Tag Archives: story

ssc

আমার এস এস সি রেজাল্ট

আমি ভালুকা উপজেলার বাটাজোর বি এম হাই স্কুল থেকে ১৯৭৭ সনে এস এস সি পাস করেছি । এই পরীক্ষার রেজাল্ট সংগ্রহ নিয়ে যে কাহিনী হয়েছিল তা আজ আমি লিখব। এস এস সি রেজাল্ট বের হবার ঘোষনা রেডিওতে দিয়েছে তিন দিন হয়। ডাকযোগে স্কুলে রেজাল্ট পৌছতে সময় লাগার কথা দুই দিন । কিন্তু তিন দিন হয়ে গেল কিছুই জানতে পারলাম না। চিন্তায় পরে গেলাম। চতুর্থ দিন বাড়ী থেকে বের হলাম। বলে গেলাম কচুয়া যাচ্ছি। কচুয়া বাজারে একটি খোলা খালি ঘরে বেঞ্চে আমি, ফজলু, দেলোয়ার  ও কিসমত বসে কিভাবে এস এস সি পরীক্ষার ফল পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলাপ করলাম। কেউ একজন বলল যে করটিয়া একটি ক্লাব ঘরে পাচ টাকা করে নিয়ে রেজাল্ট দিচ্ছে। আমরা চারজন রওনা দিলাম করটিয়ার উদ্দেশ্যে।

একটু এদেরকে পরিচয় করিয়ে দেই। ফজলু এখন নামকরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে বি এস সি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা। ঢাকায় থাকে। দেলোয়ারও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন যুব উন্নয়নের ডেপুটি ডাইরেক্টর। ডাকায় থাকে। কিসমত কি যেন পাস করার পর দেশের বাইরে চলে যায়। তার খোজ রাখতে পারিনি। আমরা সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কচুয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই। ফজলু দেলোয়ারের চাচাত ভাই। কিসমত বয়সে বড়, ওদের চাচা হয়। তাই আমিও চাচা ডাকি। আপনি বলি। সেভেনে উঠার সময় ফজলু ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড, লুৎফর থার্ড, মোসলেম ফোর্থ, দেলোয়ার ফিফথ ও কিসমত সিক্সথ হয়, খুব সম্ভব। লুৎফর এখন পি এইচ ডি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সসিটির নাটক বিভাগের প্রফেসর। মোসলেম এস এস সি পাস করে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল।

সেভেনে উঠে ভাল ভাল ছাত্ররা এলাকার সবচেয়ে ভাল স্কুল বাটাজোর বি এম হাই স্কুলে চলে যায়। এতে ছিল ফজলু, দেলোয়ার, কিসমত সহ আরও অনেকে। আমি এই কচুয়া স্কুলেই থেকে যাই। প্রতিযোগী ভাল না থাকার জন্য আমি আস্তে আস্তে নিম্ন মানের হতে থাকি। তাছাড়া একমাত্র বিজ্ঞানের শিক্ষক ভীম চন্দ্র স্যার নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আমি নিরুপায় হয়ে ১৯৭৫ সনে এপ্রিল মাসে বাটাজোর চলে যাই। এত দিন বিজ্ঞান ক্লাশ করতে না পারায় আমি নবম শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরিক্ষায় ফিজিক্স এ খারাপ করি। আমার মাথায় জ্যাদ চেপে যায়। উন্নতি হতে হতে প্রিটেস্ট পরীক্ষায় ফার্স্ট বয় ফজলু থেকে মাত্র দুই নাম্বার কম পাই। টেস্ট পরীক্ষায় তার থেকে দুই নাম্বার বেশী পেয়ে আমি ফার্স্ট হই। তার মানে, আমিই বাটাজোর স্কুলের শেষে ফার্স্টবয় ছিলাম।

আমরা রেজাল্ট আনার উদ্দেশ্যে কচুয়া থেকে পশ্চিম দিকে পাহাড়ি পথে হাটা শুরু করলাম। খুব সম্ভব জুলাই মাস। ১৯৭৭ সন। শালগ্রামপুর গিয়ে ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকায় বসে কার রেজাল্ট কেমন হতে পারে তা নিয়ে কথা বললাম। আমি বললাম যে আমার ফার্স্ট ডিভিশন ছয়টি লেটার থাকতে পারে। ফজলুও তাই বলল। দেলোয়ার বলল যে তার দুই তিনটিতে লেটার থাকতে পারে। কিসমত চাচা বললেন যে তার রেজাল্ট আমার মতই হতে পারে। তিনি আমার পিছনেই সিট পেয়েছিলেন পরীক্ষার হলে।

আকাবাকা খাল, বিস্তির্ন বিল পারি দিয়ে বেলা ডোবার আগ দিয়ে করটিকা পৌছলাম। জমিদার বাড়ীর পশ্চিম পাশে একটি ক্লাব ঘর থেকে কাগজের টুকরায় রুল নাম্বার লিখে বেড়ার ছিদ্র দিয়ে ভিতরে দিলে ভিতর থেকে রেজাল্ট লিখে দেয়া হয়। সময় নেই। বেলা ডোবার পর বন্ধ করে দেয়া হবে।

ফজলু আগে স্লিপ ঢুকালো। রেজাল্ট দেখে কাপতে কাপতে পড়ে গেল। আমরা ধরাধরি করে ইদারা কুয়ার পারে নিয়ে বালতি দিয়ে পানি তুলে তার মাথায় দিতে লাগলাম। আমরা গ্রামে থেকে এভাবেই অজ্ঞান রুগী চিকিৎসা করতাম। আমি পানি তুলি, দেলোয়ার মাথায় পানি ঢালে। কিসমতও রেজাল্ট পেয়ে কাপতে কাপতে হয়ে পরে গেল। একি রেজাল্টএর মড়ক লাগল নাকি! এখন রইলাম আমি আর দেলোয়ার। দুইজনকে দুইজনে পানি ঢালি। ক্লাব ঘর থেকে আওয়াজ আসছে আরো কেউ আছে নাকি, বন্ধ করে দিলাম। দেলোয়ার বলে তুমি যাও আগে, আমি বলি তুমি যাও আগে। দেলোয়ার আগে গেল, কিন্তু অজ্ঞান হল না। আমি রেজাল্ট পেয়ে অজ্ঞান হলাম না। আমি পেয়েছি ফার্স্ট ডিভিশন চার লেটার, দেলোয়ার পেয়েছে ফার্স্ট ডিভিশন দুই লেটার। এবার ফজলুর স্লিপ দেখলাম। সে পেয়েছে ফার্স্ট ডিভিশন দুই লেটার। কিসমত চাচাকে বললাম “চাচা, এত ভেংগে পড়লে চলবে? সবাই কি লেটার পায়? কত মানুষ যে ফেল করে?”
চাচা বললেন “আমি ফেল করেছি গো। হু হু হু “।

আমি ফজলুকে, আর দেলোয়ার কিসমত চাচাকে ধরে নিয়ে মেইন রোডের দিকে হাটলাম। কচুয়ার সিনিয়র ফজলু ভাইর সাথে দেখা হল। তিনি ওখানে সাদত কলেজে অনার্স পড়তেন। কি হয়েছে জানতে চাইলে বিস্তারিত বললাম। আমরা চলে যেতে চাইলাম। তিনি জোড় করে তার হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। ওখানেই থাকলাম। তিনি আমাকে বিশেষ যত্ন নিলেন। এখন তিনি হাই স্কুলের শিক্ষক। ফোনে আমার খোজ খবর নেন। আমিও নেই।

সকালে নাস্তা করে নৌকা ভাড়া করে শাল গ্রামপুর পৌছলাম। মুশলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। থামার লক্ষণ ছিল না। চারজন বন্ধু ভিজে ভিজে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। ১০/১২ কিলোমিটার পায়ের পিছলা পথ। দৌড় দিলাম। এক দৌড়ে বাড়ী পৌছলাম। বাড়ী পৌছলে বৃষ্টি আরও জোরে নামল। গতকাল বাড়ীতে জানিয়ে যাইনি। মা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন।
-কই গেছিলি বাজান? কইয়া জাস নাই কেন?
– রেজাল্ট আনতে গেছিলাম।
– আনছ?
– আনছি। ফার্স্ট ডিভিশন চারটি লেটার পাইছি।
– কই? দেও।
– পরে দিব। শুক্না জামা পরে নেই।
মা আঁচল দিয়ে আমার শরীর মুছে দিলেন।

মহা খুশীতে রওনা দিলাম বাটাজোর গিয়ে সব স্যারের সাথে দেখা করতে। রাস্তায় যাকে দেখি তাকেই সালাম দেই। সালাম দিলেই জিগায় ” সাদেক, কি খবর?” আমি বলি “ফার্স্ট ডিভিশন চারটা লেটার।”

স্যারগণ আমাকে দেখে মহা খুশী। কোন এক স্যার বললেন “বেটা, আমাদের স্কুলে রেকর্ড ভেংগেছিস।” আমি টেস্টিমোনিয়াল হাতে পেয়ে বললাম “স্যার, মুল সার্টিফিকেট কবে পাব?”
– ওটা বোর্ড থেকে এক দেড় বছর পর স্কুলে পাঠাবে। এসে নিয়ে যাবে।
– যদি এর আগে দরকার পড়ে?
– তখন দরখাস্ত করে উঠান যাবে।
পাস করলাম আজ। সার্টিফিকেট দিবে দেড় বছর পর!
বাড়ী এসে একটা সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখলাম ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবরে যে বিশেষ কারনে আমার এস এস সি সার্টিফিকেট জরুরী প্রয়োজন। দুই আনা দিয়ে খাম কিনে ডাকে দরখাস্ত পাঠালাম।

সাতদিন পর ডাকে একটি চিঠি আসল। লিখা “আপনার মুল সার্টিফিকেট ডাক যোগে স্কুল বরাবরে পাঠানো হয়েছে। আপনি উহা সংগ্রহ করুন – পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক “

আমি চলে গেলাম স্কুলে। সব স্যার একটি চিঠি দেখছেন। লিখা আছে “সাদেকুল ইসলাম তালুকদারের মুল সার্টিফিকেট পাঠানো হল। উহা জরুরীভাবে সরবরাহ করুন – পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক “।

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বিস্তারিত জানালাম।
– তুমি এমন করেছে কেন?
– আমার ইচ্ছা হল, স্যার।
দেখলাম সার্টিফিকেটটা একটা শক্ত খামে অতি যত্নসহকারে ভরা হয়েছে। ভাজ হয়নি। আমি ওটা নিয়ে বাড়ি এসে মাকে দেখালাম। বললাম “এই যে আমার সার্টিফিকেট ।”
এর দুই বছর পর মা ইন্তেকাল করেন। সাভাবিক নিয়মে সার্টিফিকেট আসলে কি মা দেখে যেতে পারতেন?

১৭/৬/২০১৭ ইং

#স্মৃতিকথা #স্মৃতিচারণ #Memory #SSC #sadequel

prothom-chakri

বরিশালের গ্রামে প্রথম চাকরির স্মৃতিকথা

বন্ধু বিচ্ছিন্ন

ডাঃ নজরুল ইসলাম। বর্তমানে টাংগাইলের নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ এফসিপিএস সার্জন। তার সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব শুরু হয় ১৯৭৭ সনে কালিহাতির আউলিয়াবাদে আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই। হোস্টেলে পাশাপাশি রুমে থাকতাম। একসাথে বেড়াতাম, মন খুলে গল্প করতাম। পালাকরে গান গাইতাম। ওদের বাড়ীতেও গিয়েছি। খালাম্মার হাতে রান্নাও খেয়েছি।

বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হল যখন আমরা দুইজনই ১৯৮০ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চাঞ্চ পেলাম। থাকা শুরু হল একই রুমে। এক সাথে খেতাম, পড়তাম, ঘুরতাম, সিনেমা দেখতাম, ঘুমথেকে উঠতাম, ক্লাশে যেতাম, ছুটিতে বাড়ী যেতাম। একই রকম জামা পরতাম। ক্লাশমেটরা বলত দুই ভাই। একই রকম রেজাল্ট করতাম। রিক্সা ভাড়া শেয়ার করতাম। তাই, হাত খরচ কম লাগত। এই রকম প্রায় সব কিছুতেই আমাদের দারুণ মিল ছিল।

১৯৮৫ সনে দুইজনই এমবিবিএস পাস করে দুইজনই সার্জারিতে বিশেষ ইন্টার্নশীপ ট্রেইনিং নিলাম ভবিষ্যতে সার্জারি বিশেষজ্ঞ হবার আশায়। কিন্তু বাস্তবে সে আজ চক্ষু বিশেষজ্ঞ আর আমি প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ।

ইন্টার্ন ট্রেইনিং শেষ করে দুই জনই বেকার হয়ে গেলাম। দুই জনই মেডিকেল অফিসার হিসাবে টাংগাইলের একমাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল নাহার নার্সিং হোমে কাজ শুরু করলাম।

১৯৮৮ সনে শুনলাম আমাদের মেডিকেল অফিসার হিসাবে সবারই সরকারি চাকরির অর্ডার হয়েছে। আমাদের দুইজনকেই খুলনা বিভাগে ন্যাস্ত করা হয়েছে। জুলাইর ১ তারিখে আমরা এক সাথে খুলনা গেলাম। রাত ১১ টায় খুলনা পৌছলাম। সকাল ১০ টায় স্বাস্থ্য বিভাগের ডিভিশনাল ডাইরেক্টর অফিসে গেলাম। দেখলাম পোস্টিং অর্ডার সাইন হয়ে গেছে। আমাকে দিয়েছে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন সাব সেন্টারে। নজরুলকে দিয়েছে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার কোন এক সাব সেন্টারে। অর্ডার হাতে পেয়ে দুই বন্ধু বিমর্ষ ভাবে তাকিয়ে রইলাম। কেউ একজন বললেন “দেরী না করে তাড়াতাড়ি যোগদান করে ফেলুন। প্রথম সরকারী চাকরি, একই দিনে সবাই যোগদান না করলে সিনিয়র জুনিয়র সমস্যা হবে। বিকেল বেলায় আমরা দুইজন দুইদিকে রওনা দিলাম। আমি পুর্ব দিকে গেলাম, নজরুল পশ্চিম দিকে গেল। এই যে দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন হলাম এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন

অবস্থায় আছি। কথা হয়, দেখা হয়, মোবাইল হয়, ফেইসবুক হয়, চেট হয়।


তারিখঃ ১২/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

প্রথম কর্মস্থলে যোগদান


সময়টা ১৯৮৮ সালের ২ জুলাই।  পোস্টিং অর্ডার হাতে পেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথ কী হবে তার খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। এ ব্যাপারে সুলতান নামে আমার এক আত্মীয় তার সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে একটা রোড ম্যাপ করে দিল। সে ওখানে চাকরি করত। 

বাসে করে সাতক্ষীরায় তার বাসায় গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে সেখান থেকে হুলার হাট গেলাম। একা জার্নি, খুব খারাপ লাখছিল। হুলার হাটে সস্তা একটা হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম। 

বাথরুমের অবস্থা ভাল না থাকায় পায়খানার কাজে ওটা ব্যাবহার করলাম না। পায়খানার বেগ নিয়েই ভোর ৫ টায় রিক্সা নিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। 

ছিনতাই হবার ভয়ে ভীত ছিলাম। ঘাটে গিয়ে বসলাম। একজন দুইজন করে যাত্রী এসে বসতে লাগল। 

আমি জীবনে তখনো লঞ্চ দেখিনি। আজ  প্রথম লঞ্চ দেখার অভিজ্ঞতা হবে। বাসের মত কি আগে টিকিট করতে হবে? না উঠে টিকিট করতে হবে? এনিয়ে ছিল নানা দুশ্চিন্তা। 

স্থির করলাম আমার মত প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্র যাত্রীরা যা করবে আমিও তাই করব। দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে একটা বড় নৌযান আসছে। উপরে লিখা “এম ভি বাপ্পী”। বুঝতে পারলাম এটাই লঞ্চ। ঘাটে ভিড়ল। দেখলাম দোতলা-নিচ তলা আছে। আমি ভদ্র লোকদের দেখাদেখি দোতলায় গিয়ে বসলাম। 

বোকার মত এদিক সেদিক তাকালাম। বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলাম। লঞ্চ পূর্ব দিকে চলছিলো। পানি আর পানি। সীমাহীন পানি। জীবনে এত পানি দেখিনি। একটা লোক বেঞ্চে পা তুলে বেয়াদবের মত শুয়েছিলো। আমি তার প্রতি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এক লোক ব্রিফকেসে সুই দিয়ে খোদাই করে নাম লিখে দিচ্ছিল। আমিও পাঁচ টাকা দিয়ে নাম লিখালাম ‘সাদেক’। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 

পানি দেখে খুব ভাল লাগছিল। পানিতে অনেক মহিষ দেখতে পেলাম। মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কী যেন খাচ্ছিল। 

আমি জানতাম, মহিষ মাঠে ঘাস খায়। কিন্তু পানির নিচ থেকে কী খাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম “মহিষ পানির নিচ থেকে কি খাচ্ছে?”। লোকটি আমাকে অস্বাভাবিক মানুষ ভেবে উত্তর না দিয়ে সটকে পড়ল।  বিপরীত দিকের বারান্দায় গিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও তাই করল। 

আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ভেতরে এসে একজনকে বিষয়টি বলার পর সে বলল ”কেন? ঘাস খায়।“

আগের দুইজন তখন মনযোগ দিল। আমি জানতে চাইলাম

-পানির নিচে ঘাস জন্মায় কেমনে?
– এটাতো মাঠ। মাঠে ঘাস খাচ্ছে।
– আমি তো দেখছি সাগরের মত।
– আপনার বাড়ি কই?
 (আমি ভরকিয়ে গেলাম)

– টাঙ্গাইল জেলায় সখিপুরে, পাহাড় অঞ্চলে।
পাশ থেকে একটু শিক্ষিত একজন বললেন
-আপনি বুঝি জোয়ারভাটা দেখেননি। এখন জোয়ার। ভাটার সময় মহিষ ঘাস খাওয়া শুরু করেছিলো, জোয়ারের পানিতে মাঠ ভরে গেছে, এখনো মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে।
– এখন বুঝতে পেরেছি। বইয়ে পড়েছি।
-আপনি কী করেন? কোথায় যাচ্ছেন?
– আমি ডাক্তার। সরকারি চাকরি হয়েছে। যোগদান করতে যাচ্ছি।
-এমবিবিএস ডাক্তার?
– জ্বী।

সবাই নড়েচড়ে বসে আমার দিকে মনযোগী হল। আমিও সাচ্ছন্দ্যবোধ করা শুরু করলাম। একে একে অনেকেই টুকটাক অসুখের কথা জানাল। আমি সমাধান দিলাম। আমি ওখানকার মধ্যমণি হয়ে গেলাম। যে লোকটি পা তুলে শুয়ে ছিল সেও পা নামিয়ে বসল। বলল “ডাক্তার সাব, আমার সারাক্ষণ পায়ের তলা জ্বালাপোড়া করে। কেন এমন হয়?” এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম কেন সে বেয়াদবের মত পা তুলে শুয়েছিল।

এভাবে সবার সাথে গল্প করতে করতে সকাল ১০টার দিকে বরিশাল এসে পৌঁছলাম। 

সিভিল সার্জন অফিস থেকে কমিউনিকেশন লেটার নিয়ে বাসে চড়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে গেলাম। ইউএইচএফ পিওর নিকট পরিচয় দিলাম। পাশে একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ৫৪/৫৫ বছর বয়স্ক লোককে বললেন, ‘এই যে আপনার মেডিকেল অফিসার এসে গেছেন। আর চিন্তা নাই।’

আমি যোগদানপত্রে সই করে অফিস ত্যাগ করলাম। ওই লোকটি ছিল আমার সেন্টারের মেডিকেল এসিস্টেন্ট। আমরা চরামদ্দি সাব সেন্টারের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দিলাম। বরিশাল গিয়ে রাত্রিযাপন করে ছোট লঞ্চে করে পরদিন চরামদ্দি যেতে হবে। বাসে যেতে যেতে আলাপ হলো। ওখানে স্টাফদের কথা  জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ওখানে আছে একজন পাগলা ফার্মাসিস্ট। কোথায় থাকে, কী খায়, কী পরে তার ঠিক নাই। দেখলেই বুঝবেন। আরেকজন পিওন আছে। তাকে দিয়ে কিচ্ছু করাতে পারবেন না। কিছু বললে উল্টা আপনাকেই ভয় দেখায়ে দেবে। আপনি তো অনেক দূরের মানুষ। আপনি সামলাতে পারবেন কিনা। আপনার তো আবার নতুন চাকরি। অসুবিধা হবে না, আমি আছি না?’ শুনে আমার শরীর শিরশির করে উঠল।

সন্ধ্যার সময় আমাকে একটি কমদামি বোর্ডিংয়ে নিয়ে উঠালেন। চলে গিয়ে আবার ফিরে এলেন দুইজন চোখে সুরমা দেয়া যুবক নিয়ে। বললেন, ‘পরিচয় করে দিচ্ছি, ইনি আমার বন্ধু ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার…..!’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! ভাবলাম এই ‘বন্ধুকে’ আমি নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে।

তাদের সাথে আলাপ হল। অনেক কথার পর তারা একটা কথা বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি না? অমুককে একটু ট্যাঁক্টফুলি ম্যানেজ করতে হবে।’ 

তারা চলে গেলে আমি একটু বারান্দায় বেরুলাম। দেখলাম তারা পাশের রুমে দুইটি মেয়ের সাথে কেমন কেমন যেন কথা বলছে। আমি লুঙ্গী পরে বাথরুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বাইরে থেকে দরজার করা নাড়ল।
– কে?
– আমি বোর্ডিংয়ের লোক। কিছু লাগবে, স্যার? আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
– আমার কিছু লাগবে না। আমি এখন ঘুমাব। ডিস্টার্ব করবেন না। 
আমার বুঝতে দেরি হল না পাশের রুমের বোর্ডারদের কারবার। 

মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে রেখে তার ভাইয়ের বাসায় থাকতে গিয়েছে। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। পায়খানার বেগ থেমে গেল। বের হবার সাহস পেলাম না। গত রাতেও পায়খানা করতে পারিনি। অমনি শুয়ে পরলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের ডাক শোনে ঘুম থেকে উঠলাম। 

ছয়টায় বরিশাল থেকে ছোট লঞ্চে উঠলাম। নয়টার দিকে কাটাদিয়া ঘাটে নামলাম। ওখান থেকে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। দুই কিলোমিটার যেতে হল নৌকায়। খালের ধারের মানুষ আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো “সাহেব কে?” 
– সাহেব আমাদের চরামদ্দির নতুন ডাক্তার। এমবিবিএস। এর আগে কেউ এমবিবিএস ছিলেন না। 
– আমাদের সরকারি ডাক্তার?
– জ্বী।
-খুব ভাল।

দশটার দিকে নৌকা থেকে নামলাম। তিনি দেখিয়ে বললেন ‘এটাই আপনার হাসপাতাল।’
দেখলাম ডোয়াপাকা একটি পুরাতন টিনের ঘর। সামনে বারান্দা। হাসপাতালের সামনে প্রায় একশত জন লোক। একজন উস্কো খুসকো লোক কানে একটা বিড়ি আটকানো, গায়ে রান্নাকরার ছাই লাগানো শার্ট, মাঝে মাঝে বিড়ির আগুনে গোল গোল করে ছিদ্র করে পোড়া, পেছনে লুঙ্গীর কোছে বিড়ির প্যাকেট, আমার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল ‘সাহেব কে?’
মেডিকেল এসিস্টেন্ট বললেন, ‘ইনি আমাদের নতুন অফিসার, ময়মনসিংহ বাড়ী।’
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন

-আপনি এমবিবিএস?
– জ্বী।

লোকটি লাফ দিয়ে দুই ফুট উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট বললেন,‘ইনিই আপনার ফার্মাসিস্ট’।
ফার্মাসিস্ট নেতার ভঙ্গিতে জনগণের উদ্দেশে  ভাষণ দিতে লাগলেন-
– ভাইসব, আপনারা শান্ত হউন। আমাদের এখানে জয়েন করতে এসেছেন যিনি তিনি এমবিবিএস, যা লন্ডন থেকে পাস করতে হয়!
তিনি আগামীকাল থেকে আপনাদের দেখবেন। আজ তিনি বিশ্রাম নিবেন।
এরপর সবাই শান্ত হলেন। তিনি সবাইকে বিদায় করে আমার কাছে আসলেন।
আমি জানতে চাইলাম
– আপনাদের লেট্রিন কোথায়?
– আমাদের তো লেট্রিন নাই!
-তাহলে আপনি কী ব্যবহার করেন?
– আমি কলার পাতা দিয়ে একটু ঘেরাও করে বানিয়ে নিয়েছি।
– এটা কী?
– এটা ফ্যামিলি প্লানিং ভিজিটরের অফিস।
– এখানে লেট্রিন নেই?
– আছে। পাকা সেনিটারি লেট্রিন। 

শোনে আমার তিন দিনের জমানো পায়খানার বেগ ফারাক্কা বাধের উজানের শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ধেয়ে আসা শুরু করল।
– লেট্রিনের চাবি দিন।
– ওটা পিওনের কাছে।
– পিওন কই?
-বাজারে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
– ডাকেন তাকে।

তিনি দৌঁড়ে বাজারের দিকে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন-
-পেলাম না।
– ঠিক আছে, আপনারটাই ব্যবহার করব। এক বদনা পানি আনেন।

তিনি পানি আনতে চলে গেলেন। আশার আলো দেখে আমার ওইটার বেগ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। তিনি খাবার পানির এক জগ পানি নিয়ে এলেন। আমি বললাম
– আমি তো পানি খাব না, পায়খানায় ব্যবহার করব, বদনায় পানি আনেন।
– স্যার, আমার এই জগ ছাড়া আর কিছু নাই। এইটা দিয়েই পানি খাই, এইটা নিয়েই পায়খানায় যাই।

আমার রাগে, দুঃখে  বেগ নিস্তেজ হয়ে পরল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মিটিমিটি হাসছিলো। আমি মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বললাম “আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাব কই?”
ফার্মাসিস্টকে বললাম,‘যান, আমার সামনে থেকে’।
তিনি ইডিয়টের মত হেসে চলে গেলেন। 

পরে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট আমাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। আমি বললাম,

-আমি এখানে থাকতে পারব না। 
– চলেন আমাদের বাড়ী। এখান থেকে ৩ কিলো দূরে হবে।

– চলুন তাই হউক। 

বিকালে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টের বাড়ি গেলাম। তার গ্রামের নামটা এখন মনে করতে পারছি না। গিয়েই লেট্রিনের খোঁজ নিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দিলেন। পাকা লেট্রিন। তিন দিনের জমা রাখা জিনিসগুলি ত্যাগ করতে পেরে গোপাল ভাঁড়ের মত প্রশান্তি পেলাম। 

তিনদিন গোসল করিনি। অত্যন্ত গরম আবহাওয়া ছিল। গোসল করতে চাইলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে নিয়ে গেলেন। বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি আর পানি। দখিনা মিষ্টি বাতাস আসছিল। আমি শার্ট গেঞ্জি খুলে কিছুক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগালাম। অমন মিষ্টি হাওয়া আর কোথাও পাইনি। 

বিকালে ঘুম দিলাম। রাতে তার ভাইয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প হল। আবার ঘুমালাম রাতে।

দুপুরের খাবার পোলাও মাংস খেয়ে বরিশাল রওনা দিলাম। বিকেল ছয়টায় ঢাকার লঞ্চে উঠলাম। ঢাকা থেকে বাসে ফিরতে হবে বাসে। হিসাব করে দেখলাম টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই কেবিনে টিকিট না করে ৩০ টাকায় ডেকের টিকিট করলাম। ব্রিফকেস থেকে লুঙ্গী বের করে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য ব্রিফকেসের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লিখা কার্ডটা উল্টিয়ে লাগালাম। ব্রিফকেস মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। 

চারদিনের জার্নির ঘটনাগুলি মনে করতে করতে এক সময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।


তারিখঃ ১৪/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

প্রথম কর্মস্থলের ভয়াবহ দিনগুলি


১৯৮৮ সনে ৩ জুলাই বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করে প্রস্তুতিমুলক ছুটি নিয়ে টাংগাইল এসেছিলাম। দুই একদিন কাটিয়ে বেডিংপত্র, একটি হারিকেন, একটি ছোট রেডিও ও এক সেট পাতিল নিয়ে কর্মস্থলে থাকার উদ্দেশ্যে দুপুরের দিকে টাংগাইল থেকে রওনা দিলাম। পরেরদিন সকাল ১০ টায় চরামদ্দি পৌছলাম। কাটাদিয়া বাজার থেকে একটা রেইনট্রি গাছের চৌকি কিনলাম ১০০ টাকা দিয়ে। হাসপাতালের পিছনেই মেডিকেল অফিসার থাকার বাড়ী। ডোয়াপাকা তিনটি টিনের ঘর। একটি থাকার ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি বৈঠকখানা কাম চেম্বার। বাজারের ভাতের দোকানে কন্ট্রাক্ট করলাম তিনবেলা খাবার দিয়ে যেতে। একটু দুরেই পুরাতন জমিদার বাড়ী। সেই জমিদাররা কেউ থাকে না। তাদের রায়তরা থাকে।

বাড়ির সাথেই বিরাট পুকুর। শুক্না কলার পাতা বাশের উপর ভাজ করে পুকুর ঘাটে বেড়া দিলাম। হেলথ ভিজিটরের লেট্রিনের চাবি নিয়ে নিলাম। শোবার, খাবার, লেট্রিনের এবং গোসলের ব্যবস্থা হয়ে গেল। এক মাস্তান যুবক ৫/৬ জন সাংগ নিয়ে হাজির হল। বললো
– আমার নাম অমুক। আপনার কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন। কোন হালার পো আপনাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। ডাক্তার সাব, আমাকে কিন্তু আগের ডাক্তার সাব তিন মাস অন্তর একটি করে রগে দেয়ার সেলাইন দিতেন হাসপাতাল স্টোর থেকে। আমি ওটা মদের সাথে মিশিয়ে খাই। তাতে তিন মাস চাংগা থাকি। দিবেন কিন্তু।

মেডিকেল এসিস্টেন্ট চোখ ইশারা দিয়ে রাজি হতে বললেন। আমি রাজি হলাম। চলে গেলো সে।
কিছুক্ষণ পর একজন এলেন। পরিচয় দিলেন তিনি পাশের বাড়ীর মকবুল দফাদার।
– আমি মকবুল দফাদার। সব সময় আমাকে কাছে পাবেন। আপনার আগের অফিসারের সাথে আমি প্রায় সব সময় থাকতাম।

শুনে আমি তেমন কিছু বললাম না।

রাত হলো। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব ছিল। চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। আমি একা একটা পুরাতন ঘরে। এই বাড়ি বৃটিশ আমলের। হাসপাতাল বৃটিশ আমলের। মনে হলো এখানে ভুত পেত্নি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। হারিকেন নিভিয়ে শুইয়ে পরেছিলাম। ঘুম আসছিল না। চারদিক নিরব ছিল। ভুত এসে মাথার উপর সিলিং দিয়ে হাটা শুরু করল। আমার বুক কাপা শুরু করল। পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সাইন্স জ্ঞান কোন কাজে আসল না। কাপড় দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম। ভুতের হাটা থামছিলো না। এক সময় সাহস করে উঠে বসলাম। মনে হলো যেন আমার মাথার উপর তিনি পা রাখবেন। থরথরি কাপছিলাম। হারিকেন ধরালাম। উপর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। দেখলাম তিনি জ্বল জ্বল করে আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। সারা শরীর কাল, শুধু চোখ দেখা যায়। চিনতে চেষ্টা করলাম। তিনি বললেন “মিয়াও”। স্বস্থি পেলাম। একজন সংগি পেলাম।

পরেরদিন সকাল নয়টায় প্রথম অফিস করতে গেলাম। মেডিকেল এসিস্টেন্ট থেকে ঔষধের চার্জ হ্যান্ড ওভার লিস্ট নিলাম। এই হ্যান্ডওভার লিস্টটা আমার পুর্বের অফিসার দিয়ে গেছেন মেডিকেল এসিস্টেন্টের নিকট। মার্মাসিস্টের নিকট থেকে চাবি নিয়ে স্টোর খুললাম। ঔষধ গুনে লিস্টের সাথে মিলালাম। চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বৃটিশ আমলের শক্ত কাঠের হাতল-ভাংগা চেয়ার। ভারি মোটা কাঠের টেবিল। মেডিকেল এসিস্টেন্ট পরামর্শ দিলেন
– আপনি তো আমাদের অফিসার। পুরুষ রুগী গুলি বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলি আপনি দেখুন। পাশের রুমে বসে আমি মহিলা রুগী দেখব।
– পুরুষ মহিলা সবার জন্য আমাকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। সবাইকে দেখতে হবে।
– আপনি একা এত ঝামেলায় জড়াবেন না।

মনে পরল ইউএইচএফপিও সাহেব বলে দিয়েছেন “মেডিকেল এসিস্টেন্ট এলাকার অভিজ্ঞ লোক, তার পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে সমস্যা হবে না। ” আমি রাজি হলাম। অনেক রুগী আসে। আমি পুরুষ রোগী দেখি, তিনি দেখেন মহিলা রুগী। তিনি পিয়নকে দায়িত্ব দিলেন স্লিপ দেখে ঔষধ বিতরণ করতে। আমি অফিস শেষে পিয়নকে বললাম “স্লিপগুলি নিয়ে আস।” সে নিয়ে আসল। আমি রেখে দিতে বললাম। সে ওগুলি পুকুরে ফেলে দিল।

বিকেলে হাটতে গিয়ে একটি ঔষধের দোকানে গিয়ে বসলাম। ওখানে এলাকার অনেকের সাথে পরিচয় হল। পরেরদিন এক মুদির দোকানের সামনে বসা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার, গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ও হাই স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে আড্ডা হল। এই ভাবে প্রতিদিন বিকেলে তাদের সাথে গল্প করে কাটালাম। বাসায় সকাল বিকাল প্রাইভেট প্রেক্টিস করলাম। বেশ রুগী হয়। ঘনঘন মারামারির রুগী আসত। সাথে মাস্তানরা আসত ইনজুরি সার্টিফিকেটের জন্য তদবির করতে। আমি সার্টিফিকেটের ধারাগুলি বুঝতাম না। দফাদার আমাকে বুঝিয়ে দিতেন।

একদিন মুদির দোকানের সামনে চেয়ার ফেলে বসে আমরা গল্প করছিলাম। গল্প বলার মধ্যমণি ছিলাম আমি। আমি মজার মজার গল্প বলতাম আর সবাই মনযোগ গিয়ে শুনতেন। মুদির দোকানদার হা করে শুনছিল। হটাৎ সে বলে বসল “স্যার, আপনার কাছে ভালো মানুষ যায় না।” আমি শুনেও না শুনার ভান করে গল্প বলা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেলাম। ভাবলাম মারামারির কেসের দালাল ও মাস্তানরা যেহেতু আমার চেম্বারে ঘুরাফেরা করে লোকটি হয়ত তাদের মিন করে বলছে ভাল মানুষ আমার কাছে যায় না। কিছুক্ষণ পর লোকটি আবারো ঐ কথা বলে বসলো। তখন আর ধৈর্য ধরতে পাড়লাম না। বললাম “ঐ মিয়া, ফাইজলামি কথা বলবেন না। ভালো মানুষ কি শুধু আপনার কাছে আসে?”
– স্যার, রাগ করছেন, ক্যা? আমি অনেকবার আপনার বাসায় গিয়েছি একটু খোজ খবর নিতে। সব সময় দেখেছি রুগী আর রুগী, একজনও ভাল মানুষ না।
– ও তাই বলুন।

একদিন বিকেলে বাজারে এক ঔষধের দোকানে বসে গল্প করছিলাম। একজন যুবক ১০/১২ জন সাংগ নিয়ে আসল। দোকানদার তার পরিচয় ও ক্ষমতা বর্ননা করে আমার পাশে বসাল। কথাবার্তায় বেশ ভদ্র। শিক্ষিত যুবক। বললেন
– কেমন চলছে আপনার হাসপাতাল?

 আমি আমার হাসপাতালের ভালদিকগুলি তার কাছে তুলে ধরলাম।

– আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্ট পাবলিকের হাতে মাইর খাবে।
– কেন? কি করেছে?
– খুব খারাপ? আপনি পুরুষ রুগী আর উনি মহিলা রুগী দেখছেন কেন?
– এমনি, ভাগ করে নিয়েছি, সুবিধার জন্য।
– মহিলা রুগী আপনার সেবা পাওয়ার অধিকার আছে না? বুদ্ধিটা তো আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্টের। ও বেটা মহিলাদের থেকে টাকা পয়সা, ডিম সব্জি ইত্যাদি নিয়ে বেশী করে ঔষধ দেয়। সেদিন আমার ভাবীর কাছ থেকে ১২ টাকা নিয়েছে। নিজে যা বুঝবেন তাই করবেন। ও বেটার বুদ্ধিতে চলবেন না।
– আচ্ছা আমি দেখব। আপনারা কিছু কইরেন না।

পরদিন হাসপাতালে রুগী দেখছিলাম। এগারটা বেজে গেল। মেডিকেল এসিস্টেন্ট এলেন  না। মহিলা রুগীগুলি গেঞ্জাম শুরু করে দিল। কেউ একজন এসে আমাকে বলল “বাসায় যান, সমস্যা আছে”।

আমি বাসায় দিয়ে দেখি উঠুনে মেডিকেল এসিস্টেন্ট খালি গায়ে শুয়ে গোংরাচ্ছে। সারা শরীরে ফাটা ফাটা মাইরের দাগ। আমি বললাম
– কে মেরেছে, কি দিয়ে মেরেছে?
– দুইটি স্কুল পড়ুয়া ছেলে রাস্তা দিয়ে আসার সময় আচমকা কাউল্ফা গাছের ডাল দিয়ে বেদম পিটিয়েছে। আমি ব্যাথা সহ্য করতে পারছি না।

আমি নিজেই তার সারা শরীরে ব্যাথানাশক মলম লাগিয়ে দিলাম। আমি আবারো কিংকর্তব্য বিমুড় হলাম। আমি জিগালাম
– উপরের লেভেলে কাউকে জানাব?
– না স্যার, এরা এলাকার ছেলে, আরো ঝামেলা বাড়তে পারে।

পিওনকে দিয়ে তাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম। সব রুগী বিদায় করে দিলাম।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুইটার সময় এক অপরিচিত লোক এলেন। আমাকে বললেন “ইনি এলাকার লোক, এলাকার ছেলেরা মেরেছে, আমরাই এর মিমাংসা করে দিতে পারব। আপনি উপরে কাউকে জানাইয়েন না।” এক ঘন্টা পর আরেকজন এসে একই কথা বলে গেলেন। আমি অপরিচিত লোকদের সাথে কি কথা বলে কোন বিপদে পড়ি ভেবে লুকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করলাম। থাকার ঘরে দুইটি দরজা ছিল। এক দরজা দিয়ে বেড় হয়ে তালা লাগালাম। আরেক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে কপাট লাগিয়ে দিলাম। বুঝালাম ডাক্তার তালা লাগিয়ে চলে গিয়েছে। চৌকিতে শুয়ে রইলাম। জুলাই মাস প্রচন্ড গরম পড়েছিল। বাইরে কয়েকজন লোকের আওয়াজ পেলাম। বলাবলি করছিল
-ডাক্তার মনে হয় ভয়ে পালিয়েছে।
-মনে হয় ভিতরেই আছে।
-ডাক্তার সাব, আমি অমুক উপজেলার একাউন্ট অফিসার, এলাকায়ই বাড়ী। ভিতরে থাকলে দরজা খুলুন।
এই বাচ্চা বেড়ার নিচ দিয়ে দেখো তো ভিতরে কোন মানুষ দেখা যায় কিনা।

আমি কাথা দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে লম্বা হয়ে মরা লাশের মত নিথর পড়ে রইলাম।

-মনে হয় একটা মানুষ কাথা মুরু দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
-এই, এত ঘরমের মধ্যে কেউ কাথা গায় দেয়?

তারা বিফল হয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যা হল, রাত্রি হল, হারিকেন লাগালাম। ফার্মাসিস্টকে কোন দায়িত্ব না দেওয়াতে সে ফ্রি স্টাইলে ঘুরে বেড়াত। আমার কাছ দিয়েও আসত না। আমি একদম একা। আমি হারিকেনের সামনে ঝিম মেরে বসে আমার পরিনতি কি হতে পারে তার বিভিন্ন রকম কল্পনা জল্পনা করছিলাম।

রাত প্রায় ১২ টা। বাইরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আশে পাশে কেউ নেই। আমি অসহায় একজন একাকি একটি ভুতুরে বাড়ীতে বসে আছি। হটাৎ উত্তর পাশের জানালা দিয়ে নিচু স্বরে একটি শব্দ আসল “ঘুম আসে না, স্যার?” আমি চমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখি জানালা খোলা।
– কেক, কেক, কে ওখানে?
লোকটি ফস করে মেচ দিয়ে কুপি বাতি ধরিয়ে মুখের পাশে ধরে এক ঝাকা দাত বেড় করে বললেন
– আমি আপনার ফার্মাসিস্ট, স্যার।
– আপনি এখানে কি করছেন? জানালা দিয়ে উকি মারছেন কেন? চলে যান।
– আপনাকে একা রেখে কি চলে যাওয়া যায়?
-আপনি একটা আস্তা পাগল।
– পাগল আমি না, স্যার, পাগল আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্ট । সে তো মাইর খাইছে ওর পিওন বেটাও মাইর খাবে। আপনি দানবীরের মত এক মাসের ঔষধ দুই তিন দিনে বিতরন করে শেষ করে ফেলেছেন। আগামীকাল ঔষধ দিতে না পাড়লে পাবলিক আপনার উপরও চড়াও হবে। আপনার আগের অফিসার ঔষধের লিস্ট দিয়ে গেছেন মেডিকেল এসিস্টেন্টের কাছে, আর ঔষধের স্টোরের চাবি দিয়েছেন আমাকে। এখন বুঝুন কে পাগল। বাচতে চাইলে ঔষধের চাহিদা দিন। আমি আগামীকালই নিয়ে আসি।
– মেডিকেল এসিস্টেন্ট বলেছে ঔষধ আনতে ৪০০ টাকা ঘুষ দিতে হবে। এই টাকা নাকি আমার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। আমি পারব না।
– নাউজুবিল্লাহ, ও বেটা একটা বেআক্কেল। কেউ কি অফিসার থেকে ঘুষ নেয় নাকি। অফিসারকেই ঘুষ দিয়ে চলতে হয়। ঘুষ দিতে হলে আমিই আমার পকেট থেকে দিব। আপনে জানবেন কেন?
– আপনি নাকি আগের স্টেশনে এলাকার লোকদেরকে পিটায়েছিলেন?
– ওখানে ওরা আমার অফিসারকে তাপ্পর মেরেছিল। স্যার আমার সামনে কাঁদছিলেন। আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আমি তাদেরকে আন্দাগুন্দা পিটিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। ওখান থেকে এখানে আমাকে বদলি করা হয়েছে। অফিসারের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিব। স্যার, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?

আমি দরজা খুলে তাকে ভিতরে এনে বসালাম। তিনি তার জীবনের অনেক কাহিনী শুনালেন। তিনি আমাকে অনেক নিয়ম কানুন শিখালেন। আমি তার ভিতর মেধা খুজে পেলাম। তার উপর ভরসা আসল। তিনি ঔষধের চাহিদা প্রস্তুত করে আমার সই নিলেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন আমি যেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে পরের দিন একটি মতবিনিময় সভা করি। আমি ঘুমিয়ে পরলাম। ভোরে তিনি ঔষধের জন্য বরিশাল সিভিল সার্জন অফিস চলে গেলেন এবং সন্ধায় চাহিদার ঔষধ নিয়ে ফিরে এলেন। কোন রকম ঘুষ ছাড়াই। আমি একটা সাদা কাগজে নোটিশ লিখে পিওন দিয়ে হেড, মাস্টার, ব্যাংক ম্যানেজার, দফাদার এবং আরো কয়েকজন লোক নিয়ে হাসপাতালে মিটিং করলাম। মিটিং-এ এক যুবক হটাৎ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল “ডাক্তার সাব, আমার ব্লাড প্রেসারটা একটু মেপে দেন না।” আমার ভিতরে রাগ উঠে গেল। কিন্তু তা প্রকাশ হতে দিলাম না। সামনের দাতের অর্ধেক বের করে হাসির ভান করে বললাম “এখন তো মিটিং চলছে, মিটিং শেষে মেপে দিব।” মিটিং-এ মেডিকেল এসিস্টেন্টের বড়ভাই উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হল এক দিন পর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে স্কুল ভবনে এর বিচার হবে।

বিচার বসল। হেডমাস্টার ভুমিকা ভাষণ দেয়ার সাথে সাথে যেই যুবকের ইংগিতে মাইর দেয়া হয়েছে সেই যুবক বলে উঠলেন “আমার ভাগ্না অন্যায় করেছে তার বিচার আমিই করছি।” বলেই একটা পাতলা বেত দিয়ে হাল্কা করে একটা আঘাত করলেন তার দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া ভাগ্নাটাকে। সাথে সাথে হেডমাস্টার তাকে উদ্ধার করে সরিয়ে ফেললেন। বললেন “বাচ্চা, মানুষ অন্যায় করে ফেলেছে, তাকে তো মেরে ফেলা যায় না।” সবাই তাতে রায় দিলেন। বিচার শেষ হল।

একদিন পর মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে নিয়ে উপজেলায় গেলেন। উপজেলা কর্মকর্তাসহ আমরা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে সিভিল সার্জন ও ডেপুটি সিভিল সার্জনের সামনে ঘটনা তুলে ধরলাম। এক সময় অফিস কক্ষে একা ডাকলেন। বসা ছিলেন সিভিল সার্জন (সি এস) ও ডেপুটি সিভিল সার্জন(ডিসিএস)। সিএস আমার সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা জেনে নিলেন। বললেন
– তুমি যেখানে আছো, তার ছয় কিলো মিটার চতুরদিকে কোন এম বি বি এস ডাক্তার নেই। ওখানে তুমি অবস্থান করে প্রাইভেট প্রাক্টিস করবে। অনেক রুগী পাবে। এলাকার লোকজন ভাল। ভাল ডাক্তারের সাথে তারা ভাল আচরণ করবে। তোমার চিন্তা নাই। তোমার মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বদলি করে ওএসডি করে রাখব। তোমার সাথে অন্য কোন মেডিকেল এসিস্টেন্ট দিব না। তোমার বর্তমান পিওন বদলি করে ভাল একজন দিব।
– স্যার, আমি অফিস টাইমের বাইরে প্রাইভেট রুগী দেখি।
– অফিস টাইমেও সরকারি ফ্রি রুগী দেখার ফাকে ফাকে প্রাইভেট রুগী দেখবে। তারা অনেক দূর থেকে নৌকা নিয়ে তোমার কাছে আসবে, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করালে বিরক্ত হবে। ওরা ধনি মানুষ। ওদের সাথে গরীবরা রাগ করবে না। তোমার প্রতি গরীবরা রাগ করবে না। ঝামেলায় ফেললে ধনিরাই ফেলবে। হাসপাতালের ঔষধ গরীব-ধনি সবার জন্য। কাজেই, প্রাইভেট রুগীর প্রেস্ক্রিপশনের ঔষধ যদি হাসপাতালে থাকে তবে তাদের দিবে। হিসাবের খাতায় ঔষধের খরচ লিখে রাখবে। ঐ খাতা বাসায় নিয়ে যাবে। বাসায় ঔষধ রাখবে। ওখান থেকেও ঔষধি দিয়ে খাতায় লিখে রাখবে। তুমি তো এটা বেচে দিচ্ছ না। ফার্মাসিস্ট পাগল হলেও ভাল মানুষ। তার কাছেও কম দামের কিছু ঔষধ রাখবে। সেও অল্প স্বল্প প্রাক্টিস করে।

ডিসিএস বলনেন
– আমার বাড়ীও ওখানে। সিএস স্যার যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। আপনি যখনি চাহিদা পাঠাবেন আমি এক কার্টুন ঔষধ বেশী দিব।

আমি নির্বাক হয়ে শুনছিলাম। ভাবলাম আবার যে কোন বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

দুই একদিন পর নতুন এক অত্যন্ত ভাল পিওন এসে গেল। পাড়ার একজন প্রাক্তন পিওন এসে তার ছেলেকে আমার খেদমতে দিয়ে গেলেন। দফাদার আমার সিকিউরিটি বন্ধু। সিএস ও ডিসিএস স্যারগনের পরামর্শ মত সব ঠিক ঠাক মত চলল। পাগলা ফার্মাসিস্ট-এর সাথে কত যে মজার মজার আলাপ হয়েছে! তার কাছ থেকেই বেশির ভাগ অফিসিয়াল নিয়মকানুন আমার শেখা। জানি না সে এখন বেচে আছে কিনা।

তারিখঃ ১৬/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

Cesarean section

Cesarean section

সিজার অপারেশন ছাড়াই বাচ্চা হয় কেমনে?

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

শিক্ষার্থীদেরকে কোন কিছু শিখাতে গেলে তার বয়সের দিকে একটু খেয়াল রাখতে হয়। আমি একদিন এই রকম একটা সমস্যায় পড়েছিলাম। ঈদের ছুটিতে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে ও মেয়ে একজায়গায় বসে গল্প করছিলো । আমি ভাবলাম এই সুযোগে তাদেরকে একটু ধর্মীয় জ্ঞান দেই। আমি মানব সৃষ্টির শুরুটা কেমন ছিল বুঝাতে গিয়ে আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) এর সৃষ্টির কাহিনী বললাম। বিবি হাওয়ার অনেক সন্তান হলো বললাম। এরপর বলতে চেয়েছিলাম “যেহেতু সেই সময় আদমের সন্তান ছাড়া আর কোন মানুষের সন্তান ছিলনা, তাই ভাই-বোনের মধ্যেই বিয়ে সম্পাদন হয়। তারপর বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম হয় এবং এভাবে মানব সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন এই অবস্থা হয়েছে।” এর আগেই এক শিশু আমার গল্পে বাধা দিয়ে বলল “তখন তো আদম ও হাওয়া ছাড়া আর কেউ ছিলনা। তাইলে সিজার অপারেশন করে দিলো কোন ডাক্তারে?

– সিজার ছাড়াই হইছে।

– সিজার ছাড়াই বাচ্চা হয়? আমরা এখানে সবাই সিজার অপারেশন হয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মেছি। আদমের সন্তানরা সিজার ছাড়াই জন্মিল কেমনে?

আমি ভেবাচেকা খেয়ে গল্প বাদ দিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলাম

বইটি ঘরে বসে পেতে নিচের ছবির উপর ক্লিক করুন

শৈশবের একাত্তর

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

Jummaghor

Jummaghor

আমাদের গ্রামের জুম্মাঘর

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমি বুঝমান হয়েই দেখেছি আমাদের বড়বাইদপাড়া গ্রামের আজিম উদ্দিন সিকদার বাড়ির কেন্দ্রীয় মসজিদটি। আমরা বলতাম জুম্মাঘর। এটার চালের ছাউনি ছিলো ঢেউ টিনের। বেড়া ছিল চেপটা টিনের। মেঝে ছিল কাঁচা। চট বিছিয়ে নামাজ পড়তাম। ঐ বাড়ির মানুষ জুম্মা ঘরে পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করতেন আজান দিয়ে। গ্রামের মুছুল্লিরা শুধু শুক্রবার জুম্মার নামাজ জামাতে আদায় করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার কাক্কী (জয়নাল ভাইর মা) জুম্মাঘরের মাইঝাল (মেঝে) ও পিড়া (ডোয়া) হাইল মাটি (বাইদের মাটি) দিয়ে লেপে দিতেন।

আজিম উদ্দিন সিকদার দাদা বহরমপুর থেকে এসে এখানে বাড়ি করে একটা পুকুর খনন করেন সেই ব্রিটিশ আমলে। পুকুরের পশ্চিম পাশে তিনি এই জুম্মাঘর নির্মাণ করেন গ্রামের মানুষের নামাজ আদায় করার জন্য। উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া, পূর্বপাড়া, তালুকদার বাড়ি, নওপাড়া ও চনপাড়ার সব মুছুল্লিরা এই মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মিলন মেল হতো। মসজিদ প্রাঙ্গণে বড় আম গাছ ছিলো। সেই আমগাছের নিচে একটা বাঁশের মাচাং ও দুইটা ঘোড়া কাঠ ছিলো। নামাজ শুরুর আগে ও পরে এখানে বসে যুকক ও কিশোর বয়সের মুছুল্লিরা খোস গল্প করতো। গ্রামের মানুষের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে বড়রাও আলাপ আলোচনা করতেন। গ্রামের মাতবর ছিলেন কোরবান আলী সিকদার কাক্কু ও কাশেম তালুকদার কাক্কু (মিয়াকাক্কু)। মাতবরের মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারতো না।

এই মসজিদের ইমাম ছিলেন শিরিরচালার হাছেন ক্কারীসাব। তিনি শুক্রবারের জুম্মার নামাজে ইমামতি করতেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে মিলাদ পড়ে দোয়া করে বখসিয়ে দিতেন। আমাদের শমে কাক্কুও মিলাদ পড়াতেন। আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন তালেবে ইলিম হিসাবে।

আমগাছ তলায় মাঝে মাঝে মাসআলা নিয়ে অল্প বয়সের যুবকদের মধ্যে তর্ক লেগে যেতো। মিয়া কাক্কু এগিয়ে এসে থামিয়ে দিয়ে সঠিক মাসআলা কি হবে বলে দিতেন। মিয়া কাক্কুর উপরে কেউ কোন মাসআলা বলতে সাহস পেতো না। মাসআলা বলার পরে এটা পাকাপোক্ত করার জন্য ইমাম সাবকে জিজ্ঞেস করতেন “তাই না হুজুর?” হুজুর ইতস্তত করে গোল টুপিটা ডান হাত দিয়ে হালকা ঘুরান মেরে বলতেন “ঐত্য।” তারপর টুপিটা মাথা থেকে খুলে ফু দিয়ে গোল করে আবার মাথায় পরে দ্রুত চলে যেতেন জুম্মা ঘরের ভিতর। ‘ঐত্য’ কথাটি একটি হালকা সম্মতিসরূপ একটি শব্দ। আমার মেয়ে দুটি যখন ছোট ছিলো তখন দুজনে মাঝে মাঝে তর্কে করে কার কথা ঠিক এটির সমাধান নিতে আমার কাছে এলে আমিও বলে দিতাম “ঐত্য। তোমাদের জন্য আজ কি যেনো আনত হবে?”

ইমাম সাব ছিলেন ক্কারী। অল্প কিছু মাস আলা জানতেন। অল্প কিছু বয়ান করতেন খুতবার আগে অথবা নামাজের পর দোয়ার আগে। দোয়াকে মুছুল্লিরা খুব প্রয়োজন মনে করতেন। শেষ দোয়া না করে কেউ বের হতে চেতেন না। জুম্মার নামাজ শেষ হতে প্রায় দুটো বেজে যেতো। মুছুল্লিদের ক্ষুধা পেতো। হুজুর দোয়া করার আগে কিছুক্ষণ বয়ান করতেন। মুছুল্লিরা কেউ কেউ বলে উঠতেন “হুজুর, দোয়া কইরা দেইন।” হুজুর বলতেন “মুক্তাছার করতাছি। আর এটু বহুন।” মুক্তাছার মানে কি আমি জানি না। তবে বুঝে নিয়েছি ‘সংক্ষিপ্ত’। হুজুর হাছেন ক্কারী সাব ছিলেন মুক্তার আলী মাস্টার স্যারের বড় ভাই। উভয়ই খুব ভালো মানুষ।

আয়েন উদ্দিন সিকদার দাদার ছেলে হাছেন সিকদার কাক্কু খুব নিয়মিত মুছুল্লি ছিলেন। তিনি সবার আগে এসে প্রথম কাতারে ইমাম সাবের পিছনেই বসতেন। সবার শেষে তারাহুরো করে উপস্থিত হতেন ওহাদালী কাক্কু (ওয়াহেদ আলী)। ওহাদালী কাক্কু অল্প লেখাপড়া জানলেও সুর করে ভালো পুথি পড়তে পারতেন। আমি মাঝে মাঝে কাক্কুদের বাড়ি গিয়ে পুথি পড়তে বলতাম। কাক্কু বারান্দায় জলচৌকিতে বসে আমাকে পুথি পড়ে শুনাতেন। আমরা পুথিকে বলতাম কিতাব। এটা ছিলো জংগে কারবালার কিচ্ছা। কাক্কু চৌকিতে কিতাব খুলে রেখে সোজা হয়ে বসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিনয় করে কিতাব পাঠ করতেন। “ঘোরায় চড়িয়া মর্দ চলিতে লাগিলো ” বলার সময় মনে হতো যেনো কাক্কুই চড়ে তলোয়ার হাতে ছুটে চলেছেন। “শত শত মারা গেলো মর্দ কাতারে কাতার” শুনে মনে হতো কাক্কুর সামনেই শত শত সৈন্য শহীদ হয়ে পড়ে আছে। কিতাবের করুণ পংতিগুলো কাক্কু এক গালে হাত রেখে করুণ শুরে বিলাপ করে পড়তেন “ও সিমার সিমাররে……। “

জুম্মার নামাজের কোন টাইম টেবিল ছিলো না। সব মুছুল্লিরা চলে এলেই নামাজ শুরু হতো। সব মুছুল্লিরা চলে এলেও অনেক সময় মাদবর কাক্কুরা আসা পর্যন্ত হুজুর অপেক্ষা করতেন। ওহাদলী কাক্কু সবার শষে তারাহুরো করে এসে অজু করে টুপিটা মাথায় ঢুকাতে ঢুকাতে জুম্মাঘরে প্রবেশ করতেন। হাছেন সিকদার কাক্কু বলতেন ” হুজুর, নামাজ শুরু করুন। ওহাদালী আইপড়ছে।” হাছেন কাক্কু খুব ফক্কর ছিলেন। তিনি খালি হাসাতেন। একবার জুম্মায় আগে আসার গুরুত্ব নিয়ে মুক্তাছার বয়ান করছিলেন “জুম্মার নামাজে আগে আইলে বেশী লাভ। যেমন ধরুন, যে অজ প্রথম আইলো, হে পাইল একটা উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব, যে তারপর আইল, হে পাবো একটা গরু কোরবানি করার সমান ছোয়াব, তারপর যে আইলো হে পাবো একটা ছাগল কোরবানি করার সমান ছোয়াব, এভাবে কমতে কমতে সবার শেষে যে আইলো হে পাইলো একটা মুরগি কোরবানি করার সমান ছোয়াব।” হাছেন কাক্কু হেসে বলেন “হুজুর, মুরগি কোরবানি করার ছোয়াবটা তাইলে ওহাদালী পাবো।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কথা কইন না জানি কেউ।” আমি মনে করলাম “উট কোরবানি করার সমান ছোয়াবটা হাছেন কাক্কুই পেলেন।” অথচ ওয়াদালী কাক্কুর বাড়ি কিন্তু জুম্মাগরের কাছেই ছিলো। তারপরও উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করতে পারেননি।

আরেকদিন আল্লাহর নিয়ামত ও কুদরত নিয়ে হুজুর জুম্মাঘরে বয়ান দিতেছিলেন “আল্লাহ কত নিয়ামত আমাদেরকে দিয়েছেন! কত সুস্বাদু ফল দিয়েছেন আমাদের জন্য! কাঠাল, আম, জাম, কলা, লিচু, আনারস, এমন অনেক কিছু।” হাছেন কাক্কু খুশি হয়ে বলে উঠলেন “হুজুর, আর তেঁতুল। ঐডাই ত মজা বেশি। মনে অইয়াই জিলবায় পানি আই পড়ছে।” হুজুর বললেন “বয়ানের সোম কতা কইন না জানি।”

আমাদের বাড়ি জুম্মা ঘর থেকে বেশ দূরে ছিলো। প্রায় আধা কিলোমিটার হবে। পাঞ্জেগানা নামাজ জামাতে আদায় করা সম্ভব হতো না। বাড়িতেই পড়ে নিতাম। উট কোরবানি করার সমান ছোয়াব কামাই করার ইচ্ছা থাকলেও আগে যেতে পারতামনা। তালুকদার বাড়ির বড় ছোট সব মুছুল্লিরা একত্র হতে সময় লাগতো। দল বেধে মুরুব্বিদের পিছনে হেটে যেতে হতো জুম্মায়। তাই একটু দেড়িতে পৌছতে হতো জুম্মায়। রমজান মাসে তারাবি নামাজে যেতে হতো রাতের অন্ধকারে সরু পথ দিয়ে। বুইদ্যা চালা ও জুয়াদালী কাক্কুদের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। সাপ ও জংলী শুকুরের ভয় ছিলো রাস্তায়। তাই দলবেধে হারিকেন, চুঙ্গাবাতি (মশাল), দোয়াত (কুপি বাতি), বদনাবাতি, বা পাটখড়ির (সোলা) আগুন জ্বালিয়ে এই দুর্গম পথে যেতে হতো তারাবি নামাযে। এই পথে ৪ টা ঘোনাও পারি দিতে হতো। ঘোনার পিচলা বাতর (আইল) থেকে অনেকেই কাদা ক্ষেতে অন্ধকারে পড়ে যেতাম। এমন কষ্ট করে যেতে হতো আমাদের জুম্মায়।

আমাদের মক্তবে যারা প্রথম কোরআন পড়ার উপযুক্ত হতেন তারা জুম্মার দিন জুম্মায় গিয়ে সবার সামনে কোরআন হাতে নিতেন। সবাই দোয়া করতেন। মিষ্টি বিতরন করা হতো এ উপলক্ষে। আমি ও এছাক ভাই একসাথে এই জুম্মায় এসে সবার সামনে কোর আন হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষক ছিলেন নোয়াখালী নিবাসী আব্দুল কদ্দুস ক্কারী সাব। তিনি পরে পাইন্নাবাইদ গ্রামে স্থায়ী হন। খুব ছোট ছিলাম। এত ছোট কাউকে কেউ কোরআন হাতে নিতে দেখেননি। তাই, সবাই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিলেন।

জুম্মায় আনন্দও ছিলো। একবার সবে ক্কদরের রাত জেগে ইবাদত করতে আমরা জুম্মাঘরে একত্র হয়েছিলাম। মাওলানা সালাউদ্দিন দুলাভাই এটার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। একটা খাসি জবাই করা হয়েছিলো। জুম্মাঘরের উত্তর পাশে মাটি কেটে চুলা করা হয়েছিলো। কয়েকজনে মিলে রান্না করছিলেন। বাকীরা জুম্মাঘরে বসে ইবাদতে মসগুল ছিলেন। আমার ভাগে পড়েছিলো দুই পাড়া কোরআন পড়া। একেক জনে একেক রকম ইবাদত করছিলেন। কোরআন পড়া শেষ করে আমি রান্না দেখতে গেলাম। এক জনে বললেন যে যারা রান্না করছে তারাও ইবাদতের ছয়াব পাবেন। ফিরে গিয়ে দেখি মাওলানা দুলাভাই বয়ান করছেন। আমি প্রবেশ করা মাত্রই দুলাভাই বললেন “এই যে, সাদেকই বলতে পারবে। সাদেক, বলতো চাঁদে কে কে পৌছেছিলো?” আমি একটু স্টাইল করে কথা বলে উত্তর দিলাম “নীল আর্মস্ট্রং, এড উইন ই অল্ড্রিন এন্ড মাইকেল কলিন্স।” তিনি বললেন “হে, সাদেক ঠিক বলছে। ও বিজ্ঞান জানে। কাজেই আমরা যে রকম দেখি চাঁদ সে রকম না। আল্লাহ চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সব সৃষ্টি করেছেন……….। “

আমাকে ১৯৭৫ সন থেকে পড়শুনা ও চাকরি করার জন্য গ্রামের বাইরে থাকতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে গ্রামে আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। সেহেতু ঐ কেন্দ্রীয় মসজিদে আমার আর যাওয়া হয় না। নওপাড়া ও চনপাড়ার মুছুল্লিদের সুবিধার্থে দুইপাড়ার সংযোগ স্থলে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তালুকদার বাড়ির মুসুল্লিদের সুবিধার্থে তালুকদার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানের পশ্চিম পাশে শিরিরচালা – সারাসিয়া রাস্তার ধারে আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আমি বাড়ি গিয়ে তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদে জুমআর নামাজ পড়ি। ইচ্ছা থাকলেও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও চনপাড়া জামে মসজিদে যেতে পারিনা। যদি যাই, তবে নিন্দুকেরা বলবে “ডাক্তরে নিজের বাড়ির মসজিদে না গিয়ে অন্য পাড়ার মসজিদে গেছে।” বস্তুত তিনটি মসজিদই আমাদের। তিনটি মসজিদেই গ্রামের মানুষের আর্থিক সহযোগিতা আছে। নামাজে মুছুল্লিদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই আরও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। শুধু মসজিদ না, গ্রামের সবার সহযোগিতায় মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। একটা জিনিসের অভাব আছে, সেটা হলো পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা করার এখতিয়ার গ্রামের মানুষের নেই। এটা সরকারি অর্থায়নের কাজ। সরকার দেশের মেঘা মেঘা রাস্তার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। একদিন হয়তো পাকা রাস্তা হবে। সেদিন হয়তো আমরা থাকবোনা। ঘুমিয়ে থাকবো চির নিদ্রায় রাস্তার ধারের তালুকদার বাড়ি পারিবারিক গোরস্থানে বাবা-মার পাশে আসাদুজ্জামান তালুকদার মুকুলের মতো। পথচারীরা সালাম দিয়ে যাবে। মসজিদের মুছুল্লিরা জুমআর নামাজ শেষে দোয়া করবে “ইয়া, আল্লাহ, মেহেরবানী করে করববাসীদেরকে মাফ করে দিন।”

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

বড়বাইদপাড়া, সখিপুর, টাঙ্গাইল।

১৮ নভেম্বর ২০২২ খ্রি.

ময়মনসিংহ

এমন স্মৃতি কথা আরও পড়তে নিচের হ্যাস ট্যাগ শব্দের উপর ক্লিক করুন

#memoryofsadequel

ads banner:

kathal churi

কাঁঠাল চুরি

(স্মৃতি কথা)

তখন ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়তাম। তখন আম-কাঁঠাল গাছ তেমন বেশী ছিলো না। যেহেতু, তালুকদারদের মধ্যে মেঝ দাদা মেছের আলী তালুকদার প্রথম এই গ্রামে এসে বাড়ি করেছিলেন সেহেতু দাদাদের গাছগুলো তুলনামূলক বড় ছিলো। কি কারনে যেন আমরা মেছের দাদার স্ত্রী, যিনি আমাদের দাদী হন তাকে সব নাতী নাত্নিরা বাব্বু ডাকতাম। বাব্বু আমার বাবার আপন চাচী। মুকুলের আপন দাদী। দাদুদের গাছগুলো প্র‍্থম দিকে বাব্বুই লাগিয়েছিলেন। তাই, গাছগুলোর নাম বাব্বুর নামে হয়েছে। যেমন, বাব্বুর কাঁঠাল গাছ, বাব্বুর আম গাছ। বাব্বুর কাঁঠাল গাছটা ছিল বাব্বুগ ঘরের পিছে, বাঁশ আড়ার সাথে । তাই কাঠাল চুরি করা সহজ ছিলো।

এই কাঁঠাল পাকলে হয় জুম্মাঘরে দেয়া হবে শুক্রবারে। না হয় ভেঙ্গে বাব্বু মুকুলকে খাইয়ে দিবে। না হয় বাটি ভর্তি রোয়া নিয়ে ছোট কাক্কুর হাতে দিবে। এটাই ছিলো আমাদের ধারণা। শাজাহান, রাজ্জাক, মুকুল ও আমি সাধারণত এক সাথে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। বাব্বু মুকুলকে খুব আদর করতেন এবং চোখে চোখে রাখতেন। আমরা মুকুলকে নিয়ে যেদিকে যেতাম, বাব্বুও সেদিকে যেতেন। কাঁঠালটা বড় হলে পাকলো কিনা জানার জন্য পাজুন (গরু পিটানোর লাঠি) দিয়ে বারি দিতাম প্রতিদিন একবার করে। একসময় পাকার জন্য আর ধৈর্য্য ধরে না। সিদ্ধান্ত নিলাম পেড়ে মুখে কচি ঠুকায়ে পাঁকাবো। তাতে তো আমাদের লাভ হবে না। মুকুল একা খেতে পারবে, আমরা পারবো না। তিনজনে সিদ্ধান্ত নিলাম মুকুলকে সাথে নিয়ে এই কাঁঠাল চুরি করবো। তাতে ধরা পরলে মুকুল সাথে থাকলে কেউ চোর বলতে পারবে না। সেই মতো একদিন আমরা কাঠালটা ঝেংটা টান মেরে পেড়ে বাঁশ আড়ার ভিতর দিয়ে লুকিয়ে এক দৌড়ে ঘোনা পার হয়ে বুইদ্যা চালার জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লাম। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে গর্তে কাঠাল রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে ফেললাম। তারপর ৪ চোর মিলে বুইদ্যা চালার মাঝখানে যেখানে বন ছিলনা সেখানে বসে শলাপরামর্শ করলাম কিভাবে ফলোআপ দিতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো সব চোর একাত্র হয়ে প্রতিদিন একবার করে কাঁঠাল দেখে যাব। একটা আসংকা ছিলো যে কাঁঠাল পেকে গেলে আড়ার শিয়াল মাটি থেকে কাঁঠাল তুলে খেয়ে ফেলবে। তাই রাতে হুয়া হুয়া করে শিয়াল ডাকলে মনে করতাম কাঁঠালটা খেয়ে শিয়াল আনন্দ করছে। কাঁঠাল দেখতে যাওয়ার আগে আমরা একে অন্যকে ডাকতাম। সিদ্ধান্ত হয়েছিলো যে “ঠাল” বললে মনে করবো ঐ চুরি করা কাঠাল।

in-feed-ads:

একদিন আমি শাজাহানকে ডাকলাম “এই শাজাহান, ঠাল।” অন্যরাও বলে উঠলো “ঠাল।” সেখানে কয়েকজন মুরুব্বিও ছিলেন। মোতালেব ভাই বললেন “কি ব্যাপার? কিসের ঠাল?” আমি বললাম “এটা আপনি বুঝবেন না। এটা আমাদের সাংকেতিক ভাষা।” ভাই বললেন “বুঝব না মানে? কাঁঠাল চুরি করছস। এখন কাঁঠালকে বলছস ঠাল। তাই না?” আমরা বললাম “তা না।” তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম জেড়ার হাত থেকে। পরামর্শ করলাম এখন থেকে ঠাল বলা যাবে না। বলবো লঠাকা। রাজ্জাক বললো “এটা বললে আবার ধরা খাবা। বাশার ভাই বানান উল্টো করে কথা বলতে পারে। বুঝে ফেলবেন লঠাকা মানে কাঠাল।” চুরি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঐদিন আর ফলোআপ দিতে গেলাম না। পরেরদিন গিয়ে দেখি শিয়ালে কাঁঠাল খেয়ে মাটির সাথে চেড়াবেড়া করে রেখে গেছে। কেইত্তা দেখে মনে হলো বাত্তি হইছিলো না। আমরা খেলে হয়তো পাইনছা লাগতো। যাহোক, চুরিটা সাকসেসফুল হলো না।

বড় হয়ে বুঝেছি, ওটা চুরি ছিলো না। দাদীর গাছের কাঁঠাল চুরি করে খেলে সেটা চুরি হয় না। চুরি করে খেয়েছে শিয়ালে।

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

১১ অক্টোবর ২০২২

ময়মনসিংহ

#memoryofsadequel

Story

ছেলেবেলার গল্প – প্লে লিস্ট

মাছেরে | Machere | টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায় | Traditional fishing video of BD

আমার পারিবারিক জীবন – জীবনের গল্প

My Family Life – Life Story

জার্নি বাই ট্রেইন – জীবনের গল্প

Journey by Train – Life Story