Tag Archives: Barishal

kirtonkhola

কীর্তনখোলা নদীতে বোটিং, ১৯৯৯ সন

পুরনো হার্ড এলবাম থেকে।

১৯৯৯ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে এক্সটার্নাল এক্সামিনার হিসাবে পরীক্ষা নিতে গিয়ে এই নদীতে বোটিং করি।

বরিশালের কীর্তনখোলা নদী:

কীর্তনখোলা নদী বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এবং স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবহন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নদীটি আড়িয়াল খাঁ নদীর একটি শাখা এবং দক্ষিণে পায়রা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

এই নদী বরিশালের প্রধান নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার উপর দিয়ে প্রতিদিন শতাধিক লঞ্চ, ট্রলার ও কার্গো চলাচল করে। বর্ষাকালে নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য হয়ে ওঠে। নদী তীরবর্তী এলাকা শহরের বাসিন্দাদের কাছে বিনোদনের জায়গা হিসেবেও জনপ্রিয়।

সংক্ষিপ্ত তথ্য:

অবস্থান: বরিশাল শহর

দৈর্ঘ্য: প্রায় ২০ কিলোমিটার

ব্যবহার: নৌপরিবহন, মাছ ধরা, পর্যটন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: তীরবর্তী সবুজ বন, সূর্যাস্ত দৃশ্য

prothom-chakri

বরিশালের গ্রামে প্রথম চাকরির স্মৃতিকথা

বন্ধু বিচ্ছিন্ন

ডাঃ নজরুল ইসলাম। বর্তমানে টাংগাইলের নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ এফসিপিএস সার্জন। তার সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব শুরু হয় ১৯৭৭ সনে কালিহাতির আউলিয়াবাদে আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই। হোস্টেলে পাশাপাশি রুমে থাকতাম। একসাথে বেড়াতাম, মন খুলে গল্প করতাম। পালাকরে গান গাইতাম। ওদের বাড়ীতেও গিয়েছি। খালাম্মার হাতে রান্নাও খেয়েছি।

বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হল যখন আমরা দুইজনই ১৯৮০ সনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চাঞ্চ পেলাম। থাকা শুরু হল একই রুমে। এক সাথে খেতাম, পড়তাম, ঘুরতাম, সিনেমা দেখতাম, ঘুমথেকে উঠতাম, ক্লাশে যেতাম, ছুটিতে বাড়ী যেতাম। একই রকম জামা পরতাম। ক্লাশমেটরা বলত দুই ভাই। একই রকম রেজাল্ট করতাম। রিক্সা ভাড়া শেয়ার করতাম। তাই, হাত খরচ কম লাগত। এই রকম প্রায় সব কিছুতেই আমাদের দারুণ মিল ছিল।

১৯৮৫ সনে দুইজনই এমবিবিএস পাস করে দুইজনই সার্জারিতে বিশেষ ইন্টার্নশীপ ট্রেইনিং নিলাম ভবিষ্যতে সার্জারি বিশেষজ্ঞ হবার আশায়। কিন্তু বাস্তবে সে আজ চক্ষু বিশেষজ্ঞ আর আমি প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ।

ইন্টার্ন ট্রেইনিং শেষ করে দুই জনই বেকার হয়ে গেলাম। দুই জনই মেডিকেল অফিসার হিসাবে টাংগাইলের একমাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল নাহার নার্সিং হোমে কাজ শুরু করলাম।

১৯৮৮ সনে শুনলাম আমাদের মেডিকেল অফিসার হিসাবে সবারই সরকারি চাকরির অর্ডার হয়েছে। আমাদের দুইজনকেই খুলনা বিভাগে ন্যাস্ত করা হয়েছে। জুলাইর ১ তারিখে আমরা এক সাথে খুলনা গেলাম। রাত ১১ টায় খুলনা পৌছলাম। সকাল ১০ টায় স্বাস্থ্য বিভাগের ডিভিশনাল ডাইরেক্টর অফিসে গেলাম। দেখলাম পোস্টিং অর্ডার সাইন হয়ে গেছে। আমাকে দিয়েছে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়ন সাব সেন্টারে। নজরুলকে দিয়েছে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার কোন এক সাব সেন্টারে। অর্ডার হাতে পেয়ে দুই বন্ধু বিমর্ষ ভাবে তাকিয়ে রইলাম। কেউ একজন বললেন “দেরী না করে তাড়াতাড়ি যোগদান করে ফেলুন। প্রথম সরকারী চাকরি, একই দিনে সবাই যোগদান না করলে সিনিয়র জুনিয়র সমস্যা হবে। বিকেল বেলায় আমরা দুইজন দুইদিকে রওনা দিলাম। আমি পুর্ব দিকে গেলাম, নজরুল পশ্চিম দিকে গেল। এই যে দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন হলাম এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন

অবস্থায় আছি। কথা হয়, দেখা হয়, মোবাইল হয়, ফেইসবুক হয়, চেট হয়।


তারিখঃ ১২/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

প্রথম কর্মস্থলে যোগদান


সময়টা ১৯৮৮ সালের ২ জুলাই।  পোস্টিং অর্ডার হাতে পেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথ কী হবে তার খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। এ ব্যাপারে সুলতান নামে আমার এক আত্মীয় তার সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে একটা রোড ম্যাপ করে দিল। সে ওখানে চাকরি করত। 

বাসে করে সাতক্ষীরায় তার বাসায় গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে সেখান থেকে হুলার হাট গেলাম। একা জার্নি, খুব খারাপ লাখছিল। হুলার হাটে সস্তা একটা হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম। 

বাথরুমের অবস্থা ভাল না থাকায় পায়খানার কাজে ওটা ব্যাবহার করলাম না। পায়খানার বেগ নিয়েই ভোর ৫ টায় রিক্সা নিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। 

ছিনতাই হবার ভয়ে ভীত ছিলাম। ঘাটে গিয়ে বসলাম। একজন দুইজন করে যাত্রী এসে বসতে লাগল। 

আমি জীবনে তখনো লঞ্চ দেখিনি। আজ  প্রথম লঞ্চ দেখার অভিজ্ঞতা হবে। বাসের মত কি আগে টিকিট করতে হবে? না উঠে টিকিট করতে হবে? এনিয়ে ছিল নানা দুশ্চিন্তা। 

স্থির করলাম আমার মত প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্র যাত্রীরা যা করবে আমিও তাই করব। দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে একটা বড় নৌযান আসছে। উপরে লিখা “এম ভি বাপ্পী”। বুঝতে পারলাম এটাই লঞ্চ। ঘাটে ভিড়ল। দেখলাম দোতলা-নিচ তলা আছে। আমি ভদ্র লোকদের দেখাদেখি দোতলায় গিয়ে বসলাম। 

বোকার মত এদিক সেদিক তাকালাম। বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলাম। লঞ্চ পূর্ব দিকে চলছিলো। পানি আর পানি। সীমাহীন পানি। জীবনে এত পানি দেখিনি। একটা লোক বেঞ্চে পা তুলে বেয়াদবের মত শুয়েছিলো। আমি তার প্রতি বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম। এক লোক ব্রিফকেসে সুই দিয়ে খোদাই করে নাম লিখে দিচ্ছিল। আমিও পাঁচ টাকা দিয়ে নাম লিখালাম ‘সাদেক’। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। 

পানি দেখে খুব ভাল লাগছিল। পানিতে অনেক মহিষ দেখতে পেলাম। মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কী যেন খাচ্ছিল। 

আমি জানতাম, মহিষ মাঠে ঘাস খায়। কিন্তু পানির নিচ থেকে কী খাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম “মহিষ পানির নিচ থেকে কি খাচ্ছে?”। লোকটি আমাকে অস্বাভাবিক মানুষ ভেবে উত্তর না দিয়ে সটকে পড়ল।  বিপরীত দিকের বারান্দায় গিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও তাই করল। 

আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ভেতরে এসে একজনকে বিষয়টি বলার পর সে বলল ”কেন? ঘাস খায়।“

আগের দুইজন তখন মনযোগ দিল। আমি জানতে চাইলাম

-পানির নিচে ঘাস জন্মায় কেমনে?
– এটাতো মাঠ। মাঠে ঘাস খাচ্ছে।
– আমি তো দেখছি সাগরের মত।
– আপনার বাড়ি কই?
 (আমি ভরকিয়ে গেলাম)

– টাঙ্গাইল জেলায় সখিপুরে, পাহাড় অঞ্চলে।
পাশ থেকে একটু শিক্ষিত একজন বললেন
-আপনি বুঝি জোয়ারভাটা দেখেননি। এখন জোয়ার। ভাটার সময় মহিষ ঘাস খাওয়া শুরু করেছিলো, জোয়ারের পানিতে মাঠ ভরে গেছে, এখনো মহিষ মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে।
– এখন বুঝতে পেরেছি। বইয়ে পড়েছি।
-আপনি কী করেন? কোথায় যাচ্ছেন?
– আমি ডাক্তার। সরকারি চাকরি হয়েছে। যোগদান করতে যাচ্ছি।
-এমবিবিএস ডাক্তার?
– জ্বী।

সবাই নড়েচড়ে বসে আমার দিকে মনযোগী হল। আমিও সাচ্ছন্দ্যবোধ করা শুরু করলাম। একে একে অনেকেই টুকটাক অসুখের কথা জানাল। আমি সমাধান দিলাম। আমি ওখানকার মধ্যমণি হয়ে গেলাম। যে লোকটি পা তুলে শুয়ে ছিল সেও পা নামিয়ে বসল। বলল “ডাক্তার সাব, আমার সারাক্ষণ পায়ের তলা জ্বালাপোড়া করে। কেন এমন হয়?” এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম কেন সে বেয়াদবের মত পা তুলে শুয়েছিল।

এভাবে সবার সাথে গল্প করতে করতে সকাল ১০টার দিকে বরিশাল এসে পৌঁছলাম। 

সিভিল সার্জন অফিস থেকে কমিউনিকেশন লেটার নিয়ে বাসে চড়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলে গেলাম। ইউএইচএফ পিওর নিকট পরিচয় দিলাম। পাশে একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ৫৪/৫৫ বছর বয়স্ক লোককে বললেন, ‘এই যে আপনার মেডিকেল অফিসার এসে গেছেন। আর চিন্তা নাই।’

আমি যোগদানপত্রে সই করে অফিস ত্যাগ করলাম। ওই লোকটি ছিল আমার সেন্টারের মেডিকেল এসিস্টেন্ট। আমরা চরামদ্দি সাব সেন্টারের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দিলাম। বরিশাল গিয়ে রাত্রিযাপন করে ছোট লঞ্চে করে পরদিন চরামদ্দি যেতে হবে। বাসে যেতে যেতে আলাপ হলো। ওখানে স্টাফদের কথা  জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ওখানে আছে একজন পাগলা ফার্মাসিস্ট। কোথায় থাকে, কী খায়, কী পরে তার ঠিক নাই। দেখলেই বুঝবেন। আরেকজন পিওন আছে। তাকে দিয়ে কিচ্ছু করাতে পারবেন না। কিছু বললে উল্টা আপনাকেই ভয় দেখায়ে দেবে। আপনি তো অনেক দূরের মানুষ। আপনি সামলাতে পারবেন কিনা। আপনার তো আবার নতুন চাকরি। অসুবিধা হবে না, আমি আছি না?’ শুনে আমার শরীর শিরশির করে উঠল।

সন্ধ্যার সময় আমাকে একটি কমদামি বোর্ডিংয়ে নিয়ে উঠালেন। চলে গিয়ে আবার ফিরে এলেন দুইজন চোখে সুরমা দেয়া যুবক নিয়ে। বললেন, ‘পরিচয় করে দিচ্ছি, ইনি আমার বন্ধু ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার…..!’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! ভাবলাম এই ‘বন্ধুকে’ আমি নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে।

তাদের সাথে আলাপ হল। অনেক কথার পর তারা একটা কথা বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি না? অমুককে একটু ট্যাঁক্টফুলি ম্যানেজ করতে হবে।’ 

তারা চলে গেলে আমি একটু বারান্দায় বেরুলাম। দেখলাম তারা পাশের রুমে দুইটি মেয়ের সাথে কেমন কেমন যেন কথা বলছে। আমি লুঙ্গী পরে বাথরুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বাইরে থেকে দরজার করা নাড়ল।
– কে?
– আমি বোর্ডিংয়ের লোক। কিছু লাগবে, স্যার? আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
– আমার কিছু লাগবে না। আমি এখন ঘুমাব। ডিস্টার্ব করবেন না। 
আমার বুঝতে দেরি হল না পাশের রুমের বোর্ডারদের কারবার। 

মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে রেখে তার ভাইয়ের বাসায় থাকতে গিয়েছে। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। পায়খানার বেগ থেমে গেল। বের হবার সাহস পেলাম না। গত রাতেও পায়খানা করতে পারিনি। অমনি শুয়ে পরলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের ডাক শোনে ঘুম থেকে উঠলাম। 

ছয়টায় বরিশাল থেকে ছোট লঞ্চে উঠলাম। নয়টার দিকে কাটাদিয়া ঘাটে নামলাম। ওখান থেকে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। দুই কিলোমিটার যেতে হল নৌকায়। খালের ধারের মানুষ আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো “সাহেব কে?” 
– সাহেব আমাদের চরামদ্দির নতুন ডাক্তার। এমবিবিএস। এর আগে কেউ এমবিবিএস ছিলেন না। 
– আমাদের সরকারি ডাক্তার?
– জ্বী।
-খুব ভাল।

দশটার দিকে নৌকা থেকে নামলাম। তিনি দেখিয়ে বললেন ‘এটাই আপনার হাসপাতাল।’
দেখলাম ডোয়াপাকা একটি পুরাতন টিনের ঘর। সামনে বারান্দা। হাসপাতালের সামনে প্রায় একশত জন লোক। একজন উস্কো খুসকো লোক কানে একটা বিড়ি আটকানো, গায়ে রান্নাকরার ছাই লাগানো শার্ট, মাঝে মাঝে বিড়ির আগুনে গোল গোল করে ছিদ্র করে পোড়া, পেছনে লুঙ্গীর কোছে বিড়ির প্যাকেট, আমার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল ‘সাহেব কে?’
মেডিকেল এসিস্টেন্ট বললেন, ‘ইনি আমাদের নতুন অফিসার, ময়মনসিংহ বাড়ী।’
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন

-আপনি এমবিবিএস?
– জ্বী।

লোকটি লাফ দিয়ে দুই ফুট উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট বললেন,‘ইনিই আপনার ফার্মাসিস্ট’।
ফার্মাসিস্ট নেতার ভঙ্গিতে জনগণের উদ্দেশে  ভাষণ দিতে লাগলেন-
– ভাইসব, আপনারা শান্ত হউন। আমাদের এখানে জয়েন করতে এসেছেন যিনি তিনি এমবিবিএস, যা লন্ডন থেকে পাস করতে হয়!
তিনি আগামীকাল থেকে আপনাদের দেখবেন। আজ তিনি বিশ্রাম নিবেন।
এরপর সবাই শান্ত হলেন। তিনি সবাইকে বিদায় করে আমার কাছে আসলেন।
আমি জানতে চাইলাম
– আপনাদের লেট্রিন কোথায়?
– আমাদের তো লেট্রিন নাই!
-তাহলে আপনি কী ব্যবহার করেন?
– আমি কলার পাতা দিয়ে একটু ঘেরাও করে বানিয়ে নিয়েছি।
– এটা কী?
– এটা ফ্যামিলি প্লানিং ভিজিটরের অফিস।
– এখানে লেট্রিন নেই?
– আছে। পাকা সেনিটারি লেট্রিন। 

শোনে আমার তিন দিনের জমানো পায়খানার বেগ ফারাক্কা বাধের উজানের শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ধেয়ে আসা শুরু করল।
– লেট্রিনের চাবি দিন।
– ওটা পিওনের কাছে।
– পিওন কই?
-বাজারে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
– ডাকেন তাকে।

তিনি দৌঁড়ে বাজারের দিকে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন-
-পেলাম না।
– ঠিক আছে, আপনারটাই ব্যবহার করব। এক বদনা পানি আনেন।

তিনি পানি আনতে চলে গেলেন। আশার আলো দেখে আমার ওইটার বেগ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। তিনি খাবার পানির এক জগ পানি নিয়ে এলেন। আমি বললাম
– আমি তো পানি খাব না, পায়খানায় ব্যবহার করব, বদনায় পানি আনেন।
– স্যার, আমার এই জগ ছাড়া আর কিছু নাই। এইটা দিয়েই পানি খাই, এইটা নিয়েই পায়খানায় যাই।

আমার রাগে, দুঃখে  বেগ নিস্তেজ হয়ে পরল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মিটিমিটি হাসছিলো। আমি মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বললাম “আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাব কই?”
ফার্মাসিস্টকে বললাম,‘যান, আমার সামনে থেকে’।
তিনি ইডিয়টের মত হেসে চলে গেলেন। 

পরে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট আমাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। আমি বললাম,

-আমি এখানে থাকতে পারব না। 
– চলেন আমাদের বাড়ী। এখান থেকে ৩ কিলো দূরে হবে।

– চলুন তাই হউক। 

বিকালে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টের বাড়ি গেলাম। তার গ্রামের নামটা এখন মনে করতে পারছি না। গিয়েই লেট্রিনের খোঁজ নিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দিলেন। পাকা লেট্রিন। তিন দিনের জমা রাখা জিনিসগুলি ত্যাগ করতে পেরে গোপাল ভাঁড়ের মত প্রশান্তি পেলাম। 

তিনদিন গোসল করিনি। অত্যন্ত গরম আবহাওয়া ছিল। গোসল করতে চাইলাম। তিনি আমাকে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে নিয়ে গেলেন। বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি আর পানি। দখিনা মিষ্টি বাতাস আসছিল। আমি শার্ট গেঞ্জি খুলে কিছুক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগালাম। অমন মিষ্টি হাওয়া আর কোথাও পাইনি। 

বিকালে ঘুম দিলাম। রাতে তার ভাইয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প হল। আবার ঘুমালাম রাতে।

দুপুরের খাবার পোলাও মাংস খেয়ে বরিশাল রওনা দিলাম। বিকেল ছয়টায় ঢাকার লঞ্চে উঠলাম। ঢাকা থেকে বাসে ফিরতে হবে বাসে। হিসাব করে দেখলাম টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই কেবিনে টিকিট না করে ৩০ টাকায় ডেকের টিকিট করলাম। ব্রিফকেস থেকে লুঙ্গী বের করে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য ব্রিফকেসের ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার লিখা কার্ডটা উল্টিয়ে লাগালাম। ব্রিফকেস মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। 

চারদিনের জার্নির ঘটনাগুলি মনে করতে করতে এক সময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।


তারিখঃ ১৪/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি

প্রথম কর্মস্থলের ভয়াবহ দিনগুলি


১৯৮৮ সনে ৩ জুলাই বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করে প্রস্তুতিমুলক ছুটি নিয়ে টাংগাইল এসেছিলাম। দুই একদিন কাটিয়ে বেডিংপত্র, একটি হারিকেন, একটি ছোট রেডিও ও এক সেট পাতিল নিয়ে কর্মস্থলে থাকার উদ্দেশ্যে দুপুরের দিকে টাংগাইল থেকে রওনা দিলাম। পরেরদিন সকাল ১০ টায় চরামদ্দি পৌছলাম। কাটাদিয়া বাজার থেকে একটা রেইনট্রি গাছের চৌকি কিনলাম ১০০ টাকা দিয়ে। হাসপাতালের পিছনেই মেডিকেল অফিসার থাকার বাড়ী। ডোয়াপাকা তিনটি টিনের ঘর। একটি থাকার ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি বৈঠকখানা কাম চেম্বার। বাজারের ভাতের দোকানে কন্ট্রাক্ট করলাম তিনবেলা খাবার দিয়ে যেতে। একটু দুরেই পুরাতন জমিদার বাড়ী। সেই জমিদাররা কেউ থাকে না। তাদের রায়তরা থাকে।

বাড়ির সাথেই বিরাট পুকুর। শুক্না কলার পাতা বাশের উপর ভাজ করে পুকুর ঘাটে বেড়া দিলাম। হেলথ ভিজিটরের লেট্রিনের চাবি নিয়ে নিলাম। শোবার, খাবার, লেট্রিনের এবং গোসলের ব্যবস্থা হয়ে গেল। এক মাস্তান যুবক ৫/৬ জন সাংগ নিয়ে হাজির হল। বললো
– আমার নাম অমুক। আপনার কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন। কোন হালার পো আপনাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। ডাক্তার সাব, আমাকে কিন্তু আগের ডাক্তার সাব তিন মাস অন্তর একটি করে রগে দেয়ার সেলাইন দিতেন হাসপাতাল স্টোর থেকে। আমি ওটা মদের সাথে মিশিয়ে খাই। তাতে তিন মাস চাংগা থাকি। দিবেন কিন্তু।

মেডিকেল এসিস্টেন্ট চোখ ইশারা দিয়ে রাজি হতে বললেন। আমি রাজি হলাম। চলে গেলো সে।
কিছুক্ষণ পর একজন এলেন। পরিচয় দিলেন তিনি পাশের বাড়ীর মকবুল দফাদার।
– আমি মকবুল দফাদার। সব সময় আমাকে কাছে পাবেন। আপনার আগের অফিসারের সাথে আমি প্রায় সব সময় থাকতাম।

শুনে আমি তেমন কিছু বললাম না।

রাত হলো। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব ছিল। চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। আমি একা একটা পুরাতন ঘরে। এই বাড়ি বৃটিশ আমলের। হাসপাতাল বৃটিশ আমলের। মনে হলো এখানে ভুত পেত্নি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। হারিকেন নিভিয়ে শুইয়ে পরেছিলাম। ঘুম আসছিল না। চারদিক নিরব ছিল। ভুত এসে মাথার উপর সিলিং দিয়ে হাটা শুরু করল। আমার বুক কাপা শুরু করল। পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সাইন্স জ্ঞান কোন কাজে আসল না। কাপড় দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম। ভুতের হাটা থামছিলো না। এক সময় সাহস করে উঠে বসলাম। মনে হলো যেন আমার মাথার উপর তিনি পা রাখবেন। থরথরি কাপছিলাম। হারিকেন ধরালাম। উপর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। দেখলাম তিনি জ্বল জ্বল করে আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। সারা শরীর কাল, শুধু চোখ দেখা যায়। চিনতে চেষ্টা করলাম। তিনি বললেন “মিয়াও”। স্বস্থি পেলাম। একজন সংগি পেলাম।

পরেরদিন সকাল নয়টায় প্রথম অফিস করতে গেলাম। মেডিকেল এসিস্টেন্ট থেকে ঔষধের চার্জ হ্যান্ড ওভার লিস্ট নিলাম। এই হ্যান্ডওভার লিস্টটা আমার পুর্বের অফিসার দিয়ে গেছেন মেডিকেল এসিস্টেন্টের নিকট। মার্মাসিস্টের নিকট থেকে চাবি নিয়ে স্টোর খুললাম। ঔষধ গুনে লিস্টের সাথে মিলালাম। চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বৃটিশ আমলের শক্ত কাঠের হাতল-ভাংগা চেয়ার। ভারি মোটা কাঠের টেবিল। মেডিকেল এসিস্টেন্ট পরামর্শ দিলেন
– আপনি তো আমাদের অফিসার। পুরুষ রুগী গুলি বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলি আপনি দেখুন। পাশের রুমে বসে আমি মহিলা রুগী দেখব।
– পুরুষ মহিলা সবার জন্য আমাকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। সবাইকে দেখতে হবে।
– আপনি একা এত ঝামেলায় জড়াবেন না।

মনে পরল ইউএইচএফপিও সাহেব বলে দিয়েছেন “মেডিকেল এসিস্টেন্ট এলাকার অভিজ্ঞ লোক, তার পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে সমস্যা হবে না। ” আমি রাজি হলাম। অনেক রুগী আসে। আমি পুরুষ রোগী দেখি, তিনি দেখেন মহিলা রুগী। তিনি পিয়নকে দায়িত্ব দিলেন স্লিপ দেখে ঔষধ বিতরণ করতে। আমি অফিস শেষে পিয়নকে বললাম “স্লিপগুলি নিয়ে আস।” সে নিয়ে আসল। আমি রেখে দিতে বললাম। সে ওগুলি পুকুরে ফেলে দিল।

বিকেলে হাটতে গিয়ে একটি ঔষধের দোকানে গিয়ে বসলাম। ওখানে এলাকার অনেকের সাথে পরিচয় হল। পরেরদিন এক মুদির দোকানের সামনে বসা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার, গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ও হাই স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে আড্ডা হল। এই ভাবে প্রতিদিন বিকেলে তাদের সাথে গল্প করে কাটালাম। বাসায় সকাল বিকাল প্রাইভেট প্রেক্টিস করলাম। বেশ রুগী হয়। ঘনঘন মারামারির রুগী আসত। সাথে মাস্তানরা আসত ইনজুরি সার্টিফিকেটের জন্য তদবির করতে। আমি সার্টিফিকেটের ধারাগুলি বুঝতাম না। দফাদার আমাকে বুঝিয়ে দিতেন।

একদিন মুদির দোকানের সামনে চেয়ার ফেলে বসে আমরা গল্প করছিলাম। গল্প বলার মধ্যমণি ছিলাম আমি। আমি মজার মজার গল্প বলতাম আর সবাই মনযোগ গিয়ে শুনতেন। মুদির দোকানদার হা করে শুনছিল। হটাৎ সে বলে বসল “স্যার, আপনার কাছে ভালো মানুষ যায় না।” আমি শুনেও না শুনার ভান করে গল্প বলা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেলাম। ভাবলাম মারামারির কেসের দালাল ও মাস্তানরা যেহেতু আমার চেম্বারে ঘুরাফেরা করে লোকটি হয়ত তাদের মিন করে বলছে ভাল মানুষ আমার কাছে যায় না। কিছুক্ষণ পর লোকটি আবারো ঐ কথা বলে বসলো। তখন আর ধৈর্য ধরতে পাড়লাম না। বললাম “ঐ মিয়া, ফাইজলামি কথা বলবেন না। ভালো মানুষ কি শুধু আপনার কাছে আসে?”
– স্যার, রাগ করছেন, ক্যা? আমি অনেকবার আপনার বাসায় গিয়েছি একটু খোজ খবর নিতে। সব সময় দেখেছি রুগী আর রুগী, একজনও ভাল মানুষ না।
– ও তাই বলুন।

একদিন বিকেলে বাজারে এক ঔষধের দোকানে বসে গল্প করছিলাম। একজন যুবক ১০/১২ জন সাংগ নিয়ে আসল। দোকানদার তার পরিচয় ও ক্ষমতা বর্ননা করে আমার পাশে বসাল। কথাবার্তায় বেশ ভদ্র। শিক্ষিত যুবক। বললেন
– কেমন চলছে আপনার হাসপাতাল?

 আমি আমার হাসপাতালের ভালদিকগুলি তার কাছে তুলে ধরলাম।

– আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্ট পাবলিকের হাতে মাইর খাবে।
– কেন? কি করেছে?
– খুব খারাপ? আপনি পুরুষ রুগী আর উনি মহিলা রুগী দেখছেন কেন?
– এমনি, ভাগ করে নিয়েছি, সুবিধার জন্য।
– মহিলা রুগী আপনার সেবা পাওয়ার অধিকার আছে না? বুদ্ধিটা তো আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্টের। ও বেটা মহিলাদের থেকে টাকা পয়সা, ডিম সব্জি ইত্যাদি নিয়ে বেশী করে ঔষধ দেয়। সেদিন আমার ভাবীর কাছ থেকে ১২ টাকা নিয়েছে। নিজে যা বুঝবেন তাই করবেন। ও বেটার বুদ্ধিতে চলবেন না।
– আচ্ছা আমি দেখব। আপনারা কিছু কইরেন না।

পরদিন হাসপাতালে রুগী দেখছিলাম। এগারটা বেজে গেল। মেডিকেল এসিস্টেন্ট এলেন  না। মহিলা রুগীগুলি গেঞ্জাম শুরু করে দিল। কেউ একজন এসে আমাকে বলল “বাসায় যান, সমস্যা আছে”।

আমি বাসায় দিয়ে দেখি উঠুনে মেডিকেল এসিস্টেন্ট খালি গায়ে শুয়ে গোংরাচ্ছে। সারা শরীরে ফাটা ফাটা মাইরের দাগ। আমি বললাম
– কে মেরেছে, কি দিয়ে মেরেছে?
– দুইটি স্কুল পড়ুয়া ছেলে রাস্তা দিয়ে আসার সময় আচমকা কাউল্ফা গাছের ডাল দিয়ে বেদম পিটিয়েছে। আমি ব্যাথা সহ্য করতে পারছি না।

আমি নিজেই তার সারা শরীরে ব্যাথানাশক মলম লাগিয়ে দিলাম। আমি আবারো কিংকর্তব্য বিমুড় হলাম। আমি জিগালাম
– উপরের লেভেলে কাউকে জানাব?
– না স্যার, এরা এলাকার ছেলে, আরো ঝামেলা বাড়তে পারে।

পিওনকে দিয়ে তাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম। সব রুগী বিদায় করে দিলাম।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুইটার সময় এক অপরিচিত লোক এলেন। আমাকে বললেন “ইনি এলাকার লোক, এলাকার ছেলেরা মেরেছে, আমরাই এর মিমাংসা করে দিতে পারব। আপনি উপরে কাউকে জানাইয়েন না।” এক ঘন্টা পর আরেকজন এসে একই কথা বলে গেলেন। আমি অপরিচিত লোকদের সাথে কি কথা বলে কোন বিপদে পড়ি ভেবে লুকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করলাম। থাকার ঘরে দুইটি দরজা ছিল। এক দরজা দিয়ে বেড় হয়ে তালা লাগালাম। আরেক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে কপাট লাগিয়ে দিলাম। বুঝালাম ডাক্তার তালা লাগিয়ে চলে গিয়েছে। চৌকিতে শুয়ে রইলাম। জুলাই মাস প্রচন্ড গরম পড়েছিল। বাইরে কয়েকজন লোকের আওয়াজ পেলাম। বলাবলি করছিল
-ডাক্তার মনে হয় ভয়ে পালিয়েছে।
-মনে হয় ভিতরেই আছে।
-ডাক্তার সাব, আমি অমুক উপজেলার একাউন্ট অফিসার, এলাকায়ই বাড়ী। ভিতরে থাকলে দরজা খুলুন।
এই বাচ্চা বেড়ার নিচ দিয়ে দেখো তো ভিতরে কোন মানুষ দেখা যায় কিনা।

আমি কাথা দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে লম্বা হয়ে মরা লাশের মত নিথর পড়ে রইলাম।

-মনে হয় একটা মানুষ কাথা মুরু দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
-এই, এত ঘরমের মধ্যে কেউ কাথা গায় দেয়?

তারা বিফল হয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যা হল, রাত্রি হল, হারিকেন লাগালাম। ফার্মাসিস্টকে কোন দায়িত্ব না দেওয়াতে সে ফ্রি স্টাইলে ঘুরে বেড়াত। আমার কাছ দিয়েও আসত না। আমি একদম একা। আমি হারিকেনের সামনে ঝিম মেরে বসে আমার পরিনতি কি হতে পারে তার বিভিন্ন রকম কল্পনা জল্পনা করছিলাম।

রাত প্রায় ১২ টা। বাইরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আশে পাশে কেউ নেই। আমি অসহায় একজন একাকি একটি ভুতুরে বাড়ীতে বসে আছি। হটাৎ উত্তর পাশের জানালা দিয়ে নিচু স্বরে একটি শব্দ আসল “ঘুম আসে না, স্যার?” আমি চমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখি জানালা খোলা।
– কেক, কেক, কে ওখানে?
লোকটি ফস করে মেচ দিয়ে কুপি বাতি ধরিয়ে মুখের পাশে ধরে এক ঝাকা দাত বেড় করে বললেন
– আমি আপনার ফার্মাসিস্ট, স্যার।
– আপনি এখানে কি করছেন? জানালা দিয়ে উকি মারছেন কেন? চলে যান।
– আপনাকে একা রেখে কি চলে যাওয়া যায়?
-আপনি একটা আস্তা পাগল।
– পাগল আমি না, স্যার, পাগল আপনার মেডিকেল এসিস্টেন্ট । সে তো মাইর খাইছে ওর পিওন বেটাও মাইর খাবে। আপনি দানবীরের মত এক মাসের ঔষধ দুই তিন দিনে বিতরন করে শেষ করে ফেলেছেন। আগামীকাল ঔষধ দিতে না পাড়লে পাবলিক আপনার উপরও চড়াও হবে। আপনার আগের অফিসার ঔষধের লিস্ট দিয়ে গেছেন মেডিকেল এসিস্টেন্টের কাছে, আর ঔষধের স্টোরের চাবি দিয়েছেন আমাকে। এখন বুঝুন কে পাগল। বাচতে চাইলে ঔষধের চাহিদা দিন। আমি আগামীকালই নিয়ে আসি।
– মেডিকেল এসিস্টেন্ট বলেছে ঔষধ আনতে ৪০০ টাকা ঘুষ দিতে হবে। এই টাকা নাকি আমার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। আমি পারব না।
– নাউজুবিল্লাহ, ও বেটা একটা বেআক্কেল। কেউ কি অফিসার থেকে ঘুষ নেয় নাকি। অফিসারকেই ঘুষ দিয়ে চলতে হয়। ঘুষ দিতে হলে আমিই আমার পকেট থেকে দিব। আপনে জানবেন কেন?
– আপনি নাকি আগের স্টেশনে এলাকার লোকদেরকে পিটায়েছিলেন?
– ওখানে ওরা আমার অফিসারকে তাপ্পর মেরেছিল। স্যার আমার সামনে কাঁদছিলেন। আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আমি তাদেরকে আন্দাগুন্দা পিটিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। ওখান থেকে এখানে আমাকে বদলি করা হয়েছে। অফিসারের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিব। স্যার, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?

আমি দরজা খুলে তাকে ভিতরে এনে বসালাম। তিনি তার জীবনের অনেক কাহিনী শুনালেন। তিনি আমাকে অনেক নিয়ম কানুন শিখালেন। আমি তার ভিতর মেধা খুজে পেলাম। তার উপর ভরসা আসল। তিনি ঔষধের চাহিদা প্রস্তুত করে আমার সই নিলেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন আমি যেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে পরের দিন একটি মতবিনিময় সভা করি। আমি ঘুমিয়ে পরলাম। ভোরে তিনি ঔষধের জন্য বরিশাল সিভিল সার্জন অফিস চলে গেলেন এবং সন্ধায় চাহিদার ঔষধ নিয়ে ফিরে এলেন। কোন রকম ঘুষ ছাড়াই। আমি একটা সাদা কাগজে নোটিশ লিখে পিওন দিয়ে হেড, মাস্টার, ব্যাংক ম্যানেজার, দফাদার এবং আরো কয়েকজন লোক নিয়ে হাসপাতালে মিটিং করলাম। মিটিং-এ এক যুবক হটাৎ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল “ডাক্তার সাব, আমার ব্লাড প্রেসারটা একটু মেপে দেন না।” আমার ভিতরে রাগ উঠে গেল। কিন্তু তা প্রকাশ হতে দিলাম না। সামনের দাতের অর্ধেক বের করে হাসির ভান করে বললাম “এখন তো মিটিং চলছে, মিটিং শেষে মেপে দিব।” মিটিং-এ মেডিকেল এসিস্টেন্টের বড়ভাই উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হল এক দিন পর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে স্কুল ভবনে এর বিচার হবে।

বিচার বসল। হেডমাস্টার ভুমিকা ভাষণ দেয়ার সাথে সাথে যেই যুবকের ইংগিতে মাইর দেয়া হয়েছে সেই যুবক বলে উঠলেন “আমার ভাগ্না অন্যায় করেছে তার বিচার আমিই করছি।” বলেই একটা পাতলা বেত দিয়ে হাল্কা করে একটা আঘাত করলেন তার দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া ভাগ্নাটাকে। সাথে সাথে হেডমাস্টার তাকে উদ্ধার করে সরিয়ে ফেললেন। বললেন “বাচ্চা, মানুষ অন্যায় করে ফেলেছে, তাকে তো মেরে ফেলা যায় না।” সবাই তাতে রায় দিলেন। বিচার শেষ হল।

একদিন পর মেডিকেল এসিস্টেন্ট আমাকে নিয়ে উপজেলায় গেলেন। উপজেলা কর্মকর্তাসহ আমরা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে সিভিল সার্জন ও ডেপুটি সিভিল সার্জনের সামনে ঘটনা তুলে ধরলাম। এক সময় অফিস কক্ষে একা ডাকলেন। বসা ছিলেন সিভিল সার্জন (সি এস) ও ডেপুটি সিভিল সার্জন(ডিসিএস)। সিএস আমার সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা জেনে নিলেন। বললেন
– তুমি যেখানে আছো, তার ছয় কিলো মিটার চতুরদিকে কোন এম বি বি এস ডাক্তার নেই। ওখানে তুমি অবস্থান করে প্রাইভেট প্রাক্টিস করবে। অনেক রুগী পাবে। এলাকার লোকজন ভাল। ভাল ডাক্তারের সাথে তারা ভাল আচরণ করবে। তোমার চিন্তা নাই। তোমার মেডিকেল এসিস্টেন্টকে বদলি করে ওএসডি করে রাখব। তোমার সাথে অন্য কোন মেডিকেল এসিস্টেন্ট দিব না। তোমার বর্তমান পিওন বদলি করে ভাল একজন দিব।
– স্যার, আমি অফিস টাইমের বাইরে প্রাইভেট রুগী দেখি।
– অফিস টাইমেও সরকারি ফ্রি রুগী দেখার ফাকে ফাকে প্রাইভেট রুগী দেখবে। তারা অনেক দূর থেকে নৌকা নিয়ে তোমার কাছে আসবে, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করালে বিরক্ত হবে। ওরা ধনি মানুষ। ওদের সাথে গরীবরা রাগ করবে না। তোমার প্রতি গরীবরা রাগ করবে না। ঝামেলায় ফেললে ধনিরাই ফেলবে। হাসপাতালের ঔষধ গরীব-ধনি সবার জন্য। কাজেই, প্রাইভেট রুগীর প্রেস্ক্রিপশনের ঔষধ যদি হাসপাতালে থাকে তবে তাদের দিবে। হিসাবের খাতায় ঔষধের খরচ লিখে রাখবে। ঐ খাতা বাসায় নিয়ে যাবে। বাসায় ঔষধ রাখবে। ওখান থেকেও ঔষধি দিয়ে খাতায় লিখে রাখবে। তুমি তো এটা বেচে দিচ্ছ না। ফার্মাসিস্ট পাগল হলেও ভাল মানুষ। তার কাছেও কম দামের কিছু ঔষধ রাখবে। সেও অল্প স্বল্প প্রাক্টিস করে।

ডিসিএস বলনেন
– আমার বাড়ীও ওখানে। সিএস স্যার যা বলেছেন, ঠিক বলেছেন। আপনি যখনি চাহিদা পাঠাবেন আমি এক কার্টুন ঔষধ বেশী দিব।

আমি নির্বাক হয়ে শুনছিলাম। ভাবলাম আবার যে কোন বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

দুই একদিন পর নতুন এক অত্যন্ত ভাল পিওন এসে গেল। পাড়ার একজন প্রাক্তন পিওন এসে তার ছেলেকে আমার খেদমতে দিয়ে গেলেন। দফাদার আমার সিকিউরিটি বন্ধু। সিএস ও ডিসিএস স্যারগনের পরামর্শ মত সব ঠিক ঠাক মত চলল। পাগলা ফার্মাসিস্ট-এর সাথে কত যে মজার মজার আলাপ হয়েছে! তার কাছ থেকেই বেশির ভাগ অফিসিয়াল নিয়মকানুন আমার শেখা। জানি না সে এখন বেচে আছে কিনা।

তারিখঃ ১৬/৬/২০১৭ ইং
ময়মনসিংহ – কিশোরগঞ্জ – ময়মনসিংহ জার্নি