারপর কাগজ দেয়া হবে।” পরে কি হয়েছিল আমি জানি না।

কাবিননামা শেষ হলে বরের হাতের উপর কনের বাবার হাত রেখে দুলাভাই পাঠ করাতেন কনের বাবাকে “বলুন, আমার কন্যা, মুসাম্মত অমুক খাতুনকে এত টাকা দেন মোহরে আপনার কাছে বিবাহ দিলাম।” দুলাভাই বরকে বলতে বলতেন “আপনি বুলুন, কবুল, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করিলাম।” বর বলতেন “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করিলাম।” দুলাভাই বরের উদ্যেশ্যে বলতেন “আপনার বিবিকে ভরনপোষণ দিবেন, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী চলাফেরা করাবেন এবং পর্দা পুশিদায় রাখবেন। তিন মাসের অধিক কাল নিরুদ্দেশ থাকিলে, পাগল কিংবা কারাগারাবদ্ধ হইলে বিবি আপনাকে তালাক দিতে পারিবেন। খাতা বন্ধ করলে বরপক্ষ সবাইকে খাজা বাতাসা ও কদমা খাওয়াইত। আমার কাছে সাদা কদমা খুব মজা লাগতো।

আমাদের গ্রামে একজন গরীব লোক ছিল। নিজের জমি ছিলো না। খুব আলসে ছিল। বোকাও ছিল। তার নাম লিখলাম না। ছদ্মনাম দিলাম হামজা। হামজা ভাই মাঝে মাঝে বোকার মতো কথা বলতেন। কেউ বোকার মতো কথা বললে আমরা বলতাম ” তুই অবা হামজা ভাইর নাগাল কথা কস ক্যা?” চৈত্র মাসে অথবা যে মাসে কোন কাজ থাকত না সেই মাসে হামজা ভাই খাবেন কী। কামলা দিলে যা টাকা পাওয়া যেতো সেই টাকা দিয়ে হামজা ভাই চাউল ও আটা কিনে খেতেন। মানে, দিন এনে দিন খেতেন। একদিন কামলা না দিলে না খেয়ে থাকতে হতো তার স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ। হামজা ভাইর বউ পরের ধান ভেনে অল্প কিছু চাউল পেতেন। আঁচলে করে আনতেন। শরীর খুব দুর্বল ছিল অল্প খেয়ে খেয়ে। তাই, ঢেকিতেও তেমন বল করে পার দিতে পারতেন না। যেদিন কামলা দিতে না পারতেন সেদিন হামজা ধনি বাড়ি থেকে এক কামলার দাম নিতেন। সেই টাকায় কাজের সময় তিনি কামলা দিয়ে পরিশোধ করতেন। মৌসুমের সময় কামলার দাম দুইগুন তিনগুন হলেও তিনি তা নিতে পারতেন না। যেহেতু তিনি অগ্রিম টাকা নিয়ে নিয়েছেন। অগ্রিম টাকা নিয়ে মৌসুমের সময় কামলা দিলে তাকে বলা হয় ঠুকা কামলা। হামজা ভাই ছোটদের মতো সামনে ভাজ করে লুঙ্গি পরতেন। তাই, আরও বোধাই বোধাই দেখা যেতো। কম বয়সেই তিনজন সন্তান রেখে হামজা ভাইর স্ত্রী মারা যান।

গ্রামে গরীব পরিবার স্ত্রী ছাড়া চলতে পারে না। তাই, হামজা ভাই আরেকটি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বিয়ের কাবিনের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। হামজা ভাই কিস্তিটুপি পাতালি করে পরেছিলেন। তাতে আরও বোধাই বোধাই লাগছিলো। যথারীতি কাবিন সম্পাদন করে হামজা ভাইর হাত ধরলেন তার শশুর। কাজী বলতে বললেন “বলুন, আমার কন্যা।” হামজা ভাইর শশুরে বলার কথা। ভুলক্রমে হামজা ভাই বলে ফেললেন “আমার কন্যা।” দুলাভাই ধমক দিয়ে বললেন “এই বোধাই, কারে কী কয়।” আমি ও মজি ভাই হাসতে হাসতে খেরের উপর লুটিয়ে পড়লাম।

২২/৪/২০২২ খ্রি.
ময়মনসিংহ