Tag Archives: ঘুড়ি

guddi

গুড্ডি

(স্মৃতি কথা)

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

ঘুড়িকে আমরা বলতাম গুড্ডি। গুড্ডি তৈরি করতে কাগজ, বাঁশের বাতি, আঠা ও সুতা লাগতো। শক্ত কাগজ লাগতো। আমরা এই কাগজকে বলতাম বাঁশ তাও। আমরা জানতাম বাঁশ তাও বাঁশ থেকে তৈরি হয়। এই কাগজের রঙ বাদামী ছিল। ডিজাইন করে বাঁশ তাও কেটে আঠা দিয়ে বাঁশের ফ্রেমে আটকানো হতো। ঘুড়ি উড়ানোর মৌসুমে অর্থাৎ জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে বল গোটা পাকতো। এগুলো বন্য ফল। আবেদ আলী কাক্কুদের বাড়ির উত্তর পাশে একটা বল গোটা গাছ ছিলো। আমরা বড়বাইদপাড়ার প্রায় সবাই এই গাছের বল গোটা তুলে এর আঠা দিয়ে গুড্ডি বানাতাম। বড় বড় গুড্ডির মাথায় বা ঘারে বেত বাঁধা হতো, বলা হতো বেত আলা গুড্ডি। বর্গা হাটে বেত উঠতো। এই বেত দিয়ে হস্ত শিল্পের কাজ করা হতো। ছাত্র পিটাতেও এই বেত ব্যবহার করা হতো। এই বেতের বাকল মিহি করে ছিলিয়ে পাতলা ফিতার মতো করে গুড্ডির বেত বানানো হতো। বাঁশের বাতিতে টাইট করে বেঁধে ধনুকের মতো করে গুড্ডিতে লাগানো হতো। গুড্ডি ওড়ার সময় বাতাস লেগে বেত গুণ গুণ করে বাজতে থাকতো। এই ধরনের বেত আলা গুড্ডি বড়রা উড়াতো।

আকার আকৃতি অনুযায়ী গুড্ডির বিভিন্ন ধরনের নাম ছিলো। সহজ ও কম খরচে বানানো হতো পতিঙ্গা। পতঙ্গের মতো দেখতে। ছোট এবং পাতলা ছিলো। এটার নিচের দিকে ছোট ছোট দুটো লেজ ছিল। গুড্ডি সুতার সাথে বেঁধে বাতাসে উড়াতে হয়। গুড্ডির সাথে তিনটা সুতা লাগানো থাকে। উপরের দিকে দুইটা, নিচের বা পেটের দিকে একটা। উপরের দুইটা নিচের থেকে খাটো।সাপের মতো ডিজাইন করে যে গুড্ডি বানান হতো তার নাম ছিলো সাপা। অনেকে বলতো হাপা। চার কোনা আয়তকার গুড্ডিকে বলা হতো চং। বড় সাইজের গুড্ডি যার লেজ ছিলো ফিংগে বা ফেইচ্চা পাখির লেজের মতো তাকে বলা হতো ফেইচ্চা গুড্ডি। বড় বড় গুড্ডি যার লেজ ছিল ভাতের পাতিল বা পাইল্যার মতো তার নাম ছিলো পাইল্যা গুড্ডি। বড় বড় চং, ফেইচ্চা গুড্ডি ও পাইল্যা গুড্ডির ঘারে বেত বেঁধে দেয়া হতো ভন ভন করে বাজানোর জন্য। সন্ধ্যার সময় ঝোপে ঝারে এক যোগে শত শত ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতো। আর আকাশে অনেকের বেতা আলা গুড্ডি ডাকতো। দুই ধরনের ডাক মিলে এক অপুর্ব নৈসর্গিক সুর তৈরি হতো। সেই সুর আজও কানে বাজে। এখনো গ্রামের বাড়ি গিয়ে রাত্রিযাপন করি। সন্ধ্যা নেমে আসলে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে পাই। কিন্তু গুড্ডির ডাক শুনতে পাই না।

গুড্ডি উড়ানো হতো দখিনা বাতাসে। আমাদের বাড়ির দক্ষিনে বাইদের ওপারে সড়াসিয়া গ্রাম। বড়বাইদপাড়া গ্রামের দক্ষিনেও সাড়াসিয়া গ্রাম আবার পূর্বেও সাড়াসিয়া গ্রাম। চটানের বাইদ সাড়াসিয়া গ্রামকে দুইভাগে ভাগ করেছে – উত্তর সাড়াসিয়া এবং দক্ষিণ সাড়াসিয়া। চটান বাইদের দক্ষিন পাড়ে নুরজাহা ভাইদের বাড়ি এবং উত্তর পাড়ে জাফর ভাইদের বাড়ি। দুই জনের বাড়িই আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। ওনারা সমবয়সী ছিলেন। দুই জনই বিবাহিত যুবক ছিলেন। আমি তখন কিশোর। দুই জনই পাল্লা দিয়ে গুড্ডি উড়াতেন। দুই জনের ঘুড্ডিতেই বড় বড় বেত বাঁধা থাকতো। ওনাডের গুড্ডির সুতা এত লম্বা ছিলো যে বাতাস কমে গেলে গুড্ডিগুলো আমাদের বাড়ির কাছাকাছি নেমে আসতো। আমি চালায় একাকি বসে বসে ঘুড্ডি উড়া উপভোগ করতাম। আমি বাবার কাছে তেমন কিছু আব্দার করতাম না। বাবার যদি কষ্ট হয়! তাই। বাবা আমার ইচ্ছাটা বুঝতে পেরে নিজ হাতে একটা বিনা ভাড়া গুড্ডি বানিয়ে দেন। কিন্তু সেটা দেখতে ভালো ছিলো না। আমার পছন্দ হয়নি। খসরু কাক্কু ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “তোর বাপের বানানো বিনাভাড়া, হে, হে, হে।” আমি তারপর থেকে ওটা আর উড়াইনি।

আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বাইদের বাতরে (আইলে) বসে জাফর ভাই ও নুরজাহা ভাইর ঘুড্ডি উড়া দেখতাম। বাবা এলেন কাছে। আমি একটু লজ্জিত হলাম। বাবার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “বাজান, আমি তোমারে ভালা একটা পাইল্যা গুড্ডি কিন্যা দিমু। নও ইদ্দুগ বাইত যাই।” বাবা, আকবর ভাই ও আমি উত্তর সাড়াসিয়া গ্রামের ইদ্দু ভাইদের বাড়ি গেলাম গুড্ডি কিনতে। ইদ্দু ভাই গুড্ডি তৈরির একজন ভালো কারিগর ছিলেন। মনের আনন্দে ইদ্দু ভাইর কাছ থেকে কেনা গুড্ডি বেশ কিছু দিন উড়ালাম। ঐ গুড্ডিতে বেত বাঁধা ছিলো। আমি ঘরেও সুতা ধরে গুড্ডি মাথার উপর ঘুরাতাম ভন ভন করে ডাক শোনার জন্য। এক দিন বাবা ঘরে প্রবেশ করেছেন এই দময় আমি বাবাকে দেখতে পাইনি। যেই গুড্ডি ঘুরান মেরেছি অমনি ওটার চোক্ষা মুখ বাবার মাথায় লেগে চামড়া ছিদ্র হয়ে রক্ত বের হয়ে গেলো। বাবা মাথায় হাত দিয়ে হাতে রক্ত দেখতে পেয়ে রাগে আমার গুড্ডি ভেঙ্গে চুরমার করে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আমি কয়েকদিন শোক কাটালাম। আবার ক্ষেতের বাতরে বসে বসে জাফর ভাইর গুড্ডি উড়া দেখা শুরু করলাম। আমার কষ্ট বুঝতে পেরে বাবা আমাকে আরেকটা গুড্ডি কিনে দিলেন ইদ্দু ভাইর কাছ থেকে।

এবার ঘটলো আরেক ঘটনা। আমাদের একটা দামী টেপাটেপা গাভিন ছাগল ছিলো। আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে বারচা ক্ষেতে হাচার দিয়ে পাহারা দিতাম। কারন, পাশের গজারি বনে বাস করতো শেয়াল মশাইরা। একদিন গুড্ডি উড়াতে উড়াতে আমি চলে গিয়েছি বড়বাইদের কুয়ারপাড়ের ক্ষেতের বাতরে। এদিকে একা পেয়ে শেয়াল মশাই ছাগলের গলা দাঁত দিয়ে ছিদ্র করে দিয়েছে। ছাগলটা মারা গেছে। তিনি রাতে টেনে নিয়ে জংগলে নিয়ে ধীরে ধীরে ভক্ষন করবেন। এই দৃশ্য দেখে বাবা রাগে ফেটে পড়ে খুঝতে খুঝতে আমাকে কুয়ার পাড়ের ক্ষেতের বাতরে গুড্ডি উড়ানো অবস্থায় পেলেন। কোন কথা নেই। গুড্ডিটা নামালেন। মট্টশ করে ভেঙে দিয়ে চলে গেলেন। আমি বাড়ি গেলাম। দেখলাম বিশাল দেহি গাভীন প্রিয় ছাগলটা আমাদের ছনপাওড় ক্ষেতে মরে পরে আছে। আমি শোকে ভেঙ্গে পড়লাম। টেনে মরা ছাগলটাকে বাড়ির উঠানে নিয়ে রাখলাম এই ভেবে যে শিয়ালকে এই ছাগল খেতে দেব না।

কয়েকদিন ছাগল ও গুড্ডির শোক এক সাথে পালন করলাম। বাবা আমার কষ্টের কথা ভেবে আবার আরেক বেতায়ালা গুড্ডি ইদ্দু ভাইর কাছ থেকে কিনে দিলেন।

ইদ্দু ভাই, জাফর ভাই, নুরজাহা ভাইরা কি বেচে আছেন। তোমরা কিশোররা, যারা বড়বাইদপাড়ায় থাকো তারা কি গুড্ডি উড়াও? আবেদ আলী কাক্কুগ বাড়ির পিছনের বলগোটা গাছটি কি এখনো আছে?

২৪ জুন ২০২৫ খ্রি