Tag Archives: Professor Dr. Kajol Kanti Chowdhury

Kajol Da

কাজল দা

ডাঃ সাদেকুল ইসলাম তালুকদার

(স্মৃতি কথা)

কাজল দার পূর্ণ নাম প্রফেসর ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরী। সবাই বলে কাজল দা। আমিও বলি কাজল দা। কিন্তু সম্বোধন করি স্যার বলে। তবে আমাদের ব্যাচের অনেকেই দাদা বলে সম্বোধন করে। যদিও তিনি আমাদের থেকে ৭ বছরের বড় এবং একাডেমিক শিক্ষক। তবে শিক্ষককে যেমন সবাই ভয় পায়, কাজল দার ছাত্ররা তেমন ভয় পায় না। তবে সবাই কাজল দাকে ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। আমি এমবিবিএস পড়েছি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সন পর্যন্ত। কাজল দা এম-১০ ব্যাচ এবং আমি এম-১৭ ব্যাচ। শিক্ষক হিসেবে দাদাকে পাই ১৯৮৩ সনে থার্ড ইয়ারে উঠে। তিনি সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ছিলেন।

ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে রেজিস্ট্রার হলো শিক্ষকের প্রথম ধাপ। কাজল দাকে আমি শুধু রেজিস্ট্রার হিসাবেই পেয়েছি। তিনি খুব সম্ভব সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে কনসালটেন্ট অথবা এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পর্যন্ত প্রোমোশন পেয়েছিলেন। তিনি এত ভালো টিচার হলেও তাকে নাকি বেখাপ্পা দূরে দূরে বদলী করা হতো। ডা: রিক্তা দি তার স্ত্রী । তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাস্থেসিওলজিস্ট বা অজ্ঞানের ডাক্তার। তিনি সবসময় ময়মনসিংহেই ছিলেন। সরকারের প্রতি বিরক্ত হয়ে কাজল দা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন হয়ে যান। স্বাধীনভাবে ময়মনসিংহ শহরে প্রাইভেট হাসপাতালে সার্জিক্যাল কেইসগুলো নিখুত হাতে ম্যানেজ করতে থাকেন। এক সময় এমন একজন মেধাবী শিক্ষককে জোড় করে কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ এসোসিয়েট প্রফেসর হিসাবে নিয়োগ দেন এবং পরবর্তীতে তিনি ফুল প্রফেসর হন সার্জারী বিভাগের।

এই কাজল দার ক্লাশ পাই আমি ১৯৮৩ সনে সার্জারী ওয়ার্ডে। শিক্ষক হিসাবে তিনি তেমন স্মার্ট ছিলেন না। কথা বার্তায়ও তেমন স্মার্ট ছিলেন না। কিন্তু তার মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং দক্ষতা ছিলো অগাধ। পড়ানোর সময় ছাত্রদেরকে “আপনি” বলে সম্বোধন করতেন। হাসি হাসি মুখ থাকতো। কোন দিন থাকে বিরক্ত হতে দেখিনি। কাউকে ধমক দিতে দেখিনি। তার মুখ থেকে হাজার বার “ঠিক আছে” শব্দটি শুনেছি। রোগীর পিঠে হাত দিয়ে দরদের সাথে কথা বলতেন। আমি শুনেছি, তিনি শুধু পড়াশোনা ও চাকরি নিয়ে পড়ে থাকতেন। রিক্তা দিকে নিয়েও বাইরে বের হতেন না। প্যান্ট বা শার্ট অতি পুরাতন বা ছিড়ে গেলে নতুন আরেকটা বানানোর জন্য দর্জির দোকান পর্যন্ত যাওয়ার তার সময় ছিলো না। তিনি তার পুরাতন প্যান্ট বা শার্ট রিক্তা দির কাছে দিয়ে দিতেন। রিক্তা দি শহরে গিয়ে ফেব্রিকস কিনে পুরাতনটার মাপে বানিয়ে আনতেন। এগুলো আমার শুনা কথা। রিক্তা দির ছোট বোন শিপ্রা আমার ক্লাসমেট ছিলো। সে খুব চঞ্চল ছিলো। তিরিং বিরিং করে চলাফেরা করতো। খালি পড়া নিয়ে থাকতো। অন্যরা বলতো, এটা রিক্তা দির বোন, কাজল দার শ্যালিকা। সে আমেরিকা প্রবাসী। তার মেধা এবং সার্ভিস বাংলাদেশীদের ভাগ্যে বেশীদিন জোটেনি।

আমি এমবিবিএস পাস করি ১৯৮৫ সনের সেপ্টেম্বরের রেগুলার ফাইনাল পরীক্ষায়। রেজাল্ট হয় নভেম্বর মাসে। ইন-সার্ভিস ট্রেইনিং শুরু করি নভেম্বরের ২১ তারিখে। এই ট্রেইনিংটা সরকারি চাকরি হিসাবে গণ্য হতো। এখন এর নাম দিয়েছে ইন্টার্নশিপ। এটা চাকরি হিসাবে গণ্য হয় না। ইনসার্ভিসের এক বছরের ৬ মাস মেডিসিন, সার্জারী অথবা গাইনি এর যেকোনো একটিতে বিষয়ভাবে ট্রেইনিং নিতে হতো। বাকী ৭ মাস অন্যান্য বিষয়ে ট্রেইনিং করতে হতো। আমি বিশেষ ট্রেইনিং নিয়েছিলাম সার্জারিতে। সার্জারির তিনটি ইউনিট ছিলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ইউনিট ১ এর প্রধান ছিলেন সার্জারি বিভাগের হেড প্রফেসর ডাঃ এয়ায়েত কবীর স্যার, ইউনিট ২ এর প্রধান ছিলেন প্রফেসর ডাঃ আব্দুস শাকুর স্যার এবং ইউনিট ৩ প্রধান ছিলেন প্রফেসর ডাঃ সেলিম ভুইয়া স্যার। ইউনিট ৩ এই ছিলেন কাজল দা। তাই আমি ইউনিট ৩ পছন্দ করে ৬ মাস কাজল দার অধীনে সার্জারিতে বিশেষ ট্রেইনিং নেই। দাদার সাথে থেকে আমি তার অসাধারণ গুণাবলীর সন্ধান পাই। রোগীর প্রতি ছিল অনেক দয়া, মায়া এবং ভালোবাসা। তিনি ঢিলেঢালা পোশাক পরতেন। শার্ট ইন করে পড়তেন না। চুলে বাম পাশে তেরা সিথি করতেন। শিনা টান করে হাটতেন না। আর বসার কক্ষে বেশীক্ষণ বসতেন না। সময়মতো ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতেন। আমরা দলবদ্ধ হয়ে তার সাথে হাটতাম। কেউ রাউন্ডে ফাকি দিতাম না। রাউন্ড দেয়া শুরু করতেন ওয়ার্ড থেকে, শেষ করতেন কেবিন দিয়ে। সব সময় গরীব রোগীদের প্রায়োরিটি দিতেন। ওয়ার্ডে ২৪ টা করে বিছানা ছিলো। এক নং বেডের রোগী আগে দেখতেন। বেডের পাশে গিয়ে রোগীর কাদে হাত রেখে জিজ্ঞেস করতেন “এখন কেমন লাগছে?” তিনি ছাত্র-শিক্ষক, রোগী, ছোট-বড় সবাইকে “আপনি” বলতেন, “তুমি” বলতেন না। অপারেশন করা রোগীকে এভাবে জিজ্ঞেস করতেন “চাচামিয়া, পায়হানা অইছে?” যেসব রোগীর পায়খানা হয়নি তাদের পেটে মাসাস করে করে পায়খানা মলদার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বলতেন “এহন পায়হানায় যান, পায়হানা য়বো।” তিনি রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন। রোগীর সাথে আসা লোকের প্রতি তেমন মনোযোগ দিতেন না। তার হাতে অপারেশন করা রোগী দুই তিন বছর পর এলেও তিনি চিনে ফেলতেন এবং আগের ঘটনাগুলোর প্রসংগ টেনে কথা বলতেন। তার মাথায় মেমোরিতে ছিলো শুধু রোগী এবং রোগীর রোগ। পৃথিবীর সুস্থ্য মানুষগুলো তার কাছে কিছুই ছিলো না। তেলবাজি তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি প্রত্যেক রোগী নিজ হাতে পরীক্ষা করতেন, রোগের ব্যাখ্যা দিতেন এবং আমাদেরকে হাতে কলমে শিখাতেন। পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডের প্রতিটি রোগী এভাবে দেখে শেষ করে কেবিনের রোগী দেখতে যেতেন। কেবিনের রোগীগুলো দেখা শেষ হলে তিনি আমাদের দিকে ঘুরে মুসকি হেসে হলতেন “ঠিক আছে যান।” সবাই ক্লান্ত অবস্থায় চলে যেতো ডক্টরস ক্লাবে। সেখানে গিয়ে চা, কফি, সিংগাড়া, সমুচা ইত্যাদি খেয়ে রিলাক্স হয়ে ওয়ার্ডে ডিউটিরত ডক্টরস রুমে ফিরে এসে কাজলদার নির্দেশনার স্লিপ দেখে দেখে রোগীর ফাইলে লেখা লেখি করতো। কিন্তু আমি সাধারণত তা করতাম না। কাজল দার পিছে পিছে হাটতাম। দাদা পিছন ফিরে বলতেন, ” ঠিক আছে যান। আমি অমুক ওয়ার্ডে একটা রোগী দেখতে যাবো।” আমি দাদার পিছে পিছে সেই ওয়ার্ডেই যেতাম। আমাদের হাসপাতালে তখন ২২ টা ওয়ার্ড ছিলো। প্রায় সব বিভাগের প্রফেসরগণ জটিল জটিল রোগী পরামর্শের জন্য কাজল দাকে ফোন করে রাখতেন। দাদা নিজের ওয়ার্ডের রাউন্ডের পর ঐসব ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখতেন। আমি বিনয়ের সাথে দাদার কাছে ঐসব রোগীর সমস্যা ও তার ব্যাখ্যা জানতে চাইতাম। দাদা আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। তারপর তিনি চলে যেতেন অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন করতে। ইনসার্ভিস ট্রেইনি হিসাবে আমি দাদার সাথে এসিস্ট করতাম। আমি কাজে কর্মে ধীরগতির। অপারেশনে ধীর গতিতে কাজ করা যাবে না। প্রফেসর ডাঃ সেলিম ভুইয়া স্যারের সাথে যখন এসিস্ট করতাম তিনি আমার ধীর গতিতে বিরক্ত হয়ে বলতেন “সাদেক, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।” শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যেতো। বিরক্ত হয়ে তিনি কয়েকদিন আমাকে কুনুই দিয়ে বুকের পাজরে গুতাও দিয়েছেন। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই ভবিষ্যতে আমি সার্জারিতে ক্যারিয়ার করবো না। আমি ভাবতে থাকি কোন বিষয়ে ক্যারিয়ার করলে আমি ধীরে ধীরে কাজ করতে পারবো। আমি খুজে পাই প্যাথলজি। তাই আমি পরে প্যাথলজি নিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি এম ফিল করি ১৯৯৫ সনে তদানিন্তন আইপিজিএম আর, শাহবাগ থেকে। আমি যতই ধীরগতির হই না কেন, কাজল দা আমার প্রতি বিরক্ত হন নাই। ওনার কাছে সব কিছুই “ঠিক আছে।”

অপারেশনের রোগীর সেলাই করার জন্য সিল্ক ও ক্যাটগাট সুতা লাগে। সরকার যা সাপ্লাই দিতো তার দশ গুণ বেশী রোগী হতো। তাই প্রায় সব রোগীকে সূতা কেনার জন্য স্লিপ দিতাম। সবার সূতাই ওটিতে রাখতাম। দশজন রোগীকে সূতা কিনতে বললে পাঁচ জনেই কিনতে পারতো না। কাজল দা বলতেন “আচ্ছা, ঠিক আছে।” কাজল দা খুব মিতব্যয়ী ছিলেন। তিনি ধনী রোগীদের অপারেশন করার সময় বারতি সূতা যত্ন করে রেখে দিতেন। সেই সূতা দিয়ে গরীব রোগীর পেট সেলাই করতেন। এই জন্যই তিনি বলতেন “আচ্ছা ঠিক আছে। ” কাজেই কাজল দার কাছে কোন সমস্যাই সমস্যা না।

১৯৮৬ সনের নভেম্বরের শেষে আমি ইন-সার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে ময়মনসিংহ থেকে চলে যাই। টাঙ্গাইল শহরের একমাত্র প্রাইভেট হাসপাতাল “নাহার নার্সিং হোমে” চাকরি নেই। প্রথম ৬ মাস মেডিকেল অফিসার হিসাবে এবং শেষের ৬ মাস মেডিকেল ডাইরেক্টর হিসাবে ওখানে সার্ভিস দেই। কাজল দার থেকে শেখা সার্জিক্যাল স্কিল সেখানে আমার কাজে লাগে। ১৯৮৮ সনের জুলাই মাসে সরকারি চাকরি পেয়ে প্রথম এক বছর বরিশালের বাকেরগঞ্জে এবং তারপর ১৯৯২ সন পর্যন্ত শেরপুরের নকলা উপজেলায় চাকরি করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্যাথলজি বিভাগের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করি। আমার সভাবের মিল পেয়ে এই বিষয়য়ের উপরই ক্যারিয়ার করি এবং ১৯৯৫ সনে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি এম ফিল পাস করে ময়মনসিংহেই শিক্ষকতা করতে থাকি।

ইতিমধ্যে কাজল দা সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগে যোগদান করেছেন। তিনি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের শিক্ষকতার পাশাপাশি ময়মনসিংহ শহরের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে অপারেশন করতেন। আমিও তখন নিজে প্রাইভেট প্যাথলজি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রাইভেট প্যাথলজি প্রাকটিস করতাম। তিনি তার অপারেশন করা রোগীদের বায়োপসি পরীক্ষা করার জন্য আমার কাছে পাঠাতেন। পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্রায়ই তার সাথে আমার মোবাইলে কথা হতো। “আচ্ছা ঠিক আছে” বলে তিনি কথা শেষ করতেন। ডাক্তারদের সরকারি চাকরি করতে হলে ভালো ভালো পজিশন ও পোস্টিং প্লেসের জন্য লবিং করতে হতো। এই গুণটি দাদার মধ্যে ছিলো না। আমার মধ্যেও নাই। তাই দাদাকে অল্প বয়সেই সরকারি চাকরি ইস্তফা দিতে হয়। আমাকেও ১২ বছর ময়মনসিংহ থেকে অনেক দূরে রাখা হয়। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। একবার প্রাইভেট ক্লিনিকে অপারেশন করা রোগীর মৃত্যু হলে সার্জন ডাঃ কাজল দা, অজ্ঞানকারী ডাঃ তুহীন ভাই ও ক্লিনিকের মালিককে এরেস্ট করে প্রশাসন। ময়মনসিংহের সকল স্তুরের ডাক্তার দাদাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তীব্র আন্দোলন করে ঢাকা ময়মনসিংহ হাই ওয়ে অবরোধ করে রাখে। প্রশাসন বাধ্য হয়ে তিন দিন পর সবাইকে মুক্তি দেয়। এত ভালোবাসতো সবাই কাজল দাকে। প্যাথলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডাঃ মীর্জা হামিদুল হক স্যার দেখতাম খুব খাটাখাটি করছেন দাদাকে বের করে আনার জন্য। তিনি আমার কাছে বলনেন “আমি যখন বৌ-বাচ্চাদেরকে ময়মনসিংহ রেখে ঢাকায় পোস্ট গ্রাজুয়েট এম ফিল কোর্স করি তখন কাজলও পিজিতে সার্জারিতে এফসিপিএস কোর্স করে। ময়মনসিংহ এলে সব সময় আমার বাচ্চাদের খোজ-খবর নিয়ে যেতো। ওর মতো এত ভালো মানুষ আর হয় না। কাজল দা মীর্জা স্যারের থেকে এক ব্যাচ জুনিয়র। দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ হারুন ভাই গতকাল বললেন “কাজল দা কিন্তু কোন সময় ঔষধ কোম্পানির দেয়া কোন ট্রায়ালের ঔষধ প্রেসক্রিপশন করতেন না।” এমন হাজারো গুণের গুনান্নিত ছিলো কাজল দার জীবন।

গত তিন চার বছর আগে কে যেন ফেইসবুকে কাজল দার ছবি তুলে পোস্ট দিয়েছিল যেখানে দেখা যাচ্ছে কাজল দা বাঁশের আগায় কাঠি বেধে শহরের ময়লা ড্রেইন পরিস্কার করছেন নিজ হাতে। আমরা কয়েকজন ডাক্তার একটা মাইক্রোবাসে করে কলেজে যাচ্ছিলাম। কেউ একজন বলছেন “কাজল স্যার এমন বড় মাপের একজন ডাক্তার হয়ে এভাবে নিজ হাতে ড্রেইন পরিস্কার করা ঠিক হয় নাই।” সবাই তার কথায় সায় দিল। তারা সবাই জুনিয়র ডাক্তার ছিলো। কাজল দার এমন কাজ করা তাদের পছন্দ হয়নি। আমি তেমন কোন মন্তব্য করলাম না।

২০১৯ সনে আমাদের ব্যাচের এমবিবিএস ভর্তির ৪০ বছর পুর্তি উপলক্ষে দেশে বিদেশে অবস্থানরত ১৪৫ জনের মধ্যে ১২০ জনই উপস্থিত হয় রিইউনিয়ন অনুষ্ঠানে। আমি তখন প্যাথলজি বিভাগের হেড ছিলাম। ময়মনসিংহ শহরে অবস্থানরত আমাদের শিক্ষকদেরকে দাওয়াত দেয়ার দ্বায়িত্ব পড়ে আমার উপরে। সেই সুবাদে আমি দাওয়াত কার্ড নিয়ে শহরে অবস্থানরত সব স্যারদের বাসায় যাই। কাজল দার বাসা ময়মনসিংহ পলিটেকনিক মোড়ের কাছাকাছি। আমি বাসার কাছে গিয়ে ফোন দেই। দাদা নিচে নেমে এসে কার্ড হাতে নিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলেন “আচ্ছা ঠিক আছে। “

রিইউনিয়নের দিন আগেই এসে কাজল স্যার ক্যাম্পাস দিয়ে বেড়াতে থাকেন। আমি তার সাথে হেটে হেটে কিছু সময় দেই। তিনি আমার জীবনের পরাজয়ের কাহিনীগুলি শুনে বলেন “আপনি একটু লবিং করে চলতে পারলেন না! আচ্ছা ঠিক আছে।”

জুলাই ২৪ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এমএমসি-ডে পালিত হয় অন্যরকম আনন্দ উল্লাসে। আমি ও কাজল দা সকাল-বিকাল উভয় অনুষ্ঠানেই উপস্থিত হয়ে আনন্দ উপভোগ করি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রাকন ছাত্র এবং শিক্ষক হিসাবে উভয়েই বক্তব্য রাখি। সাংস্কৃতিক সন্ধায় কাজল দার ডান পাশেই আমি বসেছিলাম। অনুষ্ঠানের ফাকে ফাকে কাজল দা টুকটাক কিছু কথা বলেন আমার সাথে। রাত গভীর হলে সিনিয়ররা সবাই চলে গেলেও কজল দা সামনের সারিতেই বসে থাকেন। আমি সাধারণত রাত ১১ টার পর বাইরে থাকি না। সেদিন কাজল দার সৌজন্যে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত অবস্থান করেছিলাম। সবশেষ ইভেন্ট ছিলো র‍্যাফেল ড্র। বিশটি পুরস্কার ছিল র‍্যাফেল ড্রতে। শুরু হয় বিশতম পুরস্কার দিয়ে, শেষ হয় প্রথম পুরস্কার দিয়ে। আমি উঠাই দ্বিতীয় পুরস্কারের কুপন, কাজল দা উঠান প্রথম পুরস্কারের কুপন। এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। এরপর কাজল দাকে বিদায় সম্ভাসন জানিয়ে চলে আসি। এটাই ছিলো আমার কাজল দার সাথে শেষ সান্নিধ্য সময়।

মৃত্যুর আগে এরপর কাজল দাকে মাত্র একবার দেখেছি। খুব সম্ভব এক মাস আগে দেখিছি। আমি যাচ্ছিলাম আমার ল্যাবের চেম্বারের দিকে, দাদা ফিরছিলেন দাদার বাসার দিকে। উভয়েই রিক্সায় যাচ্ছিলাম। ভিরের মধ্যে আমাদের রিক্সা ক্রস করছিলো। আমি ডান হাত উঠিয়ে ইশারায় আদাব দিলাম। দাদাও ডান হাত উঠিয়ে মৃদু হেসে আদাব প্রহন করলেন। দাদার হাসিটা অনেক মিস্টি ছিল। চোখের কোনা সামান্য চেপে ঠোঁটের কোনা কিছুটা প্রসারিত করে মধুর একটা হাসি দিতেন। এটাই ছিলো আমার সাথে দাদার শেষ বিদায়ের হাসি।

৯ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. সকালে ফেইসবুকের মাধ্যমে খবর পেলাম কাজল দা আর নেই। তিনি ভোরে ঢাকায় স্কোয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হ্রদ রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। আমি কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগে চাকরি করি। কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। এমএলএসএস জানালেন যে কাজল স্যারের লাস নিয়ে এসেছে দেখার জন্য। হঠাৎ মনে পড়লো কাজল দার শেষ হাসিটা। সিদ্ধান্ত নিলাম দাদার শেষ হাসিটাই আমার শেষ স্মৃতি হয়ে থাক।

সন্ধার সময় ব্যস্ততা একটু কমলে একটা ছবি দিয়ে মৃত্যু সংবাদ দিলাম আমার ফেইসবুক পেইজে। কোন রকম বুস্ট করা ছাড়াই তিন চার দিনে সেটা প্রায় আশি হাজার ভিউ হয়। মানুষ এত ভালোবাসতো কাজল দাকে। আমিও কাজল দার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে আমার এই স্মৃতি কথা আপনাদের কাছে শেয়ার করলাম।

১৮ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি.

(ময়মনসিংহ থেকে এনায়েতপুর জার্নি করার সময় অভ্র সফটওয়্যার দিয়ে মোবাইলে টাইপ করে লেখা)

#স্মৃতিকথা #kajol #memory