Tag Archives: story

Amir Ali

আমীর আলীর শেষ বিদায়

(স্মৃতি কথা)

সাগরদিঘি পর্যন্ত এলেই আমীর আলীর ফোন এলো। কুশল বিনিময় হলো।

– কোথায় তুমি?

– আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসতেছি। ঢনঢনিয়া পর্যন্ত এসে গেছি।

– কোন সমস্যা হইছে?

– না, এমনিতেই তোমার সাথে দেখা করতে আসতেছি।

– তা, তুমি আসবে, আমাকে জানিয়ে আসবে না? ১৪/১৫ কিলোমিটার পথ হেটে এসে এখন ফোন করছো? আমি তো চলে যাচ্ছি ময়মনসিংহ। প্রাইভেট কারে যাচ্ছি। সাগরদিঘি পর্যন্ত এসে গেছি। ময়মনসিংহ গিয়ে অফিস ধরতে হবে। পরে একদিন দেখা করবো, ইনশাআল্লাহ। তুমি আমাদের বাড়ি যাও। আমি ভাতিজা মান্নান তালুকদারকে বলে দিচ্ছি তোমাকে আমার লেখা স্মৃতি কথার বইগুলো দিয়ে দিতে।

মান্নান আমীর আলীকে বই প্রদানের ছবি তুলে আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়।

এর বেশ কিছু দিন পর আমীর আলী ফোন করে। কিন্তু তার কথা ভালো করে বুঝা যাচ্ছিল না। তার ছেলে আমাকে বুঝিয়ে বললো যে, তার বাবার জিহবার এক কিনারায় বিড়াট একটা ঘা হয়েছে, জিহবা নাড়াতে পারেন না। খেতেও পারেন না, কথা বলতেও পারেন না। এরপর যতবার ফোন করেছে আমি আমির আলীর কথা তেমন বুঝতে পারিনি। আমি অনুরোধ করে আমীর আলীকে ময়মনসিংহ আনালাম। দীর্ঘ বছর পর আমার বাল্য বন্ধুর সাথে দেখা হলো। আমি তাকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। কেউ কথা বলছিলাম না। একে অপরের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। ছেড়ে দিয়ে আমীর আলীর জিহবার ঘা দেখলাম। আমার মনে হলো ক্যান্সার হয়েছে। আমি নিজেই তার এফএনএসি পরীক্ষা করলাম। ক্যান্সারই ধরা পরলো। চিঠি লিখে মুখ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ শমরেস কুন্ডু দাদার কাছে পঠালাম। দাদা বায়োপসি করে আমার কাছে সেম্পল পাঠালেন। আমীর আলী বাড়িতে চলে গেলো। তিন দিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট দিলাম, ক্যান্সার।

Continue reading

Cesarean section

Cesarean section

সিজার অপারেশন ছাড়াই বাচ্চা হয় কেমনে?

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

শিক্ষার্থীদেরকে কোন কিছু শিখাতে গেলে তার বয়সের দিকে একটু খেয়াল রাখতে হয়। আমি একদিন এই রকম একটা সমস্যায় পড়েছিলাম। ঈদের ছুটিতে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে ও মেয়ে একজায়গায় বসে গল্প করছিলো । আমি ভাবলাম এই সুযোগে তাদেরকে একটু ধর্মীয় জ্ঞান দেই। আমি মানব সৃষ্টির শুরুটা কেমন ছিল বুঝাতে গিয়ে আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) এর সৃষ্টির কাহিনী বললাম। বিবি হাওয়ার অনেক সন্তান হলো বললাম। এরপর বলতে চেয়েছিলাম “যেহেতু সেই সময় আদমের সন্তান ছাড়া আর কোন মানুষের সন্তান ছিলনা, তাই ভাই-বোনের মধ্যেই বিয়ে সম্পাদন হয়। তারপর বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম হয় এবং এভাবে মানব সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন এই অবস্থা হয়েছে।” এর আগেই এক শিশু আমার গল্পে বাধা দিয়ে বলল “তখন তো আদম ও হাওয়া ছাড়া আর কেউ ছিলনা। তাইলে সিজার অপারেশন করে দিলো কোন ডাক্তারে?

– সিজার ছাড়াই হইছে।

– সিজার ছাড়াই বাচ্চা হয়? আমরা এখানে সবাই সিজার অপারেশন হয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মেছি। আদমের সন্তানরা সিজার ছাড়াই জন্মিল কেমনে?

আমি ভেবাচেকা খেয়ে গল্প বাদ দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলাম

বইটি ঘরে বসে পেতে নিচের ছবির উপর ক্লিক করুন

শৈশবের একাত্তর

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

Jummaghor

Jummaghor

আমাদের গ্রামের জুম্মাঘর

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমি বুঝমান হয়েই দেখেছি আমাদের বড়বাইদপাড়া গ্রামের আজিম উদ্দিন সিকদার বাড়ির কেন্দ্রীয় মসজিদটি। আমরা বলতাম জুম্মাঘর। এটার চালের ছাউনি ছিলো ঢেউ টিনের। বেড়া ছিল চেপটা টিনের। মেঝে ছিল কাঁচা। চট বিছিয়ে নামাজ পড়তাম। ঐ বাড়ির মানুষ জুম্মা ঘরে পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করতেন আজান দিয়ে। গ্রামের মুছুল্লিরা শুধু শুক্রবার জুম্মার নামাজ জামাতে আদায় করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার কাক্কী (জয়নাল ভাইর মা) জুম্মাঘরের মাইঝাল (মেঝে) ও পিড়া (ডোয়া) হাইল মাটি (বাইদের মাটি) দিয়ে লেপে দিতেন।

আজিম উদ্দিন সিকদার দাদা বহরমপুর থেকে এসে এখানে বাড়ি করে একটা পুকুর খনন করেন সেই ব্রিটিশ আমলে। পুকুরের পশ্চিম পাশে তিনি এই জুম্মাঘর নির্মাণ করেন গ্রামের মানুষের নামাজ আদায় করার জন্য। উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া, পূর্বপাড়া, তালুকদার বাড়ি, নওপাড়া ও চনপাড়ার সব মুছুল্লিরা এই মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মিলন মেল হতো। মসজিদ প্রাঙ্গণে বড় আম গাছ ছিলো। সেই আমগাছের নিচে একটা বাঁশের মাচাং ও দুইটা ঘোড়া কাঠ ছিলো। নামাজ শুরুর আগে ও পরে এখানে বসে যুকক ও কিশোর বয়সের মুছুল্লিরা খোস গল্প করতো। গ্রামের মানুষের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে বড়রাও আলাপ আলোচনা করতেন। গ্রামের মাতবর ছিলেন কোরবান আলী সিকদার কাক্কু ও কাশেম তালুকদার কাক্কু (মিয়াকাক্কু)। মাতবরের মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারতো না।

এই মসজিদের ইমাম ছিলেন শিরিরচালার হাছেন ক্কারীসাব। তিনি শুক্রবারের জুম্মার নামাজে ইমামতি করতেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে মিলাদ পড়ে দোয়া করে বখসিয়ে দিতেন। আমাদের শমে কাক্কুও মিলাদ পড়াতেন। আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন তালেবে ইলিম হিসাবে।

আমগাছ তলায় মাঝে মাঝে মাসআলা নিয়ে অল্প বয়সের যুবকদের মধ্যে তর্ক লেগে যেতো। মিয়া কাক্কু এগিয়ে এসে থামিয়ে দিয়ে সঠিক মাসআলা কি হবে বলে দিতেন। মিয়া কাক্কুর উপরে কেউ কোন মাসআলা বলতে সাহস পেতো না। মাসআলা বলার পরে এটা পাকাপোক্ত করার জন্য ইমাম সাবকে জিজ্ঞেস করতেন “তাই না হুজুর?” হুজুর ইতস্তত করে গোল টুপিটা ডান হাত দিয়ে হালকা ঘুরান মেরে বলতেন “ঐত্য।” তারপর টুপিটা মাথা থেকে খুলে ফু দিয়ে গোল করে আবার মাথায় পরে দ্রুত চলে যেতেন জুম্মা ঘরের ভিতর। ‘ঐত্য’ কথাটি একটি হালকা সম্মতিসরূপ একটি শব্দ। আমার মেয়ে দুটি যখন ছোট ছিলো তখন দুজনে মাঝে মাঝে তর্কে করে কার কথা ঠিক এটির সমাধান নিতে আমার কাছে এলে আমিও বলে দিতাম “ঐত্য। তোমাদের জন্য আজ কি যেনো আনত হবে?”

ইমাম সাব ছিলেন ক্কারী। অল্প কিছু মাস আলা জানতেন। অল্প কিছু বয়ান করতেন খুতবার আগে অথবা নামাজের পর দোয়ার আগে। দোয়াকে মুছুল্লিরা খুব প্রয়োজন মনে করতেন। শেষ দোয়া না করে কেউ বের হতে চেতেন না। জুম্মার নামাজ শেষ হতে প্রায় দুটো বেজে যেতো। মুছুল্লিদের ক্ষুধা পেতো। হুজুর দোয়া করার আগে কিছুক্ষণ বয়ান করতেন। মুছুল্লিরা কেউ কেউ বলে উঠতেন “হুজুর, দোয়া কইরা দেইন।” হুজুর বলতেন “মুক্তাছার করতাছি। আর এটু বহুন।” মুক্তাছার মানে কি আমি জানি না। তবে বুঝে নিয়েছি ‘সংক্ষিপ্ত’। হুজুর হাছেন ক্কারী সাব ছিলেন মুক্তার আলী মাস্টার স্যারের বড় ভাই। উভয়ই খুব ভালো মানুষ।

আয়েন উদ্দিন সিকদার দাদার ছেলে হাছেন সিকদার কাক্কু খুব নিয়মিত মুছুল্লি ছিলেন। তিনি সবার আগে এসে প্রথম কাতারে ইমাম সাবের পিছনেই বসতেন। সবার শেষে তারাহুরো করে উপস্থিত হতেন ওহাদালী কাক্কু (ওয়াহেদ আলী)। ওহাদালী কাক্কু অল্প লেখাপড়া জানলেও সুর করে ভালো পুথি পড়তে পারতেন। আমি মাঝে মাঝে কাক্কুদের বাড়ি গিয়ে পুথি পড়তে বলতাম। কাক্কু বারান্দায় জলচৌকিতে বসে আমাকে পুথি পড়ে শুনাতেন। আমরা পুথিকে বলতাম কিতাব। এটা ছিলো জংগে কারবালার কিচ্ছা। কাক্কু চৌকিতে কিতাব খুলে রেখে সোজা হয়ে বসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিনয় করে কিতাব পাঠ করতেন। “ঘোরায় চড়িয়া মর্দ চলিতে লাগিলো ” বলার সময় মনে হতো যেনো কাক্কুই চড়ে তলোয়ার হাতে ছুটে চলেছেন। “শত শত মারা গেলো মর্দ কাতারে কাতার” শুনে মনে হতো কাক্কুর সামনেই শত শত সৈন্য শহীদ হয়ে পড়ে আছে। কিতাবের করুণ পংতিগুলো কাক্কু এক গালে হাত রেখে করুণ শুরে বিলাপ করে পড়তেন “ও সিমার সিমাররে……। “

জুম্মার নামাজের কোন টাইম টেবিল ছিলো না। সব মুছুল্লিরা চলে এলেই নামাজ শুরু হতো। সব মুছুল্লিরা চলে এলেও অনেক সময় মাদবর কাক্কুরা আসা পর্যন্ত হুজুর অপেক্ষা করতেন। ওহাদলী কাক্কু সবার শষে তারাহুরো করে এসে অজু করে টুপিটা মাথায় ঢুকাতে ঢুকাতে জুম্মাঘরে প্রবেশ করতেন। হাছেন সিকদার কাক্কু বলতেন ” হুজুর, নামাজ শুরু করুন। ওহাদালী আইপড়ছে।” হাছেন কাক্কু খুব ফক্কর ছিলেন। তিনি খালি হাসাতেন। একবার জুম্মায় আগে আসার গুরুত্ব নিয়ে মুক্তাছার বয়ান করছিলেন “জুম্মার নামাজে আগে আইলে বেশী লাভ। যেমন ধরুন, যে অজ প্রথম আইলো, হে পাইল একটা উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব, যে তারপর আইল, হে পাবো একটা গরু কোরবানি করার সমান ছোয়াব, তারপর যে আইলো হে পাবো একটা ছাগল কোরবানি করার সমান ছোয়াব, এভাবে কমতে কমতে সবার শেষে যে আইলো হে পাইলো একটা মুরগি কোরবানি করার সমান ছোয়াব।” হাছেন কাক্কু হেসে বলেন “হুজুর, মুরগি কোরবানি করার ছোয়াবটা তাইলে ওহাদালী পাবো।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কথা কইন না জানি কেউ।” আমি মনে করলাম “উট কোরবানি করার সমান ছোয়াবটা হাছেন কাক্কুই পেলেন।” অথচ ওয়াদালী কাক্কুর বাড়ি কিন্তু জুম্মাগরের কাছেই ছিলো। তারপরও উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করতে পারেননি।

আরেকদিন আল্লাহর নিয়ামত ও কুদরত নিয়ে হুজুর জুম্মাঘরে বয়ান দিতেছিলেন “আল্লাহ কত নিয়ামত আমাদেরকে দিয়েছেন! কত সুস্বাদু ফল দিয়েছেন আমাদের জন্য! কাঠাল, আম, জাম, কলা, লিচু, আনারস, এমন অনেক কিছু।” হাছেন কাক্কু খুশি হয়ে বলে উঠলেন “হুজুর, আর তেঁতুল। ঐডাই ত মজা বেশি। মনে অইয়াই জিলবায় পানি আই পড়ছে।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কতা কইন না জানি।”

আমাদের বাড়ি জুম্মা ঘর থেকে বেশ দূরে ছিলো। প্রায় আধা কিলোমিটার হবে। পাঞ্জেগানা নামাজ জামাতে আদায় করা সম্ভব হতো না। বাড়িতেই পড়ে নিতাম। উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করার ইচ্ছা থাকলেও আগে যেতে পারতামনা। তালুকদার বাড়ির বড় ছোট সব মুছুল্লিরা একত্র হতে সময় লাগতো। দল বেধে মুরুব্বিদের পিছনে হেটে যেতে হতো জুম্মায়। তাই একটু দেড়িতে পৌছতে হতো জুম্মায়। রমজান মাসে তারাবি নামাজে যেতে হতো রাতের অন্ধকারে সরু পথ দিয়ে। বুইদ্যা চালা ও জুয়াদালী কাক্কুদের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। সাপ ও জংলী শুকুরের ভয় ছিলো রাস্তায়। তাই দলবেধে হারিকেন, চুঙ্গাবাতি (মশাল), দোয়াত (কুপি বাতি), বদনাবাতি, বা পাটখড়ির (সোলা) আগুন জ্বালিয়ে এই দুর্গম পথে যেতে হতো তারাবি নামাযে। এই পথে ৪ টা ঘোনাও পারি দিতে হতো। ঘোনার পিচলা বাতর (আইল) থেকে অনেকেই কাদা ক্ষেতে অন্ধকারে পড়ে যেতাম। এমন কষ্ট করে যেতে হতো আমাদের জুম্মায়।

আমাদের মক্তবে যারা প্রথম কোরআন পড়ার উপযুক্ত হতেন তারা জুম্মার দিন জুম্মায় গিয়ে সবার সামনে কোরআন হাতে নিতেন। সবাই দোয়া করতেন। মিষ্টি বিতরন করা হতো এ উপলক্ষে। আমি ও এছাক ভাই একসাথে এই জুম্মায় এসে সবার সামনে কোর আন হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষক ছিলেন নোয়াখালী নিবাসী আব্দুল কদ্দুস ক্কারী সাব। তিনি পরে পাইন্নাবাইদ গ্রামে স্থায়ী হন। খুব ছোট ছিলাম। এত ছোট কাউকে কেউ কোরআন হাতে নিতে দেখেননি। তাই, সবাই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিলেন।

জুম্মায় আনন্দও ছিলো। একবার সবে ক্কদরের রাত জেগে ইবাদত করতে আমরা জুম্মাঘরে একত্র হয়েছিলাম। মাওলানা সালাউদ্দিন দুলাভাই এটার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। একটা খাসি জবাই করা হয়েছিলো। জুম্মাঘরের উত্তর পাশে মাটি কেটে চুলা করা হয়েছিলো। কয়েকজনে মিলে রান্না করছিলেন। বাকীরা জুম্মাঘরে বসে ইবাদতে মসগুল ছিলেন। আমার ভাগে পড়েছিলো দুই পাড়া কোরআন পড়া। একেক জনে একেক রকম ইবাদত করছিলেন। কোরআন পড়া শেষ করে আমি রান্না দেখতে গেলাম। এক জনে বললেন যে যারা রান্না করছে তারাও ইবাদতের ছয়াব পাবেন। ফিরে গিয়ে দেখি মাওলানা দুলাভাই বয়ান করছেন। আমি প্রবেশ করা মাত্রই দুলাভাই বললেন “এই যে, সাদেকই বলতে পারবে। সাদেক, বলতো চাঁদে কে কে পৌছেছিলো?” আমি একটু স্টাইল করে কথা বলে উত্তর দিলাম “নীল আর্মস্ট্রং, এড উইন ই অল্ড্রিন এন্ড মাইকেল কলিন্স।” তিনি বললেন “হে, সাদেক ঠিক বলছে। ও বিজ্ঞান জানে। কাজেই আমরা যে রকম দেখি চাঁদ সে রকম না। আল্লাহ চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সব সৃষ্টি করেছেন……….। “

আমাকে ১৯৭৫ সন থেকে পড়শুনা ও চাকরি করার জন্য গ্রামের বাইরে থাকতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে গ্রামে আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। সেহেতু ঐ কেন্দ্রীয় মসজিদে আমার আর যাওয়া হয় না। নওপাড়া ও চনপাড়ার মুছুল্লিদের সুবিধার্থে দুইপাড়ার সংযোগ স্থলে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তালুকদার বাড়ির মুসুল্লিদের সুবিধার্থে তালুকদার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানের পশ্চিম পাশে শিরিরচালা – সারাসিয়া রাস্তার ধারে আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আমি বাড়ি গিয়ে তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদে জুমআর নামাজ পড়ি। ইচ্ছা থাকলেও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও চনপাড়া জামে মসজিদে যেতে পারিনা। যদি যাই, তবে নিন্দুকেরা বলবে “ডাক্তরে নিজের বাড়ির মসজিদে না গিয়ে অন্য পাড়ার মসজিদে গেছে।” বস্তুত তিনটি মসজিদই আমাদের। তিনটি মসজিদেই গ্রামের মানুষের আর্থিক সহযোগিতা আছে। নামাজে মুছুল্লিদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। শুধু মসজিদ না, গ্রামের সবার সহযোগিতায় মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। একটা জিনিসের অভাব আছে, সেটা হলো পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা করার এখতিয়ার গ্রামের মানুষের নেই। এটা সরকারি অর্থায়নের কাজ। সরকার দেশের মেঘা মেঘা রাস্তার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। একদিন হয়তো পাকা রাস্তা হবে। সেদিন হয়তো আমরা থাকবোনা। ঘুমিয়ে থাকবো চির নিদ্রায় রাস্তার ধারের তালুকদার বাড়ি পারিবারিক গোরস্থানে বাবা-মার পাশে আসাদুজ্জামান তালুকদার মুকুলের মতো। পথচারীরা সালাম দিয়ে যাবে। মসজিদের মুছুল্লিরা জুমআর নামাজ শেষে দোয়া করবে “ইয়া, আল্লাহ, মেহেরবানী করে করববাসীদেরকে মাফ করে দিন।”

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

বড়বাইদপাড়া, সখিপুর, টাঙ্গাইল।

১৮ নভেম্বর ২০২২ খ্রি.

ময়মনসিংহ

এমন স্মৃতি কথা আরও পড়তে নিচের হ্যাস ট্যাগ শব্দের উপর ক্লিক করুন

#memoryofsadequel

ads banner:

kathal churi

কাঁঠাল চুরি

(স্মৃতি কথা)

তখন ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়তাম। তখন আম-কাঁঠাল গাছ তেমন বেশী ছিলো না। যেহেতু, তালুকদারদের মধ্যে মেঝ দাদা মেছের আলী তালুকদার প্রথম এই গ্রামে এসে বাড়ি করেছিলেন সেহেতু দাদাদের গাছগুলো তুলনামূলক বড় ছিলো। কি কারনে যেন আমরা মেছের দাদার স্ত্রী, যিনি আমাদের দাদী হন তাকে সব নাতী নাত্নিরা বাব্বু ডাকতাম। বাব্বু আমার বাবার আপন চাচী। মুকুলের আপন দাদী। দাদুদের গাছগুলো প্র‍্থম দিকে বাব্বুই লাগিয়েছিলেন। তাই, গাছগুলোর নাম বাব্বুর নামে হয়েছে। যেমন, বাব্বুর কাঁঠাল গাছ, বাব্বুর আম গাছ। বাব্বুর কাঁঠাল গাছটা ছিল বাব্বুগ ঘরের পিছে, বাঁশ আড়ার সাথে । তাই কাঠাল চুরি করা সহজ ছিলো।

এই কাঁঠাল পাকলে হয় জুম্মাঘরে দেয়া হবে শুক্রবারে। না হয় ভেঙ্গে বাব্বু মুকুলকে খাইয়ে দিবে। না হয় বাটি ভর্তি রোয়া নিয়ে ছোট কাক্কুর হাতে দিবে। এটাই ছিলো আমাদের ধারণা। শাজাহান, রাজ্জাক, মুকুল ও আমি সাধারণত এক সাথে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। বাব্বু মুকুলকে খুব আদর করতেন এবং চোখে চোখে রাখতেন। আমরা মুকুলকে নিয়ে যেদিকে যেতাম, বাব্বুও সেদিকে যেতেন। কাঁঠালটা বড় হলে পাকলো কিনা জানার জন্য পাজুন (গরু পিটানোর লাঠি) দিয়ে বারি দিতাম প্রতিদিন একবার করে। একসময় পাকার জন্য আর ধৈর্য্য ধরে না। সিদ্ধান্ত নিলাম পেড়ে মুখে কচি ঠুকায়ে পাঁকাবো। তাতে তো আমাদের লাভ হবে না। মুকুল একা খেতে পারবে, আমরা পারবো না। তিনজনে সিদ্ধান্ত নিলাম মুকুলকে সাথে নিয়ে এই কাঁঠাল চুরি করবো। তাতে ধরা পরলে মুকুল সাথে থাকলে কেউ চোর বলতে পারবে না। সেই মতো একদিন আমরা কাঠালটা ঝেংটা টান মেরে পেড়ে বাঁশ আড়ার ভিতর দিয়ে লুকিয়ে এক দৌড়ে ঘোনা পার হয়ে বুইদ্যা চালার জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লাম। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে গর্তে কাঠাল রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে ফেললাম। তারপর ৪ চোর মিলে বুইদ্যা চালার মাঝখানে যেখানে বন ছিলনা সেখানে বসে শলাপরামর্শ করলাম কিভাবে ফলোআপ দিতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো সব চোর একাত্র হয়ে প্রতিদিন একবার করে কাঁঠাল দেখে যাব। একটা আসংকা ছিলো যে কাঁঠাল পেকে গেলে আড়ার শিয়াল মাটি থেকে কাঁঠাল তুলে খেয়ে ফেলবে। তাই রাতে হুয়া হুয়া করে শিয়াল ডাকলে মনে করতাম কাঁঠালটা খেয়ে শিয়াল আনন্দ করছে। কাঁঠাল দেখতে যাওয়ার আগে আমরা একে অন্যকে ডাকতাম। সিদ্ধান্ত হয়েছিলো যে “ঠাল” বললে মনে করবো ঐ চুরি করা কাঠাল।

in-feed-ads:

একদিন আমি শাজাহানকে ডাকলাম “এই শাজাহান, ঠাল।” অন্যরাও বলে উঠলো “ঠাল।” সেখানে কয়েকজন মুরুব্বিও ছিলেন। মোতালেব ভাই বললেন “কি ব্যাপার? কিসের ঠাল?” আমি বললাম “এটা আপনি বুঝবেন না। এটা আমাদের সাংকেতিক ভাষা।” ভাই বললেন “বুঝব না মানে? কাঁঠাল চুরি করছস। এখন কাঁঠালকে বলছস ঠাল। তাই না?” আমরা বললাম “তা না।” তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম জেড়ার হাত থেকে। পরামর্শ করলাম এখন থেকে ঠাল বলা যাবে না। বলবো লঠাকা। রাজ্জাক বললো “এটা বললে আবার ধরা খাবা। বাশার ভাই বানান উল্টো করে কথা বলতে পারে। বুঝে ফেলবেন লঠাকা মানে কাঠাল।” চুরি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঐদিন আর ফলোআপ দিতে গেলাম না। পরেরদিন গিয়ে দেখি শিয়ালে কাঁঠাল খেয়ে মাটির সাথে চেড়াবেড়া করে রেখে গেছে। কেইত্তা দেখে মনে হলো বাত্তি হইছিলো না। আমরা খেলে হয়তো পাইনছা লাগতো। যাহোক, চুরিটা সাকসেসফুল হলো না।

বড় হয়ে বুঝেছি, ওটা চুরি ছিলো না। দাদীর গাছের কাঁঠাল চুরি করে খেলে সেটা চুরি হয় না। চুরি করে খেয়েছে শিয়ালে।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

১১ অক্টোবর ২০২২

ময়মনসিংহ

#memoryofsadequel

Story

ছেলেবেলার গল্প – প্লে লিস্ট

মাছেরে | Machere | টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায় | Traditional fishing video of BD

আমার পারিবারিক জীবন – জীবনের গল্প

My Family Life – Life Story

জার্নি বাই ট্রেইন – জীবনের গল্প

Journey by Train – Life Story