train

Journey by Train

জার্নি বাই ট্রেইন

২০০৮ সন, জানুয়ারি মাস। আমার ছোট মেয়ে দীনাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে মাইগ্রেশন ফর্মে প্রথম পছন্দ দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ লিখে ময়মনসিংহ চলে এলাম। দিনাজপুর যাত্রার উদ্যেশ্যে দীনার মা স্বপ্না, দীনা ও আমি রওনা দিলাম। রত্না স্বপ্নার ইমিডিয়েট ছোট বোন। দীনার খালামনি। তার বাসা টাঙ্গইল। তার বাসায় রাত্রিযাপন করলাম। সকালে নানারকম রেসিপি দিয়ে নাস্তা করলাম। দীনা মেডিকেলে চাঞ্চ পাওয়াতে তারা সবাই খুশী।

বাসে দিনাজপুর যাওয়া অনেক কষ্টের ভেবে এবার ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়েছিল রত্নার পরামর্শেই। রত্না বলল “বাসে আট দশ ঘন্টা বসে থাকা খুব কষ্টের। ট্রেনে কি ফাইন কোন ঝাকি নাই। আরামে বসে যাওয়া যায়। নাস্তা করা যায়। বাথরুম করা যায়। কত সুবিধা!” আমরা টাঙ্গাগাইলা মানুষ। আগে এই জেলায় ট্রেন লাইন ছিল না। ট্রেন লাইন পেয়েছি যমুনা নদীর উপর সেতু হওয়ার পর। ট্রেনে উঠেছি মাত্র কয়েকবার। ট্রেনে হুরমুরি ওঠ-নামা করা আমার কাছে ঝামেলার মনে হতো। তাই আমি সাধারণত বাসেই জার্নি করতাম। খুব ছোট বেলায় দীনা ট্রেন জার্নি করেছে। সেটা তার মনে থাকার কথা না।

Read more: train

ট্রেনটা সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে টাঙ্গইল হয়ে দিনাজপুর যাবে। এগারোটার দিকে টাঙ্গইল টাচ করবে। আমাদেরকে একটু আগেই স্টেশনে উপস্থিত হতে হবে টিকিট করার জন্য। স্বপ্না আমাকে ডাক্তার বলে ডাকে। সকাল থেকেই কিছুক্ষণ পরপর তার সতর্কবাণী আমাকে বিরক্ত করছিল। সে বারবার বলছিল “এই ডাক্তার, তুমি কিন্তু দীনার প্রতি খেয়াল রাখবে। ট্রেনের ঢুলানিতে তার বমি হতে পারে। আল্লাহ নাকরুক, বমি করতে করতে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে !” আবার বলে “এই ডাক্তার, অপরিচিত কারো কাছের কিছু কিন্তু খাবে না।” বারবার বলে “এই ডাক্তার, দীনাকে কিন্তু একা বাথরুমে পাঠাবে না। তুমি বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আল্লাহ না করুক, কেউ যদি বাইর থেকে বাথরুমের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়! মা আমার ফাপর হয়ে যাবে।” আমি দেখলাম নানারকম অজানা আতংকে স্বপ্না অস্থির। আমি তেমন তার কথায় পাত্তা দিচ্ছিলাম না। একটু একটু সশার টুকরা মুখে দিয়ে কচকচ করে চিবাচ্ছিলাম। একটা দুইটা বরই মুখে দিয়ে চিবাচ্ছি্লাম। রত্নার সাথে ঠাট্টা মস্করা করছি্লাম। রত্নাও সতর্ক কম করছে না। বলছে “এই দুলাভাই, দীনা বাথরুমে গেলে খেয়াল রাখবেন।” ইত্যাদি। ট্রেন আসার সময়ের এক ঘন্টা আগেই রত্না, দীনা, স্বপ্না ও আমি রিক্সা করে সাবালিয়া থেকে টাঙ্গইল রেল স্টেশনে গেলাম। টিকিট করলাম। দুই ঘন্টা বিলম্ব করে ট্রেন এলো। ততক্ষণ দীনার মা-খালাদের সতর্কবাণী শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে পড়ছি। ট্রেনে উঠে বসলাম।

কিছুদুর চলার পর একটু বোরিং লাগছিল। ইয়ার ফোনটা কানে লাগিয়ে মোবাইল থেকে মেহেদী হাসানের গজল শুনতে থাকলাম। দীনাও তার কানে ইয়ার ফোন লাগাল। সে কি শুনছিল তা আমি জানি না। গরম জামা গায়ে ছিল। দুপুরের পর থেকে গরম একটু বেশী মনে হচ্ছিল। আমার প্রশ্রাবের চাপ হল। দীনাকে সীটে রেখে টয়লেটে গেলাম। টয়লেটে ঢুকে ভাল করে ভিতর থেকে শিটকিনি লাগালাম। ট্রেন দুলছিল খটর খট খটর খট শব্দে। আমিও দুলছিলাম । প্রশ্রাব করার পঅর বের হওয়ার জন্য প্রস্ততি নিলাম। শিটকিনি খুললাম। দরজা ধাক্কা দিলাম। দরজা খুলছে না। খুলছে না কেন? বুঝতে পারলাম কেউ বাইরে থেকে শিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে। এইবার মনে পড়ল স্বপ্নার সতর্ক বাণীর কথা। তার ধারনা ছিল দীনা আটকা পড়তে পারে। দীনা ছোট্ট মেয়ে। সে আটকা পরতে পারে। কিন্তু দীনার বাবা যে আটকা পরতে পারে তা কারো মাথায় ছিল না। আমি একটু ধৈর্য ধরলাম। ভাবলাম আমার পর যার প্রশ্রাবের সিরিয়াল সেই বাইরের শিটকিনি খুলে যখন প্রবেশ করবে তখন তার পাশ দিয়ে আমি আসতে করে বের হয়ে যাব। কিন্তু পনের বিশ মিনিট অতিবাহিত হল কারো দেখা পেলাম না। এবার টেনশন শুরু হল। ঘামতে লাগলাম। ফুল সুয়েটার পরা ছিল। সুয়েটারের নিচে ঘাম চাপা পরে অসস্তি লাগা শুরু হল। টয়লেটটা ছিল পশ্চিম পাশে। বিকেলের পশ্চিমা রোদে টয়লেট গরম হতে লাগলো। আমার শরীরে জ্বালা ধরে গেল। চলন্ত ট্রেনের ঝাকুনিতে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছি। কিন্তু এই দোলায় আরাম নেই, আছে কষ্ট। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দীনাকে কল দিলাম। বিপত্তির কথা জানালাম। আরো ১০ মিনিট গেল। দীনা তার বাবাকে উদ্ধার করতে এলো না। আমি আবার কল দিলাম। দীনা বলল “তুমি কোন টয়লেটে গেছো, আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না।”
-আমরা যে কম্পার্টমেন্টে ছিলাম সেইটার টয়লেটে।
-ওটা তো খালি।
-আমার মনে হয় তুমি উলটা দিকে খোঁজ করছো।
-তাহলে অন্য দিকে যাব?
-যাও।
অনেকক্ষণ দীনার কোন রেস্পন্স নাই।
আমি ঘেমে অস্থির।
-আব্বু, আমি কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট খোঁজ করে দেখেছি কোন টয়লেট বাইরে থেকে বন্ধ না।
-তুমি বেশী দূর আর যেও না, সীট হারিয়ে ফেলবে।

দরজার কাছে এক সিকুরিটি ম্যান বসে ঘুমাচ্ছিল। দীনার মোবাইল অন ছিল। আমি শুনলাম দীনা বলছে “পুলিশ আংকেল, আমার আব্বু টয়লেটে গিয়ে আটকা পড়েছে। আংকেল, আংকেল…।” পুলিশ আংকেল কিছুই বুঝতে পারলেন না ঘুম থেকে জেগে উঠে। আমি পুলিশের সাথে দীনার ডায়লগ শুনে আরো চিন্তিত হয়ে পরলাম। ঘামতেই থাকলাম। মনে পরল ছুটির ঘন্টা সিনেমার কথা। স্কুল ছুটির পর দারোয়ান টয়লেট চেক না করেই এক ছাত্রকে টয়লেটে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে গিয়েছিল। স্কুল কয়েকদিন ছুটি ছিল। ততদিনে ছেলেটির করুন মৃত্যু হয়। আমি মরব না। কিন্তু ঘেমে আমার বারটা বেজে যাবে। এক সময় কারো প্রশ্রাব পায়খানার চাপ এলে আমাকে উদ্ধার করবেই। কিন্তু যদি কারো চাপ না আসে! হায়, হায়! এক সময় দীনার ফোন এলো “আব্বু, আমি এখন আমার সীট চিনতে পারছি না।” আরেক টেনশন শুরু হল আমার।

অনেকক্ষণ আবার ফোন এল “আব্বু, আমি সীট খুঁজে পেয়েছি। চিন্তা করো না।”

এভাবে অবরুদ্ধ অবস্থায় আমার চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট কেটে গেলো। ট্রেন চলছে তার নিজস্ব গতিতে । আমি দুলছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এক সময় ছিটকিনি খুলে একজন লোক ভিতরে দাঁড়ানো আমাকে দেখতে পেল। বুঝতে পারলাম তার চাপ এসেছে। আমি আসতে করে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে পরলাম। সে ঢুকে পরল। কিন্তু জানল না আগের জনের ভাগ্যে কি দুর্গতি হয়েছিল। সীটে গিয়ে বাপবেটি এনিয়ে কথা বললাম। দীনা বলল “আমি তো দেখলাম ঐ টয়লেট থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো।” আমি আর তাকে  এনিয়ে বেশী জেরা করলাম না। ট্রেনের সিকুরিটিকে বিস্তারিত জানালাম। সতর্ক করে বললাম “আমি যেন আগামী সপ্তাহে কোন টয়লেটে দরজার বাইরে ছিটকিনি না দেখি। সবগুলো খুলে ফেলবেন।”এরপর ট্রেনে আমি মাত্র দুইএকবার ভ্রমন করেছি। অনেকদিন পর দীনা বলল “আম্মু সতর্ক করেছিল, ট্রেনে খোলা দরজার কাছে না যেতে। তাই আমি হয়ত ভাল করে টয়লেটের দরজা চেক করি নি।”

রাত আটটার দিকে দিনাজপুর পৌঁছলাম। অধ্যক্ষ স্যার আমাদের জন্য কলেজের ডর্মেটরির ভিআইপি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন ।  দীনা ও আমি সেই রুমে অবস্থান করলাম। সকালের দিকে দীনা তার হোষ্টেল রুমে উঠল। তার রুমমেট পেখম তখন ক্লাসে ছিল। খবর পেয়ে রুমে এলো। দীনাকে জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্ব প্রকাশ করল। আমার ভাল লাগলো।
১৯/২/২০১৮ খ্রি.