comment

সেমিনারে অডিয়েন্স হিসাবে কমেন্ট করার কৌশল

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল মিটিংয়ে বা সেমিনারে দুইটি পর্ব থাকে – প্রেজেন্টেশন ও ডিসকাশন পর্ব। ডিসকাশন পর্বে সিনিয়র অডিয়েন্সরা সাধারণত কমেন্ট করে থাকেন। সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করলে প্রেজেন্টার উতসাহ পায়। নিম্নে একটা কমেন্ট করার নমুনা দেয়া হলো।

“Thank you.

I would like to appreciate the Dental Unit of our Medical College for the excellent presentation on Basic Concept of Clinical Dentistry.

Special thanks to Dr. Anar for presenting the topic with clarity and confidence.

The content was informative and well-structured, showing a good understanding of the subject.

However, I would like to make a small suggestion about the PowerPoint slides.

The font size was a bit small and the line spacing was quite tight, which made it difficult to read from a distance.

Improving these visual aspects would make future presentations even more effective.

Overall, it was a good and thoughtful presentation.

Thank you once again for your effort and contribution.”

#clinicalmeeting#seminar

medical-degrees

চিকিৎসকদের মেম্বারশিপ, ফেলোশিপ, ডিপ্লোমা ও ডিগ্রির মধ্যে পার্থক্য কি কি?

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে মেম্বারশিপ (Membership), ফেলোশিপ (Fellowship), ডিপ্লোমা (Diploma), এবং ডিগ্রি (Degree) এই চারটি শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ধরণের যোগ্যতা ও স্বীকৃতি বোঝায়। নিচে সংক্ষেপে ও স্পষ্টভাবে প্রতিটির ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১. ডিগ্রি (Degree):

এটি একটি একাডেমিক বা পেশাগত যোগ্যতা যা বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত হয়।

উদাহরণ:

MBBS (Bachelor of Medicine, Bachelor of Surgery)

BDS (Bachelor of Dental Surgery)

MD (Doctor of Medicine)

MS (Master of Surgery)

MPhil / PhD (Research-based degrees)

বৈশিষ্ট্য:

সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী (২–৫ বছর)

স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়/পাবলিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদান করা হয়

সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষার জন্য আবশ্যক

২. ডিপ্লোমা (Diploma):

সংজ্ঞা: এটি একটি স্বল্পমেয়াদী বিশেষায়িত কোর্স যা নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য দেওয়া হয়।

উদাহরণ:

DLM (Diploma in Laboratory Medicine)

DCH (Diploma in Child Health)

DGO (Diploma in Gynaecology and Obstetrics)

DMU (Diploma in Medical Ultrasound)

বৈশিষ্ট্য:

সময়কাল সাধারণত ১–২ বছর

কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ফোকাস করে

ডিগ্রির তুলনায় কম প্রভাবশালী, তবে প্র্যাকটিসের জন্য সহায়ক

৩. মেম্বারশিপ (Membership):

সংজ্ঞা: এটি একটি স্বীকৃত মেডিকেল কলেজ বা প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া, যেখানে নির্দিষ্ট পরীক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এই পদ পাওয়া যায়।

উদাহরণ:

MCPS (Member of College of Physicians and Surgeons)

MRCP (Member of the Royal College of Physicians, UK)

MRCS (Member of the Royal College of Surgeons)

FCPS Part I পাস করলেই BCPS এর provisional membership পাওয়া যায়

MACP (Member of American College of Physicians)

বৈশিষ্ট্য:

মূলত ব্রিটিশ বা আন্তর্জাতিক বোর্ডের অংশ

উচ্চতর বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণের সূচনা ধাপ

কঠিন পরীক্ষা পাস করে অর্জন করতে হয়

৪. ফেলোশিপ (Fellowship):

সংজ্ঞা: এটি একটি সম্মানসূচক বা বিশেষজ্ঞ স্তরের স্বীকৃতি, যা অনেক সময় অভিজ্ঞতা, গবেষণা বা উন্নত প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।

উদাহরণ:

FRCS (Fellow of the Royal College of Surgeons)

FCPS (Fellow of the College of Physicians and Surgeons – যেমন: বাংলাদেশ, পাকিস্তান)

FACS (Fellow of American College of Surgeons)

FACP (Fellow of American College of Physicians)

বৈশিষ্ট্য:

Membership পাস করে অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জনযোগ্য

কিছু ফেলোশিপ গবেষণামূলক ও কিছু ক্লিনিকাল প্রশিক্ষণভিত্তিক

চিকিৎসককে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত করে

সারাংশ:

বিষয় সময়কাল কাদের জন্য কোথায় দেওয়া হয় গুরুত্ব

ডিগ্রি: ২–৫ বছর চিকিৎসার মৌলিক বা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ

ডিপ্লোমা: ১–২ বছর বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা মেডিকেল কলেজ/বোর্ড মাঝারি

মেম্বারশিপ: পরীক্ষা নির্ভর আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রার্থী র‍য়াল কলেজ/বোর্ড বিশেষজ্ঞ হবার প্রথম ধাপ

ফেলোশিপ: অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ সিনিয়র চিকিৎসক র‍য়াল কলেজ/বোর্ড বিশেষজ্ঞ/লিডারশিপ স্বীকৃতি

taxila

তক্ষশিলা

তক্ষশিলা, ১১ মার্চ, ২০০৪ সন
(পুরোনো হার্ড এলবাম থেকে)
করাচিতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ানস ও পাকিস্তান কলেজ অব ফিজিসিয়ানস এর যৌথ কনভোকেশন ও কনফারেন্সে যোগ দিতে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। কনফারেন্স শেষে অনেক দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করি। এই ছবিটি তক্ষশীলা ভ্রমণের।

তক্ষশিলা (টেক্সিলা), পাকিস্তান – ১ মিনিটে জানুন

তক্ষশিলা (Texila বা Taxila) বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত এক প্রাচীন নগরী, যা ইতিহাসে জ্ঞানের এক বিশাল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

১. ঐতিহাসিক গুরুত্ব: এটি প্রাচীন গন্ধার রাজ্যের অংশ ছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।

২. বিশ্ববিদ্যালয়: তক্ষশিলা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে চিকিৎসা, ধর্ম, গণিত, দর্শন ও যুদ্ধবিদ্যা পড়ানো হতো।

৩. বিশিষ্ট ছাত্র: আচার্য চাণক্য, আয়ুর্বেদাচার্য চরক ও চিকিৎসক জীবক এখানে শিক্ষালাভ করেন।

৪. ধর্মীয় কেন্দ্র: এটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও গন্ধার শিল্পের মিলনস্থল। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে এখানকার ভূমিকা বিশাল ছিল।

৫. ধ্বংস ও সংরক্ষণ: নানা আক্রমণে শহরটি ধ্বংস হয়। বর্তমানে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

তক্ষশিলা শুধু একটি প্রাচীন শহর নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বিদ্যার আলো ছড়ানো এক গর্বিত নিদর্শন।

tetul

ছাদবাগানে থাই মিষ্টি তেতুল চাষ

ছাদবাগানে থাই মিষ্টি তেতুল চাষ – ৫০ সেকেন্ডে তথ্য

১. প্রজাতি পরিচিতি: থাই মিষ্টি তেতুল (Sweet Tamarind) দেখতে বড়, রসে ভরা ও কম টক।

২. চারা রোপণ: ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বড় টবে বা ড্রামে চারা রোপণ উপযোগী।

৩. মাটি: বালুকাময় ও জৈবসারে সমৃদ্ধ মাটি সবচেয়ে ভালো। পানি নিষ্কাশন ভালো থাকতে হবে।

৪. সার ব্যবস্থাপনা: গোবর, ভার্মি কম্পোস্ট ও অল্প পরিমাণ টিএসপি ও এমপি ব্যবহার করুন।

৫. পানি: সপ্তাহে ২ বার নিয়মিত পানি দিন। অতিরিক্ত পানি জমতে দেবেন না।

৬. ছাঁটাই: গাছের আকৃতি ঠিক রাখতে ছাঁটাই করুন, এতে ফলন বাড়ে।

৭. ফলন: গাছ লাগানোর ২-৩ বছরের মধ্যে ফল দেয়।

৮. রোদ: গাছটি পূর্ণ রোদ পছন্দ করে, ছাদ বাগানের জন্য উপযুক্ত।

৯. রোগবালাই: সাধারণত রোগ কম হয়, তবে প্রয়োজন হলে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করুন।

১০. ব্যবহার: তাজা খাওয়া যায়, আচার, জ্যাম ও রস বানানো যায়।

ইচ্ছাশক্তি আর যত্ন থাকলে ছাদেই মিলবে বিদেশি মিষ্টি তেতুলের স্বাদ!

kakrol

ছাদবাগানে কাকরোল চাষ

ছাদবাগানে কাকরোল চাষ – ৫০ সেকেন্ডে তথ্য

১. পরিচিতি: কাকরোল পুষ্টিকর সবজি, ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী।

২. চারা রোপণ: মার্চ-এপ্রিল বা জুন-জুলাই মাসে রোপণ উপযুক্ত। বীজ বা কন্দ থেকে চাষ করা যায়।

৩. মাটি: জৈবসারে সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি উপযোগী। টব বা ড্রাম ব্যবহার করুন।

৪. মাচা তৈরি: কাকরোল লতাজাতীয় উদ্ভিদ, তাই শক্ত ও ছায়ামুক্ত মাচা তৈরি করা প্রয়োজন।

৫. সার ব্যবস্থাপনা: গোবর, কম্পোস্ট, টিএসপি ও এমপি প্রয়োগ করতে হবে।

৬. পানি: সপ্তাহে ২-৩ বার পানি দিন, তবে জলাবদ্ধতা এড়াতে হবে।

৭. পরাগায়ন: অধিক ফলনের জন্য পুরুষ ফুল থেকে স্ত্রী ফুলে হাতে পরাগায়ন করা যেতে পারে।

৮. রোগবালাই: পোকামাকড় ও ছত্রাক প্রতিরোধে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করুন।

৯. ফসল সংগ্রহ: চারা রোপণের ৩-৪ মাস পর থেকে ফল সংগ্রহ করা যায়।

১০. উৎপাদন: নিয়মিত পরিচর্যায় একটি গাছ থেকেই বহু ফল পাওয়া যায়।

ছাদে মাচা আর যত্ন থাকলেই ঘরেই মিলবে টাটকা কাকরোল!

dhundol

ছাদবাগানে ধুন্দল চাষ (১ মিনিটে পড়া যায়):

ধুন্দল (sponge gourd) একটি সহজলভ্য সবজি, যা ছাদবাগানে সহজেই চাষ করা যায়।

বীজ বপন:

মার্চ থেকে আগস্ট মাস ধুন্দল চাষের উপযুক্ত সময়। টবে বা ড্রামে ভালোভাবে পঁচানো গোবর, দোআঁশ মাটি ও একটু বালু মিশিয়ে বীজ বপন করুন।

টব ও মাটি:

১৬-১৮ ইঞ্চি গভীর টব বা ড্রাম ব্যবহার করুন। মাটি হতে হবে ঝরঝরে ও পুষ্টিকর।

মাচা তৈরি:

ধুন্দল লতানো গাছ, তাই বীজ গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে মাচা বা বাঁশের খুঁটি দিয়ে উঠার ব্যবস্থা করতে হবে।

সার ও পানি:

প্রতি ১৫ দিন পরপর তরল জৈব সার বা কম্পোস্ট দিন। নিয়মিত হালকা পানি দিন, তবে পানি যেন জমে না থাকে।

রোগবালাই:

পোকা বা ছত্রাক হলে নিমতেল বা সাবান পানি স্প্রে করতে পারেন।

ফলন:

বপনের ৫০-৬০ দিনের মধ্যে ফল ধরা শুরু করে। ছোট ও নরম অবস্থায় ফল তুলুন।

ধুন্দল দ্রুত বাড়ে, সহজ পরিচর্যায় ছাদ থেকেই পরিবারের জন্য তাজা সবজি পাওয়া যায়।

myiazaki

মিয়াজাকি

ছাদবাগানে মিয়াজাকি আম চাষ (১ মিনিটে পড়া যায়):

মিয়াজাকি আম, জাপানি এক্সোটিক জাতের লালচে-বেগুনি রঙের দামী আম, এখন ছাদবাগানেও চাষ করা সম্ভব।

চারা নির্বাচন:
বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে গ্রাফটেড (কলম করা) মিয়াজাকি আমের চারা সংগ্রহ করুন।

টব ও মাটি:
১৮-২০ ইঞ্চি গভীর টব বা ড্রাম ব্যবহার করুন। দোঁআশ মাটি, গোবর সার, হাড়গুঁড়ো ও ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে প্রস্তুত করুন।

রোপণ ও আলো:
রোপণের পর গাছকে ৬-৮ ঘণ্টা রোদ দিতে হবে। ছাদের এমন জায়গায় রাখুন, যেখানে পানি না জমে।

সার ও পানি:
প্রতি মাসে জৈব সার দিন। বাড়ন্ত অবস্থায় নাইট্রোজেন ও ফল আসার আগে পটাশযুক্ত সার দিন। নিয়মিত পানি দিন, তবে জলাবদ্ধতা নয়।

মাচা বা বাঁশ:
গাছ বড় হলে হালকা বাঁশ বা খুঁটি দিয়ে সাপোর্ট দিন।

ফলন ও যত্ন:
সাধারণত ২-৩ বছরে ফল ধরে। ফুল আসার সময় পরাগায়নে সাহায্য করুন। পাখি ও পোকা থেকে বাঁচাতে ফল ব্যাগে ঢেকে দিন।

বিশেষ যত্ন:
গাছটি সৌন্দর্যময় এবং ফলটি দামী হওয়ায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি।

সঠিক পরিচর্যায় ছাদেই উৎপাদন সম্ভব এই ‘লাল হীরা’খ্যাত মিয়াজাকি আম।

amra

আমড়া

ছাদবাগানে থাই মিষ্টি আমড়া – (এক মিনিটে পড়া যায়)

থাই জাতের মিষ্টি আমড়া ছাদবাগানের জন্য এক অসাধারণ ফলদ বৃক্ষ। এটি দেখতে সাধারণ আমড়ার মতো হলেও স্বাদে মিষ্টি ও কম টক। গাছটি সাধারণত খাটো হয়, টবে চাষযোগ্য এবং বছরে একাধিকবার ফল দেয়।

সঠিক রোদ, পানি ও সুষম জৈবসার ব্যবহার করলে ছাদে সহজেই ফলন হয়। ফলগুলো মাঝারি আকৃতির, খোসাসহ খাওয়া যায়, আর কচি অবস্থায় খেতেও দারুণ। রোগবালাই কম, রক্ষণাবেক্ষণ সহজ—তাই নগরবাসীর জন্য একটি চমৎকার পছন্দ।

ছাদবাগানে নতুন কিছু চাইলে এই মিষ্টি থাই আমড়া হতে পারে লাভজনক ও সুস্বাদু একটি সংযোজন।

pairabond

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র, পায়রাবন্দ, রংপুর, ১৯ জুন ২০০৪ খ্রি

(পুরনো হার্ড এলবাম থেকে)

রংপুর মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্যাথলজি এক্সটার্নাল এক্সামিনার হিসাবে পরীক্ষা নিতে গিয়ে বিকেলে বেড়াতে গিয়েছিলাম।

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র :

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে অবস্থিত, যা নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান। কেন্দ্রটি তার স্মৃতিকে সম্মান জানাতে নির্মিত হয়েছে।

এখানে একটি ছোট জাদুঘর, পাঠাগার, সভাকক্ষ ও প্রদর্শনী এলাকা রয়েছে, যেখানে বেগম রোকেয়ার জীবন, সাহিত্যকর্ম ও নারীর অধিকার নিয়ে তার আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে।

শিক্ষার্থী, গবেষক ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। নারীশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান জানতে এটি এক অনন্য কেন্দ্র।

ma

আমার মা

(স্মৃতিকথা)

ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

আমার মায়ের নাম ফাতেমা বেগম। নানা-নানী ডাকতেন ফতে বলে। আমার মার বড় ভাই ছিলেন তিনজন। বোনের মধ্যে মা-ই বড়। মামাদের নাম হোসেন আলী, সিবা উদ্দিন ও রিয়াজ উদ্দিন। আমার একমাত্র খালার নাম লাল বানু। নানার নাম আমির উদ্দিন। নানা বাড়ি কালিহাতির পূর্বে রৌহা গ্রামে। নানা ছিলেন কাজেম উদ্দিন মাস্টার নানার বড় ভাই। সব কথা আমি মা-র কাছে শুনেছি। ব্যবসার জন্য বাবা দীর্ঘদিন বাহিরে থাকতেন। মা আমাদের নিয়ে বাড়িতে থাকতেন। মাঝে মাঝে নানা এসে মাকে দেখে যেতেন। আসার সময় নানা মার জন্য অনেক কিছু আনতেন। লাঠির আগায় পোটলা ঝুলিয়ে কাঁধে নিয়ে আসতেন। সেই পোটলায় থাকতো ছেই (আস্ত কাঁচা খেসারী কলাই), খেশারীর ডাল অথবা বিভিন্ন রকমের মসলা। এসবই নানারা চাষ করতেন। এগুলো আমাদের কিনতে হতো না। নানা শুয়ে শুয়ে আমাকে গল্প শুনাতেন। গল্প ও ছড়াকে আমরা বলতাম হাস্তর। নানা অনেক শিক্ষামূলক হাস্তর বলতেন। তাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ), তার মেয়ে ফাতেমা (রাঃ) ও মেয়ে-জামাই হজরত আলী (রাঃ)-এর কাহিনী থাকতো।

সন্ধার পরই রাতের খাবার খেয়ে কেরাইস তেলের দোয়াত নিভিয়ে আমরা শুয়ে পরতাম। ঘুমানোর আগে যখন আমরা ঝামেলা করতাম তখন মা আমাদেরকে শান্ত করার জন্য হাস্তর বলতেন। নানা যেভাবে হাস্তর বলতেন মাও সেভাবে হাস্তর বলতেন। ধর্মীয় হাস্তর ছাড়াও মা কিছু কিছু রসিকতার হাস্তর বলতেন। সেগুলো নাকি মা আমার ছোট ফুফুর কাছে শুনেছিলেন। আমি মার ছোট বেলার কথাও জানতে চাইতাম। মা ছোট কালের কথাও বলতেন। মার নাম কে রেখেছে, খালার নাম কে রেখেছে, এমন প্রশ্ন করতাম। মা বলতেন

– তোমার নানা আর তোমার নানার ভায়েরা মিলে কিতাব (পুঁথি) পড়তেন সুর করে। জংগে কারবালা, লাল বানু-শাহ জামাল নামে দুইটা কিতাব ছিল। জংগে কারবালা কিতাবে হযরত ইমাম হোসেনের (রাঃ) মা এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মেয়ে হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর নামের সাথে মিলিয়ে আমার নাম রেখেছেন। লালবানু শাহ জামাল কিতাবে লালবানুর নাম থেকে তোমার খালার নাম রেখেছেন। তোমার খালার শশুর আমাদের খালু হয়। নালের (লালবানুর) শাশুড়ি আমাদের খালা হয়।

– অ, এই জন্যই ত খালার শাশুড়ির চেহারা আর আমাদের নানীর চেহারায় হুবহু মিল আছে।

– তোমার খালার প্রথম বিয়ে খুব ধনী বাড়িতে হয়েছিল। বাড়ির কাছেই। তিন বাড়ি পরেই। ছোট্টুনি থাকতেই তারা নিছিল। গেন্দা বউ দিয়ে তারা কাজ করাতো। একদিন তোমার খালা একাই রান্না ঘরে রান্না করছিল নাড়া (খর) দিয়ে জ্বাল দিয়ে। নাড়ার আগুন বেড়া বেয়ে ঘরের চালে উঠে যায়। দেখে চমকে গিয়ে নালে এক দৌড়ে আমাদের বাড়ি এসে পড়ে। বাড়ি পুড়ে সাব হয়ে যায়। এরপর তারা অপবাদ দেয় যে নতুন বউয়ে বাড়িতে আগুন দিয়ে পালিয়ে গেছে। এইজন্য সেই বিয়ে টিকে নাই। পরে মাইজবাড়ি আমাদের খালাতো ভাইয়ের কাছে বিয়ে হয়েছে।

আমার মায়ের চেহারা খুব সুন্দর ছিল। লম্বাও ও ফর্সা ছিলেন বাবার চেয়ে অনেক বেশি। বাবাকে মার সাথে মানাতো না। আমার মনে প্রশ্ন ছিলো কি করে নানা এখানে মাকে বিয়ে দিলেন। আমি মাকে প্রশ্ন করেছি

– আপনার বিয়েও কি খালার মতো ছুট্টুনি কালে হয়েছিল?

– না, আমি একটু বড়ই ছিলাম। তবে তোমার বাবার চেয়েও ১০ বছরের ছোট ছিলাম। ছেলে দেখে আমাকে বিয়ে দেয় নাই। বাজানে দেখছে বংশ। তালুকদার বংশ। তাছাড়া তোমার দাদা আমাকে অনেক পণ দেয়। আমি শশুর বাড়ি গিয়ে খুব মুস্কিলে পড়ে যাই। তোমার দাদী ছিল অন্ধ। তোমার দাদা ছিল উড়াইটা ধরনের। সকালের খাওয়া খাইত দুপুরে, দুপুরের খাওয়া খাইত বিকালে। পাড়ার বেটিরা এসে ধান চাউল ঝেরে দিতো। যাওয়ার সময় আঁচলে করে অনেক কিছু নিয়ে যেতো। প্রতিবাদ করলে তোমার দাদা আমার উপর রাগ করতেন। অল্প রাগ করেই অনেক জিনিস নষ্ট করতেন। রাগ করে ঘরের চাউল, মুড়ি উঠানে হাঁসের পায়খানার উপর ফেলে দিতেন। তোমার ফয়েজ চাচা ও বেলাল উদ্দিন চাচারও খুব রাগ ছিল। তারাও রাগ করে গরম ভাত উঠানে মেইল্লা মারতো। এই ভাবে সবাই সংসারটাকে ফতুর করতেছিল। আমাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হতো। পাহাড়ে এসে বেচে গেছি।

– আপনি কোনো সময় রাগ করে বাপেবাড়ি চলে আসেন নি?

– একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। তোমার বড় মামী আর ছোট মামীর মা যিনি, তোমরা নানী ডাকো, উনি আমাদের ফুফু, তোমার নানার বোন। তোমার দুই মামী সহোদর বোন। অর্থাৎ দুই ভাইয়ে দুই ফুফাতো বোন বিয়ে করেছেন। ফুফুর শশুর বাড়ি রৌহার পশ্চিম পাড়ায়। ওখানে এক খন্ড জমির জন্য তোমার দাদারা দাবী করতেন তাদের জমি বলে আবার ফুফুর শশুরবাড়িরাও দাবী করতেন তাদের জমি বলে। এনিয়ে একটা বিরাট কয়চান (ঝগড়া) বেঁধে যায়। দুইপক্ষ লাইঠাল এনে মারামারিও করে। ঐসময়ে আমি ছিলাম আমার বাপের বাড়ি। এটার জের ধরে তোমার নানা আমাকে আটকে দেন। কয়চান শেষ না হলে আমাকে শশুড় বাড়ি যেতে দিবেন না। তোমার দাদাও আমার খোজ নিতে আসতেন না। আসা নিষেধ ছিল তালুকদার বাড়ির পক্ষ থেকে। কিন্তু তোমার বাবা যুত করে যুত করে (চুপিচুপি) রাতে আমাকে দেখতে আসতেন। একদিন রাতের অন্ধকারে তোমার বাবার সাথে যুত করে তোমার দাদার বাড়ি চলে যাই। এই রাগে তোমার নানা আমাকে অনেকদিন আনতে যান নি। নোকাইল বিলে পানি ছিল। তোমার বাবা আমাকে কাঁধে নিয়ে নোকাইল পার করেন। কয়চান শেষ হলে আমি বাপের বাড়ি আসি।

মা রাতে আমাদের করুন একটা ঘটনা প্রায়ই শুনাতেন। তিনি বলতেন দক্ষিণ দেশের এক বৃদ্ধলোক নানাদের বাড়ি ভিক্ষা করতে আসতেন। তিনি নাকি আগে ধনী লোক ছিলেন। দরিয়ায় (সমুদ্রে) সব বিলীন হয়ে এখন ভিক্ষুক হয়েছেন। তিনি ভিক্ষা চাইতে এসে সুর করে গীত গাইতেন। সেই গীত মা সুন্দর সুরে গেয়ে আমাদের শুনাতেন। সেই গীতে এমন একটা পংতি ছিল-

দখিণা দরিয়ার মধ্যে রে

নায় মারিবে পাক রে

অরে মাঝি খবরদার।।

এগুলি গাইতে গাইতে মার গলায় কান্না এসে যেতো। চোখ মুছতেন। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাদতেন। আমি মনে করতাম মা নানার কথা অথবা নানীর কথা মনে করে কাঁদছেন। আমরা মার কান্নার কারণ কোনদিন জানতে চাই নি।

মা কানে খুব কম শুনতেন। আমাদেরকে মার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে হতো। কম শুনাতে মা সামাজিক ভাবে একটু হেহ হতেন। অনেকে বিরক্ত হয়ে বলে বসতেন “আর কালা। কিচ্ছু শুনে না।” এই কথাটা শুনলে আমি খুব কষ্ট পেতাম। মার মাথা ফাটার পর কানে কম শুনতেন। আমরা মার চুল সরিয়ে দেখেছি কপাল থেকে শুরু করে এক কানের উপর দিয়ে একটা ফাটা চিহ্ন। আমি জানতে চেয়েছি

– আপনার মাথা ফাটলো কিভাবে?

– সেটা সরমের কথা। তোমার বেলাল উদ্দিন কাক্কু বিয়ে করে নতুন বউ এনেছেন। বাসর রাত ছিল। নতুন বউ ভোরে উঠে জানালো যে তার গোসল করতে হবে। ভাবি হিসাবে আমার দায়িত্ব দেবরের নতুন বউকে পানি তুলে দেয়া। আমাদের পাটকুয়া ছিল (ইঁদারা কুয়া)। তখনও অন্ধকার ছিলো। ফজরের আজান হয়তো দিয়েছে। নতুন বউ কুয়ার পাড়ে দাড়িয়েছিল। আমি ঠিলার (মাটির কলসি) গলায় রশি দিয়ে কুয়ায় নামালাম। ঠিলা পানিতে ভরে যেই রশিরে টান দিয়েছি অমনি পা ফসকে কুয়ায় পড়ে গেলাম। অনেক গভীর ছিল সেই কুয়া। পড়তে পড়তে কুয়ার পাটের বারি খেয়ে মাথা ফেটে গলগলি রক্ত ছোটলো। তোমার চাচী “কুয়ায় পড়ছে গো, কুয়ায় পড়ছে গো” বলে চিল্লাতে থাকলো। সবাই তখন ঘুমিয়ে ছিল। তোমার কোরবান কাক্কু পুকুরের ওপারে ঘাট উদ্ধারে (পায়খানায়) বসেছিলেন। চিল্লাচিল্লি শুনে দৌড়ে এসে কুয়ায় নেমে আমাকে তুলে আনেন। গামছা দিয়ে বেধে রক্ত পড়া বন্ধ করেন। মাথার খুলির এক দিকে ফেটে যায়। সেকারনে কানের ক্ষতি হয়েছে।

আমি শুনেছি, সব মা সব সন্তানদের সমান চোখে দেখেন। কিন্তু আমার মায়ের বেলায় মনে হয় সেটা ঠিক না। আমার মনে হয়েছে, মা আমাকে একটু বেশী চোখেই দেখেছেন। আমার খাওয়া নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতেন। যখন যেটা খেতে পছন্দ করতাম সেটা রান্না করার চেষ্টা করতেন। সবার মায়ের রান্না থেকে আমার মায়ের রান্না আমার কাছে ভালো লাগতো। মার রান্না আর খালার রান্নার স্বাদ প্রায় কাছাকাছি ছিল। লাইলি বুর রান্না প্রায় মার রান্নার মতো স্বাদের। বড় মেয়ে মুনাও মার মতো রান্না করতে পারে। মুনার চেহারা প্রায়ই মার মতো হয়েছে। ও কিন্তু মার মতোই আমার খোজ খবর নেয়। সপ্তাহে একদিন হাট থেকে বাবা খাসির গোস্তো আনতেন। খাসির গোস্ত আমার খুব পছন্দের ছিল। বাবা হাট থেকে অনেক রাতে ফিরতেন। মা খাসির গোস্ত রান্না শেষ করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। মা আমার কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুলে জোড় করে সেই গোস্তের মজানি (কসানি) দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন।

বড় হতে থাকি আর মা থেকে দূরে যেতে থাকি। মাকে নানান অসুখে পেয়ে বসে। এলাকায় তেমন ভালো ডাক্তার ছিলো না। বাবা হাট থেকে যেসব ঔষধ এনে দিতেন সেসব ঔষধে কোন কাজ করতো না। মা খুব কষ্ট পেতেন। বাবা মার চিকিৎসায় অনেক টাকা অপচয় করেন। মা শুকিয়ে কংকালের মতো হয়ে যান। বাচবেন বলে মনে হলো না। আমি হোস্টেলে ব্যবহারের জন্য একটা মশারী কিনেছিলাম। দেখে মা বললেন “মশারীটা বেশ সুন্দর। আমি মরার পর এই মশারী বেঁধে আমার লাশ ধোয়াইও।” আমি এইচএসসি পড়া নিয়ে মহা ব্যস্ত ছিলাম। আমার জমানো বৃত্তির টাকা বাবাকে দিয়ে বললাম মাকে টাঙ্গাইল নিয়ে গিয়ে ডা. এইচ আর খানকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে। অনেক টাকা খরচ করে ডা. এইচ আর খানকে দেখায়ে চিকিৎসা করা হলো ১৯৭৮ সনে। মা সুস্থ হয়ে স্বাস্থ্যবান হলেন। আমার খুব ভালো লাগলো।

কিন্তু পড়ের বছর আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এসময় বাবাও অসুস্থ ছিলেন। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা থাকাতে আমিও অনেকদিন বাড়ি আসিনি। পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে পরীক্ষার দোয়া নিতে বাড়ি এলাম। দেখি মা মৃতপ্রায়। জ্ঞান নেই তেমন। আমার মন ভেঙ্গে গেলো। মা শুয়েছিলেন নিশ্চুপ নিস্তেজ হয়ে। আমি পায়ে ছুয়ে বললাম “মা আমি পরীক্ষা দিব এবার। আমার জন্য দোয়া করবেন। মা শুনতে পেলেন বলে মনে হলো না। আমি পা থেকে হাত আমার বুকে নিয়ে সেলাম করা শেষ করে চোখ মুছে রওয়ানা দিলাম। নওপাড়া পর্যন্ত গেলে পেছন থেকে কে যেনো ডেকে বলল “যাইও না। তোমার মা বলতাছে ‘সাদেক আলী কি গেছে গা?’

আমি বাড়ি ফিরলাম। মা বলে ডাক দিলাম। মা চোখ তুলে তাকালেন। আবার চোখ বুজলেন। আমি সারারাস্তা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলাম। মামাবাড়ি, দাদাবাড়ি ও ফুফুবাড়ি ঘুরে পরীক্ষার জন্য দোয়া করতে বললাম। এও জানালাম যে পরীক্ষা পর্যন্ত মা বেচে থাকবেন কি না, আল্লাহ জানেন।

১৯৭৯ সনে আমাদের আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে প্রথম পরীক্ষার সেন্টার হল আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে। ২৯ শে মে বৃ্হস্পতিবার বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা দিলাম। ৩১ মে শনিবার বাংলা দ্বিতীয় পত্র হল। ২ জুন সোমবার ইংলিশ প্রথম পত্র পরীক্ষা দিয়ে খেয়ে হোস্টেলে ঘুমালাম। পায়ের আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেল। চোখ মেলে দেখি আমার এক বছরের বড় আমার চাচাত ভাই পাশের বাড়ির জিন্না ভাই। দেখেই বুঝে ফেললাম জিন্না ভাই খুব একটা সাংঘাতিক খারাপ সংবাদ নিয়ে এসেছেন।  হয়ত মা আজ নেই। জিন্না ভাই বললেন “তোমাকে বাড়ি যেতে হবে এখনি। কাক্কি হয়ত বাচবে না। সাথে তোমার মশারিটা নিয়ে যেতে বলেছেন।”

আমি যখন হোস্টেলে উঠার জন্য নতুন মশারি কিনি মশারিটি দেখে আমার অসুস্থ মা বলেছিলেন “আমি এবার হয়ত আর বাচব না। আমি মরে গেলে এই মশারি বেধে ধোয়াইও।” এই কথা লাইলি বুবু ও ভাবী শুনেছিলেন। আমার আর বুঝতে দেরী হল না যে মা নেই।

আমি প্রিন্সিপাল কিবরিয়া স্যারের কাছে গিয়ে বললাম
-স্যার, মা মারা গেছেন। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
– কে বলেছে?
– আমার চাচাত ভাই এসেছেন।
– অখিল বাবু, ওর ভাইকে এখানে নিয়ে আসুনত।

জিন্না ভাই এলে আমাকে রুমে যেতে বললেন। আমি রুমে গিয়ে রেডি হয়ে গেলাম। স্যার অখিল চন্দ্র নাথ স্যারকে নিয়ে আমার কাছে এলেন। অখিল স্যার ছিলেন আমাদের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটর। কিবরিয়া স্যার আমাকে বললেন “মা বাবা সবার বেচে থাকে না। হয়ত তোমার মা বেচে নেই। মন ভাংবে না। অখিল বাবু তোমাকে বাইসাইকেলে ডাব্লিং করে বাড়ি নিয়ে যাবেন। যদি তোমার মা ইন্তেকাল করেই থাকেন তবে তাকে দাফন করে অখিল বাবুর সাথেই এসে পরবে। আগামীকাল পরীক্ষায় বসবে। মা মরে গেলে মা আর পাবে না। পরীক্ষা বাদ দিলে জীবনে অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে।”

আমি নিরবে সাইকেলে অখিল স্যারের সামনে বসলাম। আমি তখন হাল্কা পাতলা হলেও ওজন আমার ৫৬ কেজির কম ছিল না। এই আমাকে নিয়ে অখিল স্যার সাইকেল চালিয়ে পাহাড়ের দুর্গম রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাদছিলাম। ভন্ডেশ্বর, খালুয়া বাড়ি, আওলাতৈল, মরিচা, বাঘেরবাড়ি, দেবলচালা, সিরিরচালা, ঢনডনিয়া, জিতাশ্বরি, নওপাড়া সুদীর্ঘ ১২/১৩ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে রাত ১০ টার দিকে বাড়ি পৌছলাম। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল জানাজার জন্য। আমি অজু করে জানাজায় শরীক হলাম। দাফন হল। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে ফজরের নামাজ পড়ার পর অখিল স্যার বললেন “কিবরিয়া স্যার তোমাকে পরীক্ষা শুরুর আগেই ফিরিয়ে নিতে বলেছেন।”
আমি বললাম “চলেন, স্যার।”

কাক্কি (হাসেন কাক্কুর স্ত্রী) বললেন “ও এবার জ্যৈষ্ঠ মাসে আম দুধ-খায় নাই। একটু দাড়ান সামান্য আম-দুধ খাক।” আমি আম দুধ খেয়ে সাইকেলে বসলাম। পরীক্ষা শুরুর আধ ঘন্টা আগে গিয়ে পৌঁছলাম। মুখ ধুলাম। আবুল হোসেন স্যার এগিয়ে এলেন। বললেন “কিবরিয়া স্যার তোমাকে পরীক্ষার হলে যেতে বলেছেন।” আমি নিরবে হলে গিয়ে বসলাম। হাতে খাতা ও প্রশ্নপত্র দেয়া হল। দোয়া পড়ে লিখা শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ লিখার পর মায়ের স্মৃতি ভাসা শুরু হয়ে গেল। চোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু হল। কোন এক স্যার মাথায় হাত বুলালেন। আমি আবার লিখলাম। লিখে শেষ করলাম। রুমে ফিরলাম। সবাই পড়া নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে শান্তনা দেবার মত সময় সবার হাতে কম। আমিও বুঝলাম। ভাগ্যের নির্মম অধ্যায় অতিক্রান্ত করছিলাম।

ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কাজটি আমি করতে পারলাম। নিষ্ঠুর হয়ে বাকী সব পরীক্ষা দিয়ে দুই বিষয়ে লেটারমার্ক সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে পাস করে ডাক্তার হলাম। এমন নিষ্ঠুর হলাম যে পৃথিবীর আর কোন দুঃখ ও হতাসায় আমাকে এখন কাবু করতে পারে না।

মার সমবয়স্কা আমার চাচী মজিবর ভাইর মা মার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমাদের সবচেয়ে বেশি খোজ নেন। আমি বাড়ি গিয়ে কাক্কির কাছে বসে থাকি। মনে হয়, আরেকবার ডাক্তার দেখাতে পারলে হয়তো মা বেচে যেতেন। পরবর্তী চিকিৎসাগুলো হয়তো আমি করতে পারতাম। এখন হয়তো এই কাক্কির মতোই বৃদ্ধ হয়ে যেতেন। খাবার দিলে কাক্কির মতোই বলতেন “কিচ্ছু ভাল্লাগে না, কিচ্ছু খাপ্পাই না গো।” তাতেও আমার ভালো লাগতো। আমি কাক্কির চামড়া ভাজ করা মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি!

১৬/৪/২০২০ খ্রি.